সূচীপত্র
প্রচ্ছদ
------------------
অদিতি সেনগুপ্ত
------------------
সম্মিলন
------------------
কবিতাভিত্তিক
ছায়ামাখা রোদটা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বারান্দার কোণ ঘেঁষে
তাকে কী চিনি! কতটুকু
জানি!
এক নিয়ন্ত্রক —
কখনো লম্বা দড়ি, কখনো সংক্ষিপ্ত।
অর্থে অনর্থে জীবন এক বিস্ময়...
জাতি সাবধান
খন্দকার আরশাদুল বারী
সম্মিলন
এই যে আমরা ইলেকট্রিকের
তারের উপর দিয়ে হাঁটছি, এই যে আমরা
একে অপরের শরীরের উপর দিয়ে হাঁটছি, আমাদের তলা দিয়ে চলে যাচ্ছে পাতালরেল, জানালা খোলা সামনের বাস রাস্তার দিকে, বামদলের বন্ধ কার্যালয়ের সামনে
পাগল
অপেক্ষা করছে, ডলারের দামের আঁচ তার সর্বাঙ্গে, উড়ালসড়ক থেকে লাফিয়ে নামছে শতভাগ স্বস্তি, টোল প্লাজায় আগুন লেগেছে বিকেল বিকেল, নদ-নদী তোমরা
এখনো চুপ কেন
রূ প ক চ ট্টো পা ধ্যা য়
রাঢ়ভূমির ধূলা মঞ্জরী
আজ তার হাতেই চকচকে কুঠার!
মথুর গোয়ালা বসে বসে মশক পাহাড়ের বাপ বাপান্ত করে। রাত ভোর গালাগালির ওপর হিম জমে ওঠে!
আর শরীর জুড়ে খোল বাজায় কৃষ্ণকায় প্রেমিক!
স্মৃতির দুয়ারে
গল্পাণু
থলিটা
বিপ্লব নসিপুরী
অবিচ্ছিন্ন বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আলোর পথকে করছে রুদ্ধ।সারাদিন ধরে বিরামহীন বৃষ্টির মুক্তধারা ঝরে পড়ছে।কখনো ক্রুদ্ধ মেজাজে, কখনো ক্লান্তি জড়ানো পায়ে।সন্ধ্যার পরেও নিস্তার নেই।কানাই আজ যেতে পারেনি
ভিক্ষাবৃত্তির তরে।জীর্ণ গৃহে তাকিয়ে দেখেছে বৃষ্টির রেখা।বাটিতে যা অবশিষ্ট ছিল
তাতে খিদের তলানিটুকু ভরেছে।দিনের আলো ডুবতেই জমাট আঁধারের মতো খিদেটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল।ক্ষুধার্ত কানাই ছানি পড়া চোখে কষ্ট করে চেয়ে আছে। ওরা তো আসে এইসময়।
বৃষ্টিটা কী বাধা হয়ে
দাঁড়ালো ওদের গতিপথে।
ঘেউঘেউ শব্দের সাথে তীক্ষ্ণ বাঁশির শিস তৃপ্তির স্বাদ আনল। এগিয়ে যাচ্ছে শ্বাপদ,এগিয়ে যাচ্ছে সে।একপায়ে।বারিস্নাত খাবারের থলিটা বিষণ্ণ বদনে চেয়ে।
প্রার্থনা
কেয়া নন্দী
মা, আজ ফিরতে দেরী
হবে।অফিস ফেরত জগন্নাথ দর্শন করে আসবো। টিয়া ' র কথায় সম্মতিসূচক
হাসে শ্রীরূপা।
টিনের
বাক্সটা খোলে ____ স্মৃতিরা সব উপুড় করে
চোখে নামে। একটাকার টিপের পাতা,কাঁচের চুড়ি আর ফাউন্টেন পেনটা
রেখে বাকি সব বিলীন করে
দিয়েছে। প্রশ্নের মুখে পড়ার ভয়ে।
সেবার রথের মেলায় বিকাশ চুড়িতে শ্রীরূপা ' র হাতদুটো রঙিন
করে দিয়েছিল।বেশ চলছিল।বিশ্ববিদ্যালয় শেষে আর যোগাযোগ রাখেনি
বিকাশ। নিয়ম মেনে শ্রীরূপার বাড়ি বদলে যায়।
শ্রীরূপা ভাবে, টিয়ার বাবা সোনার বালা দিলেও সেদিনের কাঁচের চুড়ির কাছে তা বড়ই নিস্প্রভ।
শঙ্কিত মনে শ্রীরূপা প্রার্থনা করে, টিয়া আর সায়ান যেন
যুগ যুগ ধরে যুগ্মভাবে রথের রশি ছুঁতে পারে।
সাঁতার
মেনকা সামন্ত
কয়েকটা আম বাগান পেরিয়ে
তালসারিতে এসে পড়ল অরুণা।তালদিঘিটা সেই রকমই আছে।তেমনি পরিষ্কার জল।সেই সান বাঁধানো ঘাট। পরিবর্তন বলতে ঘাটের চাতাল টা একটু ক্ষয়ে
গেছে। সেই চাতালের উপর গিয়ে বসলো অরুণা।ছোট্টবেলার অনেক স্মৃতি হুড়মুড়িয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। সে জলে খুব
ভয় পেতো।তার মা সুধা তাকে
হাত ধরে ধরে জলে নামাতো। এমনি করে জলের ভয় তার কাটিয়েছিল, এবং তাকে এত সুন্দর সাঁতার
শিখিয়ে দিয়েছিল যে, সেই তালদিঘি এপার ওপার সাতরে পার হত।জলে সাঁতার কাটা তো অরুণা ভালোই
শিখেছিল।কিন্ত,জীবনের বাস্তব নদীতে সাঁতার কাটতে সে পারেনি মোটেই।
বাবার নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকা তার গোবেচারি মা তাকে এই
সাঁতার টা ঠিকমতো শেখাতে
পারেনি,যার ফলে অরুণার অবস্থা আজ এই জায়গায়
এসে দাঁড়িয়েছে।চাতাল থেকে জলে পাটা ডোবাল অরুণা। তারপরে একটা অস্ফুট কান্নায় ভেঙে পড়ল -----'মা'।
আনুপূর্বিক
নিষিদ্ধ নজরুল বাজেয়াপ্ত কাব্যগ্রন্থ
মোঃ শাহ জামাল
কাজী নজরুল ইসলাম যখন নিষিদ্ধ এবং তাঁর বই বাজেয়াপ্ত করা
হয়, তখনকার উক্তি ছিল বাঙ্গালির মুক্তি সাধকের হাতে নয়। বিদ্ব্যানের হাতেও নয়। বাঙ্গালির মুক্তি কবির হাতে। এ কথার প্রতিফলন
ঘটে বাঙালির স্বদেশমুক্তির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সেই সময়ের স্বাধীনতার আন্দোলনের আহবান ছিল কবির কাছ থেকেই। সেই কবি হলেন বিদ্রোহী কবি, সাম্যের কবি, গণজাগরণের কবি, রেনেসাঁসের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। এই আন্দোলনের সূত্রপাতের
জের ধরেই ব্রিটিশ সরকার নজরুলকে নির্যাতন-গ্রেপ্তার করে। স্বদেশ মুক্তির আন্দোলন সকল ধর্ম-বর্ণের মাঝেই রূপ নেয়। অবশ্য কিছু কিছু মুসলিমদের মাঝে নজরুল বিষ বৃক্ষেও পরিণত হন। তাকে কাফের ফতোয়া দেয়া হয়। আবার হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছেও নজরুল বৈষম্যের শিকার হন। নির্যাতনের শিকার হন। যার প্রমান মেলে নজরুলকে চশমা পরিহিত মানুষ ধরে নিয়ে যখন ড্রেনে ফেলে দেয়। পরবর্তীতে নজরুল চশমা পরিহিত মানুষকে ভয় পেতেন। শোষণ-বঞ্চনাই নজরুলকে বজ্রশক্তিতে পরিণত করেছে। স্বাধীন চিত্তের জাগরণে নজরুল ছিল চির সমুন্নত।
কাজী নজরুল কোন ব্যক্তি-গোষ্ঠী, সমাজ-রাষ্ট্র কিংবা দেশের নয়। নজরুলকে বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি, মানবতার কবি, ইত্যাদি খেতাবে ভূষিত করা হয়। আমি বলব নজরুল ছিলেন সংকট মুক্তির কবি। জাগরণের কবি হিসেবে কোথাও নজরুলের নৈতিক স্খলনের উপমা নেই। তিনি এক উজ্জল দৃষ্টান্ত।
