প্রচ্ছদ ঋণঃ- অদিতি সেনগুপ্ত
সূচীপত্র
-----------------------
প্রচ্ছদ
------------------
অদিতি সেনগুপ্ত
সম্পাদকীয় কলাম
-----------------------------
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
-----------------------------
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
সাক্ষাৎকার
------------------
শ্রীমতী অপর্ণা ভট্টাচার্য
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন - অদিতি সেনগুপ্ত
------------------
শ্রীমতী অপর্ণা ভট্টাচার্য
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন - অদিতি সেনগুপ্ত
কবিতা ভিত্তিক
------------------
কিংশুক চক্রবর্তী
পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়
কেয়া নন্দী
তুহিন ভট্টাচার্য
সুমিতা চৌধুরী
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
সঞ্জিত রায়
শর্মিষ্ঠা ঘোষ
সৃশর্মিষ্ঠা
প্রিয়দর্শী ঘোষ
শর্মিষ্ঠা মিত্র পাল চৌধুরী
অনিন্দ্য পাল
রঞ্জনা বসু
বিশ্বজিৎ সেনগুপ্ত
সুজাতা দে
------------------
কিংশুক চক্রবর্তী
পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়
কেয়া নন্দী
তুহিন ভট্টাচার্য
সুমিতা চৌধুরী
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
সঞ্জিত রায়
শর্মিষ্ঠা ঘোষ
সৃশর্মিষ্ঠা
প্রিয়দর্শী ঘোষ
শর্মিষ্ঠা মিত্র পাল চৌধুরী
অনিন্দ্য পাল
রঞ্জনা বসু
বিশ্বজিৎ সেনগুপ্ত
সুজাতা দে
শ্রাবণী গুপ্ত
সম্মিলন
------------------
রবিন বসু
আলোক মণ্ডল
গল্পাণু
------------------
অর্পিতা বোস
কবিতা সামন্ত
ছোট গল্প
------------------
প্রদীপ কুমার অধিকারী
ব্যক্তিগত গদ্য
---------------------
মঞ্জুশ্রী চক্রবর্তী
মুক্তপদ্য
------------------
দেবযানী মহাপাত্র
অরাজনৈতিক ভ্রম
------------------------------------
বিমান কুমার মৈত্র
চিরঞ্জীব হালদার
সম্মিলন
------------------
রবিন বসু
আলোক মণ্ডল
গল্পাণু
------------------
অর্পিতা বোস
কবিতা সামন্ত
ছোট গল্প
------------------
প্রদীপ কুমার অধিকারী
ব্যক্তিগত গদ্য
---------------------
মঞ্জুশ্রী চক্রবর্তী
মুক্তপদ্য
------------------
দেবযানী মহাপাত্র
অরাজনৈতিক ভ্রম
------------------------------------
বিমান কুমার মৈত্র
চিরঞ্জীব হালদার
সম্পাদকীয় কলাম
-----------------------
কবি নবারুণ ভট্টাচার্য্য বলেছিলেন,
"এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না"
সেই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ থেকে নিভে যাওয়া প্রতিটি বাতির গোড়ায় আমরা বিছিয়ে রেখেছি আমাদের অস্তিত্ব। অপরকে নিরাপদ জমি দেওয়াই প্রতিটি প্রজন্মের কাজ। দায়বদ্ধতাও বটে। কিন্তু সেই জমি আমরা কতটা প্রস্তুত করতে পেরেছি তাদের জন্য? খুন, ধর্ষণ এবং দুর্নীতির আঁতুড়ঘরে আমরা কতটা নিরাপত্তা আনতে পেরেছি সমাজের প্রতিটি কোণায়? এই অস্থির পরিস্থিতির মধ্যেও আমাদের এগিয়ে যেতে হচ্ছে সেই দায়টুকু কাঁধে নিয়ে। তাই কবিতার আলোর পক্ষ থেকে আমরা পূর্ববর্তী সংখ্যায় গর্জে উঠেছিলাম সমাজের এই পাশবিক উল্লাসের বিরুদ্ধে। দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ মানুষ যেমন রাস্তায় নেমেছেন অবাধে, আমরাও আমাদের ন্যূনতম দায়বদ্ধতাটুকু পালন করে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি পত্রিকার তরফে। আমরা জানি আমরা কিছুই করতে পারিনি। কিন্তু আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমরা পারব। সর্বোপরি আমরা পারিও। তাই ঘুণ ধরে যাওয়া একটা সিস্টেমের বিরুদ্ধে আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ খুব স্পষ্ট।
কবিতার আলো এই অবস্থানে ভীষণ পরিষ্কার। সুস্পষ্টভাবে আমরা আন্দোলনের জায়গায় একত্রিত করেছি আমাদের সঙ্গে থাকা একাধিক লেখকের ও কবির শক্তিশালী কলমগুলিকে। আমরা বিশ্বাস করি, মানুষই পারে মানুষকে বদলাতে। অনেকটা অন্ধকার জমলে একমাত্র আলোই পারে তার তীব্রতা ভেদ করে লক্ষ্যবস্তুকে দৃশ্যমানতা দিতে। সেই আলোটুকু বাঁচিয়ে রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর। তাই বিগত মাসের ধারাকে অব্যাহত রেখে আমরা আমাদের এই মাসের সংখ্যাতেও প্রতিবাদের কলমগুলিকে একত্রিত করলাম। একাধিক প্রতিবাদী কলম আমাদের সাহায্য না করলে এমন একটি প্রতিবাদী সংখ্যা আমরা আবার প্রকাশ করতে পারতাম না। তাই এই সংখ্যায় যেটুকু প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় তার সিংহভাগ কৃতিত্ব আমাদের লেখক ও কবিদের। এই পরিস্থিতিতে আমরা শুধুমাত্র চাই তিলোত্তমার নৃশংস খুনের বিচার। আমরা মনে করি, এই সমাজ যদি মানুষের ন্যূনতম নিরাপত্তাটুকুই প্রদান করতে অক্ষম হয়, তবে আমাদের কলমও সেই দায়ে অভিযুক্ত। এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা? রাত আসে, তবু তার পরে ফিরে আসে দিন। ভোরের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে পৃথিবীর প্রতিটি কোণ। তাই সমস্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও আমরা আশাবাদী। আমরা বিশ্বাস করি ভোর আসবেই। মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধে পিছু হটতে বাধ্য হবে সমাজের মূলস্রোতের সমস্ত বিপরীতমুখী শক্তি।
আজ আবার ২১ তারিখ। আপনাদের সামনে আরো একটি নতুন সংখ্যা প্রকাশ করবার দিন। সমাজের ন্যূনতম চাহিদা এবং বর্তমান পরিস্থিতির উপর নজর রেখে তাই কবিতার আলোর এই সংখ্যাও একটি প্রতিবাদী সংখ্যা। যাঁরা লিখলেন তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আর যাঁরা প্রতিনিয়ত ভালোবেসে আমাদের পাশে থাকেন তাঁদের কাছে আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। প্রত্যেকে লেখাগুলিকে এমনভাবে ছড়িয়ে দিন, যাতে এই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর গিয়ে পৌঁছোয় সেইসব মানুষের কানে, যারা প্রতিনিয়ত শুধুমাত্র নিজেদের স্বার্থে আঘাতে আঘাতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে সমাজের ভিতটুকু। আসুন, সকলে হাতে হাত রাখি। দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হোক সম্মিলিত প্রতিবাদ।
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
সম্পাদক
কবিতার আলো
সাক্ষাৎকার
------------------
এমাসের সাক্ষাৎকারের পাতায় যার সঙ্গে কথা বলব তিনি শিল্পাঞ্চলের একটি পরিচিত নাম। তিনি একাধারে গল্পকার, সমাজ সেবিকা এবং একজন কন্ঠনাটক শিল্পী। তিনি একজন প্রাক্তন শিক্ষিকাও বটে। তাঁর নাম শ্রীমতি অপর্ণা ভট্টাচার্য। আমি অদিতি সেনগুপ্ত, আজকে দিদির কাছ যেনে নেব দিদির কার্যকলাপ এবং সেইসঙ্গে প্রাসঙ্গিক কিছু আলাপচারিতা।
অদিতি সেনগুপ্ত || অপর্ণাদির সংস্থা 'মুক্তবিহঙ্গ'র দুটি অভিমূখ আছে - একটি সমাজসেবামূলক এবং অন্যটি সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ। আমি প্রথমেই তোমার থেকে জানতে চাইব তোমার এই মানস সন্তান মুক্তবিহঙ্গ সম্পর্কে। কী করে এরকম একটা কর্মকাণ্ডের সূচনা করার কথা ভাবলে এবং এই সংস্থার সূচনা কবে থেকে হল এসবই শুনব প্রথমে।
অপর্ণা ভট্টাচার্য || আমার যখন চারবছর বয়স। তখন রাস্তায় একজন মহিলা তার শিশু কন্যাকে নিয়ে ভিক্ষে করছিলেন। আকস্মিকভাবে ওই শিশুকন্যার মা একটি চলন্ত ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে যান। সেসময় ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন আমার দাদা। তিনি ঘটনাটা দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন। পুলিশ আসে এবং তারা ওই মহিলার মৃতদেহ উদ্ধার করে নিয়ে চলে যান। সদ্য মা হারা শিশু কন্যাটি পথের ধারেই পড়ে থাকে। দাদা বাড়িতে এসে গোটা ঘটনাটি আমার মাকে বলেন। শোনামাত্রই মা নির্দেশ দেন শিশুটিকে বাড়িতে নিয়ে আসতে। আসলে তখন আইনি জটিলতা অনেক কম ছিল তাই চটজলদি সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয় নি। যাইহোক সেই শিশুকন্যাটি আমাদের বাড়িতে এলো এবং আমরা তিন বোন থেকে চার বোন হয়ে গেলাম। পরবর্তীতে অবশ্য আইনি ভাবেই তাকে আপন করে নিয়েছিলেন আমার মা-বাবা। এবং যেভাবে যত্নসহকারে তাকে লালনপালন করতেন তারা সেটা ওই শিশুবয়সে আমার মধ্যে একটা বিরাট প্রভাব ফেলেছিল। আর সেখান থেকেই আমার মধ্যে মানুষের জন্য কিছু করার চাহিদার জন্ম দিয়েছিল।
অদিতি সেনগুপ্ত || মুক্তবিহঙ্গ কবে থেকে কাজ করছে এবং কী ধরনের কাজ করছে, একটু বলো আমাদের।
অপর্ণা ভট্টাচার্য || মুক্তবিহঙ্গ কাজ শুরু করেছিল ২০১১ সাল থেকে। আর রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল ২০১২-১৩ সালে। আমরা মূলত দুধরনের কাজ করে থাকি। এক হচ্ছে পুষ্টি এবং আরেকটি হচ্ছে শিক্ষা। আমাদের দেশের শতকরা প্রায় ৭০ শতাংশ শিশু অপুষ্টিতে ভোগে। আমার স্বামী যেহেতু পেশায় একজন চিকিৎসক তিনিই প্রথম আমাকে এ বিষয়ে দিকনির্দেশ করেছিলেন। আর এই ভাবনাটা আমরা পেয়েছিলাম একজন জার্মান লেডির কাজ থেকে। উনি এখানে এসেছিলেন একটি সমাজসেবামূলক কাজের সূত্রে। সেসময় তিনি আমাদের বলেন যে, -- তোমরা সবকিছুই দেখছ কিন্তু তোমাদের দেশে সবচাইতে শিশুমৃত্যু ঘটে অপুষ্টিজনিত কারণে। অথচ সেদিকে ফোকাস করোনা তোমরা। তখন থেকেই এ বিষয়ে কাজ করার ভাবনাটা জন্ম নিয়েছিল। পরবর্তীতে এ বিষয়ে আমার স্বামীর সঙ্গে আলোচনা করি যে এই কাজটা কীভাবে করা সম্ভব। তখন তিনি আমাকে একটা গাইডলাইন দিয়েছিলেন। আমরা যেটা করি, আর্থিকভাবে দূর্বল পরিবারের থেকে একশটি শিশুকে বেছে নিই। সেই একশটি শিশুর বয়স, উচ্চতা, ওজন এইগুলো নোট করা হয়। সেখান থেকে বেছে নেওয়া হয় অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের। হয় তো দেখা যায় ১০০ জনের মধ্যে ৩৫-৪০ টা বাচ্চা অপুষ্টিতে ভুগছে। তখন সেই বাচ্চাদের আমরা সপ্তাহে একদিন করে পুষ্টিকর খাবার দিতে শুরু করি। দুধ, ডিম, কলা, ডাল, সোয়াবিন ইত্যাদি আমরা দিয়ে থাকি এবং পরিমান এমনভাবেই দিয়ে থাকি যাতে বাচ্চাটির সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের মানুষেরাও সেগুলো একটু হলেও পায়। এছাড়া আমরা চেষ্টা করি ডিমসেদ্ধ আর কলাটা অনস্পট বাচ্চাদের খাইয়ে দিতে। এছাড়া পরিবারকে এটাও বলে রাখা হয় যে দুই বা তিন মাস পরে বাচ্চাদের ওজন নেওয়া হবে। ওজন বৃদ্ধি পেলেই এই সাপ্তাহিক খাবার দেবার প্রক্রিয়া বহাল রাখা হবে। এভাবে বছর দুই চালানোর পর দেখা যায় বাচ্চাদের ওজন একটা ঠিকঠাক জায়গাতে চলে আসে। এভাবেই চলে মুক্তবিহঙ্গের পুষ্টির লড়াই।
