বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০২৪
ব্যক্তিগতগদ্য
শুক্রবার, ২১ জুন, ২০২৪
স্মৃতির দুয়ারে | শর্মিষ্ঠা ঘোষ
কুলিকপারের বৃত্তান্ত
আমি তো আজীবন কুলিক পারের কন্যা । যতবার স্মৃতির চড়া সম্ভবনা তারও বেশিবার প্লাবন। সূর্য ঢলে পড়ল জলে। চিকচিকালো কত অমলিন স্মৃতি । জলে নেয়ে উঠে তর্পণ করি প্রিয়জনের । এক আঁজলা জল নয় সে আমার হৃদি বৃন্দাবন। শহর চিরে গুমগুমে ধোঁয়া ওঠা কয়লার ইঞ্জিন ন্যারোগেজ রেল থেকে আজকের দুখানা প্ল্যাটফর্ম আর গোটা 2 এক্সপ্রেস। তাতে কারা চলে যায় শহর ছেড়ে । আমি বসে বসে দেখি । এক জীবনের গল্পের উপর ভিড় জমায় দ্বিতীয় তৃতীয় জীবনের গল্প। আমার পুনর্জন্ম সব। সময় শ্লথ করেছে এ শরীর। ছুঁতে পারেনি মন। রোদে জলে বিবর্ণ খোলস । মনটি দুরন্ত প্রজাপতি।
বেড়ে ওঠার পথে সময়ের সাথে বসবাস না বদলালে পাললিক স্মৃতি রয়ে যায়। জন্ম-কর্ম বেড়ে ওঠা একঠাঁই হলে সবকিছুই কন্ঠস্থ সেই শহরের। সে আমার সমস্ত বিচলন মুহূর্ত। সাফল্য বোকামি ভয় ভুল পাপ। স্মৃতি আর আমি পাশাপাশি বসি। চুলে পাক। চামড়ায় ফাটল । স্মৃতিরা ঝাঁ চকচকে। টগবগে তরুণ । উচ্ছল কিশোর । টিনেজ প্রেম । ইনফ্যাচুয়েশান। গোপন ক্রাশ । তারা পিটার প্যান। কত পুরনো চিঠি হারিয়ে গেছে । প্রথম প্রেমের রক্তে লেখা চিঠিটাও। পুড়িয়ে ফেলেছি আবেগী ডায়েরি। তারপরও স্মৃতি ছাড়ে না। যাদের জড়িয়ে স্মৃতি হয়তো তাদের মনে নেই আমিই শুধু বসে আছি স্মৃতি আঁকড়ে। নিতান্ত অকেজো। ব্যর্থ বুড়ো ভাম। বয়সের সাথে সাথে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্মৃতি বেশি করে আঁকড়ে ধরছি ।
উত্তর দিনাজপুর জেলা ঘোষণা এবং রায়গঞ্জ জেলা শহর হয়ে ওঠা দুটো ঘটনাই আমার কৈশোরের | চারপাশে একগাদা মণিমুক্তো নিয়ে বাস করতুম কিন্তু কোন হুঁশ ছিল না। যখন অনেকেই আর নেই, আমিও পরিণত তখন মনে হয় আরো খানিকটা মনোযোগ, সম্ভ্রমের দাবীদার ছিলেন বুঝি তাঁরা। গেঁয়ো যোগী টাইপ ব্যাপার। শক্তি চট্টোপাধ্যায় রায়গঞ্জকে কবিতার শহর বলেছিলেন। আমার দেখা প্রথম রক্তমাংসের কবি ও সম্পাদক বাবার কাজিন তপন কিরণ রায় | চিরকুমার এই জেঠু সাদা ধবধবে পাজামা পাঞ্জাবি পরে কাঁধে একটি ঝোলাব্যাগ নিয়ে বিজয়ায় আমার আম্মা অর্থাৎ তাঁর মাসিকে প্রণাম করতে এবং কখনো সখনো এমনিই আমাদের কুশল খবর নেবার জন্য আসতেন | অতি অমায়িক | তার সম্পাদিত "অভিযান" পত্রিকা দিতেন আম্মাকে। আম্মা ছিলেন নিবিড় পাঠক। দুপুরে খেয়ে একটা বই বা ম্যাগাজিন নিয়ে শুতে যেতেন। তখন জানতামই না পূর্ণেন্দু পত্রী অমিতাভ দাশগুপ্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় তারাপদ রায় হর্ষ দত্ত অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়রা এই জেঠুর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন বহুবার | এসেছিলেন সমরেশ বসুও। আত্মীয় মহলের বাইরে ছোটবেলায় আরেক কবি দেখলুম নীরদ রায়কে | বাবার কলিগ আমার কাকু | বই বেরলে বাবাকে নাম লিখে গিফ্ট করতেন। সেটা চলে আসত আমার দখলে | তখন তিনি "দেশ"এ লিখছেন নিয়মিত। আমি যখন ক্লাস টেনে পড়তাম কাকু "আনন্দমেলা"র হয়ে আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলেন | গার্লসে পড়তে পেলাম সুনন্দা ম্যামকে | তখনো এত বুঝতাম না যে তিনিই প্রখ্যাত কবি সম্পাদক সুনন্দা গোস্বামী | নিয়মিত উত্তরবঙ্গ সংবাদে তার গল্প কবিতা বের হয়। পরে অনেক পরে ম্যামের ম্যাগাজিন "চৈতন্য"তে লিখতে লিখতে একদিন ঠাঁই পেয়ে যাব এর সম্পাদকমন্ডলীতে | ম্যামের সূত্রে পরিচয় হবে গল্পকার সম্পাদক কমলেশ গোস্বামীর সাথে। যার স্নেহ আমায় নিয়ে যায় আকাশবানী শিলিগুড়ির "প্রান্তিক" অনুষ্ঠানে। রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে পাওয়া ব্রততী ম্যামই যে বিখ্যাত কবি ও সম্পাদক "উত্তরবঙ্গের প্রগতি" পত্রিকার তখন সেসব আলাদা করে ভেবেও দেখিনি | কতদিন পর যখন লিখলাম ম্যামের ম্যাগাজিনে চিনলাম বিখ্যাত ছড়াকার চিত্রশিল্পী প্রাবন্ধিক দিলীপ ঘোষ রায় মহাশয়কেও যিনি আমায় দেখলেই বাবার খোঁজ নিতেন, বলতেন , " একবার যাব তোমার বাবার সাথে গল্প করতে | বাংলাদেশে একই জায়গায় বাড়ি ছিল আমাদের |" বিখ্যাত গল্পকার ঔপন্যাসিক দেবেশকান্তি চক্রবর্তী বাবার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, তার অকাল প্রয়াত দাদা বাবার সহপাঠী ছিলেন। ক্লাসমেট লোপার বাবা কবি কান্তি সিংহের জুতোর দোকানে বসত সুপ্রাচীন শনিবারের সাহিত্য বাসর । সে আড্ডা ৫৫০ পেরিয়ে গেছে । বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ডাক্তার বৃন্দাবন চন্দ্র বাগচী দীপাবলী উৎসব এ আমার হাতে স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতার পুরস্কার তুলে দিয়ে যে আড্ডায় আমায় যেতে বলবেন কিন্তু স্বভাবদোষে যাওয়া হয়ে উঠবে না। আরও ছিলেন জীবেশ দাস, আমার ক্লাসমেট পামেলার বাবা। সকলেই কমবেশি যুক্ত ছিলেন রায়গঞ্জ ইনস্টিটিউট এর সাথেও তৎকালীন সাংস্কৃতিক পীঠস্থান বলা যায় যাকে। এখানকার গ্রন্থাগারের সদস্য ছিলেন আমার জেঠু। জেঠুর আনা বই এর প্রথম পাঠক আমি। "মৃচ্ছকটিক" বা "এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া " প্রাইমারি স্টুডেন্ট আমার নাগালের বাইরে রাখা হত। চুরি করে পড়তুম ।
এখন বদলে গেছে শহর। জোনাকির ঝোপ সাফ হয়ে উঠেছে বাড়ি । ডাহুকের জলা খেয়ে ফেলেছে জমি হাঙরে । চু কিতকিত কাবাডি কাবাডি মাঠ জমি নেই । নেই রাঙাজেঠুর কাছে সাইকেল শেখার মাঠটাও । কাটা পড়েছে চেনা মহীরুহ। জাহাজ বাড়ি জজ বাড়ি অতীত । এজমালি বাড়ি ভেঙে আবাসন । রঙ আর ডিজাইনের বাহার। উঠোন গন। লাউমাচা গোয়ালঘরও । পুরনো কত মানুষ শহর ছেড়েছে। অর্ধেক শহর নতুন মানুষে ভর্তি। বাকি অর্ধেকের অনেকেই তৃতীয় প্রজন্ম। কেউ চলৎশক্তিহীন। অসুখ অসুখ গন্ধ। কষ্ট হয় । নতুন মাল্টিপ্লেক্স। যে সিনেমা হলগুলোতে এক সময় গানবাজনা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সিনেমা দেখেছি বন্ধ হয়েছে তারাও। অলিতে গলিতে নতুন দোকান। আলোয় বিজ্ঞাপনে ঢেকেছে রাস্তা। চেনা দোকানপাট লোকেশান বদলে যায়। বদলে যায় মালিক কর্মচারী। বদলে যায় ডাক । আমাকে ডাক নামে ডাকার মতো বেশি লোক নেই। স্মৃতিতে শুনি প্রিয় ডাকগুলো। "ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে" আসা ডাকে এক নিশি পাওয়া প্রাণ গোলকধাঁধায় যেন ঘুরে বেড়াই ।
-
প্রচ্ছদ ঋণঃ- দেবদুত মুখোপাধ্যায় সূচীপত্র ----------------------- প্রচ্ছদ ------------------ দেবদুত মুখোপাধ্যায় সম্পাদকীয় কলাম ------------...