কাজী নজরুল ইসলামই একমাত্র কবি যিনি সমান দক্ষতার সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান উভয় ঐতিহ্যকে আপন করতে সমর্থ হয়েছেন। নজরুল বুঝেছিলেন দুই সম্প্রদায় ঐক্যবদ্ধ হলে উপনিবেশ ব্রিটিশ শাসকের পতন অনিবার্য। শাসকগোষ্ঠী যে দুই সম্প্রদায়ের
মধ্যে বিভেদ তৈরি করে ফায়দা নিচ্ছে, এটা নজরুল স্পষ্টভাবে তুলেও ধরেছেন। নজরুল পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার স্বপক্ষে শৃঙ্খল মুক্তির গৌরবপূর্ণ বাস্তব প্রতিভার প্রতিফলন দেখিয়েছেন তার কবিতা, গানসহ সাহিত্যে এবং সাংবাদিকতায়। দু’একজন ছাড়া
সকল লেখকই ইংরেজ শাসকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। নজরুল ছিলেন তার উল্টো। মহাত্মাগান্ধী থেকে শুরু করে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ
নেতারা যখন ভারতবর্ষের স্বরাজ দাবী করছেন, নজরুল তখন স্বরাজ নয়, সরাসরি স্বাধীনতা দাবী করেন।
নজরুল ১৮ বছর বয়সে
সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধচর্চার পাশাপাশি ঘটনা প্রবাহ এবং সাহিত্যচর্চা নজরুলকে ভিন্নতর মানবে পরিণত করে। তাঁর লেখায় ওঠে আসে পরাধীনতার গ্লানি। তারুণ্যের নজরুল ২১ বছর বয়সেই
কবিতা লিখে ঝড় তুলেন।
তিনি রাজনৈতিক কর্মকান্ডেও সম্পৃক্ত হন। ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলনে মাহাত্মাগান্ধী, নেতাজী সুভাষবসুসহ সকল নেতৃবৃন্দের সাথে প্রতি ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের অর্থায়নে নজরুল-মুজফফর আহমদের যৌথ সম্পাদনায় সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ পাঠক প্রিয়তা অর্জন করে। ব্রিটিশের অন্যায়-অনাচারকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার অপরাধে গ্রেপ্তার হন।
১৯২২ সালে তার প্রকাশিত যুগবাণী গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করে। এর আগে নজরুল
সম্পাদিত অর্ধসাপ্তাহিক ধুমকেতু বাজেয়াপ্ত করা হয়। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লেখনী আনন্দময়ীর আগমনে কবিতা ছাপার দায়ে কারাবরণও করেন। নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্য গ্রন্থটি ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করে দেয়া হয়।
বিদ্রোহী নজরুলের অন্যান্য নিষিদ্ধ গ্রন্থের মধ্যে বিষের বাঁশী (১৯২৪), ভাঙারগান (১৯২৪), প্রলয়শিখা (১৯৩০) এবং চন্দ্রবিন্দু (১৯৩০), ‘দুর্দিনের যাত্রী’ (১৯২৬), ‘রুদ্রমঙ্গল’ (১৯২৬)। এতেই শেষনয়,
ব্রিটিশ সরকার জনরোষের ভয়ে তৎকালে নজরুলের প্রকাশিত সকল গ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করতে না পেরে ক্রয়-বিক্রয়ের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল নগ্নভাবে। পাবলিক প্রসিকিউটর, স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনার, চীফ সেক্রেটারির কাছেও পত্রজারি করা হয়। নজরুলের লেখনিতে ছিল ব্রিটিশের শাসনের নামে শোষণ এবং সমাজপতিদের মানষিকতা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। নজরুলের লেখা ছাপতে প্রকাশকরা তাদের নাম ছাপতে সাহস পেত না। তার গ্রন্থগুলো ছাপা এবং বিক্রি হতো গোপনে। তিনি লেখকের রয়্যালিটির কথাও ভাবতেন না।
১৯২৪ সালে নজরুলের প্রথম নিষিদ্ধ কাব্যগ্রন্থ ‘বিষের বাঁশী এবং ভাঙার গান প্রসঙ্গে প্রবাসী পত্রিকায় উল্লেখ, কবিতাগুলি যেন আগ্নেয়গিরি, প্লাবন ও ঝড়ে রুদ্ররূপ
ধরিয়া বিদ্রোহী কবির মর্মজ্বালা প্রকম্পিত করিয়াছে। জাতির এই দুর্দিনে মুমূর্ষু
নিপীড়িত দেশবাসীকে মৃত্যুঞ্জয়ী নবীন চেতনায় উদ্বুদ্ধ করিবে। এর পর পরই
গ্রন্থটি নিষিদ্ধ হয়। বিষের বাঁশী গ্রন্থটি সম্পর্কে প্রথম পুলিশের সিআইডি নজরে আনেন বেঙ্গল লাইব্রেরীর লাইব্রেরীয়ান অক্ষয় কুমার দত্তগুপ্ত। ১৯২৪ সালের ২২ অক্টোবর চিফ
সেক্রেটারি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিষের বাঁশী বইটি সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারকম উত্তেজক এবং বিদ্বেষ ও দ্রোহমূলক। তথাপি
বইগুলোর বিক্রি গোপনে গোপনে চলতে থাকে। বিপ্লবীদের হাতে হাতে এই বইটি শোভাবর্ধন
করে।
বিষের বাঁশীর সঙ্গে ভাঙ্গার গানও বাজেয়াপ্ত করা হয়। বিষের বাঁশীর অনেক কবিতা কল্লোল পত্রিকায় ছাপা হয়। বিষের বাঁশীর প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদটি অপূর্ব উল্লেখ করে অচিন্ত্যকুমার সেইগুপ্ত লিখেছেন, একটি রিক্ত গাত্র কিশোর হাঁটু মুড়ে বসে বাঁশের বাঁশি বাজাচ্ছে। তাকে জড়িয়ে আছে তীক্ষèজিহ্বা বিশাল বিষধর। কিশোরের ভঙ্গিতে-ভাবে ভয়ের বিন্দুবিসর্গও নেই। সে তন্ময়, তৎপরায়ণ
হয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে। বাঁশির সুরে জেগে উঠেছে নতুন দিনের সূর্য-যার আরেক নাম লোকচক্ষু, লোক প্রকাশক। প্রচ্ছদের চিত্রটি এঁকেছিলেন কল্লোল সম্পাদক কবি দীনেশ দাশ। নজরুল নিজেই লিখেছেন, এই বিষের বাঁশীর
বিষ জুগিয়েছে আমার নিপীড়িতা দেশমাতা আর আমার উপর
বিধাতার সকল রকম আঘাতের অত্যাচার।
নজরুলের সাথে বৈরিতা থাকার পরও শনিবারের চিঠি সম্পাদক সজনীকান্ত দাশ লিখেন-নজরুল বাস্তবতার পাশে দাঁড়িয়েছেন। স্বদেশী আন্দোলনের মুখে রবীন্দ্রনাথসহ কবিগণ যেভাবে বহুবিধ সঙ্গীত ও কবিতার সাহায্যে
বাঙালির দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধ করিয়া ছিলেন, অসহযোগ আন্দোলনের বৃহত্তর বিপ্লবে যে কারণেই হউক,
