প্রচ্ছদ ঋণঃ- পিনাকী রায় (কণিষ্ক)
সূচীপত্র
-----------------------
প্রচ্ছদ
------------------
পিনাকী রায় (কণিষ্ক)
সম্পাদকীয় কলাম
-----------------------------
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
-----------------------------
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
কবিতা ভিত্তিক
------------------
------------------
বিশ্বজিৎ মণ্ডল
সুশান্ত সেন
রত্না দাস
তপন মাইতি
শর্মিষ্ঠা মিত্র পাল চৌধুরী
অনীশ দাস
সৌমী চ্যাটার্জী
প্রবীর কুমার চৌধুরী
গৌতম সমাজদার
গোবিন্দ মোদক
আশুতোষ বর্মন
কেতকী বসু
তমসুক গোস্বামী
সম্মিলন
------------------
শিশির আজম
অর্ণব সামন্ত
শাশ্বত বোস
গল্পাণু
------------------
শর্মিষ্ঠা রায়
ছন্দশ্রী দাস
দেবমালা রায়
স্মৃতির দুয়ারে
------------------
------------------
কেয়া নন্দী
গল্প
------------------
------------------
রবীন বসু
সুদীপা বর্মণ রায়
অঞ্জনা মজুমদার
আনুপূর্বিক
------------------
------------------
বিধায়ক ভট্টাচাৰ্য
শংকর ব্রহ্ম
মুক্তপদ্য
------------------
------------------
নিলয় নন্দী
নিমাই জানা
সম্পাদকীয় কলাম
-----------------------
আবার দেখতে দেখতে আমরা এসে পদার্পণ করলাম নতুন মাসের ২১ তারিখে। আর ২১ তারিখ মানেই আপনাদের হাতে তুলে দেওয়া কবিতার আলোর একটি ঝকঝকে নতুন সংখ্যা। নতুনের সঙ্গে আমরা মেতে উঠি নতুন বিশ্বাসে। আমরা ভালোবাসি নতুন নতুন লেখা দিয়ে নতুন সংখ্যা সাজিয়ে আপনাদের হাতে তুলে দিতে। আর সেই সংকল্প নিয়েই প্রতিমাসে প্রকাশ করে চলেছি কবিতার আলো ওয়েবজিন সংখ্যা। একটু একটু করে পা বাড়িয়ে ধীরে ধীরে নতুনের দিকে এগিয়ে চলাই আমাদের নিয়ম। আর আমরা সেই পথে নিজেদের অগ্রসর করেছি সাধ্যমত। সময়কে গুরুত্ব দিয়ে ধীরে ধীরে বদলেছি পত্রিকার উদ্দেশ্য। বর্তমান যুগে তাই প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের সাথে সাথে আমরা প্রকাশ করে চলেছি এই ওয়েবজিন সংখ্যা। আর ইতিমধ্যে এই ওয়েবজিন যথেষ্ট জনপ্রিয়তা লাভও করেছে। আপনারা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে প্রচুর পরিমাণে লেখা দিয়ে আমাদের পত্রিকাটিকে সচল রেখেছেন। আর সকল লেখক ও পাঠকদের দেওয়া সাহসকে বুকে ধরে আমরা এগিয়ে চলেছি সেই নতুনের খোঁজে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "আমরা নূতন যৌবনেরই দূত"। এই নুতনের খোঁজে যত এগিয়ে চলা যায় ততই যেন দরজা খুলে যায় একটি একটি করে। সামনে দিগন্তবিস্তৃত আলো এবং অজানাকে জানার ইচ্ছে নিয়ে শুধু হেঁটে চলা। তাই সময়ের অনুসারী সেই নৌকায় চেপেই আমাদের পথ চলা।
আমরা চেষ্টা করি প্রতি মাসের এই সংখ্যাটিকে প্রাসঙ্গিক দিক থেকে ফুটিয়ে তোলার। আর ঠিক সেই উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা লেখাগুলিকে এক জায়গায় নিয়ে আসি। ঠিক তেমনভাবেই আমরা গুছিয়ে তুলেছি এই মাসের সংখ্যাটিও। বহু লেখার মধ্যে থেকে কিছু লেখাকে নির্বাচন করে আমরা সাজিয়েছি এই সংখ্যা। বর্তমানে কবিতার আলো ওয়েবজিন সংখ্যা পড়েন প্রচুর পাঠক। আর আমরা পাঠকদের থেকে প্রতিনিয়ত প্রতিক্রিয়া পাই। যা আমাদের নতুনভাবে ভাবতে সাহায্য করে। পথ চলতে গেলে যেটুকু সাহস এবং প্রত্যয় লাগে, তা আমাদের কাছে পাঠকরাই জুগিয়ে দেন প্রতিবার। এই সংখ্যাটি আপনাদের ভালো লাগলে নিশ্চয় আরও ছড়িয়ে দিন সকলের মাঝে। কবিতার আলোর প্রিন্টেড সংখ্যার সাথে সাথে ওয়েবজেন সংখ্যা পড়ুন এবং অন্যকেও পড়ান। এই সংখ্যাটি যত পরিমানে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম শেয়ার করবেন, ততই আপনাদের লেখা আরও মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। কবিতার আলোর সঙ্গে থাকবার জন্য সকল লেখক এবং পাঠকদের শুভকামনা জানাই।
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
সম্পাদক
কবিতার আলো
কবিতাভিত্তিক
---------------------
আত্মশ্লাঘা
বিশ্বজিৎ মণ্ডল
আরো একটু বেশি রক্তপাত হলেও
এ শরীর আর্তনাদ করে না
মাথার মধ্যে নেমে আসে, অদৃশ্য গ্রেনেড
ক্ষত বিক্ষত হই প্রতিবেলা, ঠিকাদার শ্রমিক
কিছুই বলতে পারি না, নক্ষত্র শহরের বাসিন্দা নই বলে
ছকের ভেতর সাজানো, আমাদের পাখিতুতো সংসার
ধ্বসে পড়ে, নষ্ট ডুমুরের মতো টুপটাপ
একে একে প্রতিবেশীরা সবাই চলে গেল চাঁদের উঠোনে
অথচ আমি একা ভুল অংক সাজিয়ে
শতকিয়ার পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছি, অখ্যাত পাষন্ড
------------------
মেরুপ্রভা
সুশান্ত সেন
এক ফালি চাঁদ জ্যোৎস্নায় ঢেকে রেখে
হাত বাড়ালাম মহাকাশে,
শিশিরের থেকে একটু জল নিয়ে
চাঁদের উল্টো পিঠে রেখে দিলাম
যেখানে আকর্ষণ কম।
বিন্দু বিন্দু সূর্যের আলো নিয়ে
ইন্দ্র তখন সাত ঘোড়ার রথে চেপেছেন
এবং মেরুপ্রভা দেখে
এক রাশ বিস্ময় নিয়ে গ্রমণকারী
সুইডেনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলেন।
মেদিনীপুরের এবড়ো খেবড়ো
রাস্তার কথা তাঁর মনে পড়ছিল।
------------------
ধর্ম কাব্য
রত্না দাস
থাক না পড়ে জপতপ থাক না পড়ে পূজার্চনা
কাব্যিক ধর্মেই তো গড়ে ওঠে বেঁচে থাকার প্রণোদনা
কাব্যেই ভালোবাসার চাষ, আবিষ্ট করে দীর্ঘ বরষ মাস
কবিতাই জাগিয়ে তোলে হাতে হাত রেখে পথ চলার উন্মাদনা।
এত দ্বন্দ্ব, এত দ্বিধা, সব ধর্মপথেই প্রবল বাধা
মানব ও মানবতার কথা লেখা পাতা সেকি কেবল খালি খাতা!
ওসব সরিয়ে রাখা থাক। নিগুঢ় বক্তব্য নয় সর্বজনবোধ্য
শুধু প্রেম, শুধু ভালোবাসার চাবিতেই খোলা যায় বন্ধ মনের দরজা।
চাবির নামটা কী জানে গাঁয়ের পাঁচজনা!
সে যে কবিতা। তাহার নামটি রঞ্জনা।
রঞ্জিত মধুসুরে ডেকে বলে আয়,
একসুরে গলা সেধেনি
কাব্যের দিয়াবাতি কক্ষনো নিভবে না।
------------------
হৃদয়ের কথা
তপন মাইতি
সহস্রবার বলতে পার মনের গল্প
এমনি না হয় দেখতে দেখতে চলে যাবে
প্রথম চমক না হয় দিও ইষৎ অল্প
অপলকে কেটে যাবে এমন ভাবে।
একটুখানি কাজল টেনে যদি তাকাও
পছন্দ খুব একটুখানি পাশে থেকো
মনের ভাষা মনযোগে গোলাপ দাগাও
আবেগী মন জীবন্ত প্রেম একটু আঁকো।
প্রেমে ছ্যাঁকা দেবে দিও তাতে রাজি
তবু তোমার চিরদিনের সাথী হব
ছেড়ে যাব না কক্ষনো ধরছি বাজি
বুকের মাঝে প্রিয় মানুষ হয়েই রব।
গোপনে প্রেম জাগতে হবে তোমার প্রতি
শেষ মুহুর্তে প্রেমিক পুরুষ আছি থাকব
তোমার প্রিয় গানে হয়েছি সেই ব্রতী
এক হৃদয় স্বর্ণচাঁপা বিছিয়ে রাখব।
একশো আট বার শপথ করি তোমার নামে
লাল গোলাপে রক্ত দিয়ে জীবন লিখব
প্রিয় সুবাস ভর্তি থাকবে চিঠির খামে
নিঁখুত করে গোপন মনের ভাষা শিখব।
------------------
মণিপুরের কান্না
শর্মিষ্ঠা মিত্র পাল চৌধুরী
হিমালয়ের কোলে অনাঘ্রাত কৌমার্যের প্রলোভনে;
একদিন দলে দলে পর্যটক এসেছিল। অভিমানীর কিঙ্কিণিতে করলো গভীর চুম্বন! সুডৌল বক্ষে চালালো উল্লাস অভিযান -
গভীর নাভিদেশের লোকটাক হ্রদে
ভাসালো ইচ্ছের পসরা!
কটিদেশ অনাবৃত করে অপার মুগ্ধতায় হারিয়ে গেল...
রত্নখচিত ভূমির পান্না সবুজ উপত্যকা ওদের দিল পরম শান্তি।
কিন্তু ওরা মনিপুরের চেতনাপুর ছুঁয়ে দেখলো না...
পড়লো না রাজকাহিনীর ইতিহাস...
ভাবলো না যে চিত্রাঙ্গদা রূপে আমি গান্ডীব ও অক্ষয় তূনের কাছে অপরাজিতা!
বিপদে, সম্পদে, কঠিন ব্রতে আমি যে
আর্যপুত্র অর্জুনের সহধর্মিনী!
কিন্তু আজ দলিত দেশের নারী বাহিনীর নগ্ন প্যারেড দেখে আমার যে চোখ ফেটে জল আসছে...
কাদা মাটিতে শুধুই রক্ত আর আগুন!
বীভৎসতা আর অমানবিকতা যেখানে পাশাপাশি হাঁটে...
------------------
রূপান্তর
অনীশ দাস
দূরের বনভূমির অন্ধকার কোলে
শুয়ে থাকে এক অতৃপ্ত বোবা হিংস্রতা,
সৃষ্টির সারল্য বিপাকে পড়ে যায় করুণ মুখে।
স্বার্থ নিমজ্জিত স্নায়ুতে প্রবল উচাটন,
হানাহানির প্রচণ্ড অভীপ্সা ছড়িয়েছে দিগ্বিদিক;
রুদ্ধশ্বাস সংঘর্ষের পালা।
নীরবে দেখবে সর্বলোক নির্বিকারে
নম্রতার বিনাশে তীব্র হিংসার মৃদু সৃজন!
ঘনিয়ে ওঠে সর্বত্র ধীরে ধীরে,
চন্দ্রালোকের নীরব নিশুতিতে
উঠবে জেগে সমস্ত চরাচর!
হানবে রূঢ় প্রকৃতির চাবুক
পাশবিক মনোবৃত্তিতে।
------------------
পরিণতি
সৌমী চ্যাটার্জী
চেনা পথ অচেনা হল কি?
