রবিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫

Kobitar Alo October Sankhya 2025

 



প্রচ্ছদ ঋণঃ- অদিতি সেনগুপ্ত 


সূচীপত্র

কবিতা ভিত্তিক

আসিফ আলতাফ
নিশা তালুকদার
রত্না দাস
সোমনাথ লাহা
পিউলি মুখোপাধ্যায়
দেবব্রত দত্ত
গোবিন্দ মোদক
ভাস্কর সরকার
দেবযানী ভট্টাচার্য

সম্মিলন 

চিরঞ্জিত ভাণ্ডারী
অজিত দেবনাথ
শিশির আজম
সৈকত মাজী
রূপক চট্টোপাধ্যায় 
শামীম নওরোজ 
শম্পা সামন্ত
লক্ষ্মী নারায়ণ মুখোপাধ্যায়
বাবলু সরকার 

মুক্তপদ্য

মধুপর্ণা বসু
নিমাই জানা 

গল্পাণু

কেয়া নন্দী

উপন্যাস

অহনি

আনুপূর্বিক

হিমাদ্রি শেখর দাস

ছোটগল্প

শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়



কবিতাভিত্তিক

একটি নারকেল গাছ সংক্রান্ত ইমোশন 
আসিফ আলতাফ

কোনো শহুরে বাড়ির সামনে
নারকেল গাছ দেখলেই আমি দাঁড়িয়ে যাই
এটা আপনার বাড়ি নয় তো;
ঠিকানা ভুলে যাওয়া আমার একটি স্বভাবজাত ত্রুটি
তাই আপনার বাড়ির ঠিকানা মনে রাখার জন্য চিহ্ন হিসেবে নারকেল গাছটাকেই বেছে নিয়েছিলাম;
কী বিড়ম্বনা দেখুন
এখন  কোনো বাড়ির সামনে নারকেল গাছ দেখলেই মনে হয় এখানে আপনি থাকেন না তো!
ভাবি —একবার ভেতরে যাই,
আপনি দরজা খুলে দেবেন
আমাকে দেখে হাসিমুখে বলবেন— বাইরে দাঁড়িয়ে কেন
ভেতরে আসুন
এক কাপ চা অন্তত:ত খেয়ে যান;
নারকেল গাছ তো যে-কারো বাড়ির সামনে থাকতে পারে
কিন্তু গ্রিলে হেলান দেয়া নারকেল গাছ দেখলেই মনে হয়
আপনি বারান্দায় চুল ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ;
ব্যাপারটা একদম হাস্যকর হয়ে গেল
তাই না?
কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই যে—  শহুরে বাড়ির সামনে
দাঁড়িয়ে থাকা নারকেল গাছকে
আমার আপন আপন মনে হয়;
কবিদের মানুষ কতকিছুই তো বলে
আমার এ বয়ান শুনে  আপনারাও যা কিছু বলতে পারেন।


বিরক্ত না দূরত্ব 
নিশা তালুকদার 

বীরত্ব হীনা দূরত্ব কিনা
জানতে চাওয়া আমার মন।
অকূল সাগরে ঢেউয়ে ঢেউয়ে
আসে কেন সারাক্ষণ?

তার তরীতে সূর্য ডোবে,
চন্দ্র কেন ভাসে?
মুখ গোমড়া মানুষগুলো
দুঃখ নিয়ে আসে।

চোখের জল বেশি, না সমুদ্রের?
বীরত্বের দাম বেশি, না দূরত্বের?
মাঝের দূরত্ব মানে শুধু
আবদ্ধ কত কিছু।

শান্তির খোঁজে মানুষ,
উড়িয়ে দিচ্ছে ফানুস।
শান্তি শুধুই প্রশান্তির দেশে,
রূপ না জানা ছদ্মবেশে।


হাঘরের_কথাবৃত্ত
রত্না দাস


শ্রম মন্থরতা ফুটছে দেহে জরার প্রবেশ বলিরেখায়
বিলম্বিতে বাজছেন জাকির তবলার বোল ক্লান্ত পা'য়!

অলস স্থবিরতা কোষে কোষে শৈশব থেকে কৈশোর
যৌবনবেলা ডাক দিতে দিতে রাত এখন মগ্ন ভোর।

হিমসন্ধ্যা গাঢ় হয়ে জড়িয়ে ধরছে কালের গ্রাস
ঝরে পড়ার সংকেত আসে চাওয়া পাওয়ায় শেষ মধুমাস...

প্রিয় নাম ধরে ডাকে না কেউ আর ডুব দিয়েছে যে ওপারে
ঘরে থেকেই হয়ে গেলাম কখন যেন হাঘরে ।


স্বপ্নের অপমৃত্যু
সোমনাথ লাহা

স্বপ্নটা দেখা হয়েছিল, দেখেছিল অনেক‌ই
শেষটা বোধহয় জানা ছিল কার‌ও..
ধোঁয়াশায় যখন হারিয়ে যায় চেনা পথ
হাতড়ে বেড়াতে হয় চারিপাশ
মনে হয় শূন্যের মাঝেই দাঁড়িয়ে রয়েছি
একাকিত্ব নিয়ে থাকা জীবন্ত শব।

ক্ষতবিক্ষত হয় শরীর-মন     
জর্জরিত জমাট বাঁধা বুক
কেউ কি জানত শেষটা এমন হবে
যোগ্যতা থাকবে দাঁড়িপাল্লায়
মানদণ্ড নিয়ে প্রশ্ন অনেক হবে!

সত্যি-মিথ্যের দোলাচলে কতবার
জটিল আবর্তে ঘুরতে হবে নিরন্তর
গোলকধাঁধায় ঢাকা পড়ে যাবে
আদর্শ আর মানবতার উৎসব।

কোথায় যেন সময় পড়েছে বাঁধা
থমকে গিয়েছে সকলের দেখা দৃষ্টি
ঠিক-ভুলের মাঝখানে পড়ে গিয়ে
হারিয়েছে সৃজন আর সৃষ্টি।


অক্ষমতা 
পিউলি মুখোপাধ্যায়

বিনয় মজুমদার পাশে রেখে বৃষ্টি দেখছি 
ভিজছে এক হাত, অন্য হাত দিয়ে লেখা 
তোমাকে নিয়ে এবছরের দুর্ভেদ্য জ্যামিতি 
যেখানে আমার উপস্থিতি আণুবীক্ষণিক
অথচ বাড়িয়ে দিচ্ছে তোমার রক্তে নেশার মাত্রা

অপছন্দের গল্পে নায়ক হলে, বৃষ্টিতে মনখারাপ
অজান্তে পাশাপাশি, না জানিয়ে সরে আসা 
এই রাত যেন পৃথিবী থেকে মহাশূন্যে যাত্রার
এবার আকাশ থেকেও চিহ্ন সরিয়ে দিলাম  
যাতে না দেখি চোখ তুলে বা পাশে তাকিয়ে 

কবিতা পড়তে পড়তে নিহত উপন্যাস 
বুঝে নিঃস্বার্থে তোমার অক্ষমতার বিন্যাস


মাটির গন্ধ 
দেবব্রত দত্ত

মাটির গন্ধে জন্ম নেয় যে গান, কোনও নোটেশনে 
বাঁধা যায় না। ধান কাটার ফাঁকে, কৃষাণের কণ্ঠে 
যে সুর, সে-ই প্রাচীনতম কবিতা। গোধূলির আলোয় 
শাঁখা পলার টুংটাং জেগে ওঠে আকাশে। মাটির টান। 
বাঁশির ভেতর দুঃখ, ঢোলের তালে আনন্দ। মায়ের মুখে 
রূপকথা, পাথরও কথা বলে, চাঁদ নেমে আসে উঠোনে। 
আলোয় হারিয়ে যায় বাউলের শেষ বিকেলের গান, 
'মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি'। আজও বেঁচে আছে 
এক মাটির নাড়ি, অমলিন প্রাণ। আমাদের চেয়ে পুরনো, 
আমাদের ভেতরেই নতুন হয়ে ওঠে, মানুষকে ভালোবেসে।


পলি-দিদিমণি
গোবিন্দ মোদক

পলি-দিদিমণির বাড়ির সামনে দিয়ে 
হেঁটে যেতে যেতে 
আমি প্রতিদিন খুঁজে পাই একটি নমিত ভোর
সম্মোহিত উচ্চারণ আর গোপন পলিমাটি।
আমার বাল্য-কৈশোর একাকার হয়ে যায় যৌবনে
আর খিদের রকমফেরে ভুগতে ভুগতে 
আমি ভর্তি করে ফেলি তিন চারটে কবিতার খাতা 
অথচ সেসব কথা ইলাদিকে বলা হয়ে ওঠে না
তেমন করে;
কিন্তু পলিদি – “কিরে কেমন আছিস সুমন?” 
এটা জিজ্ঞাসা করলেই আমার হাতের তালু
অনিবার্য ঘেমে ওঠে
পলিদিকে ভেবে ভেবে যে সব গোপন সুখ
আত্মস্থ করেছি সঙ্গোপনে
তার কথা ভাবতেই কথা জড়িয়ে যায় 
আর প্রাণঘাতী হিল্লোল তুলে 
“বোকা ছেলে কোথাকার!” কথাটি বলে
পলিদি চলে যায় শিফন উড়িয়ে …! 
আমার শৈশবের ধারাপাত বইটাও 
হারিয়ে গিয়েছিল বোধকরি এমনি করেই …!


টিকটিকি
ভাস্কর সরকার 


টিকটিকির গায়ে বুকেতে কী একটা পিচ্ছিল লেগে আছে 
দেয়াল এখন তাকে আর আটকায় না 
বারংবার খসে পড়ে যাচ্ছে 
আসলে সে কোনোদিনই কাঁদেনি 
পিচ্ছিল সরে গেলে 
ঈশ্বর আপনা আপনি টুক করে কাছে টেনে নেয়


আমি 
দেবযানী ভট্টাচার্য

ধ্বংসাত্মক আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষের দলে  নাম লেখাইনি কখনও,
সে আগুনকে যজ্ঞের আগুনে পরিণত করার বিদ্যে আমার অজানা নয়।
কালবৈশাখীর দাপটের ভয়ে যারা কপাটে খিল তুলে দেয় তাদেরকে বলি , সম্মুখ সমরে বুঝে নাও তোমার অস্তিত্ত্ব।

সাঁতরে অপটু জেনেও নদীতে ঝাঁপ দেওয়া থেকে বিরত হই নি কোনোদিন,
নিশ্চিন্তে আত্মসমর্পণ করে বলেছি,
এই নাও তোমার হাতেই জীবন, মরণ !

যারা নির্দ্ধিধায় ছেড়ে চলে গেছে একদিন ,তারাও ফিরতে চেয়ে জয়ী করেছে আমায়।
মুখোশেরা প্রকাশ্য রাস্তায় অথবা আড়ালে নতমস্তকে করেছে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন !
মুখোমুখি তাদের অপ্রস্তুত হাসির সামনে স্থির চোখে বলেছি ,তোমাদের ভালো হোক।


সম্মিলন


চিরঞ্জিত ভাণ্ডারী
আলো আছে

বিশ্বাস করি বলেই 
হাত বাড়িয়ে দিই
ঠিক যেভাবে পাখি ডানা মেলে
আকাশের বুকে
বাতাস ভরে পাখায়।

হয়তো বেশিরভাগ 
ঠকায় অথবা কাঁদায়
ক্ষত দিয়ে যায় কল্পনার অতীত।

তার মধ্য থেকে দু একজন যখন 
বিশ্বাসের মর্যাদা দেয়
সন্দেহ ভাঙে
এখন পৃথিবীতে আলো আছে
ফুল ফোটাবার।


মান কচু ওল

কার কাছে চাইব স্বপ্ন দেখার মতো
প্রশান্তির ঘুম
কার কাছে রাখব বিশ্বাস 
যে দেবে সুস্থ এক সভ্যতা।

পা ফেলতেই জল
হাত বাড়াতেই হতাশা
চোখ খুলতেই আঁধার। 

বৃথা সব জয়গান
মান কচু ওল 
তিন শালাই সমান।


মনের বারান্দায়

তুমি বললে;ভালোবাসি
আমি আমার ক্ষত খুলে দেখালাম
দেখালাম পাঁজরে পাঁজরে জমে থাকা কিছু বরফকুচি।

তুমি তাতে হাত রাখলে
কষ্ট গুলো ফুল হয়ে ফুটতে লাগল
যে ভাবে নরম আলোয় পাপড়ি মেলে
জুঁই চামেলি গোলাপ বেলি।

ভালোবাসার মানুষ পেলে
দুঃখেরা কেমন সুখ হয়ে 
হাঁটাহাঁটি করে মনের বারান্দায় 
বউ কথা কও পাখি বুঝি
এই ভাবেই করে ডাকাডাকি।


বেদনারা এতোখানি ভারী

বিসর্জন বলোনা
কান্নারা শোক ভুলে গেলে
স্মৃতিরা মুছে যায়
অশৌচদশা শেষে।

যেখানে প্রত্যাবর্তন সুনিশ্চিত 
সেখানে দুঃখেরা কখনও কান্না মুছেনা
চোখ পেতে রাখে 
ঠিক যেভাবে ঘুমন্ত শিশুর বুকে জেগে থাকে
কেবলই মায়ের মুখ।

শঙ্খচিলের ডানা আকাশে লিখে যায়
আগামী শরতে 
আবার এসো মাটির পৃথিবীতে
শিউলিফুলে সাজিয়ে রাখব বরণের ডালা।

আসাটা সুনিশ্চিত 
তাই বুঝি
বেদনারা এতোখানি ভারী।


শুভ বিজয়াদশমী

আমি বিজয়াদশমীর অভিনন্দন জানাতে হাত বাড়িয়ে দিতেই 
সেই লোকটি হাত বাড়িয়ে অর্ধপ্রস্ফুটিত ফুলের মতো হাসল 
যে লোকটি প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে বিক্রি করছিল কাগজেরফিরফিরি।

জিজ্ঞেস করলাম:কেমন দেখলে প্যাণ্ডেল ঠাকুর 
লোকসমাগম
সে বলে উঠল:আমি শুধু দেখছিলাম কাগজেরফিরফিরি কিনে শিশুরা মহানন্দে ফিরফিরি 
ঘোরাতে ঘোরাতে 
ঘুরছিল একপ্যাণ্ডেল থেকে আরেক প্যাণ্ডেলে।

মনে মনে ভেবে খুশি হচ্ছিলাম 
খোকার জন্য আনন্দ কেনার নামও
আসলে আরেক বিজয়াদশমী।


ইসলাম মুহাম্মদ তৌহিদ 
সমুদ্রের চিঠি

শঙ্খ কানে দিলে

সমুদ্র এক অদৃশ্য শ্বাস ফেলে—
লোনা হাওয়ায় ভেসে আসে
ভাঙা স্বপ্নের নীল কালি,
কিন্তু আমার দরজায়
কখনো থামে না সেই চিঠিওয়ালা ঢেউ!


মোহঘূর্ণির চতুর্থতর স্পর্শ

আমরা একে অপরকে ছুঁই না,
আমরা একে অপরের প্রতিসরণে লেগে থাকি,
ঠিক যেন দুই ভিজে ছায়া—
পৃথক, অথচ একই অলীক জল।

তোমার ঘামে আমার ঈশ্বর হাঁটে,
নাভির নিচে একটা ত্রিমাত্রিক প্রার্থনা ফোটে,
ঐদিকে থেকে যায়— কাঁচের ভিতর ছটফট করতে থাকা নামহীন লালসা।


অজিত দেবনাথ
একফালি ছায়া

এক শান্ত বিকেলের কাছে চেয়েছিলাম
একফালি ছায়া 
মেঘের সরণি বেয়ে হেঁটে যাব অরণ্যের
হৃদয় সঙ্গমে 
আকাশের অন্ধকার মুছে গেলে মিশে
যাব ধুলোর স্রোতে 
গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকবো শুকনো পাতার বাতিল নিশ্বাসে
কিন্তু ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কেটে গেল সমস্ত নির্জনবাস 
মনের যে কত অগম্য দৃষ্টি?
ভিতরে ভিতরে এত জীর্ণ পাতার ভাঙা কুটির!
আকাশে ধূসর মেঘ, অন্তরে শনশনে বাতাস
সামনে ওঁত পেতে রয়েছে প্রাচীন গুহানিবাস 
আমার মরচে-ধরা অপেক্ষাগুলো জেগে ওঠে জ্যোৎস্না-মাখা পাহাড়ি ভাস্কর্যে
এসেছি হারিয়ে যেতে, কিন্তু কীভাবে?
গিরিখাত ধরে বয়ে যায় বুদ্ধের নির্বাক শিলালিপি
আমি দাঁড়িয়ে থাকি শূন্য হাতে 
এইটুকুই বিশ্বাস, এইটুকুই নির্বিকার সন্ধ্যা।


বাতিঘর

বাতিঘর ছেড়ে একটি আলোর হাত সরে যায় বিষাদরঙা পাড়ে 
কাঁপতে থাকে সৈকতে ছেঁড়া বালির টানে
চাঁদ এসে ফিরে যায় দক্ষিণ বাতাসের বিরহে 
দাঁড়িয়ে থাকিনি, একা একাই হেঁটেছি নীরবে
মাধুকরীর মতো শান্ত হয়ে অনেকটা দূর
শুকনো পাতাগুলো স্পষ্ট হয়ে পড়ে থাকে পথের কুঠুরিতে
আমিও তাদের মতো ঝরে যাই বিন্দু বিন্দু অন্ধকারে 
পালিয়ে যেতে পেরেছি কি দূরে 
ওই ঢেউয়ের মতো ক্রমশ ছোটো হতে হতে?
অন্ধকার, তুমি কিংবদন্তি লুকিয়ে রেখেছ নেভানো প্রদীপ 
বাতিঘরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে অস্ফুট পিপাসা 
বুকের ভিতরে ঘুণপোকা-
গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে যতক্ষণ অন্ধকার থাকে....