তাঁহারা ঠিক সেইভাবে সাড়া দেন নাই। একমাত্র কবি নজরুলই ছন্দে গানে এই অন্দোলনকে জয়যুক্ত
করিয়া ছিলেন। পরবর্তী আন্দোলনের চারণ কবি তাহাকেই বলা যাইতে পারে।
উপলব্ধির জন্য কবি নজরুলের লেখা নিষিদ্ধ গ্রন্থের মূল্যায়নে বলা হয়, কুলভাঙ্গা আবেগের ধাক্কায় এই অসার জাতিকে
প্রাণস্পন্দনে চকিত হইয়া উঠিতে আমরাই দেখিয়াছি। কবি নজরুলের ‘বিষের বাঁশী’ এই থরথর প্রাণস্পন্দন
যুগের গান। ইহার আঘাত সরকার সহ্য করিতে পারেন নাই বলিয়াই দীর্ঘকাল ইহার প্রচার রদ করা হইয়াছিল।
জাতীয় জাগরণের সহায়ক হিসেবে এই গ্রন্থের প্রচার
ও প্রসার একান্ত আবশ্যক।
নিষিদ্ধ ‘প্রলয়শিখা’ সম্পর্কে বলা হয়, প্রলয়ের শিখা অগ্নিশিখা হয়ে যেন দেশে দাবানল জ্বালা সৃষ্টি করল। পুলিশ, গোয়েন্দা, সরকারি আমলারা পর্যন্ত হল বেসামাল। প্রলয়শিখা
ব্রিটিশ শাসকদের ঘুম হারাম করেছিল। ১৯৩০ এর ১৬ ডিসেম্বর
চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিষ্ট্রেট এর বিচারে কবির
৬ মাসের কারাদন্ড হয়।
কবির ব্যাঙ্গাত্মক কাব্যগ্রন্থ ‘চন্দ্রবিন্দু’র উপর নিষেধাজ্ঞা
ইংরেজ আমলেই প্রত্যাহার হয়। বাংলা সাহিত্যে ‘সর্বহারা’ শব্দটির প্রথম ব্যবহার করেন নজরুল। ‘সর্বহারা’ কাব্যের ছত্রে ছত্রে নিখিল বিশ্বের নিপীড়িত নিঃস্বের বঞ্চিত বুকের সঞ্চিত অভিমান যেথা পুঞ্জিভূত হয়েছিল, ধূমায়িত ছিল, কবি তাকেই ‘ভাষা দিয়ে আশা দিয়ে ভালবাসা দিয়ে’ অপরূপ করে তুলেছিলেন। শোষক শ্রেণি মেহনতী মানুষের অধিকার হরণ এবং দাবিয়ে রাখার চিত্র তুলে ধরেছেন। সর্বহারা কাব্যটি পড়লে মনে হবে কবির হৃদয়ের মর্মস্পর্শী-গগণ বিদারির আর্তি যেন নিখিল মানবতার অশ্রুকণা দিয়ে লিখিত।
নজরুলের ‘সর্বহারা’ কাব্যগ্রন্থ বাজেয়াপ্তের জন্যও পুলিশ কমিশনার টেগার্ট এবং পাবলিক প্রসিকিউটর তারকনাথ সাধু সুপারিশ করেছিল। গোয়েন্দা বিভাগের রিপোর্টে বলা হয়েছিল অষসড়ংঃ ধষষ ঃযব ঢ়ড়বসং নৎধঃযব ধ ংঢ়রৎরঃ ড়ভ
ৎবাড়ষঃ. কিন্তু সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারের অবস্থান ছিল দুর্বল। কারণ নজরুল ততোদিনে গণজাগরণের প্রতীক পরিণত হয়েছেন। গণবিক্ষোভের মুখে তাকে মুক্তি দিতে হয়েছে।
উল্লেখ্য, নজরুলের আগে বঙ্কিম, দীনবন্ধু মিত্র, শরৎচন্দ্রের গ্রন্থও বাজেয়াপ্ত হয়েছে। শরৎচন্দ্রের ‘পথেরদাবী’ উপন্যাসের উপর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে, নজরুলের নিষিদ্ধ গ্রন্থগুলোর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার নিয়ে বঙ্গীয় আইনসভায় বাদানুবাদ হয়। ১৯৪৫ এ বিষের বাঁশী,
১৯৪৭-এ যুগবাণী, ১৯৪৮
সালে প্রলয়শিখা ও চন্দ্রবিন্দুর উপর
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়। ১৯৩৯ সালের ১০ মার্চের অধিবেশনে
বঙ্গীয় আইন সভায় কাউন্সিলর হুমায়ুন কবির নজরুলের গ্রন্থের উপর নিষিদ্ধ প্রত্যাহারের প্রস্তার উত্থাপন করেন। জবাবে বঙ্গের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন যুগবাণী, বিষের বাঁশী, ভাঙ্গার গান, প্রলয়শিখা ও চন্দ্রবিন্দুকে দেশদ্রোহাত্মক
গ্রন্থ হিসেবে চিহ্নিত করেন। কথিত শক্তিশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর দেশে গণবিদ্রোহের পরিকল্পনায় বইগুলোর আগ্রহের কথা বিবেচনা করে বাজেয়াপ্তির আদেশ প্রত্যাহার না করার সরকারি
অভিমত ব্যক্ত করেন।
আইন সভার আলোচনার পর কয়েকজন কবি
সাহিত্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবী জানিয়ে বিবৃতি দেন। নজরুল ইসলাম আধুনিক বাংলায় মুসলিম জাগরণের প্রথম হুঙ্কার। তাঁহার রচনাবলী পাঠের সুযোগ হইতে বঞ্চিত হওয়া দেশবাসীর পক্ষে নিতান্তই দুঃখদায়ক। বাংলার হক মন্ত্রীসভায় দাবিটি
পূরণ না হবার কোন
কারণ থাকতে পারে না। যে ফজলুল হক
ছিলেন ‘নবযুগ’ পত্রিকার মালিক তথা পরিচালক। ফজলুল হক এখন ক্ষমতাসীন
সরকারের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪১ সালে বঙ্গ সরকারের পুলিশী প্রতিবেদনে বলা হয়, পুনরায় পরীক্ষা করে দেখা গেছে ‘যুগবাণী’ গ্রন্থটি এখনো বিপজ্জনক। এই রিপোর্টের প্রেক্ষিতে
নবযুগের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়নি।
১৯৭২ সালের ২৪ মে বঙ্গবন্ধু
ভারত থেকে নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে এনে জাতীয় কবির মর্যাদা প্রদান করেন। রেডিও-টিভি-সংবাদপত্রে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। কবিকে ধানমন্ডি ২৮ নং বাসায়
রাখা হয়। বর্তমানে বাড়িটি নজরুল ইন্সটিটিউট নামে পরিচিত। পরের দিন ২৫ মে/৭২
নজরুলের ৭০তম জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে নজরুল জয়ন্তী পালিত হয়। বাংলাদেশে এটিই প্রথম নজরুল জয়ন্তী। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয় কবিকে সম্মানসূচক ডি-লিট ডিগ্রি
প্রদান করা হয়। তথ্যসূত্র: বিভিন্ন সাময়িকী, নজরুলের কারাজীবন, নজরুলের জীবন সৃজন।
ছাড়পত্র
শিশির
আজম
সুকান্ত জন্মেছিলেন অগ্নিগর্ভ এক সময়ে। যখন মাতৃভূমি পরাধীন। পার্টি, মার্কসবাদ, সাহিত্য - কোন কিছুই তার কাছে আলাদা ছিল না। কবিতা একটি আর্ট ফর্ম। হ্যাঁ, সত্যি। এটা আরও সত্যি হয় যদি তা মানুষকে তাড়িত করে, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে, মানুষকে ভালোবাসায় প্ররোচণা দেয়। এই পথটাই বেছে নিয়েছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। এর ছাপ-তাপ তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ছাড়পত্রে'র পাতায় পাতায় পাওয়া যায়। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ সালে। মনে রাখা দরকার, এর পূর্বে ১৯৪০-এ প্রকাশিত হয়েছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের 'পদাতিক'। আর তারও পূর্বে ১৯৩৭-এ আমরা পেলাম দিনেশ দাসের 'কাস্তে'। নিশ্চয় এসবের উত্তাপ সুকান্তের চেতনায় ছাপ ফেলেছিল।