অদিতি সেনগুপ্ত || বাহ্ বেশ অভিনব এবং গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়কে বেছে নিয়েছে মুক্তবিহঙ্গ। আচ্ছা তোমরা তো মুক্তবিহঙ্গর পক্ষ থেকে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেছ। সেই বিষয়টা সম্পর্কে কিছু বলো।
অপর্ণা ভট্টাচার্য || খাদ্য এবং শিক্ষা, এই দুটোই মানুষের জীবনে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা এ দুটো বিষয়ের উপরেই মূলত কাজটা চালিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষার ক্ষেত্রেও আমরা অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া কিছু বাচ্চাদের বেছে নিই। সরকারি স্কুলে একটা মিড ডে মিল এবং ক্লাস এইট পর্যন্ত বইপত্র বিনামুল্যে পাওয়া যায়। ক্লাস নাইন থেকে ওইসব ছাত্রছাত্রীর বইপত্রের প্রয়োজনীয়তা শুরু হয়। সেগুলো আমরা প্রদান করে থাকি। সেই ব্যাচটায় হয় তো তিরিশটা বাচ্চাও থাকতে পারে। তবে সকলেই যে ক্লাস নাইন এমনটা নাও হতে পারে। নাইন-টেন অথবা তার চাইতে নীচু ক্লাস মিলিয়ে মিশিয়েই থাকে। এই ছাত্র-ছাত্রীদের যার যেটা প্রয়োজন আমরা চেষ্টা করি সেগুলো দেবার। প্রতিবছরই যে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার ছাত্র-ছাত্রী এই দলে থাকে তা কিন্তু নয়। এছাড়া আরও একটা প্রবণতা ভীষণভাবে লক্ষ্য করা যায় সেটা হল ক্লাস এইট, নাইন, টেনের পর স্কুল ড্রপআউট করা। এটা ছেলেদের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জিজ্ঞেস করলে বলে, পড়াশোনা করে কী হবে! কেউ তো চাকরি দেবেনা! এছাড়া এদের মধ্যে কেউ কেউ বাইরের রাজ্যেও চলে যায় কাজ নিয়ে। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে যেটা হয় তাদেরকে বয়স লুকিয়ে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং দেখা যায় আমরা হয় তো শুরু করেছিলাম ৪০ জন ছাত্র-ছাত্রীকে নিয়ে কিন্তু শেষপর্যন্ত থাকল ১২-১৩ জন। এই একটা জ্বলন্ত সমস্যা! এরমধ্যেই আমরা চেষ্টা করছি যতটা সম্ভব আর কি।
অদিতি সেনগুপ্ত || তবুও তো কিছু জনকে শেষপর্যন্ত ধরে রাখতে পারছ এটাই বা কম কী! আচ্ছা তুমি তো সংলাপ বলে একটি বাচিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। আমি শুনেছি তারা যৌনপল্লীর বাচ্চাদের নিয়ে কিছু কাজ শুরু করেছে এবং তুমি সেই কাজে তাদের একজন সক্রিয় কর্মী। এবিষয়ে কিছু বলো।
অপর্ণা ভট্টাচার্য || হ্যাঁ সংলাপ যৌনপল্লীর বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছে। এ বিষয়ে আমরা পাশে পেয়েছি দুর্বার গোষ্ঠীকে। দুর্বার সর্বভারতীয় একটা গোষ্ঠী। ওরা যৌনপল্লীর বাচ্চাদের পড়াশোনার দিকটা দেখছে আর আমরা দেখছি এইসব বাচ্চাদের সাংস্কৃতিক উন্নয়নের দিকটা। যাতে এই বাচ্চাদের একটা সার্বিকভাবে উন্নতি সাধন হয়। কলকাতার সোনাগাছি থেকে কাজটা শুরু করে আসানসোলেও বিস্তার করা হয়েছে এই কর্মকাণ্ড। এবং সংলাপের প্রাণপুরুষ শ্রদ্ধেয় শ্রী শুভাশীষ ঘোষ ঠাকুর জানতেন যে আমি ব্যক্তিগতভাবে সেবামূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত। তাই তিনি মূলত আমার উপর ভরসা করেই এই কাজটিকে আসানসোলে বিস্তার করতে শুরু করেছেন। কাজ শুরু হয়েছে প্রায় দুবছর হতে চলল। প্রাথমিকভাবে ওই এলাকার বাচ্চারা কিছুতেই জনসমক্ষে সহজ হতে পারত না। আমরা হয় তো গেছি ওদের ক্লাস করাতে ওরা পেছন ঘুরে বসে থাকত। সেই জায়গা থেকে আসতে আসতে অনেকটা উন্নত হয়েছে। এবছর নভেম্বরে আসানসোলে সংলাপ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে এই বাচ্চাদের দিয়ে একটি পারফরম্যান্স মঞ্চস্থ করানো হবে। এভাবেই কাজটা চলছে। আশা করছি আরও বিস্তার করতে পারব আমাদের এই কর্মযজ্ঞ।
অদিতি সেনগুপ্ত || সংলাপের এই শুভপ্রয়াস আরও ব্যপ্তি লাভ করুক এই কামনাই করছি। এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা বিষয়ে যেতে চাইছি। গত ৯ই আগস্টের পর থেকে আমাদের রাজ্যের ছবিটা সম্পূর্ণ বদলে গেছে। তিলোত্তমা, যাকে ধর্ষিত এবং খুন হতে হয়েছে নৃশংসভাবে তাঁরই কর্মস্থলে। সে আজ মৃত, কিন্তু জাগিয়ে দিয়েছে গোটা একটা ঘুমন্ত জাতীকে। আজ সেপ্টেম্বর মাসের ২১ তারিখ, মাঝে হাতে গোনা কটা দিন, তারপরেই বাঙালির সবচাইতে বড় উৎসব দুর্গাপুজো। কদিন আগে চলে গেলো বিশ্বকর্মা পুজো। কিন্তু এসবকে ঘিরে কারোর মধ্যে কোনও উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। মানুষ এখন ছুটির দিনে পুজোর বাজার না করে মিছিলে পা মেলাচ্ছে! এমনকি এও দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট বাচ্চারা বাবা মায়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে চিৎকার করছে We Demand Justice! নারীসুরক্ষা, স্বাস্থ্য পরিষেবা একটা বিরাট প্রশ্নের মুখে। একজন সমাজ সচেতন নাগরিক হিসেবে এ বিষয়ে তোমার দৃষ্টিকোণ কী?
অপর্ণা ভট্টাচার্য || আমি প্রথমেই যেটা বলব, এই ঘটনা বোধহয় পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম! একজন ডাক্তার, যার দ্বিতীয় ঘর হচ্ছে তার কর্মক্ষেত্র। সেটা হাসপাতাল হতে পারে তার চেম্বার হতে পারে এবং যেহেতু আমি একজন ডাক্তারের ঘরনী সেইহেতু আমি আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই এটা বলতে পারি। এছাড়া আরও একটা বিষয় এখানে জানিয়ে রাখি আমার স্বামী হচ্ছেন আরজি করের প্রাক্তনী। তা আমি ওনাকে যতটা না বাড়িতে পাই তার চাইতে অনেক বেশি উনি থাকেন ওনার চেম্বারে বা হসপিটালে। আমি সাক্ষী থেকেছি এমন অনেক সময়ের যখন হয় তো ডাক্তারবাবুর তীব্র জ্বর সেই অবস্থায় উনি ফোনে ওষুধ বলছেন ওনার পেশেন্টকে এবং আমি কিন্তু ফোনের উল্টোদিকে থাকা মানুষটিকে বলতে পারছি না যে উনি এখন ফোনে কথা বলার মত অবস্থায় নেই। ডাক্তাররা এভাবেই মানুষের সেবায় নিজেদের নিমগ্ন করে রাখেন। এই যে অভয়া চলে গেলেন। উনিও কিন্তু টানা ৩৬ ঘন্টা মানুষের সেবায় নিমজ্জিত রেখেছিলেন নিজেকে। ওই অবস্থায় থাকে ওইরকম নারকীয় ভাবে ধর্ষণ এবং হত্যা করা হল! আমি তো বলব মানুষের ইতিহাসে এই ঘটনা এর আগে ঘটেনি! আজ যারা প্রতিবাদের মুখ, যারা রোদ ঝড় জলকে উপেক্ষা করে দিনের পর দিন পথে পড়ে আছে তারা তো আমাদেরই সন্তান! আর তাদের সঙ্গে সঙ্গে এই যুদ্ধে আমরা সকলে জড়িয়ে গেছি! আজ এই লড়াই একটা মহানাগরিক যুদ্ধে পরিনত হয়েছে বা মহানাগরিক বিপ্লব বললেও অত্যুক্তি হবে না। রাজনৈতিক দলগুলো কী ভাবছে এ নিয়ে আমাদের কিছু এসে যায় না! মানুষের এই লড়াই আজ ইতিহাসে জায়গা করে নিল। আর এই যে আমাদের বেঁকে যাওয়া শিরদাঁড়াগুলো আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে তা ওই এক তিলোত্তমা আর পথের ধারে বসে থাকা আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জন্যই সম্ভব হয়েছে। আমরা তো এতোদিন পারিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে। আজকে ওরা সেটা করে দেখিয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য প্রায় প্রতিটা ক্ষেত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই যে দুর্নীতির ঘুণ ধরেছে আমরা তো পারিনি তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে! আমরা পিছনে সমালোচনা করেছি 'ঘন্টাখানেক' ঝড় তুলেছি! কিন্তু পথে নামতে পারিনি! এর পেছনে কোথাও একটা ভয় কাজ করেছে সর্বদা। আমরা বর্তমান প্রজন্মের অনেক সমালোচনা করি বা করেছি। আমরা বলেছি এরা উদ্ধত, ড্রাগস নেয়, আত্মকেন্দ্রিক আরও অনেক কিছু। কিন্তু আজ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে ওরা আমাদের শিখিয়ে দিল কিভাবে পথে নেমে প্রতিবাদ করতে হয়, কিভাবে মেধাকে কাজে লাগাতে হয় এবং সর্বোপরি প্রতিবাদ করতে গেলে কোনও রাজনৈতিক রঙের প্রয়োজন হয় না! আমরা এটা পারিনি এটা আমাদের ব্যর্থতা! রাজনৈতিক রঙ কখনও সমাজে বদল আনতে পারেনা। সমাজকে পাল্টায় নাগরিক। এবং এই মহানাগরিক প্রতিবাদটা উঠে আসছিল না বলেই আমরা ক্রমশ যেন মরার আগেই মরে যাচ্ছিলাম! শিরদাঁড়া হীন সরিসৃপে পরিনত হয়ে পড়ছিলাম। কিন্তু এই যে অবশেষে আমরা ঘুরে দাঁড়ালাম এই ঘুরে দাঁড়ানোটা আর বন্ধ হবে না। জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্ণা শর্তসাপেক্ষে উঠেছে ঠিকই কিন্তু আন্দোলন এখানে থেমে থাকবে না। গতকাল মহানগরীর ৪২ কিমি রাজপথ জুড়ে সুবিশাল মশাল র্যালি সেকথাই বলে গেলো। মানুষ অঙ্গীকার করল যে আগামী ২৭ শে সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের পরবর্তী শুনানি, ওইদিন সয়ালের অভিমুখ ঠিক করে দেবে আগামীতে আন্দোলন কতটা জোড়ালো হবে। এরপর আগামীতে কোন রঙ আসবে জানিনা জানতে চাইও না, কিন্তু যে রঙই আসুক তাকে, তাদেরকে সমঝে পথ চলতে হবে। আজকে নাগরিক যেভাবে জেগেছে তাতে অন্যায় যেইই করুকনা কেন তাকে টেনে নামানো হবে। পরিশেষে এটাই বলব যে ভারতীয় সংবিধান অনুসারে এইসব বিষয়ের নিষ্পত্তি একদিনে হয় না। তাই বিচার চলবে আর সেই সঙ্গে জনজোয়ারও চলতেই থাকবে। ন্যায় আমরা পাবোই, না পেলে ছিনিয়ে নেব। চরৈবতি চরৈবতি...