মেঘের মানচিত্র

দু'একটি পাতা উড়ে যায় বাঁশবনের ভিতর দিয়ে 
তুমি ছায়া ভেবে দাঁড়িয়ে থাকো 
একাকী, গাছের সিঁথিতে চোখ রেখে 
যতটুকু জিরিয়ে নেওয়া যায় 
অশান্ত বিকেল নির্জন টিলার উপরে প্রগাঢ় ঘুমে আচ্ছন্ন
কেউ তো ছিল না এই সুশান্ত অরণ্যের গর্বিত শ্যামলে-
দুকূল ছাপানো গভীর শূন্যতা, আর নির্জনতার বিনম্র স্বাক্ষর
মাথার উপরে মেঘের সুশীল মানচিত্র 
একটু একটু করে উড়ে যায় অপঠিত পৃষ্ঠার অবাধ্য নূপুরে
দূরে জোনাকির আলো বেড়ে ওঠে সন্ধ্যার আলতাপরা হাওয়ার সান্নিধ্যে।


প্রতিবেশী

ওই যে বৃষ্টির ভিতরে আকাশ ভেসে আসে 
ও কি তোমার প্রতিবেশী? 
ভুল করে মাথা রাখি মেঘের পিঠে 
আমি কি জানতাম, আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে পাহাড়ি খাদে 
ঘন জঙ্গল ছুঁয়ে ছুঁয়ে বর্ষাঋতুর আড়ালে 
আমি তো কখনো রাখিনি খোলা বেদনার তাঁবু 
রাখিনি চোখ সূর্যের সোনালি বিছানায়
অন্ধ পতঙ্গের মতো বাঁচতে চেয়েছি জানালার কার্নিশে অলস রোদের ডিঙি রেখে
রাস্তার দু'পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছি ছেঁড়া কাগজের ক্লান্ত চাঁদ
কিন্তু যখন জলের শান্ত স্রোতের হাওয়ায় ভেসে যাই নৈঃশব্দ্যের জনপথ পেরিয়ে
ভাঙনের শব্দে জেগে উঠি
নিচু হয়ে তুলে নিই বিনম্র বৃষ্টির ধ্বনি 
আর কখনো ফিরে আসবো না মরচে-ধরা জলসার মজলিশে 
ঢেউ হয়ে ভেসে যাব পুকুরের পাড়ে 
নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকব একটা সামান্য সূর্যবিন্দুর দিকে 
একাকী অন্ধকারে মিশে যাই অমল ছায়ার মুখবন্ধ খামে।


শিশির আজম
সাগরদাঁড়ি


'কখনো সাগরদাঁড়ি যদি না গিয়ে থাকো
তাহলে আর গিয়ে কাজ নেই' --
বলেছিলেন জগদীশ, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু,
আমার বন্ধু।

কেন বলেছিলেন?
কখনও জিগ্যেস করিনি জগদীশকে।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত কবিতা লিখেছেন, নাটক লিখেছেন।
কবিতা আর নাটক দুটোই আমি পড়েছি,
নাটক মঞ্চে দেখিনি।

না দেখেও বুঝেছি মধু আসলে থাকতে চান মাটিতেই।
মাটির যন্ত্রণা মুছতে
উনি কী করবেন.
কোথায় যাবেন?

ভার্সাই থেকে কতো দূর সাগরদাঁড়ি?

সাগরদাঁড়ি কখনও আমি যাইনি।

কেন যাইনি? 

জিগ্যেস করো মধুকে, ও জানে।


শিল্প কী বস্তু


এখন আমরা শিল্প নিয়েই কথা বলবো
শিল্প তো কারো ক্ষতি করে না।
মানুষ চিরকাল সাধনা করে এসেছে যেন সে পাখি হতে পারে
তো এই পাখি হবার খায়েসে
সে হারিয়েছে তার নক্ষত্রসংকুল ডানা
আর উপকূলবিস্তৃত ম্যানগ্রোভ বন।
আবার এর বিপরীত কেচ্চাও আছে --
ত্রিপোলির আমেরিকান এ্যামবেসিতে গ্রেনেড বিস্ফোরণ
মিয়ামিতে বিশ্ববানিজ্য সম্মেলনে বিক্ষোভ
সম্মেলন চত্তরে দেহে পেট্রোল ঢেলে নেপালি চাষীর আত্মাহুতি।
অস্বীকার করছিনে
এসব কান্ডকারখানায় শিল্পের হাত রয়েছে।
তবু ফের আমার মনে পড়ছে :
'খুকু, কোথায় গেল তোর বকবকানি?'
তারপর পোড়োবাড়িগুলোর খিলান দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে নক্ষত্রের পতন
বৈদ্যতিক সড়ক
দুর্বোধ্য ভাষা
যার বিন্দুবিসর্গ কিছুই বোঝা যায় না
তবু বুকে এসে লাগে
হৃৎপিন্ডে ঢুকে যায়।
হ্যা, শিল্প নিয়েই আমরা কথা বলবো
শিল্প তো কারো ক্ষতি করে না
তবু খেয়াল রাখবেন, রাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের
কোন টিকটিকি হয় তো
আপনার পাশেই বসা।


চক

আমার যা ইচ্ছে
আমি তাই লিখি
অন্য কারো মগজ ধার করা
আমার ধাতে নেই

যদিও জানি
আমাদের বাড়ির কুকুর
ক্ষেপে গিয়ে
একদিন আমাকেই কামড়াবে


ডাস্টার

যা কিছুই তুমি লেখো না কেন
আমি পারবো মুছে দিতে

নিজেকে রক্তাক্ত করে
এমন কি
নিজেকে নিঃশেষ করে হলেও
মুছে দেবো

কেন না তুমি আদৌ
ঠিক লিখছো না


পেন্সিল

মনে হচ্ছে এ-পেন্সিলে
চলবে না।
না হয় দিলাম দুটো দাগ,
তোমার চোখের নিচে দাগ
                              বদলাবে?

জাদুরজনীতে পৃথিবীর আচরণ উত্তম মতোই --
শতাব্দীর খোলে
অস্থিবিকলন
সংশয়
মনে হয় এ-পেন্সিল
(আগেকার মতো)
ঠোঁটে
নিতে পারবে না।


সৈকত মাজী
ঈশ্বর

১|

একটা ভাত ভর্তি থালা
পাতলা বিরির ডালে ডুবে গেলে,
মোচড় দিয়ে ওঠে ক্ষিদে।

হলুদ জলে মুক্তো ভাসতে দেখে
অর্ধনগ্ন ঈশ্বর,
শরীরে তার ঝুলে আছে
ম্যারাসমাস, রিকেট আর কোয়াশিয়রকর,
লোভে চকচক করে ওঠে ,ঠিকরে আসা চোখ।


২|

জমকালো পাঁচতারা রেঁস্তোরার সামনে
সংকীর্ণ একটা ফুটপাথ।
অস্থায়ী উনুনের ধোঁয়ায় বেড়ে ওঠে দূষণ।
কয়েক দলা আটা সেদ্ধ হয়ে এলে
শুরু হয় উৎসব।

শতছিদ্র একটা কালো আকাশ
ছাদ করে ঘুমিয়ে পড়ে ঈশ্বর,
সংকীর্ন ফুটপাথে।


৩|

রুক্ষ চুল, শুষ্ক মুখ,শীর্ণ দেহ
জীর্ণ পোশাকে ,ধুলো মাখা শরীরে
ঈশ্বর এসে দাঁড়ালো আমার সামনে, বাটি হাতে।

হতাশ হয়ে  চলে গেল সে।
তার পাত্রে আমি দিতে পারিনি কিছু,
তার পায়ের দাগ আলপনা হয়ে
ফুটে রইলো  আমার বুকে।


৪|

নব কর্ষিত ক্ষেতজমি যেন জরায়ু,
সুকোমল সোনার বীজ
প্রোথিত করা হচ্ছে, তার গাত্রে।

ছেঁড়া একটা আটপৌরে শাড়ি
পরেছে আজ ঈশ্বর, মাথায় তার জীর্ণ পেখা,
রচনা করে চলেছে খোরাক,
ক্ষিদে মেটানোর ।

শিশু একটি ঈশ্বর ,
মায়ের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে
উদাসী চোখে, আলের ধারে বসে,
আর ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে ঘাসের মধু।


রূপক চট্টোপাধ্যায় 
সংকেত 
স্থানাঙ্ক জ্যামিতিতে তোমার অবস্থান 
নির্ণয় করেনি কেউ। তাই এই ভবঘুরে 
পথের ধারে ডামাডোল খেলায় 
উড়িয়ে দিয়েছি আত্মপরিচিতি! 
রৌদ্র পালক খুলে ভুলে গেছি উড়ান পদ্ধতি। 
নিভে যাওয়া ঠোঁটের উপর সভ্যতার 
অসমাপ্ত চুম্বন টুকু এঁকে নিও অসুখের নামে!

তবুও তো বাউলিয়ানার তুমি একতারা ধ্বনি, রসকলি, 
বিমুগ্ধ  বৈষ্ণবী। অন্তরে পাপ লিখে রাখো।

ডাকে। একটি বার অন্তত এই সমুদ্র সংকেত পেয়ে
তোমার খাদ্য অযোগ্য পুরুষ বলে ডাকো!


নাদ

ঘোড়া রঙের বিকেল আমাদের বয়ে নিয়ে যেতো 
রোজ, 
বিশুদ্ধ ভাঁটিখানা থেকে
বামনি টিলার চূড়ার দিকে!
নিজেদের শরীরে তখন দেবতাদের মতো ঘ্রাণ । 
অনুভব করতাম হাতের দুপাশে ডানা,
কোমর পর্যন্ত শস্য খেত আর বাকি নগ্নতা টুকু 
বন্ধুদের জন্য বিকেলের খেলার মাঠ হয়ে পড়ে থাকা, পদচ্ছাপে পদচ্ছাপে আঁকা হতো গতি চিহ্ন গুলি। 

অঝোর বৃষ্টির ভেতর ফুটবলের দাপাদাপি শেষে 
শিলাবতীর জল শরীরের চুবিয়ে দেওয়া ক্লান্তি,
ভাঙা মেঘের ভেতর নক্ষত্র সংকেত, 
বিষন্ন প্রেমিকার মতো দাঁড়ানো সেগুন সুন্দরী 
আবারো ফিরিয়ে দিতে ঘরের উঠোন!

এ-শহর ঘুমতো দেয়না, তবুও লুকিয়ে লুকিয়ে 
এখনো ঘুমের ভেতর মোষের গলায়  ঘন্টা ধ্বনি শুনি,

এটুকুই ব্রহ্ম নাদ,
এটুকু শস্য আবেশে বেঁচে থাকার সহজ কৌশল! 


সংগীত 

এ যন্ত্রণায় সুর চাপিয়ে দাও
জ্বলে পুড়ে যাওয়া জীবন হোক
সাত সংসারের হারমোনিয়াম! 

বেজে উঠুক মালকোশ ছুঁয়ে 
অরন্ধন ধ্বনি, নেভানো চুলায় কিছুক্ষণ 
ছাই হয়ে শুয়ে থাকুক অভিমান। 

অহোরাত্র দরজার দিকে একদৃষ্টি চেয়ে চেয়ে 
পৃথিবীর সব গ্রন্থি খুলে গেলে,
চোখ সরোবর হয়ে আসবেই।  হংসগমন রেখা
এঁকে চলে যাবে সকালের পুরুষ। দরজা উদাস।
মৃত্যু এসে শুঁকে গেছে লাজুক কলিজা! 

আহা তবুও,
কয়েক ফোঁটা রক্ত ক্ষরণকারী কাঁটায়
বেজে বেজে উঠুক ত্রিতাপ লহরী! 


স্নান ঘরের স্মৃতি 


তোমার স্নানের অনুবাদ করি, দেখি
স্নান ঘরে তোমার শরীর ব্রহ্মময় হয়ে ওঠে। 
একে একে পালক খুলে 
তুমি যখন তলিয়ে যাও সুগন্ধি সাবানের
সফেন উৎসবে। কাঁচের সার্সিতে
আড়াল করা ব্রহ্মান্ড। যৌন অক্ষর গুলি 
পাখির মতো পাহারা দেয় নির্জন দুপুরের নগ্নতাকে!

অলস বারান্দায় জলোচ্ছ্বাস ঠেলে 
ভেসে যায় হলুদ শাড়ির নৌকা খানি।
অদ্ভুত শহরতলীর সারা গায়ে শামুকের গতি
এগিয়ে যেতে যেতে আঁকড়ে থাকে ঘড়ির কাঁটাদের।

জল আলপনার পদচ্ছাপ রেখে 
তুমিও বেরিয়ে আসো শূন্য স্নান ঘরে ফেলে
মিশরীয় যুগ পেরিয়ে মল্লভূমের দেশে!


ঘরণী তোমার জন্য 

দুখী নদীর তীরে একটি ঘর
মেঘের দেয়াল, আকাশ ছাউনির গম্বুজ! 
ওখানেই অপেক্ষায় ছ'পন কড়ি,
গুনতে গুনতে ফুরিয়ে আসবে প্যাপিরাস লিখন!

অর্থহীন নারীর কয়লা কালো হাতে
পৃথিবীর দোলোন ভার তুলে দিয়ে, 
ঈশ্বর যেখানে বিশ্রাম নিতে আসেন
মৃত্যুর দিকে একদৃষ্টি চেয়ে থাকে অবুঝ প্রেমিক

আঝোর বৃষ্টির অন্ধত্ব ছড়িয়ে থাকা রাতে,
দেবদারু গাছের পাতায় পাতায় দৃষ্টি জ্বেলে
জোনাকির স্রোত বয়ে যায়। গর্ভবতী জাগে
কোন শূন্যের আড়ালে, শিশুর ভগ্নাংশ নিয়ে!

তেমনই একটি ঘর তোমার জন্য রেখে
আমি পৃথিবীর সব ঘর ভেঙে দিতে চাই!