নীড়হারা পাখি আজ আর ম্লান আলোকে ফিরবে না ৷
ফিরবে না পূর্ণিমার চাঁদ,
হবে না চন্দ্রমাতে ঊর্মিমালার সোহাগ ;
শুকতারার, সন্ধ্যাতারায় রূপান্তর হবে না,
ধ্রুবতারা আর সঙ্গ দেবে না পথহারা নাবিকের ৷
কালের কবলে শিমূল, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া কৃষ্ণগহ্বরে পাতাবাহার,
মায়ার শাসন-ডোরে থাকা কুঁড়েঘরটি আজ শৈবলিনীর শিকার ৷
প্রেমতরঙ্গে ভাসমান নক্ষত্রগুলি অমাবস্যার চাঁদ ;
চেনা-অচেনার দ্বন্দ্বে অচেনার জয় ৷
রাখা হয়নি প্রথমদিনের প্রতিশ্রুতি,
দেখা হয়নি গিরি-ক্রোড়ে রক্তিম রবি ,
হয়নি ইছামতী তীরে বসে বাকি থেকে যাওয়া অঙ্গুলির আলাপন ৷
নিশীথ সায়রের চেয়ে বেশী কে আর অশ্রুর আপন?
দিগন্তে মিলন আজ গোধূলির মরিচীকা ;
'যাই' বলার পর আর বোধহয় ফেরা যায় না ,
বোধ হয় না !
------------------
কাকে জানাবো আর্জি
প্রবীর কুমার চৌধুরী
রাস্তার চার মাথার মোড়ে নিয়নের আলো
সময় ডেকে ডেকে বলে কি ভীষণ ভালো
শুধু দেখে ভয় পায় ঠোঁটগুলো বড় কালো।
মন ছুঁয়ে আছে কি এখনও নির্ভুল ব্যাকরণ
তবে কেন খসে পড়ে তাজা ফুলের আবরণ
কেন কেন তবে আজ অধিকারের অভিযান?
শ্যাওলা ধরেছে মনে খুলে দেয় অন্তর্বাস
বেআব্রু বিবেক পথে কি নির্মম পরিহাস
আত্মম্ভর উপমা খুঁজি নিস্কর্মায় বারোমাস।
গুটিয়ে নিয়ে সাদা পাতায় সেই ছবিটা খুঁজি
হারিয়ে গেছে সুখের ঘর হারিয়ে গেছে রুজি
ঘর ভেঙেছে কে শুনবে কাকে জানাবো আর্জি?
------------------
বিচ্ছেদ
গৌতম সমাজদার
আধখোলা জানালাটেবিলে চালশের চশমা---কলমের মুখে গলিত লাভা অপেক্ষায়।আকাশে একফালি চাঁদনির্জনতায় ঘিরে থাকা আঁচলনিজেকে খোঁজা আঁধারে অবিরাম।ভাজভাঙ্গা শাড়ী, পারফিউম মাখা জামাহারিয়ে যাওয়া শিশুর খোঁজঢাকের বাজনায় উল্লাস একটানা----।সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরাকাঁটাতারের বেড়ায় NRCবেয়নেটেও বিচ্ছেদের সুর ভারী বুটের--বিশ্বাস ধর্ম অধর্মেরগলিত লাভায় অবিশ্বাসের প্রশ্বাসচালসের চশমায় জেগে থাকাপূর্নিমার অপেক্ষায়।
------------------
গৌতম সমাজদার
আধখোলা জানালা
টেবিলে চালশের চশমা---
কলমের মুখে গলিত লাভা
অপেক্ষায়।
আকাশে একফালি চাঁদ
নির্জনতায় ঘিরে থাকা আঁচল
নিজেকে খোঁজা আঁধারে
অবিরাম।
ভাজভাঙ্গা শাড়ী, পারফিউম মাখা জামা
হারিয়ে যাওয়া শিশুর খোঁজ
ঢাকের বাজনায় উল্লাস
একটানা----।
সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরা
কাঁটাতারের বেড়ায় NRC
বেয়নেটেও বিচ্ছেদের সুর
ভারী বুটের--
বিশ্বাস ধর্ম অধর্মের
গলিত লাভায় অবিশ্বাসের প্রশ্বাস
চালসের চশমায় জেগে থাকা
পূর্নিমার অপেক্ষায়।
------------------
খোঁজ
গোবিন্দ মোদক
একটা বয়স থাকে যখন বিশ্বাস করা যায়মাটির তৈরী প্রতিমাতেও প্রাণ আছে,বিশ্বাস করা যায় যীশুকে যে পেরেকেক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিলতা থেকে আজও রক্ত ঝরে,বিশ্বাস করা যায় ঈশ্বর কুপিত হলেঝড়, ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, বন্যাকিংবা মহামারি দেখা দেয়।তারপর বাংলা ব্যাকরণ শিখে ফেললেইবেশ বুঝতে পারি ওটা অতীতকাল;সুনীল কবির মতো তাই টের পাই —প্রিয় নারীর বুকে কস্তুরীগন্ধ অলীক বস্তু।টের পাই — কেউ কথা রাখেনি, রাখে নাকিংবা রাখার প্রয়োজন বোধ করে না।তবু অনিঃশেষ কোনও এক প্রেমের সন্ধানেআদিগন্ত পথ হাঁটা শেষ হয় না।আসলে, নিজেকে খুঁজতে চাওয়ারএই যে মিথ্যে অভিনয় —তা কোনওদিনও নিজের কাছে ধরা পড়ে না,অতএব জয় হোক আমিত্বের!
------------------
গোবিন্দ মোদক
একটা বয়স থাকে যখন বিশ্বাস করা যায়
মাটির তৈরী প্রতিমাতেও প্রাণ আছে,
বিশ্বাস করা যায় যীশুকে যে পেরেকে
ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল
তা থেকে আজও রক্ত ঝরে,
বিশ্বাস করা যায় ঈশ্বর কুপিত হলে
ঝড়, ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা
কিংবা মহামারি দেখা দেয়।
তারপর বাংলা ব্যাকরণ শিখে ফেললেই
বেশ বুঝতে পারি ওটা অতীতকাল;
সুনীল কবির মতো তাই টের পাই —
প্রিয় নারীর বুকে কস্তুরীগন্ধ অলীক বস্তু।
টের পাই — কেউ কথা রাখেনি, রাখে না
কিংবা রাখার প্রয়োজন বোধ করে না।
তবু অনিঃশেষ কোনও এক প্রেমের সন্ধানে
আদিগন্ত পথ হাঁটা শেষ হয় না।
আসলে, নিজেকে খুঁজতে চাওয়ার
এই যে মিথ্যে অভিনয় —
তা কোনওদিনও নিজের কাছে ধরা পড়ে না,
অতএব জয় হোক আমিত্বের!
------------------
ফাঁকি দেওয়া আলো
আশুতোষ বর্মন
কতটুকু হাত ? হাতের বাইরে এ আকাশ।চোখের জরিপে লাগাতে চেয়েছি ফাঁস।সেকি আটকায় ? না তো।দিন ফাঁকি দেওয়া আলো অন্ধ দুচোখে পাতো।
তারপর?মেঘের পাতায় লেখা গুমোট খবর।পড়তে পেরেছে কেউ ?না। অন্ধ আকাশে শুধু মেঘেদের ঢেউ।
হাওয়ার চাদর যায় ভিজে,চোখের পাতায় সে আদর মেখেছে নিজে।প্রাণধন চলে গেলে এই শূণ্য আকাশ, রাত, মেঘ-এরাই আপন হয়,---পৌষালী আবেগ—এদের জানা নেই কপটতাফাঁকি দেওয়া আলোহীন রাতে বহুযুগ রাখে নিঃসঙ্গতা।
------------------
আশুতোষ বর্মন
কতটুকু হাত ? হাতের বাইরে এ আকাশ।
চোখের জরিপে লাগাতে চেয়েছি ফাঁস।
সেকি আটকায় ? না তো।
দিন ফাঁকি দেওয়া আলো অন্ধ দুচোখে পাতো।
তারপর?
মেঘের পাতায় লেখা গুমোট খবর।
পড়তে পেরেছে কেউ ?
না। অন্ধ আকাশে শুধু মেঘেদের ঢেউ।
হাওয়ার চাদর যায় ভিজে,
চোখের পাতায় সে আদর মেখেছে নিজে।
প্রাণধন চলে গেলে এই শূণ্য আকাশ, রাত, মেঘ-
এরাই আপন হয়,---পৌষালী আবেগ—
এদের জানা নেই কপটতা
ফাঁকি দেওয়া আলোহীন রাতে বহুযুগ রাখে নিঃসঙ্গতা।
------------------
অদৃশ্য কাগজ
কেতকী বসু
অদৃশ্য কাগজের ভিতর লেখা কথারা ঘুমিয়ে পড়েছে,চোখের ওপর থেকে সরে যাচ্ছে চাদরহালকা হচ্ছে ভেসে থাকা সত্য গুলোচুপি সাড়ে পিছন থেকে দিন গুণে চলেছে কেউ.....নির্ধারিত সময় আর সত্যি জানবে বলেঅদৃশ্য লেখাগুলো পড়ে দেখার আগেইধুলো মাটিতে চাপা পড়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
এদিক থেকে ওদিকে মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে পোকারাতবুও ভীষন ইচ্ছা করে একবার যদি পড়া যেতসাজানো লেখাগুলো সত্যি কতটা জটিল ছিল,মাত্রা,চিহ্ন মেনে অন্ত্যমিল এর কোন কবিতা!নাকি গল্প,কিছুই বোঝা গেল নাঅস্পস্ট হতে হতে ক্রমে ঢুকে গেল ইঁদুরের গর্তে।
------------------
কেতকী বসু
অদৃশ্য কাগজের ভিতর লেখা কথারা ঘুমিয়ে পড়েছে,
চোখের ওপর থেকে সরে যাচ্ছে চাদর
হালকা হচ্ছে ভেসে থাকা সত্য গুলো
চুপি সাড়ে পিছন থেকে দিন গুণে চলেছে কেউ.....