কবিতা কখনো কখনো শ্লোগান হয়ে উঠতে পারে। হোক। এই শক্তি কবিরই আছে। নজরুলকে কি আমরা অগ্রাহ্য করতে পারবো? সুভাষ মুখোপাধ্যায় বা শামসুর রাহমানকে? পিকাসোর ‘গুয়ের্নিকা’ অথবা জয়নুলের ‘দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা’ কি ‘আর্ট’ নয়? হ্যা আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন যে ফিদা হুসেনের 'ভারত মাতা' পেইন্টিং না পোস্টার? বিনয় মজুমদারের 'ভুট্টা সিরিজে'র কবিতাকে আপনি নিছক পর্ণ হিসেবেই বিবেচনা করতে পারেন। তা করুন। কিন্তু হুমায়ূন আজাদের 'পাক সার জামিন সাদ বাদ'কে তো উপন্যাসের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারবেন না অথবা সুবিমল মিশ্রকে নিছক যৌনসাহিত্যিক বললেই বা কি এসে যায়! ওর 'হারাণ মাঝির বিধবা বৌয়ের মড়া বা সোনার গান্ধীমূর্তী'কে তো বাংলা শ্রেষ্ঠ গল্পের টেবিল থেকে সরানো যাবে না। জয়নুলের 'মনপুরা '৭০' যে শাসকের নির্লিপ্ততাকে অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেয়, এটা তো রাজনীতিই। হ্যা, সুকান্তকে পড়তে গেলে ওর সময়টাকে বুঝে ওটা দরকার। না হলে আজকের দিনে আমরা ব্যার্থ হবো ওর কবিতার স্পিরিটটা অনুভব করতে।
সুকান্তকে হয় তো ইংরেজ কবি কিটসের জীবনের সঙ্গে মেলানো যায়। কিটস পঁচিশ বছর বেঁচেছিলেন, সুকান্ত একুশ বছর। দুজনেরই ব্যক্তিজীবন সংক্ষিপ্ত কিন্তু সাহিত্য-জীবনের ব্যাপ্তীকাল মহাসামুদ্রিক। দুজনেরই মৃত্যুর কারণ যক্ষা। হয় তো রাঁবো, লোরকা বা আবুল হাসানও এক্ষেত্রে তুলনীয় (৩৭ বছর বয়সে রাঁবো কবিতা লেখা ছেড়েছিলেন। কেন?)। এরা কেউই সময়কে অস্বীকার করেননি, আবার সময়ের গড্ডালিকা স্রোতে নিজেকে ভাসিয়েও দেননি। সুকান্তের গল্প-কবিতা-গানে এর বিচ্যূরণ আমরা দেখি। আর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'ছাড়পত্র'-তেই সুকান্ত নিজেকে জানান দেন নজরুল-নেরুদা-নাজিম-মায়াকোভস্কির সহযাত্রী হিসেবে। একুশ বছরের জীবনে কাব্যগ্রন্থ ছয়টি। সৃটিকর্মের তালিকা করলে ঋত্বিক ঘটক আর তারকোভস্কির সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে। ঋত্বিকের ফিচার ফিল্ম আটটি, তারকোভস্কির সাতটি। কিন্তু এদের এই সংক্ষিপ্ত সৃষ্টিকর্মের প্রভাব কি বিপুল আর ধ্বংসাত্বক!
আসলে আর্টের কচকচি কবি দেরাজেই ঢুকিয়ে রাখেন। সময়টাকে তিনি বোঝার চেষ্টা করেন, জীবনকে আলাদাভাবে দেখতে প্রলুব্ধ হন। সেই ‘আলাদা’ অবশ্য সবসময় বৃহৎ জনমানসের সঙ্গে সংহতিপূর্ণ হবে এমনটা মনে করার কারণ নেই। জনরুচি যে সবসময় মানবিক মূল্যবোধের বিচারে যথার্থ সক্ষমতা দেখিয়েছে, এমনটা তো বলা যায় না। 'রুচি' খুবই আপেক্ষিক একটা ব্যাপার। জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর অংশের সম্মতিরছাড়া হিটলার কীবাবে ফ্যাসিবাদ কায়েম করলেন? তালিবানরা যে আফগানিস্তান দখল করতে পারলেন সে কি বৃহত্তর আফগান জনগোষ্ঠীর মতামতকে উপেক্ষা করে? না। এর জন্য দরকার হয় সম্মতি উৎপাদন। আর এই কাজটা যথেষ্ট চাতুরতা আর শৈল্পীকতার সাথে করে গণমাধ্যম। বিস্ববিদ্যালয় আর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তো করেই। জনমানসের আকাঙ্ক্ষার সাথে কবির একধরণের বোঝাপড়া চলে, চলতে থাকে অবিরাম। কেন না কবিতাও তো নিজের সত্তা আর স্বাতন্ত্রবোধকে গুরুত্ব দেয়। দেয় বৈকি, শ্রমিকের ঘাম আর রক্তের অপ্রতিরোধ্য শক্তিকে মান্যতা দিয়ে। ফলে শাসকের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বটা আর অগোচরে থাকে না। এস্টাব্লিশমেন্ট তার হাড্ডিগুড্ডি চিবিয়ে খেতে চায়। একারণে লোরকাকে খুন হতে হয়, মলয় রায়চৌধুরী পড়ে যান পুলিশের রোষাণলে, নাজিম হিকমতকে জেল খাটতে হয়। আর তিরিশের কবিদের যে আত্মমগ্নতা সেটা সুকান্ত পছন্দ করেননি। ওদের কবিতার প্রকরণে যে পশ্চিমমুখীতা সেটাও গ্রাহ্য করেননি সুকান্ত। ওকে নজরুলের অনেকটা কাছাকাছি মনে করা চলে। তবে এটা নিশ্চিত যে নজরুলের কবিতার ইসলামিজমের ডগমা আর মিথ সুকান্তকে মোটেও আকৃষ্ট করেনি। আর কবিতায় প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দের ব্যাবহার তাকে বিরক্তই করেছে সম্ভবত। উনি সময়টাকে ধরেছেন আর নিজেকে সময়ের সেই আগুনে পুড়িয়ে নিয়েছেন। 'ছাড়পত্র'কে সময়ের দলিলই বলা চলে। ৩৭ টি কবিতা নিয়ে ‘ছাড়পত্র’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়, সুকান্তর মৃত্যুর পর, ভারতের স্বাধীনতার মাত্র কয়েকমাস আগে। বলা বাহুল্য, তার সবগুলো কাব্যগ্রন্থই একে একে তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত। অন্যান্য কবিতার মতো তার প্রথম কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতেও সেই সময়ের ঝড়ঝাঁপটার আঁচ রয়েছে। সময়কে সত্যের দিকে ঘুরিয়ে দেবার আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। কবি হয়ে যান রানার। ‘একটি মোরগের কাহিনী’ কবিতাটা তেতাল্লিশের মন্বন্তরের রক্তভেজা আখ্যান। তার কবিতার 'চাঁদ' হয়ে ওঠে সময়ের 'ঝলসানো রুটি'। আমরা তো দেখেছি শওকত ওসমানের 'ক্রীতদাসের হাসি' কি ভয়ংকর!