শামীম নওরোজ 
ত্রাস

রাত্রি শীতল হলে দিনের সূচনা হয়। রাত্রির পাখিগুলো দিনের আলোতে ফেরে। জলত্রাসে ফিরে আসে নদীর  কোলাহল। শিশিরের মৃত্যু হয় সূর্যের উত্তাপে। উত্তপ্ত পাখিগুলো আমাদের কুটুম নয়। 

বাড়িগুলো ভেঙে গিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেয়। ভেসে যায় লোক ও লোকালয়। জলদাহ ফিরে আসে বিপর্যস্ত লোকালয়ে। লোক নয়, লোকধর্ম ভেসে যায় জলত্রাসে। 


ভাঙন

ভাঙতে ভাঙতে ভেঙেই পড়লো। ঠেকাবার হাত নেই। ভেঙে পড়ার ইতিহাস ধুলো লিখিত রাস্তার জীবন। 
মাটিখোর শেয়ালের সঙ্গে পেরে ওঠা কষ্ট। জলের গভীরে আমার নিখোঁজ লাশের জন্য অপেক্ষা করছে কাক। 
ভয় পাবার কিছু নেই...
ধুলোঝড়ে উড়ে যাচ্ছে কাকের ইতিহাস। 


অমীমাংসিত

উপকার ও উপহার জনিত জটিলতা 
সহজে মেটার নয় 

মৃত্যুতে সবার ভয়
কেউ কেউ কাতর হয় 
কেউ কেউ আকাশের দিকে তাকিয়ে হাসে 

কোনো কিছুতেই জড়িত নয় 
নিজের ভেতর নিজেই ভেঙে খানখান হচ্ছে 

রক্তাক্ত শরীর দেবতার আশির্বাদ

সে কাউকে উপকার করে না
সে কাউকে উপহার দেয় না 
তবুও, জটিলতা 
সহজে মেটার নয় 


জন্মান্তর

জন্মগর্তে শিশুকান্না, ধাইমার খুশি 
মায়ের শরীরে প্রসব-বেদনা কমে 
রক্তাক্ত দিনের, অথবা রাত্রির পাখি 
জন্মগৃহে বাসা বাঁধে নিজস্ব নিয়মে 

শালদুধে ভরে যায় শিশুর উদর 
প্রিয় পাখিজন্ম গেরস্ত-বাড়িতে হাসে
বাবার সুরেলা কণ্ঠে আজানের ধ্বনি 
বোঝা যায়, পুত্রজন্ম মায়ের আঁচলে

রাত্রির পাখির সঙ্গে নতুন অতিথি 
জড়িয়ে পড়ছে জন্ম থেকে জন্মান্তরে


নির্জন

চাঁদ, জোছনা ও জোনাকির ভুল ঠিকানা। 
মধ্যরাত সকালের অপেক্ষায় আছে...
জানালার পাশে গাঢ় অন্ধকার, 
পাহারাদারের হাঁকে ফেটে পড়ছে রাত। 

কুকুর ডাকছে...

জোছনা ও জোনাকির পার্থক্য বোঝে 
গাঢ় অন্ধকার। 



শম্পা সামন্ত
নামজপ


পাহাড় গড়িয়ে যাচ্ছে উপত্যকায়
নদীর স্রোতের ঢেউ  মিলে যাচ্ছে প্রেম ও মৃত্যুর সমকোনে
দিগন্তে ফ্যাকাশে হলুদ জীবন শুয়ে আছে 
হোম স্টের মাথায় সোনার বর্ণের চাঁদ 
মরদের অপেক্ষায় বিধুর চাঁদনি এক

যবনিকা পড়ে গেছে অনেক্ষণ
শেষের পাঠ ও উপসংহার
নায়কের অভিযানে কাতর নায়িকা
কুসুম কুসুম প্রেম পূর্বরাগ অনুরাগ 
শুধু আকাশ মেতেছে মুক্ত মাথুরে
বিরহের পথে হেঁটেছেন কবি

গাছের তলায় ছায়ার নগরে
সুর ধরেছেন অন্ধ সুরদাস
গাইতে গাইতে কাঁদেন কাঁদেন আর গান
সংকীর্তণে পূর্ণ আখড়া
কিন্তু যার জন্য নামগান শুরু
তাকেই খুঁজে যাচ্ছি রাত্রিদিন এক করে
কোথাও সে নেই।


ঘুমের কবিতা

জুৎসই প্রেমের কথাটি লিখবার আগেই কলম পড়ে যায়
চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমে
স্বপ্নে অনেক কথাই বার বার আসে
মনেহয় এইসব সাংগাঠনিক শব্দ দিয়ে বেশ একখান কাব্য হতেই পারে
অথচ প্রেম বিষয়ক সকল শব্দেরা শবের সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত
শেষ পংতিতে এক বিস্তৃত জলাধার
যেখানে জল খায় সাঁতার কাটে এক জোড়া চখাচখি
আর মৃত্যুকালে সুইসাইড নোটে লিখে রাখে কালকের নৈরাজ্যের কথা
যেভাবে প্রেম আমাদের বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে মৃত্যু সেভাবে পারেনা
মরণ আর শ্যাম কথাটি এক হয়েও মুখোমুখী বসবার
আশ্রয় খুঁজতে খুঁজতে বিভাজিকায় রাখে বিমুগ্ধ সুর
ভোর হয়ে এলে রাতচরা প্রেম ও জানে ক্লান্তির এক বড়সর ঘুমের প্রয়োজন।


লক্ষ্মী নারায়ণ মুখোপাধ্যায় 

রাগমালা 

১.

ভুল করা ছাড়া উপায় ছিল কি আর?
কখনো বুঝিনি বৃষ্টিতে এত বেশী উষ্ণতা…

২.

কেউ তো দ্যায়নি মুছে কাজলের ক্ষত,
মাটিই শুধু জানে নদীর গভীরতা কত!

৩.

মনে মনে থেকে গেলে, তাকে 'থেকে যাওয়া' কব।
তুমি ফিরে গেলে, আমি বৃন্দাবনী হব।

৪.

কেন এত রেখেছ পিছুটান কী এত ভেবে
হাঁটু মুড়ে বসি যদি, তবুও কি ফিরিয়ে দেবে?


বাবলু সরকার 
নেল পলিশ 

ভাবছি
উঠবো কি উঠবো না 

তা শেষমেশ উঠেই পড়লাম 
শিরশির পাহাড় গাছ নদী আর
লোনা বাতাস ভরা ওর সমুদ্রের বুকে 

অতিব্যবহার? 
নিশ্চয় নয়,আমার ধারণা 
ব্যবহারই হয়নি এতটুকু 

যে টুকু জান পরিচয় ওই নখের 
সাথে নেলপলিশের সাথে 

আমি? হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ওকে
আলোয় এনে ফেলতে চাই
একেবারে লোকসম্মুখে


এই জানিস
আমার এখন প্রেম করতে 
ইচ্ছে করছে; আরে বাবা হ্যাঁ রে বাবা 
তোর সাথে না তো কি তোর 
ছেড়ে রাখা বাতিল সব জামাকাপড়ের
সাথে? কি যে বলিল না! তোকে ঘেটেই
না... সুখ অর্জন হবে মৃত খুলিগুলোর


তোর একটা ঘাসজমি ছিল না? 
মসৃণ নিকানো পুঁছানো ঘাসজমি

এই মাইরি ওই ঘাদজমিতে আমি
একবার সটান হবো ; গন্ধ শুঁকবো 

জানি সেটা খুব সুখকর হবে না 
তবু্ও তোর ঘাসজমি  বলে কথা 


কি!  অবাক হচ্ছিস তো? 
হবি হবি আরও হবি 

আসলেই তো ভালো লোক নই আমি
নইলে তোর ইয়েটিয়ে নিয়ে লোফালুফি 
করতে পারে? পারে তোকে নিয়ে 
চিতার মতো আগুনে পুড়ে মরতে?


মুক্তগদ্য


সন্ধিক্ষণের মানুষ 
মধুপর্ণা বসু

আমরা স্বর্গ পরিত্যক্ত আদম ইভের উত্তরসূরী, সে স্বর্গ আমাদের ছোটবেলা, কিশোরী মেয়েটির রসিক লহরীতে ফুলে ফেঁপে নারী হয়ে ওঠার টুপটাপ শিশির ঝরে পরা অতীতকাল। অত্যাধুনিক ঠান্ডা ঘরে রোমাঞ্চকর আলো আঁধারিতে রাত জাগা এই প্রৌঢ় চোখের ওপারে নিরলস জেগে থাকে সুনহেরী ইয়াদেঁ।
অতিরিক্ত শাসন আর বাধানিষেধের মধ্যেও ছিল ফস্কা গেড়ো। জানলার খড়খড়ি তুলে আকাশের ঘুড়ির উড়ান থেকে সদ্য গুম্ফ রেখা গজানো ডেঁপো ছেলে সবই গোচরে আসতো চৌর্যবৃত্তির নেশায় ঘেরাটোপের পাঁচিল ডিঙিয়ে আর সেটাই ছিল আমাদের জীবনের ট্রাম্প কার্ড। তবেই তো স্বাধীনতা মজে ক্ষীর হয়ে ঝটকা দিয়ে যেতো হৃৎ পঞ্জরে। সে পাওয়ার আবেশই ছিল অন্য মাত্রায়, যেন দুপুরে লাল শানের মেঝেয় শুয়ে আমচুরে টাকনা দিতে দিতে সুনীল গাঙ্গুলির 'সেই সময়' পড়ার রোমহষর্ক অনুভূতি।
যা সহজে পাওয়া যায়, পথেঘাটে, মুরি চপের মতো বেনামী সস্তায় সেই কৌতূহলহীন প্রাত্যহিকী কুড়ির শেষে আর একুশের আসার সন্ধিক্ষণে আমাদের ছিলনা। এখনকার নারী স্বাধীনতা, নারী মুক্তি, শেকল ভেঙে ফেলার জেহাদি নেশা সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে তামাটে ঠোঁট, খুলে ফেলার চূড়ান্ত দাপটে পোশাক ত্যাগ, অন্তর্বাস ত্যাগ, নারীত্ব ত্যাগ অথবা আধুনিকতার প্রচণ্ড গরমে পুরনো সবই যুক্তিহীন এ সেসব দিন নয়। সেই গুপ্ত যুগেও ছিল সংসারের পাঁচালী পড়া নিয়মের বাইরে পুরুষের ইগো, পৌরুষের দম্ভ, ইচ্ছেমতো ভাঙাগড়া যাযাবরের মতো অস্থায়ী মনোবৃত্তি,  হয়েতো- হ্যাঁ আনন্দ ফূর্তি, মস্তি,মানে অঢেল আমোদের প্রদর্শনী সেও ছিল যথেষ্ট। সেই সিলসিলা ধরে এখনো মানুষ নারী পুরুষ নির্বিশেষে আর নিশ্চিন্তে বহুমুখীতায়,ভেতর ঘর বাইরের ঘর, বসতবাড়ি বাগানবাড়ি এসব বড়ই সহজে, কোন কুণ্ঠা বা কৈফিয়ত ব্যতিরেকেই মেরী মর্জি ভেবে চলছে। এই স্পিড যুগে এতো সহজলভ্য প্রেম প্রীতি শরীর সেক্স, এবং প্রতিপত্তি যে টাকা দিয়ে অনায়াসে  মনুষ্যত্ব ছাড়া সবই কেনা যায়। তাই তো ভীষণ হিপি-জিপসী জীবন, বেদুইন মন আর চরিত্র ছড়িয়ে একাকার, সুতরাং নিয়মমাফিক পতন ও মরণ।ওই সন্ধিক্ষণে আমাদের একটা বালাই ছিল যখন বড়রা যা বলবে তার উল্টোটাই করতে হবে এসব ছিল কল্পনার অতীত। তাই কদাচিৎ স্কুল কলেজ ফেরত বন্ধুবাড়ি, বা ফুচকাওয়ালার সান্নিধ্য কলেজ কেটে সিনেমা বা ছেলে-ছোকরাদের চিঠি-চাপাটি গায়ে এসে ফুলচন্দনের মতো ঝুপ করে পরে যেতো যখন সেই মাদকের নেশার মাহাত্ম্যই ছিল নজিরবিহীন রোমাঞ্চকর। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এক রত্তি খুচরো প্রেম। তাই তার প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী দীর্ঘ। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই সেসবের ট্র‍্যাজিডি ঘটতো বাপ জ্যাঠার চটি জুতোর শাসনে, আর কালেভদ্রে বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়লে হয়েতো পরিনতি পেতো ছাদনাতলায়। 
'সব পেলে নষ্ট জীবন'এ যেন সমকালীন বেদমন্ত্র। এখন সবাই সব পেয়ে বসে আছে। তাই প্রাপ্তির কোন আহামরি আনন্দ নেই। গৃহত্যাগ, সংসার ত্যাগ, বাবা মায়ের সঙ্গ ত্যাগ, নিজের জন্মভিটে ত্যাগ, হাঁচি-কাশি বা নাসিকা গর্জনের নিমিত্তে বিয়ে বা সম্পর্ক ত্যাগ এ-যুগে এগুলো জলবৎ তরলং। কেউ কারো সূচাগ্র মেদিনী ছাড়বেনা। কম্প্রোমাইজ, অ্যাডজাস্টমেন্ট, স্যাক্রিফাইস, বোঝাপড়া, মধ্যস্থতা এসব গালভারি শব্দগুলো আর কিছুদিনের মধ্যেই লুপ্তপ্রায় প্রাণী বা উদ্ভিদের মতো অভিধানের জাদুঘরেই কাঁচের জারে মৃত জীবাশ্ম হয়ে সাজানো থাকবে। তাই সময় থাকতে মনে পড়ে গেল আরও কিছু অতীত, আরও খানিকটা বালিকা বা যুবতী বেলার রঙিন সোনালী দিন স্লো-মোশনে যেতে পারতো। যা হবার নয়, মেঘ চিঠি নিয়ে উড়ে গেছে অলকাপুরীর ঠিকানায়।আর যুগের পাখি সোনার খাঁচায় রইলো না।



অলৌকিক উপত্যকার মাংস কারখানা ও স্থাপত্য মাইক্রোসফট জিন
নিমাই জানা 


এলিজাবেথ সিনিয়ার দুর্ভেদ্য হাঙরের ফ্রায়েড মাংসের দাতব্য রথের মতোই উন্মাদ লিঙ্গগুলো বিছিয়ে রেখেছে বাদাম খোসার আরবীয় ফ্যানার রক্তস্রাব্য মাসিক ঋতুচক্র টিউবের ভেতর ঢুকিয়ে রাখা দূষিত রক্তের অ্যালফাবেটিক রহস্য কান্ডের ক্ষেপণাস্ত্র বহির্ভূত ষোড়শ মন্ত্রণালয়ে, কোশল জধপদ ভেসে আছে জলের অতলের বাইফোকাল জাহাজের কবরস্থিত কোন পালকের উড্ডয়নশীল থোরাসিক কেজে , 

আড়াই কেজি জরায়ুর তামার ভেতরে কুর্চি নদের মন্দাকিনী স্তন দুলছে ,অলিখিত রাতের উলঙ্গ ছাল ছাড়ানো মৃতদেহের ভ্যাজাইনাল ফ্লেভারের কেক সরীসৃপ খাওয়া নব্য পাথরের লালা মাখানো ডর্মেক্স ফিগারেটিভ বুটেক্স ওয়েবসাইট কিলবিল করছে নখের ডগায় , ১৩ টা পায়ু ছিদ্রবিহীন এ আই কুকুর মনিটরের স্ক্রিন চাটছে রজঃমেহন করছে জানালার পাল্লা খুলে , দীর্ঘশ্বাসের শ্বাসকষ্ট ডাইক্রোমেট প্লে স্টোর থেকে অতর্কিতে ডাউনলোড হচ্ছে হরিণীদের মতো টেম্পোরাল কক্সিস, জঘন্য মরুদ্যানের মাংস বিক্রেতার স্থাপত্যহীন জঙ্ঘার সুতার মতো শুক্র পদার্থ সারারাত চামড়া বিক্রি করে ধুয়ে ফেলি মরুদ্যানের নষ্ট মান্ধাতা গাছের প্রাণ রস , মনস্তাত্ত্বিক স্নায়ু রোগীর নিচে কালো বিড়ালেরা অতৃপ্ত সঙ্গম বহির্ভূত আশ্রমিক নারীদের মতো স্তনের নিচে চর্মরোগ লুকিয়ে রাখে ধারালো ব্লেডের মতো আমাদের হত্যার ধারাবিবরণী লিখছে অষ্টাদশী গোপবালিকার বসুদাম ও রন্ধন পিচ ফলের মতো মৎস্য সংরক্ষণাগার কালো কার্বোনেট কারখানার কম্বো সাপের মতো আলট্রাসনিক নিস্তব্ধ তরঙ্গের শ্বেত ভয়ংকর বাণী কর্ণ কুহরে খাদানের মহার্ঘ্য তেজের জল ছড়াচ্ছে লোহা পর্বতের আদিম তপস্যারত নারী , কুচু কুচু করে ছড়িয়ে রাখা হবে আমার সঙ্গমের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া পাতলা ও রাক্ষস পূর্ব জন্মের হাড়গোড় জলপ্রপাতে আমার জন্ম হবে অতি মর্দন ও সন্নিহিত ট্রাপিজিয়ামের গলা থেকে নামবে ধর্ম বহির্ভূত একটা নিষিদ্ধ দরজা ফাঁকা করে মিলিয়ে যাব ধ্বংসস্তূপ খাব ধ্বংসস্তূপের ওপরে পোঁচ দিয়ে ছিদ্র করে রাখা স্তনের কুন্ডলী নিতে ঢুকে যাব ক্ষত্রিয়দের হত্যা করব পিপাসা বহির্ভূত ল্যাটেরাইট এ চুমু দিতে থাকব চুম্বন করে চুষে খাব রাক্ষসের পরিপাকতন্ত্র , হি হি করে হাসবে ভয়ঙ্কর দেশ, লুকিয়ে রাখা আমার প্রেত দেশের পরকীয়া সম্পর্কিত উল্লিখিত ব্রহ্মশাস্ত্রের ক্ষত্রিয়ানী , 

এসো কিন্নর চামড়ার তৈরী উনুনে দুটো পুড়ে যাওয়া পা ফাঁকা করে কোক ও মূত্রত্যাগের ব্যবস্থা করি, হাসপাতালের নিচে একাকী জড়াথ্রুষ্ট ক্রুশ কাঠের উপর পেরেক ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে পোস্টমর্টমের ছোরাটাকে শুকনো করতে দিয়েছে, গ্লাভসের তলায় আমার মৃত ভ্রুণের ৭ ম চাণক্যের অযুত কক্ষাংসের বাণবিদ্ধ বাচ্চাটি অশ্বত্থামার মতো রক্ত বিক্রি করে পেপসিগার্ড কিনছে , microsoft এ ডাউনলোড হচ্ছে বিয়াংকা রানী, রবার্ট ক্রোয়েল ও শান্তনুর অবৈধ সঙ্গম পর্ব 


গল্পাণু

বুদ্ধিমান
কেয়া নন্দী

ভূত চতুর্দশীর দিনকয়েক আগে পরিতোষবাবু গত হলেন।সবে পূজো গেছে এইসময় আবার খরচের ধাক্কা। আতান্তরে পড়েছেন দুই পুত্র। শুভ্রাদেবী ভাবেন, ছেলেরা বড়ো চাকুরে, সুউপায়ী তবুও .....
       নিশ্চুপ থাকেন।
ছোটছেলে আত্মীয়পরিজন গুণে শ্রাদ্ধের হিসেবটা ফেলতেই বড়র চক্ষুচড়ক গাছ। সঙ্গে সঙ্গেই জবাব,বাবার জমানো পয়সায় শ্রাদ্ধের খরচ হয়ে যাবে কিন্তু মায়ের আগামীদিনের খরচ ......? যতই হাফ - পেনশন পাক। ওসব ভূত ভোজনে কাজ নেই।
তার চেয়ে বরং মূল্য ধরে মন্দিরে গিয়ে  শ্রাদ্ধ সারি। 
পুত্রবধূররা  কিছুটা অখুশি আত্মীয়রা এলে কয়েকটা শাড়ি হতো।
               ভূতে বিশ্বাসী শুভ্রাদেবী ভাবেন, কর্তামশাই ছেলেদের মেধা - বুদ্ধির প্রশংসা করতেন ! আজ নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছেন __ তাঁর ছেলেরা কত হিসেবী, কতো মেধাবী !! 


উপন্যাস

গৌরচন্দ্রিকা
অহনি
                                         (১)
সিলিং এর দিকে প্যাটপ্যাট করে চেয়ে আছে তন্নি। এই তার এক সমস্যা একবার ঘুম ভেঙে গেলে সহজে আর তা আসার নয়। কোথাও যাবার থাকলে নিশ্চিত শব্দহীন ঘুম ঘুমোতে পারেনা তন্নি আর আজ তো তাদের জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। এই প্রথম কলেজ যাবে তারা! যে কলেজ সম্পর্কে নানাবিধ কথা শুনে আর আকাশকুসুম কল্পনা করে এসেছে সে এ ইস্তক আজ তার সঙ্গে প্রতক্ষ্য সংযোগ হতে চলেছে এ কি আর কম উত্তেজিত ব্যাপার? ভাবনাগুলোকে আর প্রশ্রয় দেয় না তন্নি, আড়মোড়া ভেঙে উঠেই পড়ে বিছানা ছেড়ে।
বাথরুম থেকে বেরিয়েই শর্মিকে ডাকে তন্নি, 'এই শর্মি, ওঠ। উঠে পড়। ৮ টা বেজে গেছে, উঠে পড়।' শর্মি ঘুম জড়ানো গলায় 'হুম্' নামক শব্দ করে আবার পাশ ফিরে শোয়। তন্নি এবার ওর গায়ে হাত দিয়ে ঠ্যালাঠ্যালি শুরু করে, 'এই শর্মি ওঠ ওঠ। আর ঘুমোবি না। আমার বলে কলেজ যাওয়ার tension এ ঘুম হচ্ছে না আর ওনাকে দ্যাখো কেমন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোচ্ছে! আরে এই পাগলি ওঠ না। লক্ষ্মী বোন আমার উঠে পড়।' এমনিতে তন্নি শর্মিকে বোন কিংবা শর্মি তন্নিকে দিদি, এসব কখনোই বলে না। যাদের বয়সের মধ্যে মাত্র ৬ মিনিটের পার্থক্য তাদের মধ্যে এই দিদি বোন এর মতো formal সম্বোধন নিতান্তই অমূলক। অন্তত তারা দুজন সেটাই মনে করে। ছোটবেলা থেকে রীতিমতো মারামারি করে বড়ো হয়েছে এই দুই পিঠোপিঠি বোন তন্নিষ্ঠা আর শর্মিষ্ঠা। আর এখন যত বড়ো হচ্ছে ততই দুজন দুজনের খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠছে তারা। এক‌ই সঙ্গে শৈশব, কৈশোর আর সদ্য বয়ঃসন্ধি কাটানো এই দুই আত্মজের মনের ভিতরকার উথালপাথাল ভাঙাগড়াও এক তাই স্বাভাবিকভাবেই পরস্পরের প্রতি খুবই সহজ তারা। 
আরো খানিক ঘ্যানঘ্যান করার পর শেষমেশ গায়ে জল ঢালার হুমকিতে কাজ হল। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে বসল শর্মি, 'কি ব্যাপার রে তোর? কলেজ তো সেই ১০ টায় এখন বাজে ৮ টা। বাড়ি থেকে কলেজ যেতে maximum ২০ মিনিট লাগবে। এত তাড়াতাড়ি নিজেই বা উঠেছিস কেন আমাকেই বা তুলে দিলি কেন?', হাই তুলতে তুলতে কথাটা বলে শর্মি। বিস্ময়টা আড়াল করতে পারে না তন্নি, 'সেকিরে প্রথমদিন কলেজ যাবো একটু তাড়াতাড়ি বেরোবো না! অন্তত ৯ টায় তো বেরোনো উচিত। আমার তো স্নান হয়ে গেছে। তুই ঢুকলে তো আবার একঘন্টা!...' 'এই' শর্মি থামিয়ে দেয় তন্নিকে, 'তোর যেন ১০ মিনিট লাগে! নির্ঘাত সাতসকালে উঠে বাথরুমে গেছিস। কয়েকঘন্টা কাটিয়ে এখন আমাকে lecture দিচ্ছিস!' এই কথায় হেসে ফেলে তন্নি। কথাটা ভুল নয়। বাথরুমে তার‌ও একঘন্টা‌ই লাগে। ঘুম থেকে সাত তাড়াতাড়ি উঠে পড়াতে ব্যাপারটা makeup হয়ে যায়। শর্মিকে ঠ্যালা দেয় তন্নি, 'তো, তাতে কি? একঘন্টাই লাগুক আর দুঘন্টাই লাগুক স্নান করা হয়ে তো গেছে। তোর এখন‌ও হয়নি আর তাছাড়া ready হতেও তোর বেশি সময় লাগে।' কথাটা বলেই dressing table এর দিকে চলে যায় তন্নি। আয়নায় দ্যাখে শর্মি তারদিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মুচকি হাসে তন্নি, হ্যাঁ জব্দ করা গেছে। এই কথার আর কোনো উত্তর নেই শর্মির কাছে এটা জানে তন্নি। 'শোন, সাজগোজ তো করলি না জীবনে, করলে জানতি ready হতে সময় লাগে।', খানিকটা জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গিতে কথাগুলো বলতে বলতে বিছানা থেকে নেমে পড়ে শর্মি, তারপর balcony থেকে তোয়ালেটা নিয়ে ঢুকে যায় বাথরুমে।
নীচের বসবার ঘরে ততক্ষণে একহাতে খবরের কাগজ আর আরেক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে বসে পড়েছেন retired AM (Air Marshal) S.K Bose অর্থাৎ এই বাড়ির কর্তা, তন্নি-শর্মির বাবা সমীর কুমার বসু। দোর্দণ্ডপ্রতাপ এবং প্রচন্ড particular সমীর, নিজের দুঃসাহসিক মনোভাব ও কঠিন নিয়মঘেরা দৈনন্দিন যাপনের ফলে বেশ সফলতার সঙ্গেই কাটিয়েছে তার কর্মজীবন। শেষকালে একটা দুর্ঘটনার দরুন মাত্র ৫৬ তেই অবসর নিতে হয়েছে তাঁকে। তারপর থেকে মাস তিনেক কেটেছে তাঁর এই অবসরযাপনের। বাড়িতে তাই সর্বক্ষণ‌ই বিরাজ করছে একটা থমথমে ভাব। শর্মি আর তন্নি তাদের বাড়িটাকে বাড়ি না বলে boarding school বলতেই বেশি পছন্দ করে। ওদের বাপি যখন force এ ছিলেন তখন‌ও গতেধরা নিয়ম আর কাঠিন্যে তাদের প্রাত্যহিক দিনলিপি বাঁধা ছিল। শুধু নমাসে ছমাসে যখন বাপি বাড়ি ফিরতেন তখনই কড়াকড়িটা মানতে হতো ওদের। বাকি সময়টা স্বাধীন থাকতো মা-মেয়েরা। কিন্তু retirement নেওয়ার পর থেকে সেই স্বাধীনতাটুকু ঘুচে গেছে তাদের। এখন বাড়িতে সর্বক্ষণ‌ই নিয়মের কড়াকড়ি। উঁচু গলায় কথা বলা যাবে না, সন্ধ্যের পর কোনো বিশেষ কাজ ছাড়া বাড়ির বাইরে থাকা যাবে না, রাত ৯:৩০ টার মধ্যে dinner সারতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। নেহাত রাতে পড়াশোনার কথা বলে অন্তত সকালে মেয়েদের তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার নিয়মটুকু থেকে বিরত করতে পেরেছেন কমলিকা তার স্বামীকে। তিনি একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের অংকের শিক্ষিকা। কিন্তু তার স্বামীর রাশভারী মেজাজ আর কড়া জীবনবোধের কাছে তার শিক্ষিকামূলক ব্যক্তিত্ব বেশ ফিকে। স্বামীর সঙ্গে তার কথা বলাটাও নিতান্ত প্রয়োজনেই হয়। যে কঠিন নিয়মের ঘেরাটোপে বাস করে সমীর, তার মনের আশেপাশেও নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় না কমলিকা তাই এই দূরত্ব, যতটা না বেশি শারীরিক তার থেকে অনেক বেশি মানসিক। তাই দুই মেয়েকে নিয়েই কমলিকার জগৎ আর মেয়েরাও মা বলতে অজ্ঞান। বাপির সঙ্গে সরাসরি কথা তারাও খুব একটা বলে না। এব্যাপারে মা-ই ওদের মাধ্যম। কেবল কোনো ব্যাপারে অনুমতি নেওয়ার হলেই বাপির মুখোমুখি হতে হয় ওদের।
উপর থেকে দুই বোন তৈরি হয়ে যখন নামল ঘড়ির কাঁটা তখন সবে ৯ ছুঁয়েছে। তবে আরো খানিক দেরি হতো, নেহাত তন্নি হাত পা ধুয়ে শর্মির পিছনে পড়ে থেকে, ক্রমাগত তাড়া দিয়ে, বাপির ভয় দেখিয়ে শর্মিকে ভালোভাবে মানে ওর মনের মতো করে তৈরি হতে না দিয়ে কান্ডটা ঘটিয়েছে। বিরস মুখে breakfast table এ বসে পড়ে শর্মি। তন্নির ঠিক পাশের চেয়ারটাতেই সাধারণত বসে ও কিন্তু এখন রেগে আছে বলে উল্টোদিকে বসল। মানে কোনো মানে হয়? সাত তাড়াতাড়ি কলেজ গিয়ে কি ঝাঁট দেবে ওরা? প্রথমদিন কলেজ যাচ্ছে একটু ঠিকঠাক ভাবে যেতে হবে না? নিজের তো ওইটুকু ঝাঁকড়া চুল, তা আঁচড়াতে আর কত সময়‌ই বা লাগে? আর আমার এত বড়ো লম্বা চুলটাকে নিজের আয়ত্তে এনে proper ভাবে বাঁধতেই তো ২০-২৫ মিনিট লেগে যায়। এই মেয়েটার জন্য ভালোভাবে চুলটা বাঁধাই হল না। ঠিকঠাক ভাবে ready না হয়ে বাইরে বেড়োতে কেমন যেন একটা অস্বস্তি বোধ করে শর্মি। নিজেকে কেমন এলোমেলো মনে হয়। তন্নি কি সেকথা জানে না? সব জেনে বুঝেও কোথাও যাবার আগে এরকম তাড়া মারে! খুব বিরক্ত লাগছে শর্মির। Toast টার স্বাদটাও যেন বিস্বাদ লাগে তার। 
'তোমরা কলেজের schedule টা ঠিকভাবে দেখে নিয়েছো তো?', সমীরের গমগমে গলা শুনে খাওয়া থামিয়ে দুজনেই বাপির মুখের দিকে তাকায়। শর্মি ঢোক গিলে ঘাড় নাড়ে। তন্নিও নিঃশব্দে ঘাড় দোলায়। সমীর আবার বলে ওঠে, 'প্রথমবার কলেজ যাচ্ছ, একটা নতুন experience. To be very careful. Girls'College এ নাম ওঠা সত্বেও তোমাদের মা যে কেন এই coed college টাতেই তোমাদের ভর্তি করল জানি না, কিন্তু যখন ভর্তি করেই ফেলেছেন তখন তো আর কিছু বলার নেই। তোমরা তো জানোই লাগামছাড়া lifestyle আমি পছন্দ করি না। তাই কলেজে গিয়ে কেবল পড়াশোনার দিকেই মন দিয়ো। বন্ধু বান্ধব নিয়ে মশগুল হয়ে যেও না।' 'তোমার মেয়েরা যথেষ্ট বড়ো হয়েছে, এখন ওদের টা ওদের‌ই বুঝতে দিলে ভালো হয় না?' এইবার মুখ খোলেন কমলিকা। 'কলেজটার যথেষ্ট সুনাম রয়েছে, ওদের subject এর জন্য এটাই appropriate, সেই কারণেই এই কলেজে ভর্তি করিয়েছি। আর কলেজে পড়বে অথচ বন্ধু বান্ধব থাকবে না এ আবার কেমন কথা!' কমলিকার দিকে কঠোর ভাবে তাকান সমীর, 'সহপাঠী থাকতেই পারে কিন্তু অত বন্ধু বান্ধবের তো কোনো প্রয়োজন নেই।' এবার শর্মি তন্নির দিকে তাকিয়ে বলেন সমীর, 'কলেজে গেলেও বাড়ির principal টা মনে রেখো। বাড়ির গাড়িতে করে যাবে আর কলেজ হয়ে গেলে তাতে করেই ফিরবে। মাঝখানে ওই কলেজ বাঙ্ক করে সিনেমা দেখা, বন্ধুদের সঙ্গে হল্লা করা, আড্ডা মারা এসব যেন না হয়। এই নবিস কলেজগুলোতে এসব‌ই হয়।' অনেকটা বিচারের রায় শোনানোর মতো করে আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লেন সমীর। 
কলেজের গেটের সামনে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল দুইবোন। খাবার টেবিলে ওইরকম গুরুগম্ভীর পরিবেশ তৈরি হ‌ওয়ার পর‌ কেউই আর ভালো করে খেতে পারেনি‌। ওদের মাও খুব একটা জোড় করেনি ওদের। শুধু ওদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। ওদের driver কাকাকে টাটা করে দুজনেই গেট পেরিয়ে সামনের বাগান মতো জায়গাটার উপর দিয়ে ভিতরের campus এ এসে ঢোকে। বলা বাহুল্য ১০ টা এখনও বাজেনি এবং ওরা দুজন ছাড়া campus এ তেমন খুব একটা কেউ নেই‌ও। আশপাশে তাকিয়ে আরেকবার তন্নির দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকায় শর্মি। 'আরে বাবা প্রথমদিন একটু তাড়াতাড়ি আসা তো ভালো। এখন তো list দেখে আমাদের class room খুঁজতে হবে। তোর আমার department আলাদা বোধহয় building ও আলাদা হবে', মিউমিউ করে বলে তন্নি। শর্মি একটাও কথা না বলে গটগটিয়ে office room এর দিকে চলে যায়। তন্নিও মুখ বেঁকিয়ে ওর পিছু নেয়। 
তন্নি সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে বাঁদিকে তাদের জন্য নির্দিষ্ট classroom এ এসে ঢোকে। Psychology Honours এর room টা যথারীতি অন্য building এ। শর্মিকে ওর class এ পৌঁছিয়ে তন্নি বাংলা department এর UG first sem এর class এ এসেছে। এই তলায় সবকটি room ই বাংলা বিভাগের। বাঁদিকের গুলো UG আর ডানদিকের গুলো PG. ঘরটা খুব ছোট না, তবে শর্মিদের room টা এর চাইতে বড়ো। ঘরে ঢুকে মাঝের row এর একেবারে সামনের বেঞ্চটাতে বসে পড়ে তন্নি। শর্মিদের ঘরে তাও দুটো ছেলে আর তিনটে মেয়ে বসে ছিল এই ঘরটা ফাঁকা। ১০ টা বাজতে আর মিনিট তিনেক বাকি। নিজের মনেই হাসে তন্নি। বাবা! কলেজ বলতেই যে সে হাতিঘোড়া ভাবতো তা তো মোটেই না, দিব্যি সাধারণ ব্যাপার। বরং স্কুলে কড়াকড়ি ছিল অনেক বেশি। সময়ের আগে পৌঁছে এভাবে বাধাহীনভাবে class এসে বসে পড়া এসব তো সম্ভব‌ই ছিল না। হ্যাঁ সময়ের আগে সে অনেকবারই পৌঁছেছে কারণ সে বরাবরই punctual. এ নিয়ে একটা প্রচ্ছন্ন অহংকারবোধ‌ও আছে তার মধ্যে। যত‌ই বাপিকে এড়িয়ে চলুক ওরা, যত‌ই মনে মনে তার করে দেওয়া বাঁধাধরা নিয়মের গুষ্ঠি উদ্ধার করুক, কিছু কিছু প্রভাব তো পড়েইছে ওদের জীবনে। যেমন তন্নি, ঠিক সময়ে পৌঁছানোটা এখন তার একটা obsession হয়ে গেছে কিংবা শর্মি এই যে তাকে তাড়া লাগানোয় তন্নির উপর রেগে আছে, খানিকটা বিরক্ত‌ও বটে। সেটা কি এমনি? তার বেশভূষা, সাজসজ্জা বিশেষ করে চুলের ব্যাপারে সে প্রচন্ড‌ই যত্নবান এবং particular. বাড়িতে যেমন হোক বাইরে বেরোনোর হলে এ ব্যাপারে সে যথেষ্ট sensitive. 'এটা কি UG 1st sem?' হঠাৎ ভারী গলার আওয়াজে চমকে দরজার দিকে তাকায় তন্নি। মাঝারি উচ্চতা, জিন্স টি-শার্ট পরিহিত খুব সাধারণ চেহারার একটা ছেলে বড়ো বড়ো চোখে একমুখ জিজ্ঞাসা নিয়ে তারদিকেই তাকিয়ে আছে। চমক ভাবটা কাটিয়ে নির্দিষ্ট ও সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় তন্নি, 'হ্যাঁ'। দরকারের অধিক কথা সে কখনো‌ই বলে না। নিজের comfort zone এর বাইরে একটাও অপ্রয়োজনীয় কথা খরচ করতে নারাজ সে। ছেলেটা ঘরে ঢুকে ওর কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে পাশের row এর first বেঞ্চটায় বসল। আড়চোখে একবার ছেলেটার দিকে তাকিয়েই নিজের ব্যাগের ব‌ইপত্তরগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে তন্নি। 'অনেকক্ষণ এসেছিস?', একটু আগের শোনা চেনা কন্ঠস্বরে ঘুরে পাশে থাকায় তন্নি। ছেলেটা আবার‌ও জিজ্ঞাসু গোল গোল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। দুদিকে ঘাড় দোলায় তন্নি, 'না না এই খানিক আগেই এসেছি।' গায়ে পড়ে কথা বলা তন্নির কোনোদিনই ভালো লাগে না তাই কিছুটা বিরক্ত‌ই হয় সে। চেনে না জানে না এরকম দুম করে… 'Hi! আমি অহর্নিশ, অহর্নিশ উপাধ্যায়।' ভাবনায় ছেদ পড়ে তন্নির। অগত্যা ভদ্রতার খাতিরে তাকেও Hello! বলতে হয়, 'আমি তন্নিষ্ঠা বসু'। অপরদিক থেকে আরেকটা কিছু বলার তোড়জোড় সম্ভবত চলছিল কিন্তু কথা আর এগোলো না, অন্যান্য students রা একে একে আসতে শুরু করেছে।
এদিকে শর্মি ইতিমধ্যেই দুজনের সঙ্গে বেশ ভাব জমিয়ে ফেলেছে, সঞ্জনা আর বৃষ্টি। সঞ্জনা সিংহানিয়া, অবাঙালি হলেও বহুকাল কলকাতায় থাকার ফলে এখন ভেতো বাঙালি হয়ে গেছে, যদিও ওর কথায় সামান্য টান আছে। আর বৃষ্টিলেখা দত্তগুপ্ত, এক‌ই হাইস্কুলে পড়তো ওরা, তাই পুরোনো সহপাঠিনী পেয়ে শর্মি বেশ মুখরিত। আরো অনেকের সঙ্গে টুকটাক কথা চলছিল এর মাঝেই হঠাৎ গোটা ক্লাস জুড়ে কেমন যেন একটা চাপা গুঞ্জন শুরু হয়। বৃষ্টি আর শর্মি একে অপরের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে সামনের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলো বিষয়টা। দরজা দিয়ে ঢুকে আসছে একটা ছেলে, বেশ দোহারা চেহারা। বোঝাই যায় রীতিমতো স্বাস্থ্যসচেষ্ট। মুখে চোখে একটা গাম্ভীর্যময়তা ছেয়ে আছে। ছেলেটির মধ্যে একটা আকর্ষণ তো রয়েছে। শর্মিও স্থান কাল পাত্র ভুলে বেশ খানিকক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে ছিল ছেলেটার দিকে, বৃষ্টির ধাক্কাতে সম্বিত ফিরল তার। তখন‌ই ফিসফিসানিগুলো কানে এল তার, 'উফ্! দ্যাখ পুরো আগুন…', 'ছেলেটা কি handsome!' সঞ্জনা যোগ করল, 'only handsome? Hot ভি তো হ্যায়।' শর্মির‌ও ছেলেটাকে বেশ লেগেছে কিন্তু তা বলে এতকিছু ভাবনা তারমধ্যে আসে নি। এই সাতপাঁচের মধ্যে কখন যে ছেলেটা এসে ওর ঠিক পাশের desk এ এসেই বসেছে আর নিজের seat এ বসতে গিয়ে ছেলেটার গায়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলেছে শর্মি, তা সে খেয়াল‌ই করেনি। 'Excuse me, এটা কি হল?' ঝনঝনে গলাটা শুনে খানিকটা থতমত খেয়ে যায় শর্মি, 'অ্যাঁ! উম্ sorry আমি খেয়াল করিনি।' 'খেয়াল করোনি না ইচ্ছে করে গায়ে পড়লে?', কাটাকাটা গলায় বলে ওঠে ছেলেটা। মাথা থেকে পা অবধি জ্বলে ওঠে শর্মির, ঝাঁঝিয়ে ওঠে সে, 'What do you mean by that? and Who the hell are you যে আমি ইচ্ছে করে তোমার গায়ে পড়বো?' কথাটা শর্মি বেশ জোড়েই বলে ফেলেছে, class এর সবাই ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে এখন। ছেলেটা সম্ভবত এরকম প্রত্যুত্তর আশা করেনি। আসলে স্কুলে পড়াকালীন সব মেয়েরাই ওর সঙ্গে একবার কথা বলতে পারলেই বর্তে যেতো। ইচ্ছে করে গায়ে পড়ে ওর attention পাওয়ার চেষ্টা করতো, তাই ওর সঙ্গে কোনো মেয়ে যে এই tone এ কথা বলতে পারে সেটাই বড়ো রকমের আশ্চর্য লাগে ওর। মেয়েটার দিকে রাগী রাগী চোখে তাকায় ছেলেটা, 'Who knows? তোমাদের মতো মেয়েকে আমার জানা আছে, সবসময় ছেলেদের গায়ে পড়াটাই তোমাদের কাজ। Disgusting.' শর্মি আবার কিছু একটা বলতে যায় কিন্তু সেইসময় ওদের department এর HOD এসে পড়ায় আর কিছু বলা হয় না। সামনের desk ছেড়ে বৃষ্টির পাশের desk এ এসে বসে পড়ে শর্মি আর মনে মনে গজরাতে থাকে। বৃষ্টি মৃদু হেসে শর্মির কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে, 'যে দৃপ্ত চ্যাটার্জী হাইস্কুলে প্রায় সব মেয়ের ক্রাশ ছিল, যার সঙ্গে কথা বলার জন্য মেয়েরা মুখিয়ে থাকতো তুই প্রথম দিন এসে তাকে একেবারে Who the hell are you বলে দিলি!' এইবার মনে পড়ে শর্মির। হ্যাঁ এরকম একটা কিছু সে শুনেছিল বটে! স্কুলে প্রায়‌ই শুনতো coaching centre এ নাকি কে একটা ছেলে পড়ে যার প্রেমে প্রায় সক্কলেই পাগল। কিন্তু ওই coaching centre এ না পড়ায় কোনোদিনই সে ছেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেনি তার। এই অসভ্য বাঁদড় ছেলেটাই তবে সে! আরেকবার জ্বলন্ত চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মুখটা সরিয়ে নেয় শর্মি। 