নির্ধারিত সময় আর সত্যি জানবে বলে
অদৃশ্য লেখাগুলো পড়ে দেখার আগেই
ধুলো মাটিতে চাপা পড়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
এদিক থেকে ওদিকে মুখে করে নিয়ে যাচ্ছে পোকারা
তবুও ভীষন ইচ্ছা করে একবার যদি পড়া যেত
সাজানো লেখাগুলো সত্যি কতটা জটিল ছিল,
মাত্রা,চিহ্ন মেনে অন্ত্যমিল এর কোন কবিতা!নাকি গল্প,কিছুই বোঝা গেল না
অস্পস্ট হতে হতে ক্রমে ঢুকে গেল ইঁদুরের গর্তে।
------------------
শিখন্ডীর বনবাস
তমসুক গোস্বামী
শিখন্ডী মিলিল যবে শূর্পনখা সনেতরুঘেরা নদী পাড়ে পঞ্চবটী বনে;পরস্পরে করি স্বীয় দুঃখ বর্ণণ -শুরুতেই শিখন্ডী, কহে, "হে প্রিয় বোন,যৌনতা লিখিছে ভাগ্যে মস্ত পরিহাস,নর আর নারী মাঝে মোর বসবাস।বুঝিলনা কোনোদিন কেহই আমারে,প্রতিশোধ রূপে ঠাঁই, দ্রুপদাস্ত্রাগারে,মহাবীর হয়ি তবু উঠি কপিধ্বজে,কুরুক্ষেত্রে শিখন্ডিনী ঢাল রূপে সাজে।সমাজের পরম্পরা নির্দয় আচার,ভীষ্মতুল্য ইচ্ছামৃত্যু আছে যে যাহার -শুনহ ডরে সে প্রথা শিখন্ডী সমুখেঅস্ত্র ত্যাজে হস্ত হ'তে শিখন্ডী নীরিখে।সমাজে আজও মোরা পাহি নাকো ঠাঁইঘৃণা-অবহেলা-জ্বালা, বহি যে সদাই।"এত শুনি শূর্পনখা চক্ষু মুছি কহে,"দিদি, এ দুঃখ শুধু তব একা নহে।সৃষ্টিতে কঁচুকী নহে একা উপেক্ষিতা,পুংশাসিত কুলেতে নারী উপেক্ষিতা।বিশ্রবা-কৈকসী দুহিতা মিনাক্ষী নামে,জন্মেছিনু জ্যেষ্ঠভ্রাতা দশানন ধামে।পরিণয় করি দানব কুমার সনে,স্বরক্ষার্থে বিধবা করে ভ্রাতা রাবণে।নারীর আবেগ হেতা সুলভ সস্তা,নিবেদিয়া রাঘবে প্রেম, হই হেনস্তা।যে নারীর লাজ সব নাকের উপরি -কাটিয়া সে নাক তারে বিবস্ত্রা যে করি,দোষ কিবা ছিনু এই রাক্ষসাত্মজার!সম্ভ্রান্ত পরিবারের বধূ সাজিবার!সমুখে সতীনভাগ্য সহিতে না পারি,ঈর্ষায় উন্মত্ত হয়ি শক্তি ছুড়ি মারি,কিন্তু আমি এক নারী, স্বভাবের দাসী!সমাজ বিচারিল মোরে ধরি রাক্ষুসী,ব্যথিত চিত্ত মোর, যুগের তিরস্কার -রামায়ণের যুদ্ধে নাকি দায় আমার!"শিখন্ডী কহে, "শুনহ হে প্রিয় ভগিনী,পূর্বজন্মে কাশ্যাত্মজা বড় আদরিনী।নরবিধি অনুসারে অপহৃত হয়ি,শুনিলনা কেহ, আমি যে শাল্ব প্রণয়ী,করুণা দেখায়ে মোরে ফিরাইল দেশে,প্রেমিকের প্রত্যাখান - জুটি অবশেষে।এক নর সাধু, দিয়া ধর্মের দোহাইপিছায়িনু নারী অধিকারের লড়াই!কহ এবে হেতা মোর দোষ কিবা ছিনু -নরাধীন সমাজে, নারীরূপে জন্মিনু!কঁচুকী রূপেতে মুখরিত প্রতিবাদীভাঙিব সামাজিক যতেক আচারাদি,গড়িছিনু পুংজাতি নিজ আনুকূল্যে,খোয়াইবেনা স্ত্রীমান আর কোনো মূল্যে।নারীহিতে সঁপি আয় আপনারে, স্বসা,উপেক্ষা করিয়া সব যতেক জুগুপ্সা।"এভাবে রচিত কোনো মহাকাব্য হতো,উহা লিখিত কোনো অপুরুষ হয়তো,তবু থাকিতনা পিষ্ঠে কাপুরুষ ছায়া -গর্বিত হইতো স্ত্রী, মাতা, ভগিনী, জায়া।।
তমসুক গোস্বামী
শিখন্ডী মিলিল যবে শূর্পনখা সনে
তরুঘেরা নদী পাড়ে পঞ্চবটী বনে;
পরস্পরে করি স্বীয় দুঃখ বর্ণণ -
শুরুতেই শিখন্ডী, কহে, "হে প্রিয় বোন,
যৌনতা লিখিছে ভাগ্যে মস্ত পরিহাস,
নর আর নারী মাঝে মোর বসবাস।
বুঝিলনা কোনোদিন কেহই আমারে,
প্রতিশোধ রূপে ঠাঁই, দ্রুপদাস্ত্রাগারে,
মহাবীর হয়ি তবু উঠি কপিধ্বজে,
কুরুক্ষেত্রে শিখন্ডিনী ঢাল রূপে সাজে।
সমাজের পরম্পরা নির্দয় আচার,
ভীষ্মতুল্য ইচ্ছামৃত্যু আছে যে যাহার -
শুনহ ডরে সে প্রথা শিখন্ডী সমুখে
অস্ত্র ত্যাজে হস্ত হ'তে শিখন্ডী নীরিখে।
সমাজে আজও মোরা পাহি নাকো ঠাঁই
ঘৃণা-অবহেলা-জ্বালা, বহি যে সদাই।"
এত শুনি শূর্পনখা চক্ষু মুছি কহে,
"দিদি, এ দুঃখ শুধু তব একা নহে।
সৃষ্টিতে কঁচুকী নহে একা উপেক্ষিতা,
পুংশাসিত কুলেতে নারী উপেক্ষিতা।
বিশ্রবা-কৈকসী দুহিতা মিনাক্ষী নামে,
জন্মেছিনু জ্যেষ্ঠভ্রাতা দশানন ধামে।
পরিণয় করি দানব কুমার সনে,
স্বরক্ষার্থে বিধবা করে ভ্রাতা রাবণে।
নারীর আবেগ হেতা সুলভ সস্তা,
নিবেদিয়া রাঘবে প্রেম, হই হেনস্তা।
যে নারীর লাজ সব নাকের উপরি -
কাটিয়া সে নাক তারে বিবস্ত্রা যে করি,
দোষ কিবা ছিনু এই রাক্ষসাত্মজার!
সম্ভ্রান্ত পরিবারের বধূ সাজিবার!
সমুখে সতীনভাগ্য সহিতে না পারি,
ঈর্ষায় উন্মত্ত হয়ি শক্তি ছুড়ি মারি,
কিন্তু আমি এক নারী, স্বভাবের দাসী!
সমাজ বিচারিল মোরে ধরি রাক্ষুসী,
ব্যথিত চিত্ত মোর, যুগের তিরস্কার -
রামায়ণের যুদ্ধে নাকি দায় আমার!"
শিখন্ডী কহে, "শুনহ হে প্রিয় ভগিনী,
পূর্বজন্মে কাশ্যাত্মজা বড় আদরিনী।
নরবিধি অনুসারে অপহৃত হয়ি,
শুনিলনা কেহ, আমি যে শাল্ব প্রণয়ী,
করুণা দেখায়ে মোরে ফিরাইল দেশে,
প্রেমিকের প্রত্যাখান - জুটি অবশেষে।
এক নর সাধু, দিয়া ধর্মের দোহাই
পিছায়িনু নারী অধিকারের লড়াই!
কহ এবে হেতা মোর দোষ কিবা ছিনু -
নরাধীন সমাজে, নারীরূপে জন্মিনু!
কঁচুকী রূপেতে মুখরিত প্রতিবাদী
ভাঙিব সামাজিক যতেক আচারাদি,
গড়িছিনু পুংজাতি নিজ আনুকূল্যে,
খোয়াইবেনা স্ত্রীমান আর কোনো মূল্যে।
নারীহিতে সঁপি আয় আপনারে, স্বসা,
উপেক্ষা করিয়া সব যতেক জুগুপ্সা।"
এভাবে রচিত কোনো মহাকাব্য হতো,
উহা লিখিত কোনো অপুরুষ হয়তো,
তবু থাকিতনা পিষ্ঠে কাপুরুষ ছায়া -
গর্বিত হইতো স্ত্রী, মাতা, ভগিনী, জায়া।।
সম্মিলন
------------------
শিশির আজম
মধ্যরাতের কুয়াশা কারখানা
ঘাসের ভিতর সূর্য আর ছাইপোকা
পৃথিবীর জন্মরহস্যের উঁকি
মশামাছি ঘুমোবে না
যেন রেলগাড়ি সুতোয় জড়ানো
আকাশ বলছে : একটু দাঁড়াও
আমার মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে আনি
আমার চুলের মধ্য দিয়ে মাছ
সাঁতার কাটছে
আকাশের পশ্চিম তারাটি
মা হারানো
আমি খুলে ফেলি আমার পোষাক
চোখ বন্ধ
দেয়ালের ওপাশ নির্জন
নিষিক্ত আলোয় ভবিষ্যৎ জাদুরাস্তা
কাঠপেঁচা গেয়ে ওঠে :
শিশিরে ভিজেছে ডানা
শিশিরে ঘুমায় রাস্তা
আমের বাগানে কুয়াশার কারখানা
যত জন্তুজানোয়ার
বিষাক্ত ব্যাঙের ছাতা
ভূগর্ভস্ত হাড়
রাফা সীমান্তের চাঁদ
এমন কেন হয়
কোন কোন মানুষ আছে যারা ভালবাসতে গিয়ে
ভালবাসা হারিয়ে ফেলে
অথচ মানুষ এমন এক প্রাণি
যার
খিদে আছে
বৌ-বাচ্চা আছে
শেয়ারবাজার আছে
অথচ
ভালবাসা ছাড়া সে বাঁচে না
তাহলে এমন কেন হয়
এমন
কেন হয় মিস্ কার্থেজ
ফাঁস
যে কেউ
আমাকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে
ইয়ায়োই কুসামা
গত পরশু এই কাজটাই করেছে
ওর সহজ ও নিঃশঙ্ক ডটগুলোকে
যদি
কোথাও বিক্রি করে দিতে পারতাম
ডেভিড তৈরির আগে
যে বিশাল দৈত্যাকৃতির পাথরটা বছরের পর বছর ধরে
ক্যাথেড্রালের পেছনের বাগানে পড়ে ছিল
ওটা নিশ্চয় কেউ কেউ দেখেছে
কিন্তু যেদিন মাইকেলাঞ্জেলো আর আমি প্রথম ওটা দেখলাম
আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম
আর
ওটা যে পাথর না
ওর ভেতর যে প্রাণ আছে
ওটা মাইকেল তখনই আমাকে বলেছিল
আমি ফেঁসে গিয়েছিলাম
এখন
এই রাত এগারোটা উনষাটে
আমার না লেখা কবিতার সঙ্গে একই টেবিলে
আমি বসে আছি
টের পাচ্ছি
টের পাচ্ছি
ও আমাকে ফাঁসাবার ছক কষছে
যে রাত ভিনসেন্টের কাছ থেকে পেয়েছি
এক অবিশ্বাস্য রাত আমায় উপহার দিয়েছিল বন্ধু ভিনসেন্ট
ওর তো অনেকগুলো রাত
আর সবগুলো রাতেরই আলাদা আলাদা ব্যথা
আর কর্পোরেশান আছে
হ্যা ওদের প্রতি আমার হিংসাবোধ নেই
আমি নিজে তো রাত একটা পেয়েছি
একান্তই আমার রাত
আমার রাত এ্যান্টিকিউবিক আর পরিসংখ্যানচ্যূত
ভিনসেন্ট কোনভাবেই ওর দাবীদার হতে পারে না
আমাদের নির্দিষ্ট কক্ষপথ হইতে আমরা বিচ্যূত হইতেছি না কেন
চাই বা না চাই সেইটা তোয়াক্কা না কইরা
দিন শুরু হয়া যায়
দুপুর আসে
থানার বড়বাবু আসে
মহল্লার লোকজন আড়ালে ওনারে তোলাবাবু বইলাও ডাকে
কাকেদের থিকা তোলা আদায়ের হ্যাপাটা
উনিই সামলান কি না
ব্যাস্ত মানুষদের দম ফেলবার সুযোগ না দিয়া রাত আসে
গগাঁ বাড়িত নাই
অর আর্মচেয়ারে (বন্ধু ভিনসেন্টের দেয়া উপহার)
আমি খানিকটা কাইত হইছি
আমার ক্লান্ত লাগতেছে
আমার ঘুম পাইতেছে
কোত্থেকে এক সুন্দরী যুবতী নার্স আইসা
চেয়ারটায় একবার ঠ্যাস দিয়া ফুড়ুৎ কইরা উইড়া গেল
আবার
ফিরা আইলো
হ্যা চেয়ারটার আশেপাশেই অরে এখন আমি দেখতেছি
অর রংধনুময় আকাশ
অর সূর্যকেন্দ্রিক গ্রিক সিনড্রোম
আর
অর পাছাটারে
ওইটা
বাগান না হাসপাতাল কি বলবো
আমার তো মাথা ঘুর্তেছে
পেইন হইতেছে
------------------
অর্ণব সামন্ত
আচমকা শরৎ
আচমকা শরৎ যখন অকালবোধনে ডাকে
দ্রাঘিমা দাঁড়ায় থমকে লাজে রাঙা , অবাধ্য লাস্যে
লালিত্যে ধুয়ে দেয় সমস্ত সংস্কার , আদি অকৃত্রিম জাগে
ভুলে যায় সমস্ত জগৎ , কায়া , মায়া , ছায়াপথ
কথার গভীরে কথা ডুবে যায় , ভেসে ওঠে অমল ভাসানে
আবার নির্ভেজাল প্রলয়ে উদ্ভাসিত হয় অবাধ সৃজন
সমস্ত চুরমার করে ঘটে অভূতপূর্ব নির্মাণ
পদ্মপাপড়িগুলি ফুটতে থাকে ক্রমশঃ আদরে সোহাগে
ঠোঁটে ঠোঁটে অস্ফুট প্রতিজ্ঞা আলোকবর্ষে হেঁটে যায়
হৃদয়ে হৃদয়ে অলকানন্দা কবি ও কবিতা অসহায় ভাসে
প্রাণে প্রাণ ঢেলে প্রাণাধিক মাতে স্বরবর্ণ উচ্চারণে , স্থাপনে
আধফোঁটা অশ্রুশিশির জমা হয় দ্রাঘিমার নয়নে
অক্ষাংশ থাকে না দূরে ওভারল্যাপে শুধু বিদ্যুচ্চমক বিদ্যুচ্চমক
আচমকা শরৎ এসে দাবি করে , মায়িক সম্পূর্ণ তুচ্ছ
আয় আমরা উৎসের স্রোতে অমায়িক ভাসি
এই মরণে , এই সমাধিতে ডেকে নিই জীবনের চেয়েও বেশি জীবন
শিউলি সাদা ভাতের সুঘ্রাণে ম'ম' গেরস্থালি
ওতপ্রোত অভিষিক্ত দ্রাঘিমা অক্ষাংশ ভুলে
এককের গানে মুক্তিবেগের উড়ানে চলে অন্তর্কথন !