কবিতাভিত্তিক
---------------------
বিচার চাই
সুজাতা দে
খল নলচে গুঁড়িয়ে দাও বদলে দাও
তবু্ও দ্যাখো দুর্গা লড়ে।
তোমার স্বর আমার স্বর মিলিয়ে নিয়ে
বিচার দাবি ঘরে ঘরে।
ভোরের আলো যায় না ঢাকা বিন্দু দিয়েও
সূর্যালোক প্রকাশ পায়,
সত্য কি আর যায় রে চাপা
যতোই লুকাও মিথ্যা গায়ে।
আগুনশিখার মৃত্যু হলে আগুন জ্বলে...
নিজের মুখে আয়না ধরো,
ভালো করে তাকিয়ে দ্যাখো বিবেক পোড়ে
মূকাভিনয় যতোই করো!
বিল্পবের অন্য নাম তিলোত্তমা
ইতিহাসে হিসাব থাকে
নীতির পথে হাঁটতে হোঁচট মরল মেয়ে;
তবুও তাকেই মাথায় রাখে।
প্রতিবাদে সামিল স্যালুট এই মরণে
চোখ খুলেছে হাজার মেয়ে,
মানবেরা হাত ধরেছে পরস্পরে
মশাল হাতে বিচার চেয়ে।
------------------
উন্মোচন
বিশ্বজিৎ সেনগুপ্ত
ও মেয়ে তুই
ঘুমেই জেগে থাক;
লক্ষ কোটির ঘুম-ভাঙা রাত
জ্বেলেছে যে আলো-
সেই আলোতে দেবেই ধরা
আঁধার রাতের কালো।
এ বিশ্বাস সত্য হলেই
ঘুমিয়ে পড়িস তুই-
তোর ঘুমের সুখে
মায়ের চোখে
আসবে তখন ঘুম।
------------------
মহাকাল জাগে
রঞ্জনা বসু
যতবার বলেছে ওরা, মৃত্যুর কথা
অহংকারে নগ্ন করেছে যতবার
ততবারই উঠেছে জেগে
সেই মহাকাল...
অভয়া, তিলোত্তমা নাম নয় শুধু
আঁধারে জেগে ওঠা উজ্বল আলো
জাগায় নতুন পথ
মৃত্যুর পরেও
মৃত্যু ভুলে বেঁচে ওঠে, প্রতিবাদ
প্রতিরোধ গড়ে তোলে মেয়ে
হাজার মেয়ের কন্ঠে
বাঁচার ছন্দ আনে
আজও আগুনে পোড়াও যত
শরীরে এঁকে দাও ব্যথার ক্ষত
সেখানেই পরাজিত তোমার
ক্ষমতার সর্বস্ব
ওই শোনো, উঠেছে সমবেত স্বর
দিনে দিনে জমেছে ক্ষোভ
সেই ক্ষোভের লাভা স্রোত
আছড়ে পড়েছে এসে
পথে পথে, দিকে দিকে
কোথাও পাবে না পার
তিলোত্তমা চাইছে বিচার
সময় এসেছে জবাব দেবার।
------------------
রাস্তা কথা বলছে
অনিন্দ্য পাল
৩১ টা বছর কেটে যাওয়ার পর
মেয়েটা বোবা হয়ে গেল
৩১ টা বছর কথা বলার পর
মেয়েটা বোবা হয়ে গেল
তার ছেঁড়াখোড়া শরীরটা থেকে
বেরিয়ে এল নিঃশব্দে
ঘৃণা
আমাদের সবার চোখে মুখে এসে লাগল
সেই তীব্র যন্ত্রণা
আমরাও বোবা হয়ে গেলাম মেয়েটার মত
তারপর এক রহস্যময় কুয়াশার ভিতর থেকে
দেখলাম কথা বলছে
মেয়েটার সমস্ত ভাষা বুক পেতে নিয়ে
কথা বলে উঠেছে 'রাস্তা'
ভোকাল কর্ড ফুলে উঠছে বানডাকা
পাহাড়ি নদীর মত
প্রতিটা মোড় প্রতিটা ক্রসিং কথা বলে উঠছে
একই ভাষায় একই স্বরে
প্রতিটা ফুটপাত, প্রতিটা উড়ালপুল
চিৎকার করে বলছে
"উই ওয়ান্ট জাস্টিস উই ডিমান্ড জাস্টিস"
রাস্তা কথা বলছে কোটি মানুষের স্বরে
আমাদের স্বরতন্ত্রী যত ছিন্নভিন্ন হচ্ছে
রাস্তার কর্কশ সুর ছড়িয়ে যাচ্ছে তত
আমরা যত মোমবাতির আগুনে পুড়িয়ে ফেলছি
শব্দ, কষ্ট
ততই রুক্ষ হয়ে উঠছে রাজপথ
রাজপথ থেকে অনন্তে মিশে যাওয়া জমির
আলপথ
তত চিৎকার করে বলছে একটাই স্বর
বিচার চাই, বিচার হবে, দিব্যি কর!
------------------
কল্লোলিনী তিলোত্তমা
শর্মিষ্ঠা মিত্র পাল চৌধুরী
শহরের রাজপথ দখল করেছে আজ -
প্রতিবাদী রিক্সা চালক;
ফুটপাতে লেগে থাকা চায়ের দোকানে তাই,
অমর তিলোত্তমা ফলক।
সারারাত জেগে জেগে,রাজপথ জুড়ে চলে-
শতশত আগুন লেখা.....
মোমবাতি নিয়ে হাতে, ছাত্র মিছিল করে-
বদলাবে ভাগ্য রেখা !
কফি হাউসেও আঁধার;কাটাতে অন্ধকার -
ধিক্কার ছুঁয়েছে আকাশ ;
কখনো তমসা এলে,মানুষে-মানুষ মেলে-
বেঁধে বেঁধে থাকার আশ্বাস।
সমাজ সংশোধন ,মানুষ করেছে পণ !
দিকে দিকে সুনামির ঢেউ -
পলি মাটি তপ্ত আজ, তিলোত্তমার বিচার-
না পেলে ছাড়বে না কেউ ।।
------------------
রক্ত উৎসব
প্রিয়দর্শী ঘোষ
"উৎসবে সব,ফিরে আসুন,
ওসব' কাণ্ড, অনেক হয়",
সত্যিটাকে, ঢেকে রাখুন,
হোক না সেটা, ভুল নির্ণয়।
মাত্র হাজার, পঁচাশি তে,
বেচে দিন সব,মান সম্মান,
প্রমাণগুলো, মুছে দিতে,
আসুন সবাই, দিই যোগদান।
কি হবে আর , হিসাব নিয়ে,
আইন যখন,নিরুপায়
দুর্গা কিনি , বাজার গিয়ে,
যতই থাক তাঁর, রক্ত গায়।
মূর্তি পুজোই,আসল কথা
জীবিত প্রাণ, আজ ভোগ্য,
পশুর চামড়া , পশুই থাকবে,
বৃথা হবে,সব যজ্ঞ।
------------------
রাতের অস্থিরতা
সৃশর্মিষ্ঠা
তোমার স্থবিরতা আমাকে অবাক করে। ওদিকে সাপ নড়ে উঠলে ধুলোরা চলন পায়। ডানা পায় অচঞ্চল বাতাস। চাঁদের কিনারে গান ধরেছে কেউ। সুরে অরন্ধনের স্বাদ। চটে যাওয়া সাবেকি দালান। একপাশে অসুস্থ মই, টিকটিকির উত্থান ঘেঁষে ভেঙে পড়ার দ্বন্দ্ব। তুমি গান গাও মৃত সংসারী। আমি সাবধানে পার হই এই কামিনীকাঞ্চন...!
------------------
সাবধান হই
শর্মিষ্ঠা ঘোষ
প্রকৃত অর্থে রাজকপালে কবিদের মত প্রতিভাধর নই।
রাজার খিলাত পাবার আশায় শব্দ সাজাই নি মরকতে।
আমার শব্দগুলো পারগেশন অফ ইমোশন,ক্যাথারসিস।
তাই প্রতিটা শব্দ লেখার আগে ভয় করে,
পুঞ্জিভূত ক্রোধ অক্ষম ছটফট বের করে দিচ্ছি না তো!
এই ছটফটানিটাই তো আমায় জাগিয়ে রাখবে।
সেই ক্ষোভই তো আমায় স্পর্ধা যোগাবে এই ক্রান্তিকালে।
বিচার চাওয়া মানুষের ভিড়ে ছুটে যেতে, মিশে যেতে বলবে।
আমার ভেতর যত কান্না জমবে তত মুষ্টিবদ্ধ হবে হাত
অক্লেশে রক্ত চক্ষুর সামনে দাঁড়িয়ে পড়বো নির্ভীক
তত কন্ঠ চিরে চিৎকার করবো, শপথ নেব
ঘুঘুর বাসা ভেঙে দেবার গুঁড়িয়ে দেবার।
প্রতিটা শব্দ লেখার আগে তাই সাবধান হই, ফুরিয়ে যাচ্ছি কিনা!
দেখে নিই, ফুরিয়ে যাচ্ছে কিনা আমার ফিউয়েল!
------------------
মিছিলে যাই চলো
সঞ্জিত রায়
চলো মিছিলে যাই
অধিকার চাই
বিচার চাই
আওয়াজ উঠেছে জোরে
শত শত জন
হাজির এখন
তাদের কথন
আমরা যাইনি মরে।
পাচ্ছো কি ভয়
মনে অতিশয়
দুস্কৃতি রয়
রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে?
যদি তাই সই
মোরা একা নই
দলে দলে রই
পায়ে দ'লে দেব মাড়িয়ে।
একজোট হলে
যাই দলে দলে
সবে মিলে চলে
সেটাই মিছিল হবে
চলো তবে যাই
প্রতিবাদ তাই
ঘরে ঘরে চাই
সকলে মিছিলে রবে।
------------------
প্রলয়ের ছাই,তিলোত্তমা
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
ঝিমলাগা অন্ধকারে চলে যায় শেষ ট্রেন
ছায়ারাত নীলহাতে টানে ক্লান্তির ধূসর চাদর
তবু চোখে ঘুম নেই দুটি চোখ স্বপ্নোজ্জ্বল জেগে
ব্যতিক্রম লিখেছিল কাজ,প্রত্যয়ী পথের দিশা
বর্জনীয় করে কারা? ডাকিনীতন্ত্রম্ লোভ জাদু
বাজিকর লক্ষচোখে লাগায় ছলনাকাজল
রাক্ষস তীব্রতেজ ডাইনোর দাঁত,নখ, আর্তনাদ...
অকরুণ উল্লাস রস রক্ত ড্রাগনের শ্বাস
নিথর জড়পিণ্ডকেও বড়ো ভয় ফিনিক্স জাগবে
কতটা প্রবল তাই অনিচ্ছার ছাই,ক্রন্দন উৎসব
সেই ছাই অসম্ভব প্রবল হয়ে ছড়ায় দেশে দেশান্তরে
পোড়ায় বিবেকের ঘুম আর কশেরু-কোমলতা
হে প্রলয়সম্ভব ছাই! তোমার আগুন লেখে
দাহ্যতার নতুন সংজ্ঞা তিলোত্তমা প্রতিবাদী আলো
------------------
গণবিপ্লব
সুমিতা চৌধুরী
চোখের রক্ত জ্বালিয়েছে আজ
লক্ষ-কোটি মশাল,
মৃত্যু বজ্র মুঠিতে ধরেছে
গণবিপ্লবের হাল!