শাসকের ইচ্ছায় দুর্ভিক্ষ আর কোটি কোটি মানুষের মৃত্যু। তবে সুকান্ত যে ‘চারাগাছ’ রোপন করেন অমোঘ নিয়মে তা হয়ে ওঠে বিদ্রোহের দূত।
‘অবাক
পৃথিবী! অবাক করলে তুমি
জন্মেই
দেখি ক্ষুদ্ধ স্বদেশভূমি।’
কম্যুনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী হবার কারণে সুকান্তর একাডেমিক পড়াশুনা লাটে ওঠে, প্রবেশিকা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হন। কিন্তু তার কবিতায় স্ফূরিত হয় রাজনীতির আগুন, কৃষক-শ্রমিকের ক্ষুধা আর তেজ। পরাধীন দেশের নাগরিক হয়েও কবি বিশ্বনাগরিক। পৃথিবীর সমস্ত শ্রমিকের রক্তই লাল, সমস্ত শ্রমিকের ঘামই নোনতা। লেনিন তারও নেতা, তার চেতনার মশাল।
'লেনিন
ভেঙেছে রুশে জনস্রোতে অন্যায়ের বাঁধ,
অন্যায়ের
মুখোমুখি লেনিন প্রথম প্রতিবাদ।’
সময়ের প্রয়োজনে কামরুল হাসানের তুলি হয়ে ওঠে বেয়োনেট, গর্জে ওঠে জহির রায়হানের ক্যামেরা, সুকান্তের কলম হয়ে ওঠে সাধারণ দেশলাই কাঠি যে হুলুস্থুল কান্ড ঘটিয়ে দিতে পারে। হ্যা, এ-কারণেই শামসুর রাহমানের 'বন্দী শিবির থেকে' বা নির্মলেন্দু গুণের 'স্ক্রা' বা মলয় রায়চৌধুরীর 'জখম' কবিতা এবং কবিতার চেয়েও বেশি কিছু। আপনি চাইলে জহির রায়হানের 'স্টপ জেনোসাইড'কে সিনেমা বলে মানতে নাও পারেন। তো? 'হাউল' বা 'জাতিসংঘ'কে হয় তো গিন্সবার্গ ট্র্যাডিশনাল আর্টফর্মের ভাবনা থেকে লেখেননি। হয় তো।
আপনি ‘ছাড়পত্র’র কবিতাগুলোকে কবিতা বলে মানতে নারাজ? কে বলেছে আপনাকে মানতে? ওরা কি কবিতা হতে চেয়েছে? ওরা হতে চায় সিগারেট, ওরা হতে চায় দেশলাই কাঠি। এজন্যই মৃণাল সেনের হাতে নির্মিত হয় 'কলকাতা '৭১' বা 'আকালের সন্ধানে'। সত্যজিৎ রায় আমাদের নিয়ে যান 'হীরক রাজার দেশে'।
সুকান্তকে মেনে নিতে হয়েছিল ভাস্কর রদাঁর নিয়তি। অগুস্ত রদাঁর ‘বালজাক’ প্যারিস গ্রহণ করতে পারেনি। কারণ প্যারিসের বালজাক আর রদাঁর বালজাক এক ছিল না। মানুষ যা দ্যাখে শিল্পী তা-ই দ্যাখেন না। হয় তো অন্যভাবে দেখেন। অথবা আমরা যখন দেখি একটা গ্লাসের অর্ধেকটা খালি তখন কবি দেখেন গ্লাসের অর্ধেকটা ভরা। হ্যা, আমরা দেখি অন্ধকার আর কবি দেখেন আলোর অনুপস্থিতি। ডাচ পেইন্টারদের প্রতিকৃতিগুলো যে অফুরন্ত ছায়ায় ডুবে থাকে এতে ঐ প্রতিকৃতিগুলোর অন্তর্নিহীত আলোময়তাই কিন্তু শিল্পানুরাগীদের আনন্দ দেয়। দ্বন্দ্বটা এখানেই। মানে মানুষের ব্যক্তিজীবন বলে যেটা আমরা মনে করি সেটা তো আধুনিক রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানেরই বানানো খাঁচা।
মানুষ রাজনীতিপ্রবণ জীব। লেখাও রাজনীতি। তাই বলে শিল্পের সঙ্গে রাজনীতির ঠোকাঠুকি মোটেই কি হয় না? ধর্মের সঙ্গে তার ছোঁয়াছুঁয়ি? কবিতা কি? মানুষ বাদে, রাজনীতি বাদে তার অস্তিত্ব কোথায়? এমন কি ফিদা হুসেনের ঘোড়া বা নিকোলাস গ্যিয়েনের চিড়িয়াখানার পশুপাখিও কি রাজনীতির বাইরে? ফলে সুকান্তকে রাজনীতির কবি বলার কোন মানে হয় না। কারণ কবি মাত্রেই রাজনীতিক। বলা হয় ক্লিনটনের সময়ে আমেরিকা তুলনামূলকভাবে কিছুটা পরিচ্ছন্ন ছিল। কেন? হ্যা, গিন্সবার্গ নামে তখন আমেরিকায় এক ঝাড়ুদার ছিল। কবি সে। শামসুর রাহমান আর হুমায়ূন আজাদকে মেরে ফেলতে হয়েছিল। কেন না এরা ছিলেন কবি আর নোংরা পাকে অন্যদের সঙ্গে নামতে এরা রাজি হননি। তো রাজনীতিটা এসেই যায়। আপনি চান বা না চান। মানুষের পক্ষে থাকলে আপনাকে কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য না হলেও চলে। আপনি তখন কম্যুনিস্টই। যেমনটা বলেছেন চার্লি চ্যাপলিন।
সাম্রাজ্যবাদ যখন বলিভিয়ার জঙ্গলে চে গুয়েভারাকে খুন করে তখন তার পকেটে ছিল এর্নেস্তা কার্দেনালের ‘কান্তে জেনারেল’। পকেটবুক সাইজের ক্ষুদ্র এই কবিতার বই ছিল চে'র সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণা, বেঁচে থাকার রসদ।
আমাদের আছে ‘ছাড়পত্র’। আমাদের হাতে
ধরিয়ে দিয়ে গেছেন সুকান্ত। এর থেকে আমাদের
মুক্তি নেই।
‘ছাড়পত্র’ই আজ আমাদের ছাড়পত্র।
বাংলার রেনেসাঁস ও লালন
বিধায়ক ভট্টাচাৰ্য
লালনকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বাংলার রেনেসাঁসের কথা আসবেই। কারণ উনবিংশ শতাব্দী বাংলায় রেনেসাঁর সময়কাল। লালন জন্মেছিলেন ১৭৭৪ সালে। লালনের জন্মের দু বছর আগে ১৭৭২ জন্মগ্রহণ করেন আর এক যুগ স্রষ্টা, রাজা রামমোহন রায়। কাকতালীয়ভাবে এই দুই মহাপুরুষের জন্ম একই সময়ে। যখন ভারতীয় সমাজ সাবেক ব্রাহ্মণ্যবাদের বাড়াবাড়িতে বিব্রত, বিপর্যস্ত। জাত, ধর্ম, অনাচার ইত্যাদি সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের জীবন করেছিল দুর্বিসহ। নারীর প্রতি অত্যাচার, বর্ণভেদ প্রথার প্রবল প্রকাশ এবং উচ্চবর্ণ নিম্ন বর্ণের মধ্যে হানাহানি বেড়েই চলেছে। হিন্দু ধর্মের পৌত্তলিকতায় এবং বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বাড়াবাড়িতে প্রকৃত ঈশ্বরের যেন রুদ্ধশ্বাস অবস্থা। ঠিক সেই সময় অবিভক্ত বাংলার দুই প্রান্তে জন্ম নিলেন দুই মনীষী। ভারত পথিক যুগাবতার রামমোহন জন্ম নিলেন হুগলির রাধানগরে । আর একজন, যাকে বলা যায় ‘নিঃসঙ্গ বিগ্রহ’, ‘প্রতীচ্যের সক্রেটিস’ লালন ফকির জন্ম নিলেন ওপার বাংলার কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায়।