Something is cooking…
                                                
চলবে...


আনুপূর্বিক

কবিতায় ছন্দের বিবর্তন 
হিমাদ্রি শেখর দাস


রবীন্দ্রনাথ  ছন্দ সম্পর্কে বলেছেন, ‘ছন্দ কেবল বাইরে বাঁধন, অন্তরে মুক্তি। অর্থাৎ কথাকে তার জড়ধর্ম থেকে মুক্তি দেবার নামই ছন্দ।’ ছন্দ কেমন? এর ব্যবহার কীরূপ? প্রশ্ন আসতে পারে। এ প্রশ্নের কিছুটা সমাধানের জন্য হলেও জানা প্রয়োজন ছন্দ বিশ্লেষণ। ছন্দ বিশ্লেষণ করতে হলে ছন্দের কতগুলো উপাদান বা বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হয়। সাধারণত বাংলা ছন্দে অক্ষর মানে অক্ষর জ্ঞান, মাত্রা মানে মাত্রা নির্ধারণ পদ্ধতি, যতি বা ছেদ এর ব্যবহার, পর্ব বা পর্বাঙ্গ বিন্যাস, পংক্তি, চরণ এবং স্তবকের আঙ্গিক গঠনÑ এ কয়েকটি উপাদান বা বিষয় সম্পর্কে বিশদভাবে জেনে ছন্দলিপি নির্ণয় করা হয়ে থাকে বলে তা জেনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া, এগুলোর মধ্যে অক্ষর এবং মাত্রা হচ্ছে ছন্দের মূল উপাদান। প্রখ্যাত ছান্দসিক প্রবোধচন্দ্র সেন বলেছেন, ‘শিল্পিত বাকরীতির নামই ছন্দ।’
এভাবে কবিতায় ছন্দ ব্যবহারের মাধ্যমে কবিতায় গতিসৌন্দর্য বা ধ্বনিসৌন্দর্য সৃষ্টি করা হয়ে থাকে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘কবিতার বিশেষত্ব হচ্ছে তার গতিশীলতা।’ এ গতিশীলতার জন্য কবিতায় ছন্দ ব্যবহার তার পরিস্ফুটনের বাহন রূপে কাজ করে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্য তার কবি জীবনের ঊষালগ্ন কালেই বলেছিলেন, ‘অনুভবের ভাষা ছন্দোবদ্ধ। কেননা কবিতা কিছু বলে না, বেজে ওঠে।’ এই বোধ তার মধ্যে জাগ্রত হয়ে ওঠেছিল বহু আগেই। মূলত, কবিতার জন্মমুহূর্তেই নির্ণীত হয়ে যায় যে, কবিতাটি কোন ছন্দে লেখা হবে। রবীন্দ্রনাথ এটাও বলেছেন, কবিতার ছন্দ যে-নিয়মে উৎপন্ন হয়েছে, বিশ^জগতের সমস্ত সৌন্দর্যই সে নিয়মে সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া ছন্দ হচ্ছে স্মৃতিসহায়ক। ফরাসি কবি লুই আরাগাঁ বলেছিলেন, কবিতার ইতিহাস তার টেকনিকের ইতিহাস। ছন্দ ব্যবহারে আমাদের এ টেকনিকের ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি করে জেনে রাখা প্রয়োজন। এখানে বলে রাখা দরকার, ছন্দের জন্য তার চাল বা চারিত্র জানা থাকা চাই। এ জন্য অক্ষর বা মাত্রা সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন আগেই বলেছি। কেনো না অক্ষর বা সিলেবল এবং মাত্রা হলো বাংলা ছন্দের মূলভিত্তি। অক্ষর বা সিলেবল হলোÑ দুই প্রকার মুক্তাক্ষর ও বদ্ধাক্ষর। কিন্তু, অক্ষর বা সিলেবল বুঝতে হলে বর্ণ বা ধ্বনির তফাতটা বুঝতে হবে। কেননা, অক্ষর বা সিলেবল হবে আমরা যেভাবে শব্দ উচ্চারণ করি সেই অনুযায়ী, যেভাবে লিখি সেভাবে নয়। আর মাত্রা, মাত্রা হলো, অক্ষর বা সিলেবলের উচ্চারণের কাল বা সময় জ্ঞানকে মাত্রা বলে। অর্থাৎ এক-একটা অক্ষর বা সিলেবলকে কতক্ষণ ধরে উচ্চারণ হচ্ছে তার পরিমাপকই হচ্ছে মাত্রা।
কবিতার সৌন্দর্যকে জীবন্ত করে তুলতে ছন্দ এক অত্যাবশ্যক উপাদান। শব্দ, মন্থন, পলক সবই ছন্দের ছাপ রেখে যায় পাঠকের মননে। তবে ছন্দ = অদ্বিতীয় ধারা নয় — সে বিবর্তিত হয়, পরিবর্তিত হয়, নতুন নতুন রূপ নেয়। অতীতে বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ছন্দের ধরণ পরিবর্তন হয়েছে। আজ কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ছন্দের বিবর্তনকে বুঝে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি শুধু শৈলরূপ বা পদ্ধতির পরিবর্তন নয়—ছন্দের বিবর্তন কবিতার ভাবপ্রকাশ, ভাষাগত সম্ভাবনা ও অনুভূতির স্বীকৃতি।
এই প্রবন্ধে প্রথমে ছন্দের ধারণা ও শ্রেণিভেদ দেখব, তারপর বাংলা (এবং সংক্ষিপ্ত হিসাবে বিশ্ব) কাব্যচর্চায় ছন্দের ইতিহাস ও ধারা নিরীক্ষণ করব, এবং অবশেষে বিবর্তনের কারণ, নতুন ছন্দের উদ্ভব ও বর্তমান চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করব।



আদিতে “ছন্দ” বলতে শব্দ বা পদ্যকে একটি নিয়মিত প্রতিরূপে গোষ্ঠীবদ্ধ করা — অর্থাৎ, যে ধ্রুব গতি, যে নিয়মিত পুনরাবৃত্তি (মাত্রা, স্বর, যতি, তান ইত্যাদি) — তাকে ছন্দ বলা হয়। ছন্দ শুধু মাত্র “অঙ্কের নিয়ম” নয়, এটি ধ্বনিগত, বায়ুব্যয় (শ্বাস-উচ্চারণ), উচ্চারণগত গতি ও ধৈর্য, ভাব ও সুরের সমন্বয়। একাদিক ভাষাতত্ত্বে ছন্দকে “এক ধরণের পুনরাবৃত্তিমূলক গতি” হিসেবে ধরা হয় — বিশেষমাত্রা ও বেগের গতি ছন্দকে গঠন করে।
কবিতাকে শুধু তথ্যবহুল লেখা নয়, রূপমূলক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে ছন্দ কাজ করে — তা পাঠকের মস্তিষ্কে স্পন্দন সৃষ্টি করে, ছন্দস্বরূপ অনুভূতির সঞ্চার ঘটায়।


ছন্দ গঠনে যে উপাদানগুলির ভূমিকা থাকে, সেসব প্রধানাংশ নিম্নরূপ:

মাত্রা (Metre / মাপ) — প্রতিটি পদের ধ্বনিসংখ্যা বা ধ্বনিমাত্রার সীমা। (যেমন ৪ মাত্রা, ৮ মাত্রা ইত্যাদি)

যতি (Foot / পাদ) — প্রতি চরণ বা প্রতি পঙক্তিতে যে ধরণের ধ্বনির বিন্যাস থাকে।

তান (Elongation / দীর্ঘতা) — ধ্বনির প্রসার, দীর্ঘ বা স্বল্প উচ্চারণ।

যতি সম্ভাব্যতা ও যতির পরিমার্জন — কখন ধ্বনিকে ভাগ করা হবে বা মিলিত করা হবে।

উচ্চারণভঙ্গি (Accent / stress), চলমান গতি ও শ্বাস-উচ্চারণ — ধ্বনির বেদী, উচ্চারণে গতি ও স্বরোপযোগ।

অনুপ্রাস, অলংকার ছন্দ সংযোগ — ধ্বনির পুনরাবৃত্তি, রস ও সাদৃশ্য।

এই উপাদানগুলিকে কবি–ব্যবহারিক সচেতনতা, অনুভূতির গতি ও ভাষাগত প্রবণতা মিলিতভাবে রূপায়ন করে ছন্দ সৃষ্টি।

ছন্দ কবিতাকে সংগঠিত করে, এটিকে পাঠযোগ্য ও শ্রুতিমধুর করে তোলে। ছন্দ:

শব্দের স্বরবিভাজন ও ধ্বনিসাম্য তৈরি করে
কবিতার গতি ও তালের অনুভূতি দেয়
অনুভূতির প্রবণতা (উচ্চ-নিম্ন, স্থিতি-চলন) নির্দেশ করে

পাঠককে আবেগের ছন্দস্বরূপ প্রবেশ করতে সহায়তা করে

সাহিত্যিক নিয়ম ও সৃজনশীল তেওঁ পথ প্রস্তুত করে

তবে এর সীমাবদ্ধতা আছে — কখনও ছন্দ বেশি জটিল হলে ভাবপ্রকাশ বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে।


বাংলা ভাষা ও বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে ছন্দের বিবর্তন একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। বাংলা ছন্দচর্চা সাধারণত তিনটি প্রধান বিভাগে ভাবা হয় — মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত।

ইতিহাস অনুসারে, ছন্দচর্চার সূত্রীকালে সংস্কৃত ও প্রাকৃত ছন্দবিশ্লেষণ বাংলা ভাষাকে প্রভাবিত করে। বাংলা ভাষা যখন সদ্য কবিতার পথ ধরেছিল, তখন ভাষার নিজস্ব উচ্চারণ, শব্দরূপ ও কলসামঞ্জস্য নির্দিষ্ট ছন্দরূপ আবেদন দিয়েছিল।
চর্যাপদ সময়েই বাংলা কব্যশ্রেণি ছন্দ ব্যবহার শুরু করে — চর্যাপদে “মাত্রাবৃত্ত” ছন্দের ধরণ নজর আসে। যদি প্রকাশ প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়, চর্যাপদে কয়েক মাত্রার ধরণের ছন্দ (চারমাত্রা, পাঁচমাত্রা) ব্যবহৃত হয়েছে বলে দেখা যায়। তারপরে ব্রজভাষার বৈষ্ণব পদাবলী ও ভক্তিকাব্যে ছন্দচর্চা আরও সমৃদ্ধ হয়। ব্রজ পদাবলীতে ছন্দ-সংস্কৃতির বহুবিধ প্রয়োগ ও ছন্দ-বৈচিত্র্য দেখা যায়।

মধ্যযুগে বাংলা কাব্যের ছন্দচর্চা ছিল বেশ সংহত ও ছন্দনির্ভর। “পয়ার” ছন্দ ছিল প্রধান একটি ধারা, যা ৮/৬ মাত্রার গঠন প্রধানতা পায়। পয়ার ছন্দে পাঠ সুরময়তা ও গম্ভীরতা বজায় রাখতে সক্ষম। ছাপরো ছন্দ, মহাপয়ার, ভঙ্গপয়ার ইত্যাদি ছন্দরূপও মধ্যযুগে পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, মহাপয়ার হ’ল পয়ার ছন্দের একটি বিস্তৃত রূপ, যেখানে আট/দশ মাত্রার গঠন দেখা যায়। এই যুগে ছন্দ ছিল গদ্যাভিনয় ও সুরময় অভিজ্ঞতার ধারা, যেখানে ছন্দ ও সুর একসাথে মিলিত ছিল।
অক্ষরবৃত্ত ছন্দকে অক্ষরমাত্রিক, বর্ণমাত্রিক, সংকোচপ্রধান, মিশ্র-প্রকৃতিক ছন্দ বলা হয়ে থাকে। বাংলা কবিতার আদিতম ও প্রধানতম ছন্দ হচ্ছে এ অক্ষরবৃত্ত। বাংলা ছন্দের ভিত্তিই হলো অক্ষরবৃত্ত। যা কথা বলার বা প্রাণের মৌলিক ছন্দ। দেখা গেছে যে, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অধিকাংশ কবিতাই লেখা হয়েছে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে। মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে প্রবোধচন্দ্র সেন পরবর্তী সময়ে নাম দিয়েছিলেন কলাবৃত্ত ছন্দ। অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় নাম দিয়েছেন ধ্বনিপ্রধান। রবীন্দ্রনাথ নামকরণ করেছিলেন সংস্কৃত ভাঙা ছন্দ বা বজ্রবুলি-ভাঙা। মূলত, রবীন্দ্রনাথই মাত্রাবৃত্ত ছন্দের প্রকৃত প্রবর্তক। রবীন্দ্রনাথ তার ‘মানসী’ কাব্যে এ ছন্দের প্রয়োগ করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথ নাম দিয়েছিলেন হৃদ্যা। সুধীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছিলেন মাত্রিক। কালিদাস রায় নাম দিয়েছিলেন স্বরমাত্রিক। এ ছাড়া একে বিস্তারপ্রধান ও ধ্বনিমাত্রিক ছন্দ বলা হয়ে থাকে। আর স্বরবৃত্ত ছন্দকে প্রবোধচন্দ্র সেন আরেকটি নাম দিয়েছিলেন দলবৃত্ত ছন্দ।
১৮–১৯ শতকে বাংলা সাহিত্যে একটি নতুন ধারা শুরু হয় — ছন্দবিচ্যুতি, অমিত্রাক্ষর ছন্দ ও মেট্রিক বিভাজন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন করেন। অমিত্রাক্ষর ছন্দ ছেদ স্থাপন, পর্বসাম্য ভঙ্গ ও ছন্দনিয়মের অবশেষ পরিবর্তনের পথ খুলে দেয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছন্দচর্চায় এক নতুন অধ্যায় রচনা করেন। তিনি মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত ছন্দের স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত করেন এবং ছন্দে রূপশাসন ও ভাবপ্রকাশের সঙ্গম ঘটান। তাঁর পদ্যগুলিতে কখনও ছন্দের নিয়মের ব্যাপক ভঙ্গ লক্ষ্য করা যায়—অর্থাৎ ‘মুক্তক’ ছন্দ বা ছন্দহীনতাজনিত ধরণ। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম (নজরুল), স মুক্তকথা (মুক্তকবিতা) প্রভৃতি ধারার কবিরা ছন্দের গতিধারাকে আরও প্রসারিত করেন। নজরুলের কবিতায় ছন্দ ও তাল কখনও খুব নমনীয় হয়ে উঠে, কখনও কঠোর ধাঁচে।
বিংশ শতকের শেষে ও একবিংশ শতকের শুরুতে বাংলা কাব্যে ছন্দের প্রতি মনোভাব আরও নমনীয় ও বিচ্ছিন্ন হয় — অনেক কবি আংশিক ছন্দ, রসালি ক্রম, মুক্তছন্দ প্রভৃতি রূপে গমন করেন।


বর্তমান বাংলা কবিতায় ছন্দ এবং ছন্দবিচ্যুতি একত্রিতভাবে দেখা যায়। অনেক কবিতা তেমন কঠোর ছন্দে বাধা না থেকে ছন্দের আভাস বা ছন্দের ছোঁয়া রাখে। ছন্দহীন (free verse) কবিতাও সাধারণ হয়েছে।
কিন্তু “মুক্তক” ধারা বাংলা কাব্যে প্রবল প্রভাব ফেলেছে — যেখানে ছন্দ নিয়ন্ত্রণ কম, ভাবপ্রবাহ ও ভাষার অভিব্যক্তি প্রাধান্য পায়। আবার কেউ কেউ ছন্দকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত ও উদ্ভাবন করছেন — যেমন অপ্রত্যাশিত ছন্দ, ছন্দিত গতি বা দেহমূল ছন্দ।
সারাংশে, বাংলায় ছন্দচর্চার বিকাশ একটি “কাঠি ভাঙা” ধরণের বিবর্তন — প্রথাগত ছন্দ থেকে উদ্ভাবনী ছন্দের দিকে ধাপে ধাপে সরে আসা।

কোনো শৈল্পিক উপাদানই নিজে নিজে বিবর্তিত হয় না — সে বিবর্তন ধাপে ধাপে বিভিন্ন বাহ্য ও অভ্যন্তরীণ কারণ দ্বারা প্রভাবিত  হয়। ছন্দের ক্ষেত্রেও তেমনই।


প্রতিনিয়ত ভাষায় ধ্বনির গতি, স্বরের পরিবর্তন ঘটে। নতুন উচ্চারণ রীতি, আঞ্চলিক প্রবণতা, ধ্বনিসমূহের পরিবর্তন ছন্দ কে প্রভাবিত করে।

শুদ্ধ উচ্চারণ থেকে কথ্য উচ্চারণে স্থানান্তর ছন্দের সীমা পরিবর্তন ঘটায়।

শব্দ সংকোচন, ধ্বনিভ্রংশ, ধ্বনি সংযোজন ইত্যাদি ভাষাগত প্রক্রিয়া ছন্দের নির্ধারক ধারা পরিবর্তন করে।


যেসব যুগে ভাব-গভীরতা ও উদ্ভাবন বেশি, ছন্দ তার নিজেকে অভিযোজিত করে — কখনো ছন্দকে নমনীয় করে, কখনো ছন্দের গঠনকে পরিবর্তন করে।

আধুনিক কবিতা ঘিরে যে “অপ্রথাগততা ও স্বাধীনতা” আকাঙ্ক্ষিত হয়েছে, সে কারণে কিছু কবি ছন্দবিচ্যুতি গ্রহন করেছেন।

পাঠকের মনোভাব পরিবর্তন — পাঠক আজ কঠোর ছন্দরূপে আবদ্ধ থাকতে চায় না; কবিতার ভাবকে যদি ছন্দে সীমাবদ্ধ করা যায় না, তা ছাঁটাই বা ছন্দবিচ্যুতি প্রাধান্য পায়।


প্রতিটি যুগের কবি নতুনত্ব সাধনায় আগ্রহী — তাঁরা নতুন ছন্দ, ছন্দবিদ্রোহ, ছন্দবিচ্যুতি ইত্যাদির সন্ধান করেন।

ছন্দপ্রকাশ ও ছন্দবিচ্যুতির সংবর্ধনায় সাহিত্যিক চর্চা ও আলোচনা — যেমন ছন্দবিমর্ষ, ছন্দনিয়োগ বিশ্লেষণ — একটি সংস্কৃতিগত পরিবেশ তৈরি করে।

ভাষা ও কাব্যতত্ত্বের নতুন আলোচনায় ছন্দপ্রথম ধারা পুনর্বিবেচিত হয় — যেমন ধ্বনিতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব ও সাইবর্গ বিশ্লেষণ।


মুদ্রণ প্রযুক্তির প্রসার, কবিতার পাণ্ডুলিপি, সম্পাদনা প্রক্রিয়া — এ সব প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ছন্দচর্চাকে প্রভাবিত করে।

সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, অনলাইন প্রকাশনা যেখানে পাঠক তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা পড়ে, এমন পরিবেশে দীর্ঘ কঠোর ছন্দের আবেদন কম হতে পারে।

ডিজিটাল মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া ও দ্রুত পাঠশৈলীর যুগে ছন্দকে সংক্ষিপ্ততা ও অভিব্যক্তিমুখী হিসেবে বিবর্তিত হতে হয়।


সমাজের দ্রুত পরিবর্তন, শহুরে জীবনের গতি ও অস্থিরতা ছন্দকে নমনীয় করতে বাধ্য করে।

বিশ্ব সাহিত্যের ছন্দ রীতি (উদাহরণস্বরূপ, ইংরেজি, ফরাসি ছন্দ) বাংলা সাহিত্যে প্রভাব ফেলেছে, ফলে কিছু কবি আন্তর্জাতিক ছন্দ বিন্যাস অনুকরণ করছেন।

ভাষার বিনিময় ও সংস্কৃতিগত সংযোগ (যেমন লোকসংগীত, গান, বৈশ্বিক কবিতা) ছন্দচর্চায় নতুন দৃষ্টিকোণ আনছে।

এই কারনে মিলিতভাবে ছন্দের ধরণ পরিবর্তন ও বিবর্তনের প্রক্রিয়া চালায়।


নিচে ছন্দ বিবর্তনের একটি সম্ভাব্য ধাপ-রূপ রূপায়ণ দেওয়া হলো:

প্রচলিত ছন্দচর্চা
→ কবি নির্ধারিত ছন্দ নিয়ম (যেমন পয়ার) মেনে কাজ করে।

ছন্দবিচ্যুতি শুরু
→ কখনো এক বা দুই ধরণের ছেদ, অনুগামী ভঙ্গ, যতির পরিবর্তন।

আংশিক ছন্দহীন উপাদান যুক্ত
→ কিছু অংশ কঠোর ছন্দের অধীনে, অন্য অংশ ছন্দবিচ্যুতিতে।

নতুন ছন্দ উদ্ভব
→ ছন্দবিদ্বেষী ছন্দ, অমিত্রাক্ষর ছন্দ, দেহমূল ছন্দ ইত্যাদি।

মুক্তছন্দ (Free Verse / স্বল্প ছন্দ)
→ ছন্দের বাধা অনেকখানি খোলস সংকুচিত হয়, ভাবপ্রবাহ ও গতি প্রাধান্য পায়।

ছন্দ ও ছন্দবিচ্যুতি সঙ্গম
→ ছন্দর পরিবর্তন মাঝে মাঝে ছন্দের “আভাস” রেখে যায়; ছন্দ ও মুক্তগতি একসাথে কাজ করে।

এই ধাপগুলি কখনো স্পষ্টভাবে আলাদা থাকে না — একটি কবিতায় একাধিক ধাপ একসাথে কাজ করতে পারে।

অমিত্রাক্ষর ছন্দ — যার ধমনীয় সীমাবদ্ধতা থাকে না, যা মধুসূদন দত্ত প্রবর্তন করেন।
মুক্ত ছন্দ / অংশমুক্ত ছন্দ — যেখানে ছন্দাঠ রূপে সম্পূর্ণ নিয়ম থাকে না, তবে ছন্দের ছোঁয়া থাকে।

নবছন্দ / আধুনিক ছন্দ — যেমন অসম ছন্দ, যত্রতত্র ছেদাবলম্বন, ছন্দের গতি পরিবর্তন, ছন্দবহির্ভূত বাক্য বিন্যাস ইত্যাদি।


কিছু কবি এখনও নির্দিষ্ট ছন্দ (যেমন পয়ার, অক্ষরবৃত্ত) বজায় রেখে কাজ করেন, কিন্তু সেই ছন্দকে পরিবর্তন ও নমনীয়তা দিয়ে প্রয়োগ করেন।

অনেক কবি ছন্দকে মনে রেখেই লিখেন, কিন্তু ছন্দকে বাধ্য না করে — অর্থাৎ ছন্দ থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে — এই রকম নমনীয় শৈলী গ্রহন করছেন।

ছন্দবিচ্যুতি, অমিত ছেদ, গতি পরিবর্তন, উচ্চারণচালিত ছন্দ — এসব ব্যবহারে সমসাময়িক কবিতায় ছন্দের নতুন দিক দেখা যাচ্ছে।

ছন্দ এবং ছন্দহীনতার মেলবন্ধন: কবিতার মধ্যে কোথাও ছন্দ থাকবে, কোথাও ছন্দবিচ্যুতি থাকবে — এই সন্নিবেশশৈলী আজ প্রায় প্রবণ।

ছন্দবিচ্যুতি অত্যধিক হলে পাঠক বিভ্রান্ত হবে — ছন্দহীনতা বা ছন্দবিচ্যুতি অতিরিক্ত থাকলে কবিতার শিলাসত্তা হারাতে পারে।
ছন্দ ও ভাবপ্রকাশের দ্বন্দ্ব — কখন ছন্দ নিয়ন্ত্রণ বেশি করলে ভাবপ্রকাশের পথ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
উচ্চারণ বৈচিত্র্য — বাংলা উচ্চারণের আঞ্চলিকতা ও পরিবর্তন ছন্দচলনকে ঝঞ্ঝাটপূর্ণ করে দেয়।

শিল্প-মান বজায় রাখা — নতুন ছন্দ উদ্ভাবন করলে তার সৌন্দর্য, সান্দ্রতা ও শৈলুমান বজায় রাখতে হবে, নতুবা ছন্দ হতে ছিন্নভাব হয়ে যেতে পারে।

আলোচনা ও গ্রহণযোগ্যতা — নতুন ছন্দ যতই সৃজনশীল হোক, পাঠক ও সমালোচক গ্রহণ করবেন কি না, সেটি একটি চ্যালেঞ্জ।


ছন্দবিহীনতা কখনো ছন্দহীণতা নয় — নতুন ও সৃজনশীল ছন্দবিচ্যুতি কবিতাকে উন্মুক্ত করতে পারে।

নতুন ছন্দ উদ্ভাবনে ছন্দের অভ্যন্তরীণ সঙ্গতি ও বাহ্যিক ছন্দের ছোঁয়া দুইই রাখতে হবে।

ছন্দ ব্যবহার করলে পাঠককেন্দ্রিক ভাব ও ভাষাগত সাবলীলতা বজায় রাখা যাওয়া উচিত — অর্থাৎ ছন্দকে নিজেই বেছে নেয়া, ছন্দকে বাধ্য না হওয়া।
ছন্দ বিশ্লেষণ, ছন্দ–ব্যবহারের ইতিহাস পড়া ও অনুশীলন সত্যিই জরুরি — ছন্দের বিবর্তন বোঝার জন্য।

কবিতায় ছন্দের পরীক্ষা ও পরিবর্তন গতি ধীরে-ধীরে করা উচিত — বড় পরিবর্তন একবারে না, ধাপে ধাপে।
আধুনিক প্রযুক্তি (যেমন শব্দ বিশ্লেষক, ডিজিটাল কবিতা প্রকাশ মাধ্যম) ব্যবহার করে নতুন ছন্দ পরীক্ষা করা যেতে পারে।


কবিতা লেখার ক্ষেত্রে ছন্দ বিবর্তন একটি গভীর ও রূপান্তরমূলক প্রক্রিয়া। প্রথাগত ছন্দ থেকে শুরু করে ছন্দবিচ্যুতি ও নতুন ছন্দের দিকে যাত্রা, বাংলা কাব্যে এটি ইতিমধ্যে বিস্তৃতভাবে ঘটেছে। ছন্দ শুধু নিয়ম নয় — এটি অনুভূতির গতি, ভাষার চাপ ও শ্বাসের ঘূর্ণি। ছন্দের বিবর্তন কবিতা ও ভাষা—উভয়কেই নতুন দিক এনে দেয়, নতুন সম্ভাবনা তৈরি  করে।
তথ্যসূত্র;-

১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছন্দ ও গীতিকার রীতি, বিশ্বভারতী প্রকাশন, শান্তিনিকেতন, ১৯৪০।

২. মাইকেল মধুসূদন দত্ত, চণ্ডীদাসের পদ ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৮৬১।

৩. সুকুমার সেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড), আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৭৮।

৪. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, চর্যাগীতি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, কলকা↓ ৯১৬।


৫. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, ছন্দ ও কবিতা, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স, ১৯৫৫।

৬. সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, ছন্দ-বিচার, কলকাতা, ১৯৩০।

৭. ড. মুহম্মদ এনামুল হক, বাংলা ছন্দতত্ত্ব, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, ১৯৮৫।

৮. অমলেন্দু বিশ্বাস, আধুনিক বাংলা ছন্দ চর্চা ও তার বিবর্তন, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০০২।

৯. ড. মোহিতলাল মজুমদার, ছন্দ ও কাব্যরীতি, বিশ্বভারতী গ্রন্থাবলী, ১৯৬২।



ছোটগল্প

ফেরা
শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়


বাইরে কলিং বেল এর আওয়াজ শুনে অরূপ বাবু চায়ের কাপটা রেখে বেরিয়ে এসে দেখেন, 
একজন কোট প্যান্ট পড়া, লম্বা চওড়া, টকটকে ফরসা, সুদর্শন চেহারার ভদ্রলোক সদর দরজার সামনে  দাঁড়িয়ে তার দিকে হাসিহাসি মুখ করে তাকিয়ে আছেন। চশমার রোল গোল্ডের ফ্রেমের মতোই বড় উজ্জ্বল চোখদুটো। 
' তুমি অমিয় মেশোমশাইয়ের বড় ছেলে তো? চিনতে পারছো? অবশ্য না চেনারই কথা..।'
ভদ্রলোকের বয়স হলেও গলার আওয়াজ তাঁর চেহারার মতোই বেশ সফিস্টিকেটেড,সুরেলা, গাম্ভীর্যপূর্ণ। কথাগুলো এমন কায়দা করে বলা, যে শুনলে মনে হবে বোধহয় উনি বাঙালি নন। কিন্তু এই মূহুর্তে সত্যিই ঠাওর করতে পারছেন না অরূপ বাবু, মাথার কিয়দংশ জুড়ে পক্বকেশ, বৃহদাংশে টাক পড়ে যাওয়া, হাতে অ্যাটাচি কেস নেওয়া, সুটেড বুটেড এই ভদ্রলোকটি কে? অথচ উনি শুধু তাকেই নয়, বাবাকেও চেনেন।
' না, মানে ঠিক আন্দাজ করতে পারছি না..।'
 ' গৌর দাকে ভুলে গেলে? সেই কাঁচরাপাড়ার রজনী বাবু রোডের গৌরমোহন চাটুজ্যে..। '
আর বলতে হবে না। এতদিন, এতবছর পর কোত্থেকে এলেন গৌরদা?
' চেহারা তো অনেক বদলে গিয়েছে আপনার...! '
' বদলে গিয়েছে? কিরকম..এই টাকটা দেখে?'
গৌরদা হাসছেন। 
' না, মানে যখন আপনাকে দেখেছিলাম, তখন তো অনেকটা ইয়াং..। '
' পরিবর্তন তো হবারই কথা ভাই। কতো বছর পর আবার দেখা। আমি কিন্তু ঠিক চিনেছি তোমাকে। যতই লং ওয়ে দিয়ে জার্নি করে আসি না কেন..। '
' তা আপনি এতদিন ছিলেন কোথায়?'
' লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্ক... কাজের সূত্রে আজ এখানে তো কাল সেখানে। আফটার রিটায়ারমেন্ট  অবশ্য ইউ এস এ তেই রয়েছি পারমানেন্টলী। হিউস্টন। বাড়িতে অনেক নতুন মেম্বার দেখছি..।'
' তা ঠিক। সংসার এখন অনেক বড়। বিশেষ করে এই মূহুর্তে...। '
অরূপ বাবুদের যৌথ পরিবার। নতুন, পুরনো সদস্য মিলিয়ে সংখ্যাটা নেহাৎ একেবারে কম নয়। সামনে দাঁড়ানো অরূপ বাবুর স্ত্রী রীণা কিংবা ভাইয়ের বৌ স্নেহার মুখে লেগে থাকা সৌজন্যের হাসিটুকুতে স্পষ্ট অনেক কাল আগে দেখা মানুষটার ছবি এতদিনে মনে না থাকলেও বিভিন্ন সময়ে ওঁকে কেন্দ্র করে এ বাড়িতে যেসব আলোচনা বা গল্প হয়েছে, তাতে করে ভদ্রলোক যে ওদের কাছে অপরিচিত, তাও নন। এর বাইরে বাড়ির নতুন সদস্য বলতে বউমারা। ওরা নেহাৎই সেদিনের।

এখন যে ঘরে টিভি রয়েছে, সেটা বর্তমানে এ বাড়ির বড়ো বৈঠকখানা ঘর। রাস্তার পাশে আরেকটা ছোটো ড্রয়িং রুম আছে বটে, সেটা নেহাৎই অপরিচিত বাইরের লোকেদের বসবার জন্য। 
উপস্থিত নতুন সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে বড়ো বৈঠকখানার নরম কুশানে হেলান দিয়ে ঘরের চারিপাশটার দিকে তাকিয়ে গৌরদা জিজ্ঞেস করলেন,' আসল মানুষটাকেই তো দেখছি না..মেশোমশাই কোথায়? '
দেওয়ালে টাঙানো বাবার ছবিটার দিকে হঠাৎই চোখটা আটকে গেল তাঁর। লক্ষ্য করেন নি আগে। 
অরূপ বাবু থমকে গেলেন। 
' বাবা তো মারা গেছেন। '
' কি..!'
কথাটা যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠলো ঘরের আনাচে-কানাচেতে। 
' কবে?'
' নাইনটি টু..।'
' ওঃ গড! আমি লাস্ট যেবার অসলো থেকে এসেছিলাম,তখন মেশোমশাই অসুস্থ ছিলেন দেখেছি। ওখানে একটা ছোটো খাট ছিল। শুয়ে শুয়েই গল্প করলেন কত...এখানে এই ঘরে। ছবিটা দ্যাখো, ঠিক আগের মতোই হাসছেন যেন।'
বাবার সময় থেকেই বাড়িতে চেনা পরিচিত, আত্নীয় স্বজন এলে সবার আগে এ ঘরেই বসতো। বাবা ছিলেন যেমন হাস্যরসিক, তেমনি গল্পপ্রিয় মানুষ। লোকজন এখনো এলে এ ঘরেই বসে। শুধু বাবাই নেই। বাবা, মায়ের পুরনো খাটটাও আর নেই। ঘূণ ধরে কাঠ নষ্ট হয়ে গেছে অনেক দিন।
' মাসীমা কোথায়? '
' মা ও শয্যাশায়ী। অনেক দিন হয়ে গেল। এই সময়টায় উনি ঘুমোন। আপনি শেষ দেখে গিয়েছিলেন..তিরিশ বছর হতে চললো। সময়টা তো কম নয় গৌর দা। কতো কি পাল্টে যেতে পারে। কতো কি হারিয়ে যেতে পারে। এই দেখুন না, কখনো কি ভাবতে পেরেছি একদিন আপনাকে দেখেই চিনতে পারবো না? তবে এতবছর পরেও এই যে মনে করে এসেছেন, সত্যিই ভালো লাগছে! একটু পরে আপনাকে  মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনবো। শি ইজ নাইনটি থ্রি। উঠতে পারেন না। স্মৃতিশক্তি, বাকশক্তি অনেকটাই লোপ পেয়েছে। বার্ধক্য। সবার জীবনেই একদিন আসবে। তবু মা যে এখনো রয়েছেন, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। '
' ইয়েস। গ্রেট পিলার অফ এ ফ্যামিলি।'
ভিনদেশী কায়দায় উচ্চারণ। হয়তো এসে পড়েছে সময়ের সাথে সাথে। গৌর দা ঘরটার দিকে তাকিয়ে থাকেন। নিজের মনেই বলেন,' সময়। টাইম। ইট'স এ হার্ড রিয়ালিটি। আমাদের ও বাড়িটা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ফ্ল্যাট হবে। দিয়ে দেওয়াই ঠিক করলাম। কে থাকবে..বাবা নেই, মা নেই... কবছর আগে বড় দাও চলে গেছেন। বড় দার ছেলে মেয়েরা সব যে যার বাইরে...কেউ চাকরি সূত্রে, কেউ বিবাহ সূত্রে...। এখানে থাকার মধ্যে শুধু ছোটো ভাই দীপ্তেশ। ও ফ্ল্যাটের একটা পোর্শান ডিম্যান্ড করেছে। আমার অবশ্য বড়,ছোটো কোনো পোর্শানই দরকার নেই। ওদেশে থেকে এদেশের প্রপার্টি সামলানো যে কতটা মুশকিল...! ফ্ল্যাট কিনে ভাড়া বসাবো..সে যে গেড়ে বসবে না, তার গ্যারান্টিই বা কোথায়.... শুনেছি এসব নিয়ে আইনি লড়াই এ দেশে হামেশাই হয়ে থাকে..এতদিন ব্যারিস্টারী করে আর এসব ঝামেলায় যেতে ভালো লাগে না..তাই ডিসাইড করলাম...।'
রীণা প্লেটে করে চা নিয়ে এলো। সঙ্গে স্ন্যাক্স। স্নেহার হাতে আর একটা প্লেট। তাতে মিস্টি।
অরূপ বাবু তাকিয়ে আছেন গৌর দার মুখের দিকে। মনটা অন্যমনস্ক যেন। 
' সুবিমল দাও মারা গেলেন। আমরা তখন কত ছোটো। ও বাড়িতে থাকতাম। ভাইকে, আমাকে একসঙ্গে বাজারে নিয়ে যেতেন সাইকেল চড়িয়ে। এখনো মনে পড়ে। আপনি তাহলে এদেশে আর আসবেনই না দাদা? '
' তা কে বলতে পারে বলো। প্রপার্টি ছেড়ে দেওয়া আর এমনি বেড়াতে আসা, দুটো তো এক জিনিস নয়। ইমফ্যাক্ট বাড়ি বিক্রির কথা নিজে থেকে কখনো চিন্তা করিনি৷ প্রস্তাবটা যখন এলো, তখন ভেবে দেখলাম ঠিকই, বাবার তৈরি করে যাওয়া এতো বড় বাড়িটা মেনটেনেন্সের অভাবে দিন দিন ভেঙে পড়ছে। কে এসব দেখাশোনা করবে। লোক কই। ছোটো ভাই নিজেই ও বাড়ি প্রোমোটারকে দিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। ভাইপোটার তেমন কিছু হলো না। ওর নিজেরও ব্যাবসায় টানাটানি। তাছাড়া উইলো, মানে আমার স্ত্রী, সে এদেশে আসবে না। আমার ছেলে রিহান কানাডায় সেটল। এখানে আমার তো কোনো পিছুটান নেই। মেশোমশাই, মাসীমার কথা খুব মনে পড়ছিল। ভাবলাম এসেছি যখন দেখা করেই যাবো। আসল মানুষটাই যে চলে গেছেন ভাবতে পারিনি।'

অরূপ বাবুর চোখের সামনে ভাসছিল ছবিগুলো....।
গৌর দার বড় দাদা সুবিমল দার ছোটোখাটো শ্যামলা চেহারাটা, ছোটো ভাই দীপ্তেশ আর অরূপ বাবুর একসাথে হাত ধরাধরি করে স্কুলে যাওয়া, বিকেলে ছুটির পর দুজনে মিলে কত খেলাধুলা, ছুটোছুটি, ছুটির দিনে সন্তোষ মেশোমশাই( গৌরদার বাবা) আর বাবা মিলে ঘন্টা কে ঘন্টা চিঁড়েভাজা খেতে খেতে ঘরে বসে আড্ডা দেওয়া, বাড়িতে মক্কেলদের আনাগোনা, দুপুর বেলায় উঠোনে বসে মাকে কৃত্তিবাসী রামায়ণ পড়ে শোনানো শ্যামলী দির(গৌরদার মা), তারপর একসময় ও পাড়া ছেড়ে চলে আসা...বিচ্ছিন্নতা মানুষকে কত দূরে ঠেলে দেয়... বাবা আর মেশোমশাই - দুই বাড়ির দুজন মধ্যমণি... আজ কোথায় চলে গেছেন তাঁরা...জীবনের প্রান্তে সরে গেছে সেই সব অনাবিল আনন্দের দিন... যে সময়টা আর কখনো ফেরার নয়।
 অরূপ বাবুর পুত্রবধু তুহিনা আর  ছোটো ভাইপোর বৌ রীণি দুজনে বসে বসে শুনছিল গৌরদার কথা। কাঁচরাপাড়া রজনী বাবু রোডের একসময়কার পড়শী অধুনা ভিনদেশী এই সৌম্যদর্শণ মানুষটিকে ঘিরে তাদের চোখে মুখে যেন এক অজানা কৌতুহল। 
অরূপ বাবুর মনে তখন অন্য এক কৌতুহল ঘোরাফেরা করছিল। জিজ্ঞেস করলেন,' আচ্ছা গৌরদা, আমাদের ও বাড়িটা কি সেই একই রকম আছে? বেশ কয়েক বছর আগে কি একটা কাজে ওদিকে গিয়েছিলাম। বাড়িটার সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে দেখি ঘর থেকে আলো জ্বলছে। হয়তো অন্য কেউ এখন থাকে। কত হাত যে বদল হলো...। তবু বাড়ির চেহারাটা একই রকম রয়ে গেছে। এমনকি দেওয়ালের গায়ে লাল রংটা পর্যন্ত।  পাশে সেই লাইটপোস্টটা...সিমেন্টের বাঁধানো সুড়সুড়ি...আর তার পাশে বীরেশ্বর দাসের সেই পড়ে থাকা ভাঙা বাড়ি... ছোটোবেলায় যেমন দেখেছি এখনো তাই...। '
চায়ের খালি কাপটা পাশে সরিয়ে রেখে গৌরদা বললেন,' আমাদের বাড়ি সমেত টোটাল ঐ জায়গাটাই প্রোমোটারের হাতে যাচ্ছে। শুনলাম একটা হাউজিং কমপ্লেক্স তৈরি হবে। কয়েক দিনের মধ্যেই কাজ শুরু হচ্ছে। কে করছে জানো? বীরেশ্বর দাসের নাতি। সে নাকি এখন বড় প্রোমোটার। কলকাতাতেও প্রোমোটিং ব্যাবসা শুরু করেছে। '
অরূপবাবু এসব জানেন না। জানার কথাও নয়।অবাক হয়ে বললেন,' তাই নাকি? কি আশ্চর্য দেখুন...দুই বাড়ির মধ্যে এতদিনের মিলমিশ, ঘনিষ্ঠতা...আর আজ দুটো বাড়িই একইসাথে...কতকালের সব ইতিহাসের স্বাক্ষী.. মুছে যাবে সম্পূর্ণ। '
গৌরদা মাথা নাড়লেন।
' তবে কি জানো, আমাদের আশপাশের ঐসব পুরনো, ড্যাম্প ধরা,সিমেন্ট রং খসে পড়া,দেওয়ালের ফাটল দিয়ে গাছপালা গজিয়ে ওঠা ঘরবাড়ি গুলোকে যখন দেখি তখন ভাবি মানুষ গুলো কী করে বাস করে এখানে! ফ্ল্যাট হলে হয়তো বেঁচে যাবে ওরা। তারপর ধরো বীরেশ্বর দাসের ঐ অর্ধসমাপ্ত হয়ে পড়ে থাকা বাড়িটা আর তাকে ঘিরে ঐ অতোবড়ো জমি.. একেবারে জঙ্গল হয়ে পড়ে আছে। একটা গার্বেজ হয়ে উঠেছে। শুনেছি ওয়ারিশান নিয়ে ঝামেলার কারণে বাড়িটা ঐ অবস্থাতেই রয়ে গেছে। হয়তো এবার জায়গাটার চেহারা বদলাবে। কিছু ভাবছো নাকি?'
' না, হয়তো আপনি ঠিকই বলেছেন। তবু অনেককালের স্মৃতি তো...।'
' অফকোর্স। চলবে নাকি?'
গৌরদার হাতে বিদেশি ব্র্যান্ডের কিং সাইজ সিগারেট। 
' আরে নাও, নাও। রিটায়ার করে গেছো, এখন আবার সঙ্কোচ কিসের। এ জিনিস এখানে বিশেষ পাবে না। পেলেও হয়তো ডুপ্লিকেট। এদেশ থেকে আমদানি করা এই একটা অভ্যেস এখনো ছাড়তে পারিনি ভাই..। '
সাহেবি কায়দায় সিগারেট ধরিয়ে, জানলা দিয়ে ধোঁয়াটা বাইরে বের করে গৌরদা বললেন,' জানো, নানারকম মেমোরিস আমাকেও মাঝেমাঝে ঘিরে ধরে। হন্ট্ করে। হিউস্টনে নিজের কটেজে একা একা বসে এসব নিয়ে যখন ভাবি...প্যাথোস,হ্যাপিনেস,আন হ্যাপিনেস..ফিলিংস গুলো যেন নিজের মতো করে নাড়া দিয়ে যায় মনকে। চল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বিদেশে রয়েছি, হয়তো আরো কত বছর কেটে যাবে...তাই বলে দেশের কথা ভুলে যাই কী করে বলো? উইলো কিংবা আমার ছেলে রিহান..ওরা তো আর এতো কিছু বুঝবে না...এ দেশ কিংবা এসব সেন্টিমেন্টের দিক থেকে ওরা একেবারেই ব্লাইন্ড। আমার তো বয়স হচ্ছে..এনার্জি লেভেল কমে আসছে...অ্যাট লাস্ট যদি আর নাই আসা হয় এদেশে.. হয়তো সেরকম কোনো একটা ফিলিংস..তার টানেই তোমার এখানে চলে আসা..।'
' তবু আমাদের দুই বাড়ির সেই আগের আনন্দের দিন গুলো আর ফিরবে না দাদা। কত মানুষ হারিয়ে গেছে।  যারা আছে তারাও নানান পরিস্থিতির মধ্যে বাস করছে। এই ধরুন না দীপ্তেশকেই... বুঝতে পারছি ওর আজকের অবস্থা..।'
গৌর দা এবার কিছুটা গম্ভীর। 
' ওকে প্রোপোজাল দিয়েছিলাম, ছেলেটাকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দে। যা হোক লেখাপড়া শিখেছে; নিজের পায়ের মাটি শক্ত করার মতো কিছু একটা  কাজ ঠিক পেয়ে যাবে। যতদিন না এস্টাব্লিস্ট হচ্ছে, আমার কাছেই না হয় থাকবে। তখন শোনেনি। ভেবেছিল নিজের দোকানটাই ছেলের ভবিষ্যৎ। ছেলেরও সায় ছিল বাবার দিকে। বিদেশ মানেই ইনসিকিওরিটি, এরকম একটা ধারণা। কূপমণ্ডূক হয়ে  সেই তো ঘরেই বসে থাকলো আর কি..। তাহলে আর লেখাপড়া শিখে অ্যাদ্দিন টাইম ওয়েস্ট করার দরকার কি ছিল..।  এখন অবস্থার গতিকে মত পালটেছে। কিন্তু এই মূহুর্তে  ওদেশে আউটসোর্সিং এর দরজা অনেকটাই বন্ধ হয়ে গেছে। বিদেশিদের জন্য মার্কেট বলতে গেলে স্যাচুরেটেড। সবই তো জানো...খবর তো রাখো। এমনিতে এখন গিয়ে তেমন কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। তবু চেষ্টা করে দেখবো যদি কোনো কাজের ব্যাবস্থা করা যায়। জানি না কতটা কি পারবো। তবে পার্সোনাল ফিলিংস থেকে বলতে পারি, বেকার অবস্থায় এখানে পড়ে থেকে একসময় যে লাইফ লিড করেছি, অ্যাট দিজ টাইম মোটামুটিভাবে আমি সবদিক থেকে সিকিওর্ড, এটুকু বলতে দ্বিধা নেই। হয়তো ঠিক সময়ে ঠিক ডিসিশনটা নিয়েছিলাম বলেই আজকে...বাবার এনকারেজমেন্ট, নিজের অ্যাম্বিশান, সবটাই কাজে লেগে গেছে। বসে থাকলে তো আর চলবে না ভাই। '
কথাটা ভুল নয়। আবার অনেকটাই ভুল। নৈহাটি কলেজ থেকে সাধারণ ভাবে বি.কম পাশ করা একটি ছেলে বাবার টাকার জোরে একদিন বিদেশে ব্যারিস্টারী পড়তে চলে গিয়েছিল। জীবনে এরকম সুযোগ সবার আসে না। অ্যাম্বিশান তো অনেকেরই থাকে। কথাগুলো মনে হলো অরূপ বাবুর। কিছু বললেন না।
গৌর দা বলে চলেন; জীবনের প্রান্তে এসে পড়া একজন অ্যাপারেন্টলী হ্যাপি,এজেড মানুষের মতো...। ' কি জানো, লাইফের একটা রিদম আছে। সে তার নিজের মতো করে এগিয়ে যেতে চায়। ধরো না, তোমাদের আজকের এই জয়েন্ট ফ্যামিলি..কত নতুন মেম্বার..এই যে বন্ডিং গুলো,এটাই আজকের রিয়ালিটি। এক একটা সময় তার একেক রকম টেস্ট..। মানুষ যদি এর স্বাদই না পেল, তাহলে তার এক্সজিসটেন্স কোথায়? অনেকটা আমাদের পাশের পুরনো ভেঙে পড়া বাড়ি গুলোতে যুগ যুগ ধরে বসবাস করা ঐ লোকগুলোর মতো..জীবন যেন থেমে গিয়েছে একটা স্ট্যাটিক জায়গায় এসে..যেন বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়ির কাঁটা..একটা স্ট্যাগন্যান্ট পজিশান...। তবে এটা বলতে পারি, বাড়ি বিক্রি করে দীপ্তেশ যদি আজকে কোনো নতুন ওয়ে আউট খুঁজে পায়, সেটা পারমানেন্ট সলিউশান না হলেও ওর ছেলের জন্য একটা কাজের কাজ হবে।  অফকোর্স ফিনানসিয়াল সাপোর্টের দিক থেকে। ইনফ্যাক্ট ডিসিশানটা দীপ্তেশই প্রথম নিয়েছিল। ওর দিক থেকে হয়তো ও ঠিকই করেছে। একা একটা পুরনো বাড়ি নিয়ে কী করতো.. সবাই যখন কারণ সূত্রে সেপারেট হয়ে গেছে তখন আর...।'
কথাটা স্বীকার না করে পারলেন না অরূপ বাবু। যেমন  এটাও স্বীকার না করে পারলেন না, সংসারে আজ যাদের সঙ্গে তিনি জড়িয়ে রয়েছেন, সে আনন্দ কি কিছু কম? ' তুমি সত্যিই ভাগ্যবাণ অরূপ''...আজই বিকেলের আড্ডায় পার্কে বসে বলছিলেন গণেশদা। ভদ্রলোক মেয়েকে বিয়ে দেবার পর এখন স্বামী স্ত্রী মিলে একাই বাড়িতে থাকেন। অতো বড় দোতলা বাড়ি। জামাই ডাক্তার। দুদিন পর বিদেশে পাড়ি দেবে। আরো দূরে..। গণেশ দা নিজেও মোটা টাকা পেনশন পান। কোনোদিক থেকেই কোনো অভাব নেই। তবু' তুমি সত্যিই ভাগ্যবাণ অরূপ '... মনের মধ্যে লুকোনো কোনো এক্সপেকটেশন মূহুর্তের আবেগে হয়তো বেরিয়ে এসেছিল। 
গৌর দা   দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই কিরকম থমকে গেলেন।
' মেশোমশাইয়ের আমলের সেই গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা না? ওয়েস্ট অ্যান্ড ওয়াচ করপোরেশন। মেশোমশাইয়ের মুখে গল্পও শুনেছি, কীকরে সেকেন্ড ওয়াল্ড ওয়ারে বৃটিশ সোলজারদের ফেলে যাওয়া এই বিখ্যাত সুইস ঘড়িটা আর্মি ব্যারাক থেকে  হাত বদল হয়ে ওঁর হাতে চলে এসেছিল,সে কাহিনি। 
 মানুষটা আজ আর নেই। একটা বিরাট ভ্যাকুয়্যাম।ঘড়ির কাঁটা ঠিক এগিয়ে চলেছে... মেমোরিস নেভার গন্। আমার এই রোলেক্সও হয়তো আমার অ্যাবসেন্সে এ ঘড়ির মতো এতো কথা বলতে পারবে না...।'
 বেশ খানিকটা আশ্চর্য হয়েই বললাম,' সত্যিই আপনার স্মরণ শক্তির প্রশংসা না করে পারলাম না গৌর দা!'
উনি হেসে বললেন,
 ' সবই মনে আছে রে বাবা। শুধু বয়স আর সময়টাই পেরিয়ে এসেছি।' 
কি যেন ভাবেন গৌর দা। আস্তে আস্তে বলতে থাকেন,'যখন চলে যাবো এখান থেকে, রডোডেন্ড্রন, বোগেনভেলিয়া আর ইউক্যালিপ্টাসের ছায়ায় ঘেরা আমার সে কটেজে একাকী সে আমি আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে এন্ড অব দ্য ডে হয়তো এই স্মৃতি গুলোই পড়ে থাকবে গোচরে, অগোচরে। অনেকদিন আগেই ভেবে রেখেছিলাম  অখণ্ড অবসরের মুহূর্তগুলো বাজেভাবে ওয়েস্ট না করে এবার লিটারেচারে হাত দেবো। দুই দেশ,দু রকম অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ জীবন, তার চলাচল, গতিপ্রকৃতি...এসব নিয়ে লিখতে বসলে হয়তো একটা উপন্যাস হয়ে যাবে...একটু একটু করে শুরুও করেছি আমার সে বই...অ্যাট লিস্ট কিছু একটা তো দাগ থেকে যাবে পৃথিবীর বুকে...।' 
একটু অন্যরকম কৌতুহল বশতই জিজ্ঞেস করলেন অরূপ বাবু , ' আপনার ফ্যামিলি..?'
মৃদু হাসলেন গৌর দা। 
' আছে। ভালোই আছে। উইলোর কথা তো কিছুটা শুনলে। যখন ওর সঙ্গে আলাপ হয় তখন ও উইডো।বয়সে আমার থেকে বেশ খানিকটা সিনিয়র। নিজের পদবিই ব্যবহার করে। উইলো গোমস্। ওর মৃত হাসবেন্ড এর প্রপার্টি সংক্রান্ত কিছু মামলা মোকদ্দমার ব্যাপারে আমার ক্লায়েন্ট হিসেবে এসেছিল। সেখান থেকেই রিলেশন ডেভেলপ করে। ইনফ্যাক্ট আমি যেমন ওকে সাহায্য করেছি, উইলোও আমাকে এমন অনেক ব্যাপারে সাহায্য করেছে, যে কারণে আমি ওর কাছে কৃতজ্ঞ। ঋণী। পারমানেন্ট সিটিজেনশিপ পাওয়া থেকে শুরু করে, একটা সময় দায়িত্বপূর্ণ পদে থেকেও নিজের সিনিয়র, জুনিয়ার ফেলোদের দ্বারা বর্ণবৈষম্যের শিকার হওয়া একজন মানুষকে তার ক্রাইসিস পিরিয়ডে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে একমাত্র এই উইলো। সেদিন না ছিল নিজের প্রিয়জনেরা, না ভিনদেশী কোনো শুভাকাঙ্ক্ষী। ভেবেছিলাম চলে যাবো। নিজেকে ওদের মতো তো আর খাঁটি হোয়াইট চামড়া বানাতে পারবো না। কি লাভ এভাবে পরদেশে পরবাসী হয়ে পড়ে থেকে? কিন্তু সবকিছু ছেড়ে যাবোই বা কোথায়? আবার তো সেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে গিয়ে পড়তে হবে। পড়াশুনো কমপ্লিট করে ততদিনে ফ্লোরিডায় ইম্পিরিয়াল কোর্টে পাবলিক প্রসিকিউটরের  চাকরি করছি আমি। যাওয়াটা আর হলো না। উইলোই যেতে দিল না৷ আমরা বিয়ের সীদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। রিহান উইলোরই আগের ঘরের ছেলে। কালেভদ্রে তার ফ্যামিলির সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। ওদেশে আবার জানো তো, আফটার ম্যারেজ ছেলে মেয়ের নিজস্ব ফ্যামিলিতে প্যারেন্টস নট অ্যালাউড। ওরা আছে ওদের মতো করে।হয়তো ভালোই আছে। উইলোও তার মতো করে থাকতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। এখনো এই বয়সেও একটা মার্কিন এন জি ও সংস্থা নিজের হাতে চালাচ্ছে। প্রায় সারাদিনই ব্যস্ত থাকতে হয় ওকে। আমরা কেউ কারো লাইফে সেভাবে কখনোই ইন্টারফেয়ার করি না৷ আর ঠিক সেই কারণেই আমার একান্ত নিজস্ব  সেন্টিমেন্ট, চাওয়া পাওয়াগুলোর সঙ্গেও ওকে জড়