যা কিছু লাভা জমেছিল তার
খুলেছে উৎসমুখ,
শিরদাঁড়াহীন মানুষ বুঝেছে
শিরদাঁড়া পাওয়ার সুখ।
মৃতবৎ সমাজ বলছে আকুতিতে
এবার আমায় বাঁচাও,
নবনির্মাণের শপথ নিয়ে তোমরা
ব্যাধিমুক্ত নতুন প্রাণ দাও।
হারানো চেতন ফিরে পাচ্ছে
মানবিকতার সকল রসদ,
সাম্যের গানে যাচ্ছে মিশে
জীবনের সেরা সম্পদ।।
------------------
তিলোত্তমার হাসি মুখ
তুহিন ভট্টাচার্যরাগ আর ক্রোধে দাঁত নখ বের করে বাঘিনী আঁচড় কাটছে ঠান্ডা ঘরের দেওয়ালে,
ক্রমাগত হুঙ্কার দিচ্ছে গলা উঁচিয়ে আম জনতাকে
তাতে একটুও ভয় না পেয়ে
তার হুকুম না মেনে যারা সারারাত্তির
মোমবাতি মশাল জ্বালিয়ে
'তিলোত্তমার বিচার চাই ' বলে জেগে আছে রাস্তায় গলিতে মাঠে ময়দানে
প্রতিবাদী তারা জানে -
চারপাশে শামুক জীবন ছেড়ে মানুষ জেগে উঠলে একদিন সুবিচার পাবেই অকালে হারিয়ে যাওয়া তিলোত্তমা ;
ক্রান্তিকাল শেষে নতুন ভোরের সূর্য উঠবেই
সে দিন রক্তচক্ষু শাসকেরা পালিয়ে যাবে
সোনার সিংহাসন ছেড়ে ;
অকালে ঝরে যাওয়া তিলোত্তমার হাসি মুখ
ভেসে উঠবে
ওই দূর গগনের আকাশপানে।
------------------
ইচ্ছাপূরণ
কেয়া নন্দী
প্রার্থনা অনুযায়ী সকলের মনস্কামনা পূরণ হলো -----
মঙ্গলময় সবার কথা শুনেছিলো,
অনেকদিনের গুমরে থাকা প্রতিবাদ সুযোগ বুঝে বেরিয়ে এলো।
আন্দোলনের রূপে কেউ কেউ নিজের জায়গাটা একটু পোক্ত করে নিলো।
রাত দখল - চেয়ারের লোভ - জবাব দাও বিচার করো
সব শব্দেই আকাশ-বাতাস আলোড়িত হয়ে উঠলো।
যারা যারা রাতের ঘটনার প্রমাণ মুছে
দিনের আলোর মতো ঝক্ঝকে্ তরতাজা এক প্রেক্ষাপট চেয়েছিল
গণ্যমান্য ব্যক্তিদের আশীর্বাদে, বদ্যানতায় সাফল্য পেলো।
কিছু পতাকা একটু বেশি উত্তোলিত হলো
কালো পোশাকের ব্যবহার বাড়লো ;
‘মিথ্যে’ সাজাবার জন্যে ব্যারিস্টারের নাম হলো
লেখনী শৈলীর বাড়বাড়ন্ত হলো;
শব্দ বন্ধ জায়গা মত ছন্দে-মন্দে গর্জিত হলো
নেট দুনিয়ার বাজার রমরমিয়ে উঠলো।
ইচ্ছেমতো সকলেই কিছু করে দেখালো।
শুধু অন্ধকার ঘরে এক অভাগা ও অভাগিনী
শুষ্ক চোখে ক্লান্ত মনে বসে রইলো।
সকালে ‘বাছা’ আমার আসবে বলেছিল
সে এলো না।
‘কান’ সুবিচারের বাণী শুনতে পেলো না।
তৃষ্ণার্ত মন রাতের আকাশে আদরের ধনটিকে আতিপাতি করে খুঁজতে থাকে
ভাবে, এই যদি বলে ওঠে ---- ‘বাবা বয়স হয়েছে তো তোমার ;
মা এবার একটু রেস্ট নাও’।।
------------------
অভিযোজন
পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়
আঁতকে উঠলাম ! এটা কে ?
আমার মেয়েটার সমস্ত শরীর এমন রোবট-এর মতো হলো কি করে ?
জন্ম দিয়েছিলাম তো একটা কোমল পশমের মতো প্রাণের !
সে আজ একটা এরকম কঠিন যান্ত্রিকে পরিণত হয়ে গেল ?
আমার শিশুকন্যা বলে উঠল-
মা গো, কেউ যখন বদলাচ্ছে না, কোনো ব্যবস্থাপনারই যখন পরিবর্তন হওয়া অনিশ্চিত,
তখন আমাকেই রূপান্তরিত হ'তে হলো
কি করব ? নিজেকেই পাল্টে ফেলি !
কি প্রশান্তি ওর চোখেমুখে-
দেখো দেখো মা, কি শান্তি কি স্বস্তি
আমার না আছে রক্ত, না আছে যোনি...
------------------
We Want Justice
কিংশুক চক্রবর্তী
খাওয়ার টেবিল থেকে ড্রেসিং টেবিলে গেলে
প্রতিবাদের গায়ে বুঝি গয়না চড়ে
ফতুয়া থেকে জেল্লার জোব্বায়
অধিরোহনের নিঃশব্দ সরণে যে মিষ্টিমুখ
জাস্টিস কে জাস্ট 'ইস্স' ক'রে গেল
না বুঝেই
আমাদের নৃত্য, কানামাছিতে
কিছু ধুলো কুড়োল জামায়
সম্পর্কটা খাবার টেবিল আর চেয়ারের
মাঝখানে নীতির পাঁচিল
আর অদৃশ্য ঘুনপোকা
আসীনের দিকে তাকিয়ে তাই
যত বিপ্লব
কানাগলির মোড়ে দাঁড় করিয়ে দেয় বারবার
ফিপ্রনীল চাই
অথচ আমরা মুছে ফেলা মেঝের ওপর দাঁড়িয়ে
মোমবাতির মিছিল করছি
আর জাস্টিসের তালে দুলছি
অনন্ত দোলায়
চিল
শ্রাবণী গুপ্তকীভাবে বলোতো শরীরে নামবে এখুনি
আমার ভেতরে জ্বলছে আগুন,
দেখেও বলছ— দেখোনি!
বেশ বেশ তবে
নেমে পড়ো, এসো, তোলপাড় করো, রোজ রোজ
শরীরের ভাঁজে অক্ষত আছে তোমারই জন্য মহাভোজ
এসো, ছিঁড়ে খাও
ফালাফালা করে ফেলে রেখো দূরে কিছুটা
চিল ও শকুন
লুটেপুটে খাক অর্ধনগ্ন দেহটা।
সম্মিলন
------------------
রবীন বসু
(১)
উই ওয়ান্ট জাস্টিস
বুকের ভিতর থেকে বিষাদের পাখিকে উড়াই
প্রতিবাদে প্রতিবাদে রাজপথে শোককে জড়াই।
তুমি নারী রক্ত মেখে শুয়ে আছো সেমিনার হলে
কত না নিষিদ্ধ কাজ অন্ধকার হাসপাতালে চলে।
দুর্নীতি আখড়া ছিল, প্রতিবাদে ভয়ের শাসানি
লাঞ্ছনা শরীরে নিয়ে তুমি আজ মৃত্যুর পাষাণী।
জল্লাদেরা ভিড় করে, দলতন্ত্র আড়ালের খেলা
সমূহ পচন নিয়ে প্রশাসন ভাসিয়েছে ভেলা।
কত দূর রক্তচক্ষু, কতদূর ভাঙন বিন্যাস
নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয় ভয়ের অভ্যাস!
আজ দিন অন্য ভাবে, আজ রাত মুখর গর্জন
শাসকের রক্তচক্ষু উৎপাটিত তাদের তর্জন।
দিকে দিকে দেশজুড়ে ধিক্কারের ধ্বনি হচ্ছে তীব্র
মানুষের ক্ষোভ আজ গগনভেদী দৃঢ়তায় ক্ষিপ্র!
‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ধ্বনি ওঠে মধ্যরাতে পথে
তোমার মৃত্যুর বিচার যে চায়, তাদের শপথে।
(২)
বুকের ভিতর থেকে বিষাদের পাখিকে উড়াই
প্রতিবাদে প্রতিবাদে রাজপথে শোককে জড়াই।
তুমি নারী রক্ত মেখে শুয়ে আছো সেমিনার হলে
কত না নিষিদ্ধ কাজ অন্ধকার হাসপাতালে চলে।
দুর্নীতি আখড়া ছিল, প্রতিবাদে ভয়ের শাসানি
লাঞ্ছনা শরীরে নিয়ে তুমি আজ মৃত্যুর পাষাণী।
জল্লাদেরা ভিড় করে, দলতন্ত্র আড়ালের খেলা
সমূহ পচন নিয়ে প্রশাসন ভাসিয়েছে ভেলা।
কত দূর রক্তচক্ষু, কতদূর ভাঙন বিন্যাস
নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয় ভয়ের অভ্যাস!
আজ দিন অন্য ভাবে, আজ রাত মুখর গর্জন
শাসকের রক্তচক্ষু উৎপাটিত তাদের তর্জন।
দিকে দিকে দেশজুড়ে ধিক্কারের ধ্বনি হচ্ছে তীব্র
মানুষের ক্ষোভ আজ গগনভেদী দৃঢ়তায় ক্ষিপ্র!
‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ধ্বনি ওঠে মধ্যরাতে পথে
তোমার মৃত্যুর বিচার যে চায়, তাদের শপথে।
(২)
তিলোত্তমা
আমাদের স্বপ্ন নেই কোনো
আমাদের চাঁদ মরে গেছে,
আমাদের শিক্ষা ভয়ে মরে
দলতন্ত্র থাবা রেখে গেছে।
তোমরা দেখেছো কেউ রাতে
ওরা দলগত ভাবে এল,
আমি ঘুমে বিভোর ছিলুম
ওরা দেহ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেল!
মার মুখ মনে পড়েছিল
‘বাড়ি যাব’ খুশি মনে বলি,
ক্ষুধার্ত পেটে খাবার যেতে
ক্লান্তিগাঢ় ঘুম নেমেছিল!
লাঞ্ছনা নিয়ে শুয়েছি মেঝে
মৃত্যু নদীতে কাটি সাঁতার
নাক চোখ মুখে রক্তবমি
সম্ভ্রম নেই আমি ডাক্তার।
তোমরা যারা বাইরে আছো
আমার সঙ্গী, দেশের মেয়ে
রব তুলেছো, বিচার চাই—
আমার কানে আসছে ধেয়ে।
এবার তোমরা অগ্নি জ্বালো
তিলোত্তমার চিতা জ্বলুক,
অপরাধীর পোড়া মুখেই
দলতন্ত্রের ছাই পড়ুক!
------------------
একটি একরৈখিক কবিতা
আলোক মণ্ডল
(১)
উৎসব
বৃষ্টি থেমে গেছে সনাতন
ছাতা রেখে এবার বেরিয়ে পড়
সামনে উৎসবের মরশুম
থাক পড়ে যত পুরনো কাসুন্দি।
আর কয়েকটা দিন পা রাখবে
কানেক্টিভিটি
তারপর ভুলে যাবে সব,
স্লেটে ভিজে ন্যাংড়া দিয়ে আঁকি বুকি
মোছ নি সনাতন, মনে নেই!
চল ছাতা রেখে বেরিয়ে পড়ি
বৃষ্টি ধরেছে দ্যাখো, ফর্সা আকাশ।
(২)
প্রতিবাদী কবিতা আবারও
একটি প্রতিবাদ রাখলাম হাথরাসে
একটি প্রতিবাদ কাঠুয়াতে
একটি প্রতিবাদ আদিবাদী আরণ্যক গ্রামটিতে।
শরীর জাত সবটা আক্রোশ
মন জাত সবটা ক্রোধ
র-ফলা যুক্ত আমার প্রিয় বাংলা ভাষায় রাখলাম
সব ঘৃণা,সবটা ক্রোধ আর তীব্রতম প্রতিবাদ।
উচ্চারণ করলাম আর জি কর হসপিটালে
যেখানে ডাক্তার মামণির রক্তস্নাত
ছায়া এখনও দু'হাত তুলে দাবী জানাচ্ছে ন্যায় বিচারের
যেখানে কূট ষড়যন্ত্রের জাল ছেয়ে ফেলেছে সবটা আকাশ
সেখানে প্রতিটি অক্ষর বানান করে করে লিখে রাখলাম - প্র তি বা দ।
আমার মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত
যত কোশ আছে সবটা,সবটা দিয়ে হেলে পড়া
শিরদাঁড়াকে সতেজ উজ্জীবিত করে
মাচানতলার ঘড়িমোড়ে দাঁড়িয়ে কম্বুকণ্ঠে
বলতে চাই,
"আই ডিমান্ড জাস্টিস!", "উই ডিমান্ড জাস্টিস!"
বিচার চাই,
শাস্তি চাই যত আছে ধর্ষক আর ষড়যন্ত্রী।
গল্পাণু
------------------
সিকিউরিটি
কবিতা সামন্ত-- হ্যালো ভগবান, তুমি আমাদের জন্য ভালো সিকিউরিটি পাঠাও। টিভিতে দেখেছি আর বাবাও বলেছে আমরা গার্লসরা
সেফ নেই। তুমি জানো? এখানে পুলিশ গুলো খুব পাজি আর বদমাইশ। জাস্টিস করতে জানেনা।
-- মাম্মাম,মাম্মাম,কি করছো তুমি?
-- আমি? ভগবানকে বলছিলাম আমাদের জন্য ভালো সিকিউরিটি পাঠাও।
-- কি?
-- সিকিউরিটি।
-- কিন্তু কেন?
-- আমরা গার্লসরা সেফ না। তাছাড়া তুমি তো যখন তখনই বল...আমি যেন একা একা বাইরে না যাই,বাইরে পচা লোকেরা
ঘোরাফেরা করে। তাছাড়া ওই ডক্টর দিদিকেও তো কত কষ্ট দিয়েছে পচা লোকেরা।
ছোট্ট নায়রাকে তার মা বলল...
-- তার জন্য তোমাকে নিজেকে স্ট্রং হতে হবে, যে নিজেকে সেভ করতে পারে না ভাগবানও তাকে হেল্প করেনা। নিজেকেই নিজের সিকিউরিটির যোগ্য হয়ে উঠতে হবে বুঝতে পেরেছো?
------------------
রোমন্থন
অর্পিতা বোস
(১)
ফেসবুক স্ক্রল করতেই হঠাৎই চোখে পড়ল তরুণী চিকিৎসক নৃশংসভাবে খুন! চোখ বন্ধ করল। দূর সম্পর্কের আত্মীয় কুসুমদিদির মৃত শরীরটা নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। দশবছরের তুণীর মায়ের কাছে দৌড়ে যায়। আগেরদিন ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে চিলেকোঠায় জেঠুর সাথে কুসুমদিদির ধস্তাধস্তির সাক্ষী থাকার কথা বলতে থাকে ফুপিয়ে। অজান্তেই গালে হাত চলে যায় তুণীরের। প্রায় বছর চল্লিশ আগের ঠাকুরমার হাতের সেই চড়টা যেন আবার অনুভব করে। সময়ের স্রোতে পলি পড়া ছবিটা আবারও ধুয়েমুছে পরিষ্কার হলো
(২)
মিছিলে হাঁটছে পঞ্চাশ বছরের তুণীর। তিলোত্তমার বিচার দ্রুত করার দাবিতে। জানে বাড়িতে বৃদ্ধ অসমর্থ মা সব আলো বন্ধ করে দুটো মোম জ্বেলেছে। একটা তিলোত্তমার জন্য আরেকটা কুসুমদিদির জন্য।
ছোট গল্প
------------------
একদিন নয় প্রতিদিন
প্রদীপ কুমার অধিকারীঅফিস থেকে বেরিয়ে টালিগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডের কাছে আসতেই আভা লক্ষ্য করল রাস্তার উল্টো দিকে ফুটপাথের একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে আছে বেনীমাধব । লোকটার এত আস্পর্ধা অফিস পর্যন্ত ধাওয়া করেছে, একটা অস্বস্তি অনুভব করলো আভা । উত্তরপাড়াতে লোকটা যে তাকে অনুসরণ করে সেটা অনেক আগে থেকেই বুঝতে পারত আভা, শুধু না দেখার ভান করত। কিন্তু এখন!
মাথায় বড় চুল রাখে বেণী বাঁধে তাই লোকে ওকে বেনীমাধব বলে । পাতি মস্তান যাকে বলে । স্থানীয় বিধায়কের ইঁট বালি সিমেন্ট গিট্টি ছড় ইত্যাদির বেনামী প্রমোটারী ব্যবসার হোলটাইমার এবং পার্টির মদতপুষ্ট । উত্তরপাড়া স্টেশন রোডের দুপাশে যতগুলো ফ্ল্যাট বাড়ি গড়ে উঠেছে সব গুলোই ওদের তৈরী । লোকটা চৌমাথার মোড়ের রামলোচনের চায়ের দোকানে দিনরাত বসে থাকে, আভা দেখেছে কতকগুলো কুকুরও বসে থাকে । কুকুরগুলোর সঙ্গে বেনীমাধবের অনেক মিল । দরকারে কুকুরগুলো যেমন দাঁত বের করে লোককে ভয় দেখায়, বেনীমাধবও জামার আড়ালে কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবার দেখায় । বাস স্ট্যান্ডের কাছে আসতেই মানিক কাকু আক্ষেপের সুরে বলল – আজ একটু দেরী হয়ে গেল মেয়ে, বসার সিট্ পাবে না । একদম ভিতরে বাসের মধ্যে খানে চলে যাও, দরজার কাছে ভিড় হবে ওখানে দাঁড়াবে না । মানিক কাকু এই বাসের কন্ডাক্টর, আসা যাওয়ার পথে পরিচয়।
অফিস থেকে ফেরার টাইমে সাধারণত প্রত্যেকটা বাসেই ভিড় হয়, তবে আভা যে বাসটায় উঠেছিল সেটায় বসার সিট্ ফাঁকা না থাকলেও, তেমন একটা ভিড়ও ছিল না, গেট থেকে খানিকটা এগিয়ে মধ্যে খানেই দাঁড়িয়ে ছিল আভা । প্রথম দুটো স্টপেজ রাসবিহারী আর কালিঘাট পেরিয়ে যাবার পর আভার মনে হলো মানিক কাকু ঠিকই বলেছেন । আভা আরও বুঝতে পারল তার ঠিক পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বেনীমাধব । দাঁড়াতেই পারে পাবলিক বাস, কিন্তু শুধু দাঁড়িয়ে নেই । একেবারে তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে । আভা একটু সরে দাঁড়ালো যাতে সরাসরি স্পর্শ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় । যেন একটা সরীসৃপ উঠে আসছে শরীর বেয়ে! প্রথমে কোমর তারপর পিঠ এবার ঘাড়, সঙ্গে একটা গরম নিঃশ্বাস, ঘামের একটা বোটকা গন্ধ নাকে আসতেই গা টা গুলিয়ে উঠলো, প্রবল অস্বস্তি হচ্ছিলো । আভার একবার মনে হল, ঘুরে দাঁড়িয়ে, নখগুলোকে সদ্ব্যবহার করা যাক, পাশেই তো দাঁড়িয়ে আছে! ওর চোখ ওর নাক ওর কান ওর গলা ফালা ফালা করে দেওয়া যাক নখের আঁচড়ে! রক্তাক্ত করে দিয়ে, বেণীটাকে ধরে টেনে ধরে হিঁচড়ে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক বাস থেকে আর তারপর লাথি পর লাথি চালিয়ে দেওয়া যাক ওর বুকে, তলপেটে, ততক্ষনে নিশ্চয়ই পাবলিক জমায়েত হয়ে যাবে আর তার পর শুরু হয়ে যাবে গণধোলাই । মাথায় এমনি একটা চিন্তা উঁকি দিতেই, উত্তরপাড়ায় বাড়িতে অসুস্থ মা-বাবার করুণ মুখদুটো মনে পড়লো। ওদের তো সে-ই একমাত্র সম্বল, সারাদিন তারা ওর ফেরার পথ চেয়ে বসে থাকেন । সঙ্গে সঙ্গে মাথাটা কাজ করা বন্ধ করে দিলো, একেবারে স্তব্ধ । মনটাকে সংযত করতে চেষ্টা করে আভা, মনে করতে চাইলো, বাড়ির কথা, না বাড়িতে তেমন কোন চাঞ্চল্য পূর্ণ ঘটনা নেই যেটা মনে করলে এখনকার মানসিক পরিস্থিতিটাকে মোকাবিলা করতে পারবে। তাহলে? অফিসের কথা, হ্যাঁ অফিস! কিন্তু কিছুতেই কিছু করা যাচ্ছে না। বেনীমাধবের একটা হাত আভার তলপেটের নাভির কাছে, অসহ্য কিছুতেই আর সহ্য হচ্ছে না। সম্বিৎ ফিরলো একটা ধাক্কায়, বেশ ঝুঁকে পড়েছিল আভা। সামনের সিটের যে হাতলটা ধরে ছিল সেটাতেই আর একটা হাত এসে ধরল । পিছন থেকে আসা হাতটা ওর ঠিক বুকের সামনে। আভা ক্রমশ ঘেমে উঠেছে । কি করবে কিছুই বুঝে উঠে পারে না আভা, প্রকাশ্য দিবালোকে এতো লোকের মাঝে একটা অসভ্য, নাহঃ নিজের অসহায় পরিস্তিতি কে কেউ কি দেখতে পাচ্ছে না । যে বিকর্নের মত প্রতিবাদ করবে । এমন সময় আভা শুনতে পেলো মানিক কাকু যেন বলে উঠলো -"একটু সরে দাঁড়ান দাদা - টিকিট, টিকিট "
সঙ্গে সঙ্গে আরো একটা কণ্ঠস্বর প্রতিবাদের সুর -
"টিকিট চাইছেন? কিন্তু ঠেলা দিচ্ছেন কেন? দেখতে পাচ্ছেন না লেডিস আছে সামনে ।"
"দেখতেই তো পাচ্ছি তাই তো বললাম -আপনি একটু সরে দাঁড়ান ।"
“মানে?”
"মানেটা আপনি ভালো ভাবেই জানেন।"
ব্যাপারটা ক্রমশঃ ঘোরালো হয়ে উঠছে । প্রথমে কথা কাটাকাটি পরে ধস্তাধস্তি এবং শেষে এক তুলকালাম কাণ্ড । আভা আর কিছুই স্থির করতে পারল না নেমে পড়ল বাস থেকে, আর নামা মাত্রই একটা হাওড়া গামী মিনি পেয়ে গেলো, উঠে পড়ল বাসে । সেদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে সারারাস্তা কী ভাবে হাওড়া স্টেশনে পৌঁছোলো সেটা আভা নিজেই জানে না । কেবলই আগামীদিনে ওই ঘটনা পুনরাবৃত্তির আশংকায় মন অস্থির হয়ে ওঠে । মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইছিল কিন্তু মন আবার ঘুরে ফিরে সেখানেই পৌঁছে যায় । উত্তরপাড়া মোটেই আগের মত আর ছোট জায়গা নেই, কিন্তু তবুও একে অপরের পরিচিত না হলেও মুখ চেনা তো বটেই । একটা সম্ভাবনা মনের কোনে উঁকি দিতেই আভার শিরদাঁড়া বেয়ে আতঙ্কের একটা চোড়াস্রোত নামতে থাকে, আচ্ছা বাসে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দেয় নি তো? যদি তাই হয় তবে, একটা অজানা আশঙ্কায় মন অস্থির হয়ে ওঠে । বিপর্যস্ত এবং বিধস্ত মন নিয়ে আভা যখন উত্তরপাড়া স্টেশনে নামল তখন সন্ধে নামছে । হাজারও পাখি ঘরে ফিরছে । স্টেশন চত্তরে আলো ঝলমল করলেও দূরে তাকালে দেখা যায় ঘন কালো অন্ধকার । এখানে বসন্ত ঋতুটাকে বেশ অনুভব করা যায় । ভোরে হালকা কুয়াশাও থাকে । পলাশ শিমুল কৃষ্ণচূড়ার লাল রং বসন্তের বার্তা বহন করে । উত্তরপাড়ার উত্তর প্রান্তে ভাগীরথী নদী, তাই সিন্ডিকেট তার থাবা সেদিকে বসাতে পারে নি, কিন্তু পূর্ব এবং পশ্চিম প্রান্তে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে পরবর্তী শহরকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে । কলকাতার শীততাপ নিয়ন্ত্রিত চেম্বারে বসে, উত্তরপাড়ার গঙ্গার শীতল হাওয়া, মনোরম পরিবেশে ফ্ল্যাট বিক্রির বিজ্ঞাপন প্রচার করে । উত্তরপাড়ার মত শহর গুলোতে পুষে রাখে বেনীমাধবদের । রাস্তার দুপাশের ফ্ল্যাট বাড়িগুলোয় আলো জ্বলছে । আভা বাড়ির দিকে পা বাড়ায় । ও জানে যন্ত্রণা কখনও একা আসে না! মানুষ আসতে দেয় না! তারা যন্ত্রণার উৎস মূলে গিয়ে সেই যন্ত্রণার কারণ খুঁজতে চেষ্টা করে, এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ার আশঙ্কাটাও মনের ভিতরে উঁকি দিতে থাকে । পাড়ায় কান পাতা যাবে না, অফিসে সহানুভূতির নামে তির্যক মন্তব্য ভেসে আসবে, আত্মীয়-স্বজনদের ফোন আসবে প্রবল আগ্রহে জানতে চাইবে নিগ্রহ ঠিক কত দূর পৌঁছেছিল । আভার বাবা একজন রিটায়ার্ড স্কুল শিক্ষক, একেবার নিপাট ভদ্রলোক, বাজারে গিয়ে অপমানিত হবেন । সংবাদ মাধ্যমগুলো টি.আর.পি. বাড়ানোর জন্য উঠে পড়ে লাগবে, এছাড়া গোদের উপর বিষফোঁড়া সোশ্যাল মিডিয়াতো আছেই । রামলোচনের চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় আভা, গুটিকয়েক লোক সান্ধভ্রমনের পর চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছেন, বেণীমাধবের সঙ্গে সঙ্গে কুকুরগুলো বেপাত্তা। আভা এবার বাড়ির রাস্তা ধরে, চায়ের দোকান কে বাঁয়ে রেখে গলি চলে গিয়েছে সোজা ওদের বস্তিতে । আজ একটা হেস্তনেস্ত করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু বরাত জোরে বেঁচে গেলো । কেন এমন করলো? একটা প্রশ্ন করবে, শুধুই কি লোভ, যেকোনো মূল্যে যা কিছু করার আগ্রাসী আকাঙ্খা। ক্ষমতার জোরে মেয়েকে মেয়েমানুষ বানিয়ে দেবে । নিজেদের মধ্যম কৌরব দুঃশাসন ভাবে।
বাড়ি পৌঁছে প্রথমেই মায়ের প্রশ্নের সন্মুখীন হতে হলো ।
-- কি রে, চোখ মুখের এমন অবস্থা কেন? শরীর খারাপ? দেখি দেখি, কপালে হাত দিয়ে মা দেখে জ্বর হলো কিনা । স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মা বলেন, – সারাদিন কিছু খাস নি নাকি? তোকে কেমন লাগছে, যা তাড়াতাড়ি মুখ হাত ধুয়ে নে। আমি খেতে দিয়ে দি।
-- আমি কিছু খাব না, কিছু ভালো লাগছে না। মা অবাক হয়ে আভার দিকে তাকিয়ে দেখেন, কোনো কিছু বোঝার আগেই আভা বাথরুমে ঢুকে যায়। আজ স্নান করতে হবে, বেশ কয়েক বালতি জল ঢেলে নেয় মাথায় ।
স্নান সেরে শারীরিক ক্লান্তি কিছুটা দূর হয়। তারপর কিছু না খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। সারাদিনের ধকলে বিদ্ধস্থ আভার অবচেতন মন কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে অনেক দূর নিয়ে যায়, দু চোখ জুড়ে নেমে আসে ক্লান্তি। কখন মা এসে তার পাশে শুয়েছে সে কিছুই জানতে পারে না । একটা চিন্তার জাল তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল বিকেলের ঘটনায়, সত্যিই তো, ওই ভাবে ওখান থেকে পালিয়ে আসা তার একদম ঠিক হয় নি । মানিক কাকা তার জন্যই তো এই রকম একটা বিচ্ছিরি একটা ঘটনায় জড়িয়ে পড়ল, আভা ঠিক করলো দেখা হলে দুঃখ প্রকাশ করবে, ক্ষমা চেয়ে নেবে মানিক কাকার কাছে ।
পরের দিন দেখা হলে মানিক কাকা বলল – আরে ওভাবে নেমে পড়লে কেন গতকাল! অবশ্য তোমাকেই বা কী বলি! এতে তোমার কোনো দোষ নেই, যে কোনো মেয়েই ওইরকম একটা পরিস্থিতিতে এরকমই করে, তুমি দুঃখ কোরোনা । কিন্তু তুমি কী জানো তারপর কত কিছু ঘটে গিয়েছে? আমাদের বাসের ইউনিয়ন থেকে যাত্রী সুরক্ষার জন্য আদালতে মামলা করবে, কিন্তু তারজন্য তোমাকেই অভিযোগ দায়ের করতে হবে। তারপর একেবারে আদালত। আজকেই পেশী হবে । আভা কিছু একটা বলতে যাছিল কিন্তু বলতে পারল না । অভিযোগ দায়ের করার পর টোটো করে আদালতে পৌঁছে দেখল সামনে প্রচুর মানুষের ভিড়, বেশির ভাগ মহিলা, সকলের মধ্যে কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনা । একজন উকিল সাহেব এগিয়ে এলেন । বললেন, "শুনুন এখনও আপনাকে এরা কেউই চেনে না তবে আজ চিনে যাবে, একটা কাজ করুন, মাস্ক টা পরে, মুখটা ওড়না দিয়ে ঢেকে নিন । এখানে অনেক সাংবাদিক আছে, আপনার ঘটনাটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে গিয়েছে, আপনি জানেন না।"
আভা অবাক হয়ে উকিল সাহেবের দিকে তাকায় । "না আমি তো..." ওকে থামিয়ে উকিল সাহেব বলতেই থাকেন, "আচ্ছা ঠিক, ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি চলুন । তবে আদালতে দাঁড়ানোর আগে কতকগুলো কথা আপনাকে জানতে হবে । যা ঘটেছে, তাতে আপনি ইতিমধ্যে লাঞ্ছিত হয়েছেন। কিন্তু কোর্টের ভিতরে সওয়াল জবাব চলাকালীন কথার আঘাতে আরও একবার সেই লাঞ্ছনার শিকার আপনাকে হতে হবে এবং সেটা সহজভাবে মেনে নিতে হবে, তবেই আপনি জিততে পারবেন । ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় আগে যার নাম ছিল আই পি সি, এবং নাগরিক সুরক্ষা অধিনিয়ম সি আর পি সি । জনস্বার্থে, আইনের ধারা এখন বদল হয়েছে । অবশ্য সে সব আপনি বুঝবেন না ।
সকল কে এড়িয়ে আভা এবং উকিল সাহেব আদালত কক্ষে প্রবেশ করে । এর মধ্যে অনেক লোকই আদালত কক্ষে প্রবেশ করেছে । শুরু হলো আদালতের কাজ । জজ সাহেবা ডায়াসে “গাভেল” ঠুকে বললেন “সাইলেন্ট, সাইলেন্ট” এক মুহূর্তে আদালত কক্ষ পিনপতনের নীরবতা ফিরে এল । উকিল সাহেব জজ সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করলেন -
মহামান্য আদালত,
আমার মক্কেল আভা মিত্র আজ আদালতের সামনে এমন এক বিষয়ের সমাধানের আশায় আবেদন করেছেন যা আজকে দিনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যপূর্ণ । আমার মক্কেল একজন কাম কাজী মহিলা। রোজ শহরতলি উত্তরপাড়া থেকে কলকাতা শহরে আসেন, রুজি রোজগারের তাগিদে । ট্রেনে বাসে রাস্তায় রোজ কোনও না কোনও ভাবে হেনস্থার শিকার হতে হয়। প্রচণ্ড সাহসী না হলে আজকাল কলকাতা শহরে একা একজন মহিলার পক্ষে যাতায়াত করে অফিসে কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে । সরকার নির্বিকার, পুলিশ নিষ্ক্রিয়, পরিসংখ্যান অনুযায়ী অপরাধী বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পায় এবং সাজা পাওয়া তো দূরের কথা বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করে, জঘন্য অপরাধ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করে না । আমার মক্কেল গত ১৫ই এপ্রিল অফিস থেকে ফেরার সময় এমনি এক জঘন্য এবং অতীব নিন্দনীয় ঘটনার শিকার হয়েছেন । ঘটনার বিবরণ এবং প্রতক্ষ্যদর্শীর বয়ান সমেত সম্পূর্ণ রিপোর্ট আদালতে দাখিল করা হয়েছে । আবেদন কারীর পক্ষ থেকে দুটো দাবি গ্রাহ্য করার জন্য আবেদন করা হয়েছে,
এক - ঘটনার বিবরণ নির্যাতিতা মহিলার কাছ থেকে লিখিত নেওয়া সত্ত্বেও আদালতে নতুন করে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ চাওয়া হয়, তার জন্য নির্যাতিতাকে ঘটনার পুনঃ বিবরণ দিতে হয় এবং নতুন করে লাঞ্ছিত ও ধৰ্ষিত হতে হয় । আমার মক্কেল এই নিয়ম থেকে রেহাই পেতে চান ।
দুই - ভারতীয় দণ্ডবিধির আই.পি.সি এবং সি.আর.পি.সি বদল হয়েছে তার বদলে প্ৰতিস্থাপিত হয়েছে, ভারতীয় ন্যায় সংহিতা ধারা । যৌন হয়রানি অপরাধে দোষী ব্যক্তি কে ধারা ৭৫ অনুযায়ী তিন থেকে সাত বছর পর্যন্ত স্বশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে অথবা জরিমানা কিংবা উভয়ই । একজন মহিলার প্রতি যৌন উৎপীড়ণ এক জঘন্য অপরাধ, এই ধরনের জঘন্য অপরাধকে অন্য পাঁচটা অপরাধের সঙ্গে না মিলিয়ে, তারিখের পর তারিখ না দিয়ে আদালতের এক বিশেষ পদক্ষেপ নিলে অর্থাৎ যদি ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের অধীনে মামলা সম্পন্ন করা যেতে পারে তাতে প্রতিটা তারিখে নিগৃহীতা মহিলার প্রতি অন্যায় আচরণ বন্ধ করা যেতে পারে । মহানুভব, হয়তো আজ আপনার আদালতে একটা রায় আইনে পরিনত হতে পারে । এধরনের অপরাধের শাস্তি, শুধু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা। এরচাইতেও নজিরবিহীন কোনো সাজা দেওয়া হোক যেমন দ্বীপান্তর অথবা ফাঁসি, যাতে এই রকম ঘৃণ্য অপরাধ করতে আর কোনওদিন কেউ সাহস না পায় ।
“দ্যাটস অল ইওর অনার” এই বলে উকিল সাহেব চেয়ারে বসে পড়লেন।
সভা কক্ষ অস্বাভাবিক রকমের চুপ চাপ । জজ নিজেই মহিলা। জজ বললেন "কিন্তু কোর্ট কে তো জানতে হবে ঘটনার বিবরণ । অভিযোগকারী আভা মিত্রকে কাঠগড়ায় নিয়ে আসুন ।
আভা এতক্ষণ কোর্ট রুমে নিচের দিকে তাকিয়ে পাথরের মতো বসে ছিল নিশ্চুপ, নির্বিকার । ধীর পায়ে কাঠের ঘেরাটোপের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো, শপথ বাক্য পাঠ করে আভা ভেজা গলায় বলতে শুরু করলো, "আমি ব্যক্তিগত ঘটনার বাইরে এসে কিছু কথা বলতে চাই । কারণ সমস্যাটা শুধু আমার একার নয় সমগ্র নারী সমাজের। জজ সাহেবা বললেন - "পারমিশন গ্র্যান্টেড।" আভা বলতে শুরু করলো, "ক্র।ইম রেকর্ড ব্যুরো ২০২২ অনুযায়ী, ৩১৫১৬ রেপ কেস রেকর্ড করেছে, যদিও সংখ্যাটা লিখিত কিন্তু অলিখিত তার কয়েক গুন বেশি হবে । পরিসংখ্যান হিসাবে গড়ে প্রতিদিন ৮৭ টা কেস দায়ের হয় । মাই লেডি মহাভারতের কুরু সভাকক্ষে হস্তিনাপুরের এক গৃহ বধুকে দিয়ে শুরু হয়েছিল । পিতামহ ভীষ্ম হতবাক হয়ে ছিলেন, ধর্মপ্রাণ স্বামী নির্বাক ছিল । দ্রোণাচার্য, বিদুর, কৃপাচার্য এরা সবাই মাথায় হাত রেখে বসে ছিলেন । প্রবল বলশালী পাঁচ পাঁচটা স্বামী থাকা সত্ত্বেও আটকাতে পারে নি, কারণ মানসিক এবং শারীরকভাবে নির্যাতিত হয়েছিল একজন নারী। আত্মসম্মান হানি হয়েছিল একজন নারীর । আসলে পুরুষেরা বিধান দেয়, পুরুষেরাই চুপ করে থাকে । আজতো রাজতন্ত্র নেই । সিংহাসনে অন্ধ রাজা নেই । আজ ভারতবর্ষ এক গণতান্ত্রিক দেশ তবু আজও এই ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ হচ্ছে 'একদিন নয় প্রতিদিন', কারণ পুরুষতন্ত্র। এই পুরুষত্বের দাসত্ব থেকে মুক্তি চাই । আততায়ী সীমান্ত লঙ্ঘন করে অনুপ্রবেশ করলে গুলি করার নির্দেশ আছে, দেখা মাত্র গুলি করার নির্দেশ থাকে অথচ দেশের মধ্যে নারীর সন্মান কে তোয়াক্কা না করে অধিকারের উলঙ্ঘন সভ্য সমাজের জঘন্য ঘৃণ্য অপরাধের জন্য শুধু কারাদন্ড? পুরুষেরা যে নিয়মে চলে সে নিয়মের অধিকার আমারদেরও থাকুক । পুরুষের স্বার্থে যে গ্রন্থ লিখেছে আমরা সে গ্রন্থ উল্টে দিতে পারি। আমরা প্রশ্ন করলে পুরুষ সমাজ মুখ দেখাতে পারবে না, শুরু হবে এক অন্য মহাভারত। এর থেকে মুক্তি চাই। এই বৈষমের থেকে মুক্তি চায় নারী সমাজ ।"
জজ সাহেবা অর্ডার শিটে কি যেন লিখলেন এবং বললেন - "আগামী মাসে দশ তারিখ পর্যন্ত শুনানি মুলতুবি রইলো, আগামী দিনে সাক্ষী বাস কন্ডাক্টর মানিক দাসকে হাজির হওয়ার আদেশ দেওয়া হলো ।
সকলে উঠে দাঁড়ালেন । কোর্ট কাছারির কাজকম্ম আভার বোধগম্যের বাইরে। পিটিশন, ফাইল, এফিডেভিট, কোগনিজেন্স, এ আই, এই সব লিগাল টার্ম তাকে সামান্যতম ছুঁতে পারলো না।
কোর্ট রুম থেকে বেরিয়ে আভা অবাক । সে দেখলো চারিদিকে শুধু কালো কালো মাথা, অজস্র মানুষ, কাতারে কাতারে লোক জড়ো হয়েছে কোর্ট রুমের সামনে, সকলের মুষ্ঠি বদ্ধ হাত - স্লোগান দিচ্ছে - "বিচার চাই, বিচার চাই, নারীর সন্মান ফেরত চাই ।" খবরের কাগজের সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান তাদের পোজ নিতে ব্যস্ত । একদল মেয়ে এগিয়ে আসছে প্রত্যেকের হাতে জ্বলন্ত মোমবাতি, পরনে স্কুল ইউনিফর্ম, একটা গান গাইছে, প্রতিবাদের গান । চিৎকার চেঁচামিচির মধ্যে ওদের গলা সকল কে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, ওরা বলছে "চিৎকার কর মেয়ে, যতদূর গলা যায় ।" আভার মনে পড়ে যায় এই গানটা বেশ কয়েক দিন ধরে মোবাইলে ইউটিউবে শুনেছে। গানের শেষ লাইনটা ওর কানে আসে "সম্ভব হলে সূর্যের আলো মাখিস না চোখে মুখে" আভা এক টানে মুখের মাস্কটা খুলে ফেলে, খুলে দেয় ওড়না। ওদের সাথে গলা মেলায় "চিৎকার কর মেয়ে, যতদূর গলা যায়"
ঘুমন্ত আভার মুখ থেকে গোঁ গোঁ করে আওয়াজ বের হচ্ছে, কি যেন একটা বলছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। মায়ের ঘুম ভেঙে যায়, কি জ্বালাতন মা আভা কে নাড়া দিয়ে, জাগিয়ে দেয়- "এই আভা কী স্বপ্ন দেখছিস! মুখে বিচ্ছিরি একটা আওয়াজ বের হচ্ছে ।"
আভা ধরমড়িয়ে বিছানায় উঠে বসে, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে, বুঝতে পারে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছিলো ও! জানলার দিকে তাকায় বাইরে তখনও অন্ধকার সকাল হয় নি, আবার পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে । স্বপ্নের দৃশ্যটা চোখের সামনে ফুটে ওঠে । মনে মনে একটা স্থির সিন্ধান্ত নেয়। পরের দিনে অফিস থেকে ফেরার সময় আভা দেখে একটা মিছিল। সকলেই পায়ে হেঁটে চলেছে সামনে একটা ব্যানার ধরে কয়েক জন মহিলা তাতে লেখা "নারীর নিরাপত্তার অধিকার চাই।" আভা মিছিলে যোগ দেয় পা মেলায় ওদের সাথে। মা কে ফোন করে জানিয়ে দেয় ও বাড়ি ফিরবে একটু দেরিতে, তবে না ফেরা হবে না। সিদ্ধান্ত নেয় দরকার হলে "একদিন নয় প্রতিদিন” এই রকম মিছিলে সামিল হবে।।
ব্যক্তিগত গদ্য
------------------
বহ্নিশিখা এসো এসো
মঞ্জুশ্রী চক্রবর্তীশিক্ষা সংস্কৃতিতে, জ্ঞান গরিমায় বাঙালি একদিন ভারতে ছিল অগ্রগণ্য। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেও বাংলা ভারতবর্ষকে নেতৃত্ব দিয়েছে। ভারতে নবজাগরণের জোয়ার এনেছে বাঙালি মনিষা। বাঙালির সেই গর্ব খর্ব হয়ে সে আজ সে কলঙ্কিত!
গত ৯ আগস্ট রাতের অন্ধকারে নারীমাংস লোলুপ কিছু নরপিশাচের মধ্যযুগীয় বর্বরতার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন আর জি কর হাসপাতালের একজন মহিলা জুনিয়র ডাক্তার। একটি তাজা ফুলের অপমৃত্যু ঘটেছে, এক মুঠো ভবিষ্যৎ স্বপ্ন হারিয়ে গেছে মৃত্যুর হিমশীতল অন্ধকারে। নৃশংসতার এই দৃষ্টান্ত যে কোনো শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকেই বিচলিত করবে। তবে এখানে দুটি প্রশ্ন মুখ্য হয়ে উঠেছে, প্রথমত একটি মেয়ের পক্ষে তার কর্মক্ষেত্রও যদি নিরাপদ না থাকে তাহলে সমাজের কোথায় সে নিরাপত্তা পাবে? আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, কী কারণে এমন নৃশংসতার শিকার হল মেয়েটি? এর উত্তর আজ আর কারো অজানা নয়। হাসপাতালের অন্দরের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির কিছু আঁচ করতে পেরেছিল সে, তারই পরিণতি তার এই মর্মান্তিক মৃত্যু।
ধীরে ধীরে অনেক বিষয় সামনে আসছে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল যে কারণে বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। রাজ্যবাসীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে, তাই চোখের জল ক্ষোভের আগুনের রূপ নিয়েছে। রাতের রাস্তায় অজস্র মোমবাতির শিখা একত্রিত হয়েছে তিলোত্তমার বহ্নিমান আত্মাকে সুবিচার পাইয়ে দিতে। রাজ্য ছাড়িয়ে দেশ, এমনকি বিদেশের বিভিন্ন শহরের বাঙালি হয়েছে প্রতিবাদমুখর। জুনিয়র ডাক্তাররা তাদের নিরাপত্তা ও হাসপাতালকে দুর্নীতি মুক্ত করতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবিতে লাগাতার কর্মবিরতি চালিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত দুপক্ষের আলোচনায় একটা জোড়াতালি দেওয়া গোছের সমাধান সূত্র বেরিয়ে এসেছে যা বিশেষ সন্তোষজনক নয়। তবে এই অবস্থান বিক্ষোভের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক রঙের আভাস পেলেই তাকে সযত্নে পরিহার করেছেন আন্দোলনকারীরা। কারণ রাজনীতি সমাজের অংশ হলেও তা সমাজ নয়। তাই বৃহত্তর সমাজ একত্রিত হয়েছে শুধুমাত্র মনের টানে। নিত্য কর্মব্যস্ত জীবনের সমস্ত দায়িত্ব পালন করেও রাতে রাস্তায় নেমেছে মানুষ। আসলে এ লড়াই একটি বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নয়, এ লড়াই পৈশাচিকতার বিরুদ্ধে মানবতার লড়াই, দুর্নীতির বিরুদ্ধে নৈতিকতার লড়াই, নৃশংসতার বিরুদ্ধে মূল্যবোধের লড়াই।
তিলোত্তমার মধ্যে ঘরের মেয়ের ছায়া দেখতে পেয়েছে রাজ্যবাসী। তাই সারাবছর কাজের একঘেয়েমি কাটিয়ে দুয়েকদিন আনন্দ, খাওয়া দাওয়া সব মিলিয়ে যে শ্রেষ্ঠ উৎসবে মেতে ওঠে বাঙালি সেই উৎসব দরজায় কড়া নাড়লেও তাকে স্বাগত জানানোর মতো মনের অবস্থা তার আর নেই। মনের উঠোন জুড়ে মনখারাপের শিউলি ঝরে পড়ছে। তবে এই উৎসবের একটি বড়ো অর্থকরী দিক আছে তাই এই উৎসব বিঘ্নিত হোক সেটা কাম্য নয়। উৎসব হোক আড়ম্বরহীন ভাবে। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস চরিতার্থ হোক আর যে সমস্ত মানুষ সারাবছর এই কয়েকটি দিনের জন্য দিন গোনেন তাঁদের স্বপ্নপূরণ হোক। তবে খেয়াল রাখতে হবে, এই উৎসবের আমেজে গা ভাসিয়ে আমরা যেন মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হই। প্রতিবাদের এই বহ্নিশিখা মনের ভিতর অনির্বাণ রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতিতে ভরে যাওয়া এই ঘুণ ধরা সমাজের আমূল পরিবর্তন করে তিলোত্তমাকে সুবিচার পাইয়ে দেওয়া আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুন্দর সুস্থ একটা সমাজ উপহার দেওয়া আমাদের কর্তব্য। তাহলেই আর কোনোদিন কোনো তিলোত্তমার মায়ের দীর্ঘশ্বাসে বাতাস ভারী হবে না।
মুক্তপদ্য
------------------
প্রকাশ
দেবযানী মহাপাত্রশুধুমাত্র প্রকাশের উপস্থিতি কিম্বা অনুপস্থিতির তারতম্য ছাড়া দিন ও রাতের মধ্যে তেমন কোনো ভেদ নেই এখন। সর্বত্র সবসময় আন্দোলন। এই আন্দোলনের মধ্যে আমাদের সকাল হয়।তারপর দিন।তারও পরে রাত্রি।কখন ঘুমনো কখন জেগে থাকার সময়....একটা আন্দোলন বা বলা যায় একটা অভ্যুত্থান আমাদের আজন্ম আঁকড়ে ধরেথাকা ধারণা গুলোকে নতুন ভাবে ভাবতে শেখাচ্ছে। যা পেরেছি, তার চেয়েও যা পারিনি সেই তালিকা অনেক বেশি বড়।আজকাল সন্তানের মুখ আরও বেশি প্রিয় হয়।সেই মেয়ে,সেই ছেলে তাদের সবার মুখ প্রিয় হয়।ওরা সবাই অতন্দ্র। প্রহরী। প্রত্যেকে প্রত্যেকের।সর্বোপরি নিজেরা নিজেদের। এমন দিনরাত,এমন সময় এমন জাগরণ মানুষকে নতুন করে নিজেকে চিনতে শেখায়।আমি তবুও দ্বিধায়। পাশে শুয়ে থাকা সন্তানের মুখ দেখি।সন্তর্পণে ওর শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনি। অভ্যুত্থান ছুঁয়ে গেছে নাকি ওর স্বপ্নের ঘরবাড়ি? তারপর পাশের ঘরে মাকে দেখি।ব্যথায় ভরা দুটো পা নিয়ে মেঝেতে পায়চারি করছে। তার মানে আন্দোলন স্পষ্টতই থিতিয়ে দিচ্ছে ব্যথা,ঘুম, ক্লান্তি, বয়স সবকিছু।শক্ত করে মায়ের হাতধরি।চোখগুলো ধারালো আর উজ্জীবিত। হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসছে কথা,
মা,
তোমাকে ছেড়ে কখনো থাকিনি আমি
আলোর বৃত্ত ছাড়িয়ে
অন্ধকারে একা একা হেঁটে যাওয়া
শান্ত, নির্মোহ হওয়া
সেসব কিছুই পারিনি
তুমি যত দুরে যেতে বলেছ
তত আমি আঁকড়ে ধরেছি।
এইভাবে অক্ষম হয়েছি
ধীরে ধীরে,প্রতিদিন।
তোমাকে ছেড়ে কখনো থাকিনি আমি
আলোর বৃত্ত ছাড়িয়ে
অন্ধকারে একা একা হেঁটে যাওয়া
শান্ত, নির্মোহ হওয়া
সেসব কিছুই পারিনি
তুমি যত দুরে যেতে বলেছ
তত আমি আঁকড়ে ধরেছি।
এইভাবে অক্ষম হয়েছি
ধীরে ধীরে,প্রতিদিন।
জানিনা মা শুনতে পেলো কিনা। দুই হাত দিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে উঠে আসছে আমার সন্তান। ওকেও বলতে হবে,
ভুলে যাসনা এইসব দিনরাতের লড়াইপথ।এই পৃথিবীর প্রতি মুহুর্ত সম্পূর্ণভাবে মানুষের না হওয়া পর্যন্ত জাগতে থাক।
অরাজনৈতিক ভ্রম
------------------------------------
ভ্রম ও তার ভারী পাল্লা
চিরঞ্জীব হালদারখাইসে। আমার মেসিন বিগড়েছে। কাঁচা মালের লোকজন গা ঢাকা দিচ্ছে। কদিন থেকে দেখছি লাইটারে আগুন ঝলসাচ্ছে না। গ্যাস দোকানীর ছেলের পেটে ব্যথা। তিনতলা থেকে নিচে নেমে গেট খুলবো তারও উপায় নেই।প্রেমেন মিত্র বলেছিলেন এ ছাদের জল ও ছাদে গড়ায়। আমি গড়াতে পারি।কিন্তু আরাজনৈতিক সামাজিক ভ্রম কার দিকে গড়িয়ে দেবো। কে তার দায়ভার নেবে। আমার না পিসি আছে না সমাজসুপার সদানন্দ। আমাদের এক আধটা তিলোত্তমা থাকে।কাম আর দুনির মধ্যে অস্পষ্ট হাইপেন থাকে। শুধু দুটো শব্দ এক হতে চাইলে যত গন্ডগোল গ্যাংটকে। ধরুন আপনার কোন অভয়া নামের মেয়ে নেই। তার ছিটে ফোঁটা মেধাও নেই। দিন আনা দিন খাওয়া সংসার এক লক্ষীমন্ত মা জননী। সে মরল না বাঁচল দেশ জানেনা। সে ফুটবল খেললে একজনও ভালবেসে জার্সি ও দেয়নি। তার বর তাকে নাড়া দিয়ে ঠুকে ঠুকে মেরেছে। কে 498 করবে। কার এত এলেম। আহা মেয়েটা কি সৎ। তার গুনগান করার একজনও নেই।
আপনার মায়ের নাম প্রীতিলতা ওয়াদেদারও হতে পারে। তিনি আপনার পাতানো মা। আপনি অক্ষম ছেলে। তেনার স্নাতক শংসাপত্র কোন দিন হাতে পাননি। তৎকালীন সেনেট সদস্যরা এই দি এই দি করতে করতে কখন যে নিমতলা মুখি। পাতানো জননী টের পাননি। কাশীতে ত্রিগুনা সেনের এক পরিচিত এক প্রৌঢ়ার বাসি লাশ দেখে সনাক্ত করেন ইনি প্রীতি।এমন অরাজনৈতিক অমার্জনীয় সামাজিক ভ্রম তিলোত্তমার মৃত্যুর সাথে কি পৃক্ত নয়। আমরা সব কিছুতে আপদকালীন।আমাদের নিজস্ব কোন চেতনা নেই তা নয়। তবে এই আকালের দেশে প্রীতিরা হকের পেনসন না পেয়ে ভিনদেশে ভিক্ষে করতে করতে বেওয়ারিস লাশ হবে এ আর নতুন কথা কি! আপনার মেধাজাত থিসিস অন্যে জমা দিয়ে নামের পাশে 'ডক্টর' বসাবে। আপনি জেনেও চোখ বন্ধ রাখবেন। মধ্যেরাতে জীবনানন্দের গা থেকে পিরান খুলতে দেখেও মুখ ঘুরিয়ে থাকবেন। গাইডের কলা গাছ নাড়িয়ে দেননি বলে রাত নটা পর্যন্ত ঠায় বসে থাকতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্জন কক্ষে। কারণ আপনি অরাজনৈতিক ভ্রম থেকে উৎপাদিত এক জারজ। আপনার দন্ড আছে মেরু নেই। আপনার বাড়ির ড্রেনে কার লাশ আটকে আছে তা সনাক্ত না করে পিছনের দরজা দিয়ে অফিসে হাজিরা দেবেন। দেবেন তো?
আমি পুনা থেকে পুষ্কর মেলায় যাবো। আমার জন্য বিশেষ টেরেন। আমি অভিভাষন দপ্তরে না গিয়ে পাসপোর্ট হাতে পাবো কারন আমার পাতানো মেসো আমার গডমাদার। কারণ আমি পাঁচ আঙুলে সাড়ে সতেরো রতির নরওয়ের দামী হীরে নেই।দোহাই এটা নিয়ে জল ঘোলাবেন যে কোথা থেকে এটা জুটলো!
সব নদী আমার কেনা। সব আম গাছের আলফানসো আমার কথায় যুবতী হয়। সব তিলোত্তমারা ননস্টপ ডিউটি করার পর যোনি খুলে ঘুমিয়ে থাকবে আমার চোখের সামনে, এটা অরাজনৈতিক হক।
সরি আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আপনিও কি একই ঘুম কাতুরে। আপনার সুন্দরী বউকে কারা মুখচেপে উঠিয়ে নিয়ে গেল।আপনি জানলেও বলবেন না। আপনি দশলাখ পানে ওয়ালা। ধুর ঘ্যান ঘ্যান করবেন নাতো খালি। মহাসেক্রেটারীকে বলে দিচ্ছি আপনার কমপেনসেসান আরে দুলাখ বাড়িয়ে দিতে। বউ গেলে তো এই অতিরিক্ত দু'লাখে অনেক বউও পাবেন। দেখবেন আমাদের ঝান্ডায় চরিত্র হীনতার দাগ না লাগে।
আপনি না চাইলেও কিছু কিছু অরাজনৈতিক ভ্রমের গাড্ডা পডবেন। এই বর্তমান আর্থসামাজিকতায় আর রাজনৈতিক প্যাঁচ পয়জার এড়াবেন কার সাধ্য। আপনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে ভ্রমের শিকার। সোম থেকে শনি কেহ না কেহ ওৎপেতে আছে।নিস্তারহীন। নিপাট সৎ আর সাদা মানুষ হলে তো মেয়ে সম্পাদকরা আরো আরো এককাঠি উপরে। ভাবুন। ভাবা চালু করুন। কার ভ্রমের পাল্লায় আপনি ধরা দেবেন।
------------------
অকালাস সিজারিয়াস
বিমান মৈত্রকাঠামোহীন শরীর যে পশুকে ছেড়ে দিয়েছিল, রাত্রি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সে প্রথমে নিজেকে ধর্ষণ করে। যথা তারাপীঠের তান্ত্রিকগণ; শোনা যায় আপনি আপন উরূর মাংসের দ্বারা নিজের খিদে নিবারণ করতেন। তবুও নিবারণ কিছুতেই সন্তুষ্ট হয় না। তখন আপনি প্রাকৃতিক রাত্রির ও আপনার সংগৃহীত রাত্রির রাসায়নিক মিলনে একটি জারজ রাত্রির সৃষ্টি করলেন। বিধাতার দরবারে তখন ষন্ডপুরুষদের রমরমা। মহিলাদের পথেঘাটে বেরোনো বন্ধ। আত্মীয় অনাত্মীয় কাউকেই তারা রেয়াত দিচ্ছে না। আইন শৃঙ্খলা লুম্পেনদেব (থুড়ি,পড়ুন লুম্পেনদের) হাতে। নর্গরাজ্য ধর্ষরাজ্যে পরিণত হয় হয়। এরপর রাণীই নাকি নেক্সট টার্গেট। কারণ ঘরের লোকটি তো আর ধোয়া ....... নন। রাণী দেখলেন, এই-ই সুযোগ, কিছুতেই একে নষ্ট করা চলবে না। সুতরাং, ব্যক্তিগত আস্থাভাজন কিছু ষন্ডপুরুষদের সাহায্যে দায়িত্ব আপনার হাতে সমর্পণ করলেন। অকাল শ্যামা পোকার মত এরা দলে দলে জন্মাতে লাগল। একে তান্ত্রিক, তায় নরগণ। আপনার নর(ক)তান্ত্রিকগণ কচি কচি নিরীহ এই ষন্ডশাবকদের সাদরে পার্টিসাপটা বানিয়ে গ্রহন করল। এদের জন্য পাড়ায় পাড়ায় প্রাইমারী ধর্ষণালয়, সেকেন্ডারী ধর্ষণালয় নির্মাণ হল। বিডিটি ----- ব্যাচেলর অব ধর্ষণ টেকনোলজি তৈরি হল। জন্মাবার কথা অক্টোবর মাসে, কিন্ত সিজারিয়াস যুগে ভ্রুণের আগে আঠের বছরের নবজাতক ভূমিষ্ঠ হয়। সেটাই হল। ভূমিষ্ঠ হবার সাথে সাথেই তোলপার শুরু! যুদ্ধকালীন তৎপরতায় অধিকার রক্ষা কমিটি তৈরি হল। আঞ্চলিক ধর্ষক-রক্ষক কমিটি, কমিটির কমিটি, কমিটির কমিটির কমিটি... । চলছিল এভাবেই। মাঠভরা কচি কচি রোবোটিক ঘাস, মাঠের পাশে গিয়ে একবার ডাকলেই হল, একলাফে মুখে এসে পড়বে। চলছিল এভাবেই। কিন্ত বিবর্তন? আমাদের অন্তরে বাহিরে সে তার কাজ করে। তাই একদিন 'লাশ কার'? ---- এর উত্তরের খোঁজে তোলপার এই দুনিয়া।
আর তাই, চুপ, আদালত চলছে!
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনপড়লাম সেপ্টেম্বর সংখ্যা। ভালো ভালো বেশ কিছু লেখা পড়ে খুব ভালো লাগলো।
উত্তরমুছুন