রামমোহনের আধুনিকতার উৎস, পাশ্চাত্যের রেনেসাঁসের মূল কথা Man is the measure of everything, আর লালনের তত্ত্ব ‘মানুষ রতন’, যা এসেছে নাথ যোগী বাউল বৈষ্ণব সহজিয়া তত্ত্বের ভেতর থেকে। রামমোহন ছিলেন উনিশ শতকের নবজাগ্রত নগরবাসী বাঙালির নব ভাব আন্দোলনের ঋত্বিক। আর লালন বিশাল বাংলার শাস্ত্রীয় ধর্মনিরপেক্ষ মৃত্তিকা নির্ভর মানবীয় ধারায় মহান সাধক। এ দুজনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে এটা মেনে নিও বলা যায় যে, দুজনেই দিনের শেষে ‘মানুষ’কেই খুঁজে বেড়িয়েছেন। অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, ‘ দেশের শিক্ষিত নাগরিক মহলে যে সময় রেনেসাঁস বা নবজাগরণ চলছিল সেই সময়ই চলছিল অশিক্ষিত গ্রামিক লোক চিত্তে অন্য এক আলোড়ন। এর সুসংবদ্ধ ইতিহাস এখনো লেখা হয়নি। সেরকম ইতিহাস যখন লেখা হবে তখন লালন কে তার যথার্থ পরিপ্রেক্ষিতে পাওয়া যাবে।’ রামমোহন তৈরি করেছিলেন হিন্দু ধর্মকে সংস্কার করে ব্রাহ্ম ধর্ম, আর লালন সব ধর্মের উপরে উঠে তার মতবাদ প্রচার করলেন যাকে বলে মানব ধর্ম।
হিন্দু মুসলিম ধর্মের মধ্যে এই যে বিভাজন তাকে তিনি কখনোই মেনে নেন নি। তাইতো তিনি তাঁর গানের অক্ষরে অক্ষরে সাজিয়ে রেখেছেন তার প্রতিবাদ:
“ সুন্নত দিলে হয় মুসলমান মুসলমান
নারী লোকের কি হয় বিধান
বামুন চিনি পইতে প্রমাণ
বামনি চিনি কিসে রে…”
অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, ‘বাংলার নবজাগরণে রামমোহনের যে গুরুত্ব বাংলার লোক মানুষের দেয়ালী উৎসবে লালনেরও সেই গুরুত্ব দুই যমজ সন্তানের মত তাদের দুজনের জন্ম। দু'বছর আগে পরে। ইতিহাস-জননীর পক্ষে দুই বছর যেন দুই মিনিট। তবে একসঙ্গে এলেও এরা একসঙ্গে যাননি। লালনের পরমায়ু যেন রামমোহন ও বঙ্কিমচন্দ্রের জোড়া পরমায়ু। লোকসংস্কৃতিতে একক ব্যক্তিত্বের এমন বিরাট উপস্থিতি আমাদের অভিভূত করে।’ ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে বলেছেন, ‘ উদার মানবতাবাদী ভাবধারার বিকাশে লালন শাহের ও রামমোহনের ভূমিকায় এক তুলনামূলক আলোচনা করা যায়। আর তার ফলেই কলকাতা শহরের বুদ্ধিজীবীদের ও গ্রামের উপেক্ষিত জনসাধারণের চিন্তাধারার ছবিটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আমরা দেখতে পাই, পশ্চিমী হাওয়ার সংস্পর্শে না আসতে পারলেও গ্রামের সাধক ও মরমী কবিদের প্রভাবে এই উপেক্ষিত জনসাধারণের মনোজগৎ কলকাতার শিক্ষিতদের তুলনায় কম সমৃদ্ধ ছিল না।… দুর্ভাগ্যবশত রামমোহনের ভূমিকা আলোচনায় লোকসংস্কৃতির প্রবাহটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয় না’ (সূত্র : ব্রাত্য লোকায়ত লালন, সুধীর চক্রবর্তী, পৃ:১৪৮)
লালন জন্মেছিলেন ১৭৭৪ সালে এবং মৃত্যু হয় ১৮৯০ সালে। তার জীবিত কাল থেকেই বোঝা যাচ্ছে পুরো উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে লালন জীবিত ছিলেন। একজন বাউল সম্রাট, জাতি-ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে মানব কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ, লালন ফকির সারা জীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন। চন্ডীদাস লিখেছেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ লালন লিখেছেন, ‘ মিয়া ভাই কি কথা শুনাইলেন ভারী / হবে নাকি কেয়ামতে আযাব ভারী/ নর-নারী ভেস্ত মাঝার/ পাবে কি সমান অধিকার/ নরে পাবে হুরের বহর/ বদলা কি তার পাবে নারী? এখানে দুজনেই মানুষের কথা বলেছেন মানুষের সমানাধিকারের কথা বলেছেন । এখানে চন্ডীদাসের সঙ্গে লালনের প্রকাশগত একটি ফারাক আছে। সেটি হল লালন তার গানের শেষে একটি প্রশ্ন রেখে যান আগামী দিনের সত্যের কাছে।
উনিশ শতকের নবজাগরণকে ‘বঙ্গীয় নবজাগরণ’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। অথচ, সেখানে পূর্ববঙ্গের কোন প্রতিনিধির স্থান নেই! এই নবজাগরণেরও উৎসমুখ যদি মানুষ হয় তাহলে সেই মানুষকে নিয়েই তো সারা জীবনভর মূলত লালন ফকির এবং তার চারপাশে ঘিরে থাকা প্রথিতযশা সাহিত্যিক এবং সমাজ সংস্কারক, হরিনাথ মজুমদার বা ‘কাঙাল হরিনাথ’, মীর মশাররফ হোসেন, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, জলধর সেন, এরা কাজ করে গেছেন। এদের নাম নেই কেন? তাহলে কি এই নবজাগরণ শুধু শহরকেন্দ্রিক বা কলকাতা কেন্দ্রিক? বিদ্যাসাগর-রামমোহন-বঙ্কিমচন্দ্র -বিবেকানন্দ-রামকৃষ্ণ শুধু এনাদেরই অবদান আছে? পূর্ববঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে প্রান্তিক মানুষগুলোর সাথে মিশে গিয়ে তাদের জাতি, ধর্ম, নারী-পুরুষ ভেদাভেদ ভুলে সারা জীবন যারা মানুষকে নিয়ে কাজ করে গেল, লালন