ক্লদ মনের নারী
রেমব্রান্টের হলুদ আঁধারে ভাসে প্রাগৈতিহাসিক চোখ
ভাস্কর্য ছেনে ছেনে ভাবনাকে রূপ দেওয়া
লাবণ্য গ্যাছে গেরস্থালিতে বহুপদ ভোজন দিতে
লালিত বাৎসল্য পালিত পৌরুষ জ্যোৎস্নার ডানা ছড়ায়
আগুনে পুড়েও আগুনের হাত থেকে পৃথিবী বাঁচায়
প্রবহমান আগুন জেগে থাকে খননে খননে চমৎকার
রেখায় লেখায় সেই বন্দিত্বের অদ্ভুত মুক্তি উড়ান
ঢেউ ঢেউ চলকে চলকে পড়ে পানপাত্রের কানা থেকে
নক্ষত্র সীমান্ত কাঁটায় ফুটে ওঠে কুসুম তার মধ্যে মন
ক্লদ মনের নারী হয়ে সে সুখের শরশয্যায় আবহমান স্রোতস্বিনী !
পাগলির কিসসা
পাগলি একইপ্রকার থাকে
কূপমন্ডুকতাকে ভাবে সমুদ্র পিপাসা
চৌকাঠে ঢাক্কায় ইগো , স্বতন্ত্রতা
অথচ চুরমার হয়ে চেরাপুঞ্জির বৃষ্টি হবার কথা ছিল
নয়নে নয়ন পড়লেই গ্যালাক্সির
গ্যালন গ্যালন আলোকসম্প্রপাত উথলায়
মছ্ছকন্যা হওয়া তার হয় না
ছেলেকে টিউশনে নিয়ে যায় , বরকে বিরিয়ানি দেয়
দমকা হাওয়া সারা শরীর মন কাঁপায়
তবু সে পাত্তা দেয় না , এক লাখি স্যালারিতে
ভাবনায় স্যালাইন দেয় , নতুনভাবে বাঁচবার চেষ্টা করে
কিন্তু নিজের কবর নিজেই খোঁড়ে
কফিনে শেষ পেরেক নিজেই মারে
চিতার মুখাগ্নি নিজেই করে
প্রাণ দাও প্রাণ দাও বলে
শবকে আঁকড়ায় আগুন আগুন ভালোবাসে
যে আগুন তাকে বাঁচাতে পারত
তাকে না ভালোবেসে যে আগুন ছাই করে
তাতেই সমর্পণ করে নিজেকে
তবু পাগলি ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে
সেই পাগলের দিকে ছোটে
জীবনকে খুঁজে পেতে , নিজে আস্ত একটা জীবন হতে
-------------------
শাশ্বত বোস
দৃশ্যগত বসন্ত
নীল দরজাটা থেকে ক্ষুধার্ত পাখিটা
মুখে করে বয়ে আনে কোমল ফলের
নরম শাঁস। খেলনাবাটি পেয়ালায়
ঢেলে দেয় একসাথে পুড়ে যাওয়া
আগুন ও অপরাজিতা। কালো জামদানী,
জয় পরাজয়ের উথাল পাতাল ঢেউয়ে
চড়ে এগিয়ে আসে এক মুঠো পলাশ।
বিপুল স্নানঘরে, দীর্ঘ্য কথোপকথনে
ভুরি ভুরি রুপোলি পদ্ম ফোঁটে।
শিমুল অশোকের বুক ভেঙে,
দুধ সাদা রুমালের হাত ধরে,
উপচে পড়ে ঘুন পোকার ডাক।
ফিনফিনে রাত পোশাকে,
বসন্তের গভীরে ঢুকে আসে,
পোড় খাওয়া হলুদ তারাদের দল।
অচেনা শব্দের বসন্ত
প্যাটার্নের হয়তো একটা নিজস্ব সংজ্ঞা আছে।
হয়তো বা তার আছে অস্থির ঘূর্ণনে ভেসে থাকা
এক নীলচে প্রেত শরীর! যন্ত্রণাহীন মৃত্যু সেখানে কবির
অলীক কল্পনা মাত্র! বিষন্নতার উপত্যকা জুড়ে
নেমে আসে হিপোক্রেসির লাভাস্রোত।
কাঁসার থালায় তখন আবির সাজিয়ে নিয়ে আসে
এক আঁজলা বসন্ত।
তাতে অবশ্য ঘুমন্ত শেল ডাকের কিছু এসে যায় না!
মরে যাওয়া ফাগুন কিংবা নিঝুম রাত
তার কাছে যেন একই মায়ের পেটের যমজ সন্তান।
ওদের হাসির শব্দে আমরাই শুধু থালা সাজিয়ে বসে থাকি।
অবিন্যস্ত-স্থূল-অবিবেচক-নিঃসঙ্গ-নির্ভার-নিশ্চুপ
এইসব নিয়ে সমালোচনা ও প্রতিবাদের ঝড় তুলি!
স্বপ্নকে যারা সান্তাক্লজ ভাবে, তাদের ধূসর
চৌবাচ্চায় শুধু টুপটাপ ঝরে পড়ে নৈঃশব্দের কলতান!
বসন্তহীন দোল
গনগনে লালে মিশে গেছে হলাহলের নীল।
কালো পিচে শুকনো পাতার ধুলো ওড়ানো
এপিটাফ। আলো আর ঘুমের নিঃশব্দ অনুরণণ
বোধ হয় চলে যায় স্মৃতির সুখে, কামনা কলুষ
ঊর্ধ্বগামী শ্বাসকে পেছনে ফেলে। খামের ডগায়
পাক খাওয়া গভীর বসন্ত, অক্সিজেনহীন বাতাস,
ধূসর আকাশ, চারিদিক জোড়া পুরু মেঘমালায়
শুঁয়োপোকার গল্প তুলে, ঝিঝি পোকার অভিমানে
নিম্নবিত্তের সেহরা হয়ে ঝুলে থাকে,
মদ আর মরুদ্যানের মাঝে।
ডুবকুমারীর গীতবিতান
চাপা পড়ে যায়।
সোনা ধরা মুখে
চেয়ে থাকে শুধু,
এক গোছা রক্ত পলাশ।
উষ্ণতার বসন্ত
বসন্তের হাহাকারে তোমায় দেখেছিলাম।
ভেবেছিলাম তোমার দিকে বেশ খানিকটা হেঁটে গেলে
হয়তো মহাসাগর পাওয়া যাবে! ঘর গেরস্থালির রামধনু
আবির মেখে সূর্য্যের সাতটি রশ্মি, স্কুল শেষে ঢুকে পড়ে
চন্দ্রবিন্দুর পোস্ট মর্টেমে। চারিদিকে ঈর্ষাকাতর মানুষের
জোয়ারে ঈশ্বরী কৌশল, তখন যেন এক ঢেউহীন নদী।
রাত ফুরোলেই ফুসমন্তর আলো আর বাতাসের
স্পর্শে জীবন্ত হয়ে ওঠে এক
সুতীব্র স্বপ্নের মায়াপাহাড়!
তখন সে বসন্তে কেবল আমরা লেগে থাকি। যেমন
ইলিয়াসের কবরে লেগে থাকে ফাল নদীর
ফেলে আসা ইচ্ছেরা!
বিষণ্ণবেলায় সরীসৃপ চাহনিতে সর্বগ্রাসী
অকাল বার্ধক্যের প্রদোষ, হুড়মুড় করে
মিশে যায় পোড়া মাটির গন্ধ আর
রহস্যময় বেদনার অবাস্তব মনোলোগে!
তারপর সেই বসন্তে আর বলা হয়ে ওঠে না,
কে আগে যায়? মৃত্যু নাকি নীল শিরার প্রবাহ?
বৈদ্যুতিক তরঙ্গের কাছে ভেসে থাকে
দ্রবণের হলুদ জলকণা!
গল্পাণু
------------------
কুসুম
শর্মিষ্ঠা রায়সন্ধে থেকে অঝোরে কাঁদছে কুসুম। মা হারা ষোড়শী মেয়েকে কি বলবেন বুঝতে পারেন না অসহায় বাবা। মনে ভেবে রেখেছিলেন, মোড়লের ছেলে নবীনের সাথে বিয়ে দেবেন মেয়ের। ছোট থেকে ওদের বেশ ভাব। কলকাতার কলেজে পড়ে নবীন। ছুটিতে আসায় কুসুম আজ তার সাথেই ঘুরতে বেরিয়েছিল। ফিরে আসার পর থেকেই এই কান্ড!! কুসুমের সই মিতার কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন দুজনের মন কষাকষির কথা।
অনেকদিন পর নবীনের সাথে দেখা হওয়ায় আনন্দে, আবেগে কুসুম তার প্রিয় নবীনদাকে বলেছিল, “তোমাকে দেখলে আমার শরীরে কেমন যেন হয়!” নবীন বেশ রেগে বলে, “শরীর শরীর, তোমার মন নেই কুসুম!!” বড় কষ্ট পায় কুসুম। সে তো মনের কথাই বলতে চেয়েছে।
অবলোকিতেশ্বর
ছন্দশ্রী দাসআপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?
...মিউজিয়ামে
...ধ্যাত ,বলুন না ?
...মিউজিয়ামে সাজানো মূর্তির মাঝে আমিও ছিলাম শ্রমণের ভিড়ে। আপনি একবার পরম মমতায় আমার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি প্রাণ ফিরে পেলাম।
বখতিয়ার খিলজীর নালন্দা আক্রমণের সময় আমি একটি মূর্তি তৈরি করছিলাম, আপনি পাশে বসে ছিলেন।
আগুন জ্বলে উঠলে আপনার হাত ধরে গুপ্তপথে পালাতে গেলাম। একটি ভল্লা এসে আমাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল।
আপনার হাহাকার শুনতে শুনতে পরমব্রহ্মে লীন হলাম।
একদিন আমাকে উদ্ধার করা হল। স্থান হল মিউজিয়ামে।
...মনে পড়েছে। মিউজিয়ামের কিউরিও শপে। আপনি অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি কিনছিলেন।
আমি শ্রমণা, সাংবাদিক।
... আমি শীলভদ্র, আর্কিওলজিস্ট
শীলভদ্র আনমনা শ্রমণার দিকে তাকিয়ে ভাবে, সে রাতে তুমি বড্ড কেঁদেছিলে।
সহযাত্রী
দেবমালা রায়ট্রেনটা সোদপুর পেরোলো। কোথায় সুধন্য?
শবরীর এরকম একটা দিনে ... !
বেলঘরিয়াতে উঠেই সুধন্য বললো, "ফুলের জন্য ট্রেনমিস।"
ত্রিশ বছর যাতাযাতের সহযাত্রীদের কয়েকজন এখনো যায় সুধন্যর মত, আবার অনেকে নতুন ওদের ট্রেনগ্রুপে।
ওরাই ফেয়ারওয়েল দেবে শবরীকে আজ ওর চাকরির রিটায়ারমেন্টে।
ফুল, মিষ্টি, শাড়ি, শাল হাতে শবরীর কান্না পাচ্ছিল বড্ড! নিজের রান্না বিরিয়ানির প্যাকেট দিলো সবাইকে।
শিয়ালদহতে জড়িয়ে ধরা, প্রণাম করা, চোখের জলে শবরী স্থানুবৎ!
"শবরী" ঘুরতেই সুধন্য বইটা দিলো।
"আজ আমারও ডেইলিপ্যাসেঞ্জার হিসেবে শেষদিন। তিনবছর আগেই আমি রিটায়ার করেছি। তোমার ইতিবাচক মানসিকতার টানে রোজ আসতাম।"
শবরী বিদ্যুৎস্পৃষ্ট!
ভিড়ে মিলিয়ে গেল সুধন্য।
বইটা শবরীকেই উৎসর্গ করেছে কবি সুধন্য ঘোষ।
ট্রেনটা ফিরতিপথে যাচ্ছে--নতুন যাত্রীদের নিয়ে।
স্মৃতির দুয়ারে
------------------
কেয়া নন্দী
গল্প
আনুপূর্বিক
"চিলেকোঠার বন্ধ ঘরে
স্মৃতিরা সব আছে পড়ে
আজ দুপুরে তার - ই কিছু
নামলো চোখে হুড়মুড়িয়ে..."
ফ্ল্যাটে থাকা কন্যা - কে 'চিলেকোঠা' দেখাতে সেদিন পৌঁছে গিয়েছিলাম ছোটবেলার বাড়িতে। দুটো সিঁড়ি টপকে মাকড়সার ঘন বুনন সরিয়ে শিকল খুলে ছাদলাগোয়া এই ঘরে ঢুকতেই নাকে এলো একটা সিটকানো গন্ধ। মেয়ে 'ইস- আশ' করলেও আমি বুঝি এটা খুকুপিসি'র বানানো শেষ না হওয়া আচারের গন্ধ।
ঘরের মধ্যে দেয়ালে কিছু ঠাকুরের ছবি, মেঝেতে কতকগুলো আচারের বয়াম, দাদার লাটাই, পোকায় কাটা তিনটে ঘুড়ি, আমাদের কিছু পুরোনো বইখাতা মলিন অবস্থায় আজও জীবিত। কোণে একটা কালো টিনের বাক্স - অতিকষ্টে টিনের বাক্স টা খুলতেই দেখি একটা আধখানা উলের গোলা, উলবোনার কাঁটা, পিঠে তৈরির ছাঁচ, একটা কাঠের হাতা, ছেঁড়া মশারির নেট আর কতকগুলো বিধবা রুপী শাড়ি। প্রত্যেকটা জিনিসই এক - একেকটা ঘটনার স্মৃতিবাহক।
চিলেকোঠার ঘরে তক্তপোষের মলিন বিছানায় বসে মনের ক্যানভাসে চোখ রাখতেই একের পর এক ঘটনারা ভেসে ওঠে। সঠিক সময়ে খুকুপিসির সম্বন্ধ করে বড় ঘরে বিয়ে হলেও পিসেমসাইয়ের বহুগামিতার কারণে 'তার' আবার পূর্বাবস্থায় ফেরত। সেদিন থেকেই পিসি বিধবার সাজে। নীরবে আচার - নাড়ু - পিঠে বানিয়ে নিজের মুন্সিয়ানা দেখালেও সমগ্র পরিবারের কাছে কিন্তু ফেলনা। ছোটবেলায় দেখতুম বাবা - কাকাদের অ - দরকারি সব জিনিসের স্থান হতো এই ঘরে। তাই বোধহয় খুকূপিসিও এই ঘরে তার নিজের স্থান করে নিয়েছিলো।এবং দিনে দিনে 'চিলেকোঠার ঘর'-ই হয়ে উঠলো খুকুপিসির রাজ্যপাট। মরশুমি সব উপাদান দিয়ে বয়াম - বয়াম টক - ঝাল - মিষ্টি নানা রকমের আচার বানাতো। বয়ামের মুখ ছেঁড়া মশারির নেট বেঁধে রোদে দিতো। নিরিবিলি দুপুরে পিসি চিলেকোঠার সিঁড়িতে বসে লাঠি হাতে আচার পাহারা দিতো। সন্ধের মুখে শুদ্ধবস্ত্রে সেই বয়াম চিলেকোঠার ঘরে মজুত রাখতো।কাল যে আবার তাদের গায়ে রোদ লাগাতে হবে।
শুধু কি তাই! খুকুপিসির সহায়তায় দাদা এই ঘরেই ছেঁড়া ঘুড়ি জুড়তো, মাঞ্জা দিতো। দৈনন্দিন খবরের কাগজের স্থানও হতো এই ঘরে; যতদিন না সেটা বিক্রি হচ্ছে। এককথায় আমাদের বাড়ির অপ্রয়োজনীয় বস্তুসামগ্রী জমা হতো চিলেকোঠায়। লোকচক্ষুর অন্তরালে কিছু কাজের ক্ষেত্রেও এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমার দাদার গল্পের বই পড়া'র নেশা ছিল প্রবল । পরীক্ষার সময় বাবা - মা অনুমতি দেবে না বলে দুপুরে চিলেকোঠার ঘরে পড়তে আসতো; আর লুকিয়ে লুকিয়ে দিস্তাখাতার মধ্যে আনন্দমেলা, অন্যান্য গল্পের বই রেখে পড়তো। আবার কখনো কখনো এই ঘরের-ই এক চিলতে জানলায় দাঁড়িয়ে পিসি ছলছল চোখে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো। আমার কিশোরী মন সেদিনের এই লোনাজলের অর্থ বুঝতে না পারলেও আজ প্রৌঢ় বয়সেটা কিছুটা উপলব্ধি হয়।
শীতের দুপুরে ছাদে রোদ পোহানোর পর আমি ও দাদা এই ঘরেই ভাতঘুম দিতাম। আর খুকূপিসি তখন একমনে উল দিয়ে কিছু না কিছু বুনে যেতো; যার আধখানা এখনো বাক্সে পড়ে। নিয়ম করে প্রতিবিকেলে এই চিলেকোঠার সিঁড়িতে বসে পিসি আমার চুলে তেল দিয়ে শক্ত করে 'কলাবিনুনী' বেঁধে দিতো। এই সিঁড়িটা অক্ষত থাকলেও আজ এই ঘরের দেয়ালের পলেস্তারা-র সঙ্গে আমার একমাথা চুলের রেষারেষি চলছে। কে কত তাড়াতাড়ি ঝরতে পারে। একযুগ পরে এই ঘরে প্রবেশ করে স্মৃতিদের নাড়াচাড়া করতে করতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ মেয়ের ডাকে সম্বিত ফেরে ; অতীত সরিয়ে বর্তমানে আসি। এবার গাত্রোথানের পালা। মনে মনে ভাবি, চারপাশের বহুতল আবাসনের ভিড়ে যেভাবে কোঠাবাড়ী অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে সেখানে আমাদের এই 'চিলেকোঠা'র আয়ু আর বেশীদিন নেই। এই হয়তো আমার শেষ সাক্ষাৎ!!
গল্প
------------------
পরিবার
রবীন বসুপয়লা বৈশাখ বাড়িতে দুর্দান্ত সব পদ রাঁধবে রিক্তা। সুবীরকে ফোনে লিস্ট পাঠিয়েও দিয়েছে। কিন্তু সুবীর একটা কাণ্ড ঘটাল…। রিক্তা ভাবতেই পারেনি তাকে না-জানিয়ে ও এটা করবে! তাই প্রচণ্ড রেগে গেল সে।
আজ দু’বছর হল সুবীরের ট্রান্সফার হয়েছে জেলা শহরের এক ব্রাঞ্চে। কলকাতা থেকে অনেক দূরত্ব। তাই ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করা যায় না। বাধ্য হয়ে সুবীর ও তার এক কলিগ ব্রাঞ্চের লাগোয়া ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। উইকেন্ডে বাড়ি আসে। যেমন আজ এসেছে। নববর্ষের ছুটি আছে আগামীকাল।
বাবা বেঁচে থাকতে পয়লা বৈশাখে তাদের বাড়িতে ভালমন্দ রান্নার বেশ চল ছিল। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বিনানোটিশে হঠাৎ একদিন ঘুমের মধ্যে চলে গেলেন বাবা। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে সুবীর চাকরির পরীক্ষায় বসল। ব্যাঙ্কে চাকরি পেল। তার এক বছর পর বিয়ে। এখন তার দুই সন্তান। মেয়ে তিতির বড়, একাদশ শ্রেণীতে পড়ে। ছেলে সৌম্য ক্লাশ সেভেন। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই রিক্তার সঙ্গে মায়ের ঝামেলা শুরু হল। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলে নানান অভিযোগ নিয়ে হাজির হত রিক্তা। প্রায়শই মায়ের বিরস মুখ দেখত সুবীর। রিক্তা দিন দিন অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছিল। মাও বেশ খিটখিটে। একদিন রেগেমেগে রিক্তা এসে বলল, “মেয়ে বড় হচ্ছে। তার একটা আলাদা ঘর চাই। সামনে তার ফাইনাল পরীক্ষা। ছেলেটাও একদিন বড় হবে। তারও একটা ঘর চাই। তুমি মাকে কোনো হোমে রেখে এসো।”
— "সেটা কী করে সম্ভব! আমি মায়ের একমাত্র ছেলে। এ বাড়ি মায়ের, বাবা বানিয়েছে। তাঁর বাড়িতে তিনি থাকবেন না!”
— “বেশ, তবে তুমি থাকো তোমার মাকে নিয়ে, আমি চললাম বাপের বাড়ি।” রিক্তা রাগ করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
মায়ের কানে কথাগুলো গিয়েছিল। তিনি ঘরে ঢুকে ছেলেকে বললেন, “বাবা সুবীর, এই নিত্য অশান্তি আর ভাল লাগে না। তুই একটা ওল্ডেজ হোম দেখে আমাকে রেখে আয়।”
বাধ্য হয়ে বেহালার দিকে একটা হোমে মাকে রেখে এসেছে সুবীর। এতে সাংসারিক অশান্তি মিটেছে বটে, তবে তার বুকের মধ্যেটা হু-হু করে। কলকাতায় আছে অথচ মা বাড়িতে নেই। কয়েকদিন আগে তিতির ফোন করেছিল। “বাবা, ঠাকুমাকে খুব মিস করছি। এবার পয়লা বৈশাখে ঠাকুমাকে নিয়ে এসো না বাড়িতে। তাহলে ডাঁটা দিয়ে শুক্তো, যুক্তিফুল কলমিশাক ভাজা, মাছের ডিমের বড়া, আম দিয়ে ডাল, মৌরলা মাছের টক —এসব খেতে পেতাম!”
কলিং বেল বাজাতে রিক্তা দরজা খুলে দিল। দেখে সুবীরের পিছনে শাশুড়ি। রাগে ফেটে পড়ল সে। —একি কাণ্ড! তুমি আমাকে না-জানিয়ে ওঁনাকে নিয়ে এলে!”
— ”আসলে তিতির বলল, অনেক দিন ঠাকুমার হাতের রান্না খায়নি। তাই ফেরার পথে হোমে গিয়ে —”
তিতির ততক্ষণে ছুটে এসে ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরেছে। রিক্তা একবার রক্তচক্ষুতে মেয়েকে দেখে ভিতরে চলে গেল।
অনেক দিন পর সুধাদেবী আজ পয়লা বৈশাখে নিজের হাতে রান্না করলেন। নাতনি- নাতি ছেলে ছেলের-বউয়ের জন্য। কিন্তু গোল বাধল অন্য জয়গায়। বউমা রিক্তা খেতে এল না। সুবীর ছেলেমেয়েরা অনেক করে ডাকল, তবুও না। অগত্যা সুধাদেবী বউমার ঘরে গিয়ে অনুরোধ করল, “তুমি না-খেলে ছেলেমেয়ে দুটো খাবে না সুবীর ও। আমি কথা দিচ্ছি বউমা, কাল সকালেই সুবীরকে বলব আমাকে হোমে রেখে আসতে। তুমি খেতে চল।
পরদিন সকালে সুবীর একটু তাড়াতাড়ি রেডি হয়েছে। মাকে হোমে রেখে তারপর ব্যাঙ্কে যাবে। তিতির আর সৌম্যর একদম পছন্দ নয় ঠাকুমা চলে যাক। তারা মনখারাপ করে ঠাকুমার পাশে দাঁড়িয়ে। রিক্তা ঘরে ঢুকে বলল, “মা, আমাকে ক্ষমা করে দিন। আপনাকে আর হোমে যেতে হবে না। আপনি চলে গেলে আমার ছেলেমেয়ে দুটো ভাল থাকবে না।”
মা ও ছেলের চোখে ততক্ষণে জল। তিতির ও সৌম্য এবার খুশিতে তাদের ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরেছে।
আগামী
সুদীপা বর্মণ রায়আজকাল বিমানবাবুর ঘড়ি চলে ধীরগতিতে। বড় নিঃসঙ্গতা ঘরবারান্দা ,বাগান জুড়ে। এই কিছুদিন আগেও দুজন ছিলেন, হাতেহাতে কাজ ঝগড়াঝাঁটি করতে করতে কোথা দিয়ে সময় চলে যেত বুঝতে পারতেন না। একমাত্র ছেলের অস্ট্রেলিয়ায় পরিবার নিয়ে পাকাপাকি বসত। দুবছর তিনবছরে আসে একবার করে। এতে তিনি কোন দোষ দেখেন না। ছোট থেকে সন্তানকে আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে , যখন সে ডানা মেলে ,তখন পা চেপে ধরার চেষ্টা করলে নিজের হাতই ক্ষতবিক্ষত হয়। পাখি ফেরে না নীড়ে। প্রতিবছর বিদেশ থেকে দেশে আসার সামর্থ্য খুব কমজনেরই হয়। বেশিরভাগই ভাবে বিদেশে কর্মরত সবাই বিলিওনার। বাস্তবে তারাও পাইপয়সা হিসেব করে খরচ করে ,যাতে বছরে দুবছরে ফিরতে পারে নিজের ফেলে যাওয়া আত্মীয় পরিজন ঘরবাড়ি আস্তানায়।
নিজের মনকে বুঝিয়ে প্রবোধ দিয়ে দিব্যি ছিলেন বুড়োবুড়ি। হঠাৎ তাড়াহুড়ো ডাক পড়লো বুড়ির , পালিয়ে গেলো তার সাধের ঘরবাড়ি ,উঠোন ,ছাদ , বাড়ির পিছনের মস্ত বাগান ফেলে। এখন সকালবেলায় নিজেকেই নিজে চা দিয়ে ডাকেন বিমান। বারান্দায় তখন হালকা রোদে পাখির ডাকাডাকি তাদের প্রাপ্য বিস্কুটের আশায়। খবরের কাগজ পড়ে বাগানে যান। বাগানটা দেখার মত। বাড়ি করার সময় শহরের পিছন দিকে জমি কেনা নিয়ে খুঁতখুঁত করছিলেন খুব। চারপাশে ফাঁকা অমলার হাতে পোঁতা শিশুচারারা আজ বৃক্ষ। কিছু টগর জবাও আছে। যেখানেই বেরাতে যেতেন স্থানীয় গাছ সংগ্রহ ছিল অমলার নেশা। সবাইকে ঘুরেঘুরে সেবা করেন।গায়ে হাত বুলিয়ে জল দিয়ে শুকনো পাতা ঝাঁট দিয়ে পোকা ধরলে নিম জল ছিটিয়ে দেন। গাছেদের মধ্যে থাকতে থাকতে রোদ তীব্র হলেও সেভাবে গরম লাগে না। শুয়ে পড়েন পাহাড়ি অচেনা গাছটার গোড়ায়। অমলা সেবার সিকিমের এক গ্রাম থেকে এক পাহাড়ি ঝলমলে রঙিন গাছ উপহার পেলো। এনে বাড়িতে পুঁতে যত্নআত্তি করতেই সে সব গাছের মাথা ছাপিয়ে ছাতার মত মেলে দিলো ডালপালা। গাছটির তলায় শুলে এক অদ্ভুত টান টের পান। আজকাল মাঝেমাঝেই মনে হয় তাঁর চলে যাওয়ার পর এই বাগান প্রমোটারের হাতে যাবে। কদিন ধরে শরীরটা খারাপ লাগলেও ছেলেকে জানাননি। খামোখা ওর কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে লাভ কি! বাগানে ঘুরতে ঘুরতে পায়ে ঠেকলো এটা কী?ফল বলেই মনে হচ্ছে। নাকি বীজ? কুড়িয়ে হাতে নিতেই শরীরে উষ্ণতা টের পেলেন। মুখ তুলে দেখলেন পাহাড়ি গাছের কিছু ডাল ছুঁয়ে দিলো হাত। বৃদ্ধ বয়সের ভ্রম? বাতাস বইছে না তো! তবু শাখাগুলোর নেমে এসে ছুঁতে চাওয়া মিথ্যা তো নয়। একাকীত্ব ওটুকুতেই খুঁজে পায় ছায়া। ঘরে এসে ডাইনিং টেবিলে হস্তশিল্প মেলা থেকে কেনা পোড়ামাটির পাত্রে কিছুটা জলে ভাসিয়ে দিলেন বীজটা।
রাতে খাওয়াদাওয়ার পর শুতে যাওয়ার সময় আর একবার গেলেন টেবিলের কাছে। খোলা জানলা দিয়ে আবছা চাঁদের আলো পড়েছে জলে। হালকা স্ফীত লাগছে বীজের মধ্যিখানটা। ঠিক যেন অমলার গর্ভবতী অবস্থানের দিনগুলোতে চাঁদের আলো মেখে বসে আছে সে। নাহ কী সব ভাবছেন।
অদ্ভুত স্বপ্নটা দেখে শেষ রাতে ঘুম ভেঙে গেলো। একদল মানুষ , তাদের মাথা নেই। সেই জায়গায় বিভিন্ন রকম যন্ত্র। কোথাও বুলডোজার ,কোথাও ইলেকট্রনিক কুঠার, কোথাও হাতুড়ি। সবাই তীব্রগতিতে ছুটে আসছে। ছড়িয়ে পড়ছে চক্রাকারে। দল বেঁধে আক্রমণ করছে বাগানের গাছগুলোকে। আধো ঘুমেও তাদের আর্ত চিৎকার শুনে শিউরে উঠছেন বিমান। ছুটে ছুটে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন আততায়ীদের হাত থেকে অসহায় গাছেদের। কিছুতেই পেরে উঠছেন না স্বাভাবিক বয়সজনিত জড়তার কারণে।মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে পাহাড়ি গাছটা ডালপালা মেলে তুলে ধরতে এগিয়ে এলো। ঘুমটা ভেঙে গেলো যখন তখনও হাতটা সামনে বাড়ানো কোন এক অবলম্বনের খোঁজে। উঠেই তাড়াতাড়ি গেলেন টেবিলের সামনে। বীজের ওপরের ত্বকে ফাটল ধরেছে। সবুজের আভাস। বীজটা নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন পাহাড়ি গাছটার নীচে। ঈশ্বর স্মরণ করে প্রবল মমতায় পুঁতে দিলেন নতুন সম্ভাবনা। ঠিক জানা নেই তবু কোথা থেকে যেন মনের জোর খুব বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে এখনো অনেক কাজ বাকি। নবজাতকের আসার অপেক্ষা করতে হবে। সে এলে তাকে লালনপালন করতে হবে। নিশ্চিতরূপে এ বৃক্ষ রুখে দেবে আগামী ধ্বংস।
ভোরের স্বপ্ন মিথ্যা হয় না, বুঝলে অমলা।
বিজ্ঞানের আলোর রথ
অঞ্জনা মজুমদারকুশল, স্যর ডঃ বোস আর অজন্তা একটা বিশেষ মিশনে অ্যামাজনের জঙ্গলে এসেছেন। কুশল জীববিজ্ঞানী আর অজন্তা ইতিহাসের ছাত্রী। এখন তো ইতিহাস আর বিজ্ঞান বলে আলাদা কিছু হয় না। বিজ্ঞান পড়তেও ইতিহাস জানতে হয়। একটা বিশেষ প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব জানা গেছে। যদিও কুশলরা এখনো তাকে চাক্ষুষ দেখেননি। একজন আদিবাসী খবর দিয়েছেন। কুশলদের কাছে একটা যান আছে, যেটা প্রয়োজনে আকাশেও উড়তে পারে। আর এটাই ওদের রাত কাটানোর আশ্রয়। এর মধ্যে বেশি হলে চারজন মানুষ থাকতে পারে। এমন মেটেরিয়াল দিয়ে এটা তৈরি যে হাতি ওর ওপর চলে গেলেও ভাঙবে না। ভেতরে ছোট্ট কিচেন আর বায়ো টয়লেটও আছে। ওরা এটিকে টেন্টু বলে ডাকে।
অ্যামাজনের জঙ্গলে নদীর তীরে ওরা যানটি থামিয়ে লক করে নামলেন।
জাগগাটা অদ্ভুত রকমের নিঃস্তব্ধ। গাছে একটাও পাখি নেই। থমথমে পরিবেশ। এখন দুপুরবেলা, নদীর জলের আওয়াজ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই। লেজার রশ্মির লাইট নিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে যাবে সবাই, হঠাৎই প্রবল ঝড় উঠলো। চারিদিকে প্রবল আলোড়ন। বাজ পড়ছে, বড় বড় ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হতেই ওরা টেন্টুর ভেতরে ঢুকে পড়লো। ভেতর থেকে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখে ওরা, বিশেষ করে অজন্তা ভয়ে কুঁকড়ে গেল। ঝড় যেন দানবের মত মাতামাতি করছে। মাঝে মধ্যেই জোরে বাজ পড়ছে। অঝোরে বৃষ্টি নামল।
ঠিক দশ মিনিট এমন চলার পর সব হঠাৎ করে সব থেমে গেল। একটা গাছের পাতাও নড়ছে না। একটা তীব্র আওয়াজ, কানে তালা লেগে যাবার মত। জানালা দিয়ে কি দেখা যাচ্ছে ওটা?
চীনা রূপকথার ড্রাগন মাটিতে নেমে এসেছে। ধারালো জিভ বের করে একবার টেন্টুর গা চেটে দিল। তারপর একটা ধাক্কা। টেন্টুর মেসিনে সেট করা এ আই ত্বরিত গতিতে গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশে উড়ে গেল ড্রাগনের নাগালের বাইরে। মাটিতে হেঁটে জঙ্গলে ঢোকা গেল না। আকাশ থেকেই অগত্যা নজরদারি।
জঙ্গলের মাথার ওপর দিয়ে উড়তে উড়তে লেজার টেলিস্কোপ দিয়ে ভালো করে জঙ্গলে নজর করতে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখা গেল। নীচে জঙ্গলের মধ্যে একটা বিশাল প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। এখানে এমন প্রাসাদের অবস্থান আধুনিক মানুষের জানা ছিল না। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় প্রাসাদে কোনও প্রাণের চিহ্ন নেই।
ডঃ বোস বললেন, কুশল আমরা এখানেই নামব।
ডঃ বোস এর কথায় টেন্টু নীচে নেমে এল একটা ফাঁকা উঠোনের মত জায়গায়। ওরা যানের বাইরে এলেন। বিশাল বড় বড় ঘর উঠোনের চারিদিকে। সব ঘরই ভাঙাচোরা, কেবলমাত্র তিনটি ঘর ব্যবহার করা হয় মনে হচ্ছে।
প্রথম ঘরে একটা বিছানা আর একটা টেবিল চেয়ার। পরের ঘরটা দরজা ভেজানো ছিল। ভেতরে যেন একটা ল্যাবরেটরি। সারি সারি বোতলে নানা রকম রাসায়নিক পদার্থ। আর ছোট ছোট ডায়ানোসোরের কঙ্কাল। একটা মানুষের কঙ্কালও আছে। ঘরটিতে জল সরবরাহের ব্যবস্থা আদিকালের পাইপ দিয়ে পিছনের ঝর্ণা থেকে। সবাই অবাক হয়ে গেল।
পরের ঘরে ঢোকার মুখেই বাধা। একজন সিংহের চামড়া পরা মানুষ হাতে বর্শা নিয়ে দাঁড়িয়ে। অবাক হয়ে সবাই শুনলেন ইংরেজিতে মানুষটি বলছেন, হু আর ইউ? এখানে কেন এসেছেন?
ডঃ বোস বললেন, আপনি ডঃ মন্ডল,রাইট? বিখ্যাত প্রাণীবিজ্ঞানী। দশ বছর আপনি নিখোঁজ বনবাসে। আপনার রিসার্চ মানুষের কি কাজে লাগাতে চেয়েছেন। কিন্তু আপনি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলেছেন। তাই দানবের মত ড্রাগন তৈরি হয়েছে।
সরি, কিন্তু আমি কি করব? সত্যিই আমি কন্ট্রোল হারিয়েছি। আপনি দশ বছর পিছিয়ে আছেন ডঃ মন্ডল। এখনকার বিজ্ঞান আপনার সমস্যার সমাধানের পথ জানে।
সত্যি বলছেন?
বলছি। আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। বলে ডঃ বোস, ডঃ মন্ডলের হাত ধরে টেন্টুর ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভেতর দেখে ডঃ মন্ডল অবাক। এখানে কি হবে? এই যন্ত্র কি করবে?
টেন্টুর গলার আওয়াজে চমকে গেলেন ডঃ মন্ডল।
আমি আপনার সমস্যার সমাধান করতে পারি ডঃ মন্ডল। আপনি আমার ল্যাপটপের সামনে বসুন। তারপর আপনার তৈরি মডেলের নাম টাইপ করুন।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো ডঃ মন্ডল টেন্টুর বলা কথা মতো কাজ করে গেলেন। বলতে বলতেই সেই ড্রাগন তীব্র গতিতে এসে পড়ল। ভয়ংকর আওয়াজে কান পাতা দায়। টেন্টু বলল, তাড়াতাড়ি ডিলিট বটম প্রেস করুন। বলতে বলতেই বটমে হাত আর ভোজবাজির মত ওই বিশাল ড্রাগন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
সবাই হাঁপ ছেড়ে গভীর নিঃশ্বাস নিল।
ডঃ মন্ডল বললেন, আমি স্বস্তি পেলাম। আমার একটা ভুলের জন্য ঐ প্রাগঐতিহাসিক প্রাণী তৈরি হয়েছিল। ও কেবল এই বাড়ির দিকে আসত না কেন জানি না। তাই আমি বেঁচে ছিলাম। জঙ্গলের প্রান্তের গ্রামবাসীরা মাঝে মধ্যেই ওর কবলে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। আপনারা ওদের এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা করলেন।
অজন্তা এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার বলে উঠল, স্যর এখনকার পৃথিবীতে ফিরে চলুন। ওখানেই আপনি আপনার বাকি রিসার্চ করবেন। ডঃ বোস বললেন, কুশলকে চিনতে পারেন? আপনার ছেলে। আপনার নিখোঁজ হবার সময়ে ও স্কুলে পড়ত।
কুশল বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। বাবা ছেলের মিলন দৃশ্য দেখে সবার চোখে জল।
অজন্তা বলল, আমরা সবাই আপনাকে সাহায্য করব। আমরা সবাই মিলে একসাথে বিজ্ঞানের সাধনা করব।
ডঃ মন্ডলের চোখে জল। বললেন, তাই হোক। চলুন বাড়ি ফেরা যাক। টেন্টু আকাশে উড়ে গেল। বিজ্ঞানের আলোর রথ যাচ্ছে ভারতের দিকে।
আনুপূর্বিক
------------------
বাংলার রেনেসাঁস ও লালন
বিধায়ক ভট্টাচাৰ্যলালনকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বাংলার রেনেসাঁসের কথা আসবেই। কারণ উনবিংশ শতাব্দী বাংলায় রেনেসাঁর সময়কাল। লালন জন্মেছিলেন ১৭৭৪ সালে। লালনের জন্মের দু বছর আগে ১৭৭২ জন্মগ্রহণ করেন আর এক যুগ স্রষ্টা, রাজা রামমোহন রায়। কাকতালীয়ভাবে এই দুই মহাপুরুষের জন্ম একই সময়ে। যখন ভারতীয় সমাজ সাবেক ব্রাহ্মণ্যবাদের বাড়াবাড়িতে বিব্রত, বিপর্যস্ত। জাত, ধর্ম, অনাচার ইত্যাদি সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের জীবন করেছিল দুর্বিসহ। নারীর প্রতি অত্যাচার, বর্ণভেদ প্রথার প্রবল প্রকাশ এবং উচ্চবর্ণ নিম্ন বর্ণের মধ্যে হানাহানি বেড়েই চলেছে। হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতায় এবং বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বাড়াবাড়িতে প্রকৃত ঈশ্বরের যেন রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। ঠিক সেই সময় অবিভক্ত বাংলার দুই প্রান্তে জন্ম নিলেন দুই মনীষী। ভারত পথিক যুগাবতার রামমোহন জন্ম নিলেন হুগলির রাধানগরে । আর একজন, যাকে বলা যায় ‘নিঃসঙ্গ বিগ্রহ’, ‘প্রতীচ্যের সক্রেটিস’ লালন ফকির জন্ম নিলেন ওপার বাংলার কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায়।
রামমোহনের আধুনিকতার উৎস, পাশ্চাত্যের রেনেসাঁসের মূল কথা Man is the measure of everything, আর লালনের তত্ত্ব ‘মানুষ রতন’, যা এসেছে নাথ যোগী বাউল বৈষ্ণব সহজিয়া তত্ত্বের ভেতর থেকে। রামমোহন ছিলেন উনিশ শতকের নবজাগ্রত নগরবাসী বাঙালির নব ভাব আন্দোলনের ঋত্বিক। আর লালন বিশাল বাংলার শাস্ত্রীয় ধর্মনিরপেক্ষ মৃত্তিকা নির্ভর মানবীয় ধারায় মহান সাধক। এ দুজনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে এটা মেনে নিও বলা যায় যে, দুজনেই দিনের শেষে ‘মানুষ’কেই খুঁজে বেড়িয়েছেন। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, ‘ দেশের শিক্ষিত নাগরিক মহলে যে সময় রেনেসাঁস বা নবজাগরণ চলছিল সেই সময়ই চলছিল অশিক্ষিত গ্রামিক লোক চিত্তে অন্য এক আলোড়ন। এর সুসংবদ্ধ ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি। সেরকম ইতিহাস যখন লেখা হবে তখন লালন কে তার যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়া যাবে।’ রামমোহন তৈরি করেছিলেন হিন্দু ধর্মকে সংস্কার করে ব্রাহ্ম ধর্ম, আর লালন সব ধর্মের উপরে উঠে তার মতবাদ প্রচার করলেন যাকে বলে মানব ধর্ম।
হিন্দু মুসলিম ধর্মের মধ্যে এই যে বিভাজন তাকে তিনি কখনোই মেনে নেন নি। তাইতো তিনি তাঁর গানের অক্ষরে অক্ষরে সাজিয়ে রেখেছেন তার প্রতিবাদ:
“ সুন্নত দিলে হয় মুসলমান মুসলমান
নারী লোকের কি হয় বিধান
বামুন চিনি পইতে প্রমাণ
বামনি চিনি কিসে রে…”
অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, ‘বাংলার নবজাগরণে রামমোহনের যে গুরুত্ব বাংলার লোক মানুষের দেয়ালী উৎসবে লালনেরও সেই গুরুত্ব দুই যমজ সন্তানের মত তাদের দুজনের জন্ম। দু'বছর আগে পরে। ইতিহাস-জননীর পক্ষে দুই বছর যেন দুই মিনিট। তবে একসঙ্গে এলেও এরা একসঙ্গে যাননি। লালনের পরমায়ু যেন রামমোহন ও বঙ্কিমচন্দ্রের জোড়া পরমায়ু। লোকসংস্কৃতিতে একক ব্যক্তিত্বের এমন বিরাট উপস্থিতি আমাদের অভিভূত করে।’ ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে বলেছেন, ‘ উদার মানবতাবাদী ভাবধারার বিকাশে লালন শাহের ও রামমোহনের ভূমিকায় এক তুলনামূলক আলোচনা করা যায়। আর তার ফলেই কলকাতা শহরের বুদ্ধিজীবীদের ও গ্রামের উপেক্ষিত জনসাধারণের চিন্তাধারার ছবিটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা দেখতে পাই, পশ্চিমী হাওয়ার সংস্পর্শে না আসতে পারলেও গ্রামের সাধক ও মরমী কবিদের প্রভাবে এই উপেক্ষিত জনসাধারণের মনোজগৎ কলকাতার শিক্ষিতদের তুলনায় কম সমৃদ্ধ ছিল না।… দুর্ভাগ্যবশত রামমোহনের ভূমিকা আলোচনায় লোকসংস্কৃতির প্রবাহটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয় না’ (সূত্র: ব্রাত্য লোকায়ত লালন, সুধীর চক্রবর্তী, পৃ:১৪৮)
লালন জন্মেছিলেন ১৭৭৪ সালে এবং মৃত্যু হয় ১৮৯০ সালে। তার জীবিত কাল থেকেই বোঝা যাচ্ছে পুরো উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে লালন জীবিত ছিলেন। একজন বাউল সম্রাট, জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানব কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ, লালন ফকির সারা জীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। চন্ডীদাস লিখেছেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ লালন লিখেছেন, ‘ মিয়া ভাই কি কথা শুনাইলেন ভারী / হবে নাকি কেয়ামতে আযাব ভারী/ নর-নারী ভেস্ত মাঝার/ পাবে কি সমান অধিকার/ নরে পাবে হুরের বহর/ বদলা কি তার পাবে নারী? এখানে দুজনেই মানুষের কথা বলেছেন মানুষের সমানাধিকারের কথা বলেছেন । এখানে চন্ডীদাসের সঙ্গে লালনের প্রকাশগত একটি ফারাক আছে। সেটি হল লালন তার গানের শেষে একটি প্রশ্ন রেখে যান আগামী দিনের সত্যের কাছে।
উনিশ শতকের নবজাগরণকে ‘বঙ্গীয় নবজাগরণ’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। অথচ, সেখানে পূর্ববঙ্গের কোন প্রতিনিধির স্থান নেই! এই নবজাগরণেরও উৎসমুখ যদি মানুষ হয় তাহলে সেই মানুষকে নিয়েই তো সারা জীবনভর মূলত লালন ফকির এবং তার চারপাশে ঘিরে থাকা প্রথিতযশা সাহিত্যিক এবং সমাজ সংস্কারক, হরিনাথ মজুমদার বা ‘কাঙাল হরিনাথ’, মীর মশাররফ হোসেন, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, জলধর সেন, এরা কাজ করে গেছেন। এদের নাম নেই কেন? তাহলে কি এই নবজাগরণ শুধু শহরকেন্দ্রিক বা কলকাতা কেন্দ্রিক? বিদ্যাসাগর-রামমোহন-বঙ্কিমচন্দ্র -বিবেকানন্দ-রামকৃষ্ণ শুধু এনাদেরই অবদান আছে? পূর্ববঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে প্রান্তিক মানুষগুলোর সাথে মিশে গিয়ে তাদের জাতি, ধর্ম, নারী-পুরুষ ভেদাভেদ ভুলে সারা জীবন যারা মানুষকে নিয়ে কাজ করে গেল, লালন ফকির সহ সেইসব মানুষগুলোর কি রেনেসাঁস আন্দোলনে কোন অবদান নেই? এই নবজাগরণ সংগঠিত হবার পর এক শতাব্দী পেরিয়ে আরেক শতাব্দীর এক চতুর্থাংশ আমরা পার করে এসেছি। এখনো এই বিষয়ে সেরকম কোনো মূল্যায়ন চোখে পড়ছে না। তবে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক, শ্রদ্ধেয় সুধীর চক্রবর্তী (১৯৩৪-২০২০) তার ‘ব্রাত্য লোকায়ত লালন’ বইতে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এছাড়া ২০২২ সালে লিখিত শ্রদ্ধেয় প্রসাদ সেনগুপ্ত ‘র ‘নবজাগরণের বঙ্গ ও বাঙালি’ নামে গবেষণামূলক একটি বইতে এই বিষয়ে উল্লেখ আছে। তিনি লিখছেন, ‘উনিশ শতকের বাংলা এখন আমাদের কাছে উপাসনার মন্দির হতে পারে। এই মন্দিরের এক দরজা খুললে দেখা যায় যার মুর্তি- তিনি হরিনাথ মজুমদার’। ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’র সম্পাদক এবং প্রকাশক হিসেবে কাঙ্গাল হরিনাথের অবদান আমরা কমবেশি সবাই জানি। কাঙাল হরিনাথ সম্পর্কে সুধীর চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, ‘... হরিনাথ বাউল গানের আদর্শে ফিকিরচাঁদ ভনিতায় বহু গান লেখেন এবং শখের বাউল দল বেঁধে সেই সব গান প্রচার করেন। বাংলা গানে পরম্পরায় থেকে ফিকিরচাঁদি গানের ভাব ও সুরের গড়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রে ফিকিরচাঁদের একটি প্রসিদ্ধ গান হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল (মূল গানে আছে, ‘ওহে, দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে)’। ব্যবহার করে তাকে প্রসিদ্ধতর করেছেন। যাই হোক এই ভাবুক হরিনাথের সম্পূর্ণ বিপরীত সত্তা ছিল সম্পাদক হরিনাথের। ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’র ফাইল ঘাঁটলে দেখা যাবে নির্ভিক হরিনাথ কুষ্টিয়ার দরিদ্র কৃষক শ্রেণীর পক্ষে কলম ধরতেন, তাদের উপর শোষণ ও অত্যাচারের প্রতিবাদ করতেন নিজের কাগজে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর ‘লোকসংগীত সমীক্ষা’: বাংলা ও আসাম (১৮৩৫) বইতে অপ্রকাশিত কাঙ্গাল হরিনাথের দিনপঞ্জির সাক্ষ্য মেনে উল্লেখ করেছেন যে একবার ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’য় জমিদারের প্রজাপীড়নের খবর পড়ে জমিদারদের প্রেরিত লাঠিয়ালরা কাঙালকে উচিত শিক্ষা দিতে আসে। সাধক লালন তার দলবল নিয়ে লাঠি হাতে বিপন্ন বন্ধু কাঙ্গালকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।’ (ব্রাত্য লোকায়ত লালন, পৃ ২০)।
যে নারীর কোন দেশ নেই
শংকর ব্রহ্মতেরো বছর বয়স থেকে তসলিমা কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত তিনি 'সেঁজুতি' নামক একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশ করেন। ১৯৮৬ সালে 'শিকড়ে বিপুল ক্ষুধা' নামক তার প্রথম কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯৮৯ সালে 'নির্বাসিত বাহিরে অন্তরে' ও ১৯৯০ সালে 'আমার কিছু যায় আসে না' কাব্যগ্রন্থগুলি প্রকাশিত হয়। এই সময় নঈমুল ইসলাম খান দ্বারা সম্পাদিত খবরের কাগজ নামক রাজনৈতিক সাপ্তাহিকীতে নারী অধিকার বিষয়ে লেখা শুরু করেন। তার কাব্যগ্রন্থ ও সংবাদপত্রের কলামে নারীদের প্রতি ইসলামপন্থীদের শোষণের অভিযোগ করায় ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের একদল ইসলামপন্থী এই পত্রিকার অফিস ভাঙচুর করে।
তসলিমা বলেছেন, "যদি কুরআন নারীদের পর্দা করার পরামর্শ দেয়, তাহলে কি তাদের তা করা উচিত? আমার উত্তর হল না। কোন বইতে লেখা আছে, যে ব্যক্তিই পরামর্শ দিক না কেন, যেই আদেশ করুক না কেন, নারীদের পর্দা করা উচিত নয়। পর্দা নেই, চাদর নেই, হিজাব নেই, বোরকা নেই, মাথার স্কার্ফ নেই। নারীদের এই জিনিসগুলির কোনওটিই ব্যবহার করা উচিত নয় কারণ এগুলি সবই অসম্মানের হাতিয়ার"।
এই একই রকম ভাবনা বহুদিন আগে বেগম রোকেয়াও ভেবেছেন। তিনি "অলঙ্কারকে দাসত্বের প্রতীক বিবেচনা করেছেন এবং নারীদের অলঙ্কার ত্যাগ করে আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত হয়ে আর্থ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হতে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন - রোকেয়া অলঙ্কারকে দাসত্বের প্রতীক বিবেচনা করেছেন এবং নারীদের অলঙ্কার ত্যাগ করে আত্মসম্মানবোধে উজ্জীবিত হয়ে আর্থ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে সচেষ্ট হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
"আমরা বহুকাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসীত্বে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। ক্রমে পুরুষরা আমাদের মনকে পর্য্যন্ত দাস করিয়া ফেলিয়াছে।... তাহারা ভূস্বামী গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে হইতে আমাদের "স্বামী" হইয়া উঠিয়াছেন।... আর এই যে আমাদের অলঙ্কারগুলি– এগুলি দাসত্বের নিদর্শন। ... কারাগারে বন্দিগণ লৌহনির্ম্মিত বেড়ী পরে, আমরা স্বর্ণ রৌপ্যের বেড়ী পরিয়া বলি "মল পরিয়াছি। উহাদের হাতকড়ী লৌহনির্ম্মিত, আমাদের হাতকড়ী স্বর্ণ বা রৌপ্যনির্ম্মিত "চুড়ি!"... অশ্ব হস্তী প্রভৃতি পশু লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে, সেইরূপ আমরা স্বর্ণশৃঙ্খলে কণ্ঠ শোভিত করিয়া বলি "হার পরিয়াছি!" গো-স্বামী বলদের নাসিকা বিদ্ধ করিয়া "নাকা দড়ী" পরায়, আমাদের স্বামী আমাদের নাকে "নোলক" পরাইয়াছেন। অতএব দেখিলে ভগিনি, আমাদের ঐ বহুমূল্য অলঙ্কারগুলি দাসত্বের নিদর্শন ব্যতীত আর কিছুই নহে! ... অভ্যাসের কি অপার মহিমা! দাসত্বে অভ্যাস হইয়াছে বলিয়া দাসত্বসূচক গহনাও ভালো লাগে। অহিফেন তিক্ত হইলেও আফিংচির অতি প্রিয় সামগ্রী। মাদক দ্রব্যে যতই সর্বনাশ হউক না কেন, মাতাল তাহা ছাড়িতে চাহে না। সেইরূপ আমরা অঙ্গে দাসত্বের নিদর্শন ধারণ করিয়াও আপনাকে গৌরবান্বিতা মনে করি। ... হিন্দুমতে সধবা স্ত্রীলোকের কেশকর্ত্তন নিষিদ্ধ কেন? সধবানারীর স্বামী ক্রুদ্ধ হইলে স্ত্রীর সুদীর্ঘ কুম্ভলদাম হস্তে জড়াইয়া ধরিয়া উত্তম মধ্যম দিতে পারিবে। ... ধিক আমাদিগকে!আমরা আশৈশব এই চুলের কত যত্ন করি ! কি চমৎকার সৌন্দর্য্যজ্ঞান ! "
এই সময় নির্বাচিত কলাম নামক তার বিখ্যাত প্রবন্ধ-সংকলন প্রকাশিত হয়, যার জন্য ১৯৯২ সালে তসলিমা আনন্দ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৯৩ সালের মধ্যে 'অতলে অন্তরীণ', 'বালিকার গোল্লাছুট' ও 'বেহুলা একা ভাসিয়েছিল ভেলা' নামক আরও তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। 'যাবো না কেন? যাব' ও 'নষ্ট মেয়ের নষ্ট গল্প' নামক আরও দুইটি প্রবন্ধ-সংকলন এবং 'অপরপক্ষ', 'শোধ', 'নিমন্ত্রণ' ও 'ফেরা' নামক চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ময়মনসিংহ শহরে ১৯৬২ সালের ২৫শে আগস্ট তসলিমা নাসরিন জন্মগ্রহণ করেন। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। তার মা ঈদুল ওয়ারা ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান গৃহিণী এবং পিতা রজব আলী পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি ময়মনসিংহ রেসিডেন্সিয়াল স্কুল থেকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এস.এস.সি) পাস করেন। ১৯৭৮ সালে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচ.এস.সি) পাস করেন। এরপর তিনি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৮৪ সালে এম.বি.বি.এস পাস করেন। ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল তিনি সরকারী গ্রামীণ হাসপাতালে এবং ১৯৯০ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মিটফোর্ড হাসপাতালে স্ত্রীরোগ বিভাগে ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢা.মে.ক.হা)- এ অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তিনি মনে করেন, "রাষ্ট্রের কর্তব্য নারীদের শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক সহায়তা নিশ্চিত করা, যা তাদের ক্ষমতায়নের মূল কারণ।"
চলবে...
মুক্তপদ্য
------------------
বসন্তবাহার
নিলয় নন্দী
উনুনে পায়েস বসানো৷ নতুন গুড় আর কাঠকয়লার গন্ধ মিলেমিশে ফাল্গুন। আমি সংযম শিখি। পাম গাছের নীচে পেট চেপে শুয়ে থাকা সাদা বেড়ালটির মত ঘুম ঘুম সংযম। ফুল ফুটুক না ফুটুক, ল্যাপটপে বসন্ত ভ্রমর। ফুটন্ত চালের ঘ্রাণে মৈথুন মগ্নতা। মেঘ জমে আছে স্তনে। ঘেঁটে দেখি কতটা কুয়াশা, কতটাই বা বৃষ্টিদাগ। লাবণ্য মৃদু হাসে। আমি তাকে বশ করার মন্ত্র জানি না। হন্যে হয়ে ক্রোশ যোজন হাঁটি। বসন্তের বাঁকে বাঁকে পাখিদের ঘরবাড়ি। আড়ালে আবডালে জাতিস্মর প্রেম। গতজন্মে তুমিও কি সিন্ধুসারস নাকি পর্তুলিকা ফুল? কবেকার ছায়ারোদে মন পড়ে আছে। সাদা বেড়ালের লোমে মন পড়ে আছে। লাবণ্য, এইজন্মে বড়ন্তী যাবে? পলাশ কুড়োবে? বাঁশি বাজছে কোথাও। গাছের গায়ে হেলানো সাইকেল। আদুড় গায়ের গাঁ। ঊর্মি, তুমিই লাবণ্য? চৈত্রের দুপুরে আমফুলের ঘ্রাণ। বসন্ত লাগিল সখী। সিঁথিপথ লাল...
জলের ধারে এসে দাঁড়ালে আমার সফর থামে।
পলাশে মরচে পড়ে। তোমাকে আদর দিতে চাই। কবিতার মত করে কতদিন কাউকে বলিনি...
বিষাদ বলিনি। সমর্পণ বলিনি। কথোপকথন ডুবে মরে বাঁওড়ের জলে। কোকিলেরা চিনে নেয় স্তন, পায়েসের ঘ্রাণ। বেড়ালের বাচ্চা হলে আমি তার নাম রাখি বসন্তবাহার।
নষ্ট তান্ত্রিকের অগস্ত্যযোগ ও মহানক্ষত্রের জীবাণু সমগ্র
নিমাই জানামৈত্রেয় ঋষি যেদিন আত্মহত্যা করেছিল আমাদের তখন হাড়গোড় ফুসফুস আর কান্নার জরায়ু ও লাল ডিমের পকেট আর উদ্ভ্রান্ত কারখানার জলের জেলির থলথলে পকেটের স্নায়বিক কাঁকড়ারা আমাদের মাথা নিয়ে বিক্রি করেছিল হেরিপিন্ডের হাটে, পিণ্ডকে এতো কম দামে পাওয়া যায়, আমি অবৈধভাবে গর্ভ সঞ্চার হয়ে যাওয়া মুখ বধির প্রতিবিম্বকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না,
কোন নারী সেদিন পৃথিবীর যত উত্তল সাগরে উলঙ্গ হয়ে বসে থাকে আমাদের জংঘার দুই দিকে দুই পা করে, মাঝে আমাদের পিতা ও , সেদিন নিজের হাড় চামড়াকে দাঁত দিয়ে কেটে কেটে রক্ত বিক্রি করতো আর উন্মাদ হয়ে উনুনের থেকে ছেঁড়া জিবটাকে নিয়ে টাঙিয়ে রাখত বিছানার চারপাশে, এতো বিশ্বস্থ নুন আমি কখনো জীবনে চেখে দেখিনি দুই চোখে , কোন শৌচাগার আমার একান্ত দাবিদার নয় ,
প্রতিটা হাড়গোড়ের দোকানে আমারই নিজের কাটা মাথা আর অজগর সর্বদাই আমাকে অর্গাজমে ব্যতিব্যস্ত করে রাখছে রাস্তায় গাড়িতে সদ্য চাপা পড়ে যাওয়া কুকুরের বাচ্চা তার নাড়িভুড়ি আর দুগ্ধবতী স্নায়ুর রহস্যের গর্ভপাত আমাকে কোনদিন পিতামহের উত্তরাধিকার পত্র দিয়ে যায়নি। আমি এখন সেভজোন, সবাইকে আমার ভরাট বুট দিয়ে লাথি মারি ঘুমের ঘোরে থুতু ছিটিয়ে চিতায় ডাকি নিজের জীবকে, শিরা কেটে কেটে পৃথিবীর মৃত মানুষদের সাদা কাপড়ে মুড়ে গাধার বাচ্চা দিয়ে খেঁচে খেঁচে জবাই করি আর পুরুষের চামড়া ছাড়িয়ে নক্ষত্রের নুনে ডুবিয়ে রাখি পৃথিবীর শিফন নামক সামুদ্রিক মাছ কিনবো বলে,
ঈশ্বর মাঝরাতে কোনদিনই আসেননি, তার হাফ স্কার্ট লেঙ্গিস আর ফানসাইজ জাঙ্গিয়ার নষ্ট কসমিক চেরিব্লসমের ফুলগুলো গ্যাব্রিয়েল ফ্লেভারের ঘন্টার ধ্বনি শুনতো আর নখ দিয়ে আঁচড় খাটতো তেল জবজবে ওয়াচ টাওয়ারের উপর, এক্স ডট ডট অফার দ্যা লুব্রিকেন্ট নাইট, পৃথিবীর নক্ষত্র ভর্তি সূর্যের কারখানার মালিকটি আলপিন ফুটিয়ে ডিম্বানুর বাটার রোস্ট চামড়া আর জেলিফিশের হাড়গোড় দিয়ে তৈরি অ্যাস্থেটিক বস্ত্রের জীবাণুটি আমাকে কোন ভাবেই কবরের সালফার ২০০ খেতে দিল না ম্যাচিওর হস্তমৈথুন ঢাকার জন্য, তীব্র চিৎকার করি ড্রামের ভেতর,
আমি এক সাথে এত অসুস্থ ছাগ বলির মাথা দেখিনি যেখানে নষ্ট ঈশ্বরী পৃথিবীর পেট্রোলিয়াম খনিতে মুখ ডুবিয়ে নিজেকে অশ্লীল দানবীয় তৈরি করে, বায়বীয় নক্ষত্রে মিলে দিচ্ছে তার অন্তর্বাসের স্ত্রীলিঙ্গ দ্রব্যের ফটকা, মাংসভোজী পাখিটি শ্মশানকে বলাৎকার করে
সব কবিতা ও গল্প খুব ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনসুন্দর সংখ্যা হয়েছে। অভিনন্দন জানাই।
উত্তরমুছুনকয়েকটি কবিতা পড়লাম। আন্তরিকতায় পূর্ণ সম্পাদকীয়। আমার শুভেচ্ছা…
উত্তরমুছুনকয়েকটি কবিতা পড়লাম। ভালো লাগলো। সম্পাদকীয় বেশ আন্তরিক। আমার শুভেচ্ছা ও ভালবাসা ❤️—যযাতি দেবল, পানাগড় গ্রাম
উত্তরমুছুন