উপন্যাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান
উপন্যাস লেবেলটি সহ পোস্টগুলি দেখানো হচ্ছে৷ সকল পোস্ট দেখান

শুক্রবার, ২১ জুন, ২০২৪

উপন্যাস | শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়



বসতভিটা


পর্ব- ১


তারাপীঠ ধাম দর্শনের কথা ছিল সেই দিনই। সে আর হল না। রবীন্দ্র প্রান্তরে হাতড়ে বেড়ানো বোলপুর শান্তিনিকেতনের প্রাণময়তা টুকু সম্বল করে রামপুরহাট স্টেশনে যখন এসে পৌঁছলাম সন্ধ্যার ছায়া তখন বেশ দীর্ঘ।

নভেম্বর মাসের শেষ দিক। লেপ, কম্বলের সময় না এলেও হাওয়াটা আমাদের ওদিককার চেয়ে বেশ খানিকটা শিরশিরে। হালকা র‍্যাপারের মতো গায়ে জড়ানো শীতের আগমন বার্তা।

প্ল্যাটফর্মে মানুষ জন বেশ কম। ট্রেন আসার সাথে সাথে আমাদের মতো যাত্রী কজন নামলো বটে, আবার নিমেষে কে কোথায় মিলিয়েও গেল হেমন্তের চুপচাপ চলে যাওয়ার মতো।

ফাঁকা স্টেশন চত্বরের একটা বেঞ্চে বসে আমরা স্থির করে নিলাম এখন এত দেরী করে তারাপীঠের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে আর লাভ নেই।

রাখাল মানে আমার ছেলের মেসোশ্বশুর… সে এই বীরভূমের লোক। মূলত তারই উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় ছেলের বিয়ের ছমাস পর বেয়াই-বেয়ান, তস্য বেয়াই মিলে সপরিবারে আমাদের এই বীরভূমের মাটিতে পা দেওয়া। রাখাল অনেকদিন ধরেই বলে আসছিল “আমাদের বাড়ি কবে যাবেন তাহলে? শীত আসছে... কালিপুজোর পর চলুন ওই সময়টাতে ঘুরে আসি...আমার তো এবার আর পুজোতে বাড়ি যাওয়া হল না...সবাই মিলে তাহলে চলুন না...তারাপীঠ দর্শনও হয়ে যাবে, আমাদের বাড়িটা দেখে আসাও হয়ে যাবে...তার আগে বিকেল বিকেল বোলপুর...শান্তিনিকেতন....কি দাদা, তাহলে মা তারা এক্সপ্রেসে টিকিট কাটবো নাকি?”

আমার বেয়াই মশাইটি তো এককথায় রাজি।

“কাটো কাটো...কালই অনলাইনে বুকিং করে নাও...কি দাদা, একসাথে সবাই মিলে ঘুরে আসা যাবে কী বলেন? ছেলে মেয়ে ওরা ওদের মতো না হয় ঘুরবে বেড়াবে...গ্রামের দৃশ্য দেখবে...রাখাল এত করে যখন বলে তখন সক্কলে মিলে চলুন ওর বাড়িটা একবার দেখেই আসা যাক...যাবার মধ্যে আমিই শুধু একবার যা গেছি...সে কি আজকে...রাখালের বিয়ের সম্বন্ধের কথা বলতে...মাসীমা মানে ওর মায়ের আতিথেয়তা বড় ভালো লেগেছিল..!”

রাখাল যোগ করে... “দুশো বছরের বোধহয় বেশিই হবে আমাদের দেখুরিয়ার বাড়ির কালিপুজোর বয়স...প্রত্যেক বছর পাঁঠা বলি দেওয়া হয়...গতবছর নিয়ে এসেছিলাম মনে নেই?”

আমার বারো বছরের ছোট বেয়াই মশাই যাকে বলে একেবারে একইসাথে বন্ধুস্থানীয় ও ভ্রাতৃস্থানীয়, তাই জহর নামেই সম্বোধন করি আমি, সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “পুজোর সেই মাংস...কেমন খেয়েছিলেন দাদা?”

“ওই যে সেই...নিরামিষ মাংস...ওর মাহাত্ম্যই আলাদা..!”

রাখাল বলে, “দাদুর মুখে শুনেছি স্বয়ং বামাখ্যাপা আমাদের বসতভিটায় পা রেখেছিলেন…তখন থেকেই কালিপুজোর শুরু…কাপালিকের বংশধর ছিল আমাদের কোন এক পূর্বপুরুষ... নরবলি দিত...সে অনেক পুরোনো কথা....একটা রামদা আছে মন্দিরে...ওটা দিয়েই এতবছর ধরে বলিপ্রথা হয়ে আসছে....লাল শালুর কাপড় জড়ানো অবস্থায় মন্দিরে মায়ের পাশে রাখা থাকে...ও বহু পুরোনো রামদা...কত পুরোনো বাবাও ঠিক জানতেন না...বংশে  রয়ে গেছে এই অবধি....হয়তো ওই রামদা দিয়েই এককালে নরবলি হত....খুব জাগ্রত...বলতে পারেন আমাদের রায় বংশের ওটা একটা সম্পদ...তবে যখনকার জিনিসই হোক, আড়াইশো বছরের বেশি বৈ কম নয় ওর বয়স...এটুকু বাবা শুনেছিলেন দাদুর মুখে....দেখুরিয়া গ্রাম তখন বেশিটাই ঘন জঙ্গলে ভরা...দিনমানে শিয়াল ডাকতো...কোনো কোনো সময় হয়তো বাঘেরও দেখা পাওয়া যেত...অজয় নদী দিয়ে সাঁতরে ভেসে আসতো....তারাপীঠের মহাশ্মশান থেকে, পথ পেরিয়ে, নদীর তীর বরাবর জঙ্গল ধরে কোথাও একটা যাচ্ছিলেন খ্যাপা বাবা...পথমধ্যে কোনো কারণে আমাদের আড়াই শো বছরের সে বসতভিটায় পদধূলি পড়েছিল তাঁর শ্রীচরণের....ওঁর মতো সিদ্ধাচারীর  সেই পদধূলিকে স্মরণে রাখতেই প্রথম শুরু হলো মায়ের পুজো....বলি দান... আড়াইশো বছর আগেকার সে মন্দির ছিল মাটির মন্দির...এখন যে মন্দিরে পুজো হয় সেও মাটির...তবে অনেক পরেকার...দুশো আড়াইশো বছরের কোনো চিহ্ন আজ আর কোথাও নেই... আছে কেবল ওই শানানো রামদাটা...কত যুগ পেরিয়ে গেছে...কত বলি যে হয়েছে ওতে...প্রতি বছর পুজোর দিন সন্ধ্যায় রেওয়াজি খাসিকে জল আর ঘি দিয়ে স্নান করিয়ে,কপালে সিঁদুর দিয়ে, মায়ের চরণে উৎসর্গ করে  তারপর হাঁড়িকাঠে পাঠানো হয়...কত লোক যে আসে পুজো দেখতে...গ্রামের সুপ্রাচীন পুজো কিনা...তারওপর খ্যাপা বাবার মহিমা বলে কথা...আমার দুই ভাই বেঁচে থাকলে আরো কত বড় করে পুজো দিত...নেহাৎ অকালে ছেলে দুটো চলে গেল...এখন পুজোতে বাড়ি গেলে মনে হয়, কোথায় যেন আনন্দের একটা ভাঁটা পড়েছে...আচার উপাচার,লোক সমাগম সবই আছে...তবু কোথায় যেন কি একটা নেই...বড় খারাপ লাগে...পুজোর ঐ সময়টা ভাই দুটোর জন্য মনটা খাঁ খাঁ করে... গত কদিন ধরেই বুকের ভেতরটা বড় যাই যাই করছে...তাহলে কালই টিকিট বুক করে ফেলি কি বলেন? নভেম্বরের এই সিজনটাও বেশ ভালো...দিদি তো কতদিন থেকে বলেন তারাপীঠ দর্শনের কথা...নতুন বেয়াই বেয়ানকে নিয়ে চলুন সদলবলে ঘুরে আসি...”

রাখালের সম্পর্কিত দিদি মানে আমার বেয়ান রমা, সে আবার বড়ই ঠাকুর ভক্ত। নতুন জামাইকে নিয়ে সপরিবারে সাধনপীঠ দর্শনের এমন সুযোগ সেও হাতছাড়া করতে রাজি নয়।

নৈহাটি স্টেশন থেকে ভোরবেলা মা তারা এক্সপ্রেস ধরে শনি-রবি দুদিনের জন্য বেরিয়েই পড়লাম রাখালের কথায় 'সদলবলে।'


রামপুরহাট স্টেশনের কাছে হোটেল বা লজ বুকিং করে পরদিন ভোর থাকতে সবাই মিলে তারাপীঠ রওনা দেবো...পরিকল্পনাটা বাতিল করতে হল মূলত রাখালের অনুরোধেই। এখান থেকে রিক্সা করে দেখুরিয়ার বাড়িতে আজ আমাদের না নিয়ে গিয়ে সে কিছুতেই ছাড়বে না। ওখানে রাত্তিরটা থেকে পরেরদিন ভোরে তারাপীঠ মন্দিরে পুজো দিয়ে হোটেলে খেয়েদেয়ে দিব্যি বাড়ি ফিরে আসা যাবে। তাদের পরিবারের এক দুসম্পর্কের আত্নীয় মন্দিরের সেবায়েত। রাখাল তার জ্যাঠতুতো দাদাকে দিয়ে সেই লোকটিকে আমাদের আসার কথা বলেও রেখেছে।

“চলুন দাদা… তিনটে রিকশা নিলেই হয়ে যাবে...।”

বললো রাখাল।

“তোমাদের বাড়ি..! এখন এই অসময়ে...না, না… সে কালকে পুজো দিয়ে একবার ঘুরে আসা যাবেখন...”

অসহিষ্ণুতার সঙ্গে বলে উঠলো আমার বেয়ান অর্থাৎ বোনের মতো বয়সী রমা।

“কাল আর কখনই বা যাবেন দিদি...” খানিকটা বিমর্ষ হয়ে গেল রাখালের মুখখানা যেন… “তারাপীঠে পুজো… তারপর ফেরবার তাড়া...একবার তারাপীঠ পৌঁছোলে সেখান থেকে দেখুরিয়া গ্রাম...অনেক সময়ের ব্যাপার…আর তাহলে কাল বাড়ি ফেরাই হবে না...আমার পরশুদিন অফিস...যে করেই হোক কাল ফিরতে না পারলে..!”

রমার ছোট বোন মানে রাখালের স্ত্রী… সেও আজ রাত্রে তার গ্রামের শ্বশুর বাড়িতে সকলকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল।

“তাহলে সেটাই বরং ভালো হয়...আজ রাতটা অন্য কোথাও না থেকে রাখালদের বাড়িতেই না হয়…”

কথাটা বলে আমি আমার বেয়াই য়ের দিকে তাকিয়ে আস্তে স্বরে বলি, “ছেলেটা যখন এত করে বলছে..অসুবিধে তো কিছু নেই…”

কিরকম যেন অসহিষ্ণু ভাবে আমার সামনে এসে চাপা কন্ঠে রমা বলে, “নীলিমা মানে আমার ছোট বোন যে কবার ওদের বাড়ি এসে রাত কাটিয়েছে...ফিরে এসে জানেন কী বলেছে? বলেছে, --দিনের বেলায় কিংবা পুজো পার্বনে লোক সমাগমের মাঝে একরকম করে কেটে যায়...কিছু বোঝা যায় না... অন্য সময় রাত-বিরেতে বুকের ভেতরটা কিরকম ভার হয়ে আসে...গা ছমছম করে...থাকার মধ্যে ওই তো তিনটে প্রাণী...ছোটো দ্যাওরের বিধবা বউ..ছেলে...সেও তো প্রায় থাকেই না...নিজের কাজকম্ম নিয়ে ব্যস্ত…আর ওই বুড়ি শাশুড়ী...ওরা ওই পরিবেশে থেকে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে... তাই হয়তো কিছু মনে হয় না... এসব কথা বলতে তো আর পারি না কাউকে... কখন সকাল হবে আর পালাবো এই অপেক্ষায় রাত জেগে থাকি... দু চোখের পাতা এক করতে পারি না...কি জানি হয়তো আমারই সব মনের ভয়...যদি তা ই হয় তাহলে আমিই বা কি করবো...--

বলুন দাদা, এসব কথা শুনলে তারপর রাতে ওই বাড়িতে কখনো থাকতে ইচ্ছা করে? দু দুটো জোয়ান মদ্দ ছেলে অপঘাতে শেষ হয়ে গেল... কতদিনই বা হয়েছে...পিন্ড দান করেছে কি করেনি কে জানে… সাধে কি আর এখন ও বাড়িতে না যেতে চাইছি দাদা... আপনি তো জানেন, আপনার বউমার প্রকৃতি... মেয়েটা আমার একেই ভীতু...নতুন বিয়ে হয়েছে ওদের...মন্ত্রপুত তাবিজ মাদুলি রয়েছে....কোন ভরসায় যাবো..যেতে মন চায় কখনো...নীলিমা এখন মুখে যতই বলুক, --সকলে একসাথে যাচ্ছি, কোনো অসুবিধে হবে না... বাড়িতে ওদের বলা আছে আগে থেকে...আসছি শুনলে আনন্দই পাবে ওরা…--

আনন্দ পাবে…অসুবিধে হবে না...সব না হয় বুঝলাম...বেড়াতে এসে মেয়েটা আমার কোনো কারণে যদি ভয়টয় পায়...যেখানে তুই নিজেই স্বামী আর মেয়েকে নিয়ে একরাতের বেশি থাকতে পারতিস না.... ভাবুন একবার..কেন, পরে কি ঘুরে আসা যেত না...”

“এসব অহেতুক ভাবনার কোনো ভিত্তি আছে দেখুন তো দাদা..! যেমন তোমার বোন তেমন তুমি...এসব কথা রাখাল শুনতে পেলে বেচারী কি ভাববে..!”

পাশে দাঁড়িয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে জহর।

একটু হেসে বললাম, “আরে আমরা তো যাচ্ছি সবাই....গল্প করে দিব্যি রাত কাটিয়ে দেওয়া যাবে...”

রাখালের দুই তরতাজা ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনা এর আগে একদিন জহরের মুখেই শুনেছি আমি। বড় ভাই রেল লাইন পেরোতে গিয়ে নলহাটির কাছে বিভৎস ভাবে ট্রেনে কাটা পড়ে। তার বছর খানেকের মাথায় রাখালদের বাড়ির কালিপুজোর পরেরদিনের বাসি খিচুড়িপ্রসাদ খেয়ে বিষক্রিয়া জনিত কারণে আন্ত্রিক রোগে আকস্মিক ভাবে মারা যায় ছোট ভাইটি।

...”মর্মান্তিক মৃত্যু....এক বছরের মাথায় দুটো তরতাজা প্রাণ কিভাবে চলে গেল...!”

বলেছিল জহর।

সেদিন কথাগুলো শুনেছিলাম মাত্র। হয়তো মনের হাজারো ভীড়ে হারিয়েই যেত এতদিনে...যদি না চারিপাশের এই প্রায়ান্ধকার পরিবেশ পরিস্থিতি নতুন করে আর একটা অন্যরকম মুহূর্তকে জাগিয়ে তুলতো।

কাছে দূরে ইতিউতি দুএকটা দোকান প্রদীপের আলোর মতো জ্বলছিল৷ সে শিখাগুলোর দিকে তাকিয়ে কেন জানি না মনে হলো, এসেছি যখন একবার ঘুরে যাবো না? এরকম শিরশিরে হাওয়া, ধোঁয়াশায় ভরা সন্ধ্যা, সকলের একত্রিত হওয়া...এমন সুযোগ সত্যিই যে বড় একটা আসে না জীবনে!

                  ** ক্রমশ **

Kobitar Alo March Sankhya 2025

   প্রচ্ছদ ঋণঃ-  পিনাকী রায় (কণিষ্ক)