ফকির সহ সেইসব মানুষগুলোর কি রেনেসাঁস আন্দোলনে কোন অবদান নেই? এই নবজাগরণ সংগঠিত হবার পর এক শতাব্দী পেরিয়ে আরেক শতাব্দীর এক চতুর্থাংশ আমরা পার করে এসেছি। এখনো এই বিষয়ে সেরকম কোনো মূল্যায়ন চোখে পড়ছে না। তবে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, গবেষক, শ্রদ্ধেয় সুধীর চক্রবর্তী (১৯৩৪-২০২০) তার ‘ব্রাত্য লোকায়ত লালন’ বইতে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এছাড়া ২০২২ সালে লিখিত শ্রদ্ধেয় প্রসাদ সেনগুপ্ত ‘র ‘নবজাগরণের বঙ্গ ও বাঙালি’ নামে গবেষণামূলক একটি বইতে এই বিষয়ে উল্লেখ আছে। তিনি লিখছেন, ‘ উনিশ শতকের বাংলা এখন আমাদের কাছে উপাসনার মন্দির হতে পারে। এই মন্দিরের এক দরজা খুললে দেখা যায় যার মুর্তি- তিনি হরিনাথ মজুমদার’। ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’র সম্পাদক এবং প্রকাশক হিসেবে কাঙ্গাল হরিনাথের অবদান আমরা কমবেশি সবাই জানি। কাঙাল হরিনাথ সম্পর্কে সুধীর চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, ‘... হরিনাথ বাউল গানের আদর্শে ফিকিরচাঁদ ভনিতায় বহু গান লেখেন এবং শখের বাউল দল বেঁধে সেই সব গান প্রচার করেন। বাংলা গানে পরম্পরায় থেকে ফিকিরচাঁদি গানের ভাব ও সুরের গড়ন খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘পথের পাঁচালী’ চলচ্চিত্রে ফিকিরচাঁদের একটি প্রসিদ্ধ গান হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল (মূল গানে আছে, ‘ওহে, দিন তো গেল সন্ধ্যা হলো পার করো আমারে)’। ব্যবহার করে তাকে প্রসিদ্ধতর করেছেন। যাই হোক এই ভাবুক হরিনাথের সম্পূর্ণ বিপরীত সত্তা ছিল সম্পাদক হরিনাথের। ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’র ফাইল ঘাঁটলে দেখা যাবে নির্ভিক হরিনাথ কুষ্টিয়ার দরিদ্র কৃষক শ্রেণীর পক্ষে কলম ধরতেন, তাদের উপর শোষণ ও অত্যাচারের প্রতিবাদ করতেন নিজের কাগজে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস তাঁর ‘লোকসংগীত সমীক্ষা’: বাংলা ও আসাম (১৮৩৫) বইতে অপ্রকাশিত কাঙ্গাল হরিনাথের দিনপঞ্জির সাক্ষ্য মেনে উল্লেখ করেছেন যে একবার ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’য় জমিদারের প্রজাপীড়নের খবর পড়ে জমিদারদের প্রেরিত লাঠিয়ালরা কাঙালকে উচিত শিক্ষা দিতে আসে। সাধক লালন তার দলবল নিয়ে লাঠি হাতে বিপন্ন বন্ধু কাঙ্গালকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন।’ ( ব্রাত্য লোকায়ত লালন, পৃ ২০ )।
অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় লিখেছেন, ‘ স্ত্রী শিক্ষা ও বাংলা শিক্ষার জন্য সেকালে অল্প লোকেই অনুরাগ প্রকাশ করিতেন। হরিনাথ স্বয়ং বালিকা পাঠশালা ও বাংলা পাঠশালা সংস্থাপন করিয়া অধ্যাপনা ও অধ্যায়ন কার্যে যুগপৎ মনোনিবেশ করেন। তাহার প্রতিষ্ঠিত উপায় পাঠশালায় জীবিত রহিয়াছে এবং অনেক অজ্ঞানান্ধ নর-নারীর চক্ষুরুম্মিলনের সহায়তা করিতেছে!’ ( অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় রচনা সংগ্রহ, পৃ ৪১৯)।
একথা ভাবলে সত্যিই আশ্চর্য হতে হয় যে, আজ থেকে ১৭১ বছর আগে (১৩ই জানুয়ারি, ১৮৫৪) কুমারখালী গ্রামের এই চরম দারিদ্র-পীড়িত মানুষটি , তাঁর জীবনের শেষ সম্বল কয়েক কাঠা জমি দান করে শুধুমাত্র বাংলা শিক্ষার প্রচার এবং প্রসারের উদ্দেশ্যে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। অল্প কদিনের মধ্যে সেটি সুনাম অর্জন করায় উড্রো, মার্টিন, প্রমূখ্য পরিদর্শকের সুপারিশে সরকার বিদ্যালয়ের জন্য আর্থিক অনুদান মঞ্জুর করেন। এরপর ১৮৬০ সালে হরিনাথ নিজের বাড়ির চন্ডীমন্ডপে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং বিনা বেতনে সেই স্কুলে তিনি শিক্ষকতার কাজে যোগদান করেন।
‘উনিশ শতকের কলকাতার প্রভাব ও পরিবেশ রামতনু লাহিড়ী থেকে বিদ্যাসাগরের মতো মফস্বলী বা গ্রামীণ উৎসের ব্যক্তিদের সামান্য জীবন এত বিস্তারে ও ফল পরিনামে শাখায়িত করে দিয়েছিল যে সে কথাই আমরা বড় মুখ করে বলি। বাঙালি মধ্যবিত্ত মানসে মেট্রোপলিটন মন, রেনেসাঁস, এলিটিস্ট-অনুষঙ্গ, ইংরেজি বিদ্যা ও প্রতীচ্চের চিন্তা নায়কদের ভাবনার সংক্রান্ত বিষয়ে পাতার পর পাতা ভরে ওঠে উচ্ছ্বাসে গর্বে। Albion's distant shore'- এর জন্য যশোহরের সাগরদাঁড়ির যুবকের হিন্দু কলেজীয় দীর্ঘশ্বাস, উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও খ্রিস্টধর্মগ্রহণকে আমরা রোমান্টিক উন্মাদনার সারাৎসার ভাবি। কিন্তু সেই ঝোঁকে অবজ্ঞাত থেকে যায মেহেরপুরের গাঁড়াডোব গ্রামের মুন্সি জমিরুদ্দিনদের জীবন-সংগ্রাম, কুমারখালির হরিনাথ মজুমদারের দুরূহ সাংবাদিকতার ব্রত পালনের নিষ্ঠা, লাহিনীপাড়ার মীর মোশাররফ হোসেনের গদ্যচর্চা, মেহেরপুরের দিনেন্দ্রকুমার রায়ের অনন্যব্রত সাহিত্য নিষ্ঠার সততা, কিংবা নিম্নবর্গে স্বনির্বাসী লালন ফকিরের জাতি বর্ণ দ্রোহের বলিষ্ঠতার কথা। সমকালীন এসব ব্যক্তি অনেক ক্ষেত্রে সহ যোদ্ধা এবং জন্ম সাল ও কর্মকালের চুলচেরা হিসাবে রামমোহন, বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র, হরিশ মুখার্জি, রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সমসাময়িক। পাশ্চাত্য নবজাগরণের তীব্র বিদ্যুৎছটা, ইংরেজি কেতাবের বিচ্ছুরিত জ্ঞানের আলো, প্রতীচ্চের প্রত্যক্ষবাদ, হিতবাদ বা উপযোগিতাতত্ত্ব, পিরিতি প্যাট্রিয়টিজম না হয় এঁরা তেমন করে পাননি, তবু আপন অন্তরের অনুজ্ঞা থেকে, নিজেদের করুন অভিশপ্ত গ্রামিক বাতাবরণে, শত বাধা ও বিরুদ্ধতার মধ্যেও এঁরা প্রশস্ত করতে চেয়েছেন অপরাজেয় মানব মহিমার সংকল্প, সমন্বয়বোধের সমতল এবং সৃজনের অন্তঃস্রাবী নিগূঢ় ও প্রবর্তনাকে। কিন্তু আমাদের শিক্ষিত সমাজ এবং নগরমনস্ক বুদ্ধিজীবীরা সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতির এসব অন্তজ সন্তানদের বড় একটা আমল দেননি।’ ( ব্রাত্য লোকায়ত লালন, সুধীর চক্রবর্তী, পৃ ১৪৮)।
আমরা দেখেছি ২০০৪ সালের বিবিসি এক জনমত সমীক্ষায় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে ২০ জনের একটি নামের তালিকা ঘোষণা করে। সেখানে রাজা রামমোহনের নাম ১০ নম্বরে, আর লালন ফকিরের নাম ১২ নম্বরে।
আমরা আগেই দেখেছি যে লালনের গানে একটা প্রশ্ন চিহ্ন থাকে। একটা চরম জিজ্ঞাসা সত্যের কাছে। উনবিংশ শতাব্দীতে লালনে তাঁর সাবলীল উচ্চারণে যে প্রশ্ন সমাজের কাছে রেখে গেছেন সেটি এই বিংশ শতাব্দীতে এসেও অক্ষরে অক্ষরে সত্য বলে প্রমাণিত। তাঁরই একটি গান এখানে উল্লেখযোগ্য,
জাত গেল জাত গেল বলে, একি আজব কারখানা
সত্য কাজের কেউ নয় রাজি সব দেখি তা না না না।।
যখন তুমি ভবে এলে
তখন তুমি কি জাত ছিলে
যাবার বেলায় কি জাত নিলে
একথা আমায় বল না।।
ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি
একই জলে সব হয় গো শুচি
দেখে শুনে হয় না রুচি
যমে তা কাউকে ছাড়বে না।।
গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়
তাতে ধর্মের কী ক্ষতি হয়
লালন বলে জাত কারে কয়
এই ভ্রম তো গেল না।।
লালন লেখাপড়া জানতেন না। লিখিত জ্ঞানের বয়স মাত্র দু’শো বছরের। তার আগে হাজার হাজার বছরের জ্ঞান তা মূলত টিকে ছিল শ্রুতির রূপে। জানা যায় যে, জ্ঞান সাধনার যে শ্রুতিনির্ভর ধারা লালনই তার সর্বশেষ প্রতিনিধি। লালনের শিষ্যদের মধ্যে কেউ কেউ কিছু লেখাপড়া জানতেন। লালন যখন গানের কথাগুলো বলতেন শিষ্য রা সেটি তাদের সাধ্যমত লিখে রাখতে। তার কিছু আমরা পেয়েছি রবীন্দ্রনাথের লালনের গান সংগ্রহের মধ্যে দিয়ে। গোটা উনিশ শতক জুড়ে এমন কোন চিন্তানায়ক পাওয়া যাবে কি, যিনি এরকম একটি চিন্তার স্কুল খুলে বসেছিলেন? যাক মুখ নিঃসৃত এই অমৃত বাণী আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
চাতক বাঁচে কেমনে
শুদ্ধ মেঘের বরিষণ বিনে।।
কোথায় হে নব জলধর
চাতকিনি ম’লো এবার
ও নামে কলঙ্ক তোমার
বুঝি রাখলেন ভুবনে।।
চাতক ম’লে যাবে জানা
ও নামের গৌরব রবে না
জল দিয়ে কর সান্তনা
দাসীকে রেখে চরণে।।
তুমি দাতা শিরোমনি
আমি চাতক কলঙ্কিনী
অন্য আশা নাই জানি
ফকির লালন তাই ভণে।।
লালনের জন্ম তিথি উপলক্ষে দোল পূর্ণিমায় প্রতিবছর কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় লালন মেলার আয়োজন করা হয়। তিনি যখন জীবিত ছিলেন তখন থেকেই এই দিনটি খুব ঘটা করে আয়োজন করা হতো। এই দোল পূর্ণিমার মধ্যে দিয়ে মানুষের ভালোবাসা মানুষের মেলামেশা ও সহাবস্থান। আর উনিশ শতকের নবজাগরণের মূল বিষয় ছিল এই মানুষ। লালন বলেছেন:
এমন মানব জনম আর কি হবে।
মন যা করো ত্বরায় কর এই ভবে।।
অনন্ত রূপ সৃষ্টি করলেন সাঁই
শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই
দেব-দেবতা গণ করে আরাধন
জন্ম নিতে এই মানবে।।
কত ভাগ্যের ফলে না জানি
পেয়েছো এই মানব-তরণী
বেয়ে যাও ত্বরায়, তোমার সুধারায়
যেন ভারা না ডোবে।।
মানুষে করতে মাধুর্য ভজন
তাইতো মানব রূপ গঠলেন নিরঞ্জন
এবার ঠকলে আর না দেখি কিনার
লালন কয় কাতরভাবে।।
পরিশেষে এ কথা বলাই যায় যে রামমোহনের ধর্মসংস্কার, তথা ব্রাহ্ম ধর্মের মানবমুক্তির আন্দোলন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শিক্ষানীতি ও সমাজ সংস্কারের লড়াই, রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সহজ সরল ভাষায় ‘যত মত তত পথ’, ভক্তিবাদের এক নিঃশব্দ বিপ্লব, এবং বিবেকানন্দের বাস্তববাদী সংঘবদ্ধ ধর্মীয় আন্দোলনকে এক সূত্রে গেঁথেছিলেন লালন ফকির। তার গানের ছিল ভাববাদ, ছিল সমাজ সংস্কারের আবেদন। ছিল সম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা, সর্বোপরি মানুষের কল্যাণ সাধন ও মানুষের মুক্তিতে এক নিরবিচ্ছিন্ন আন্দোলন জারি রেখেছিলেন সারা উনিশ শতক জুড়ে। বস্তুত বঙ্গীয় নবজাগরণের অন্যতম প্রধানের চরিত্র ছিলেন লালন এ কথা আমরা নির্দ্বিধায় বলতেই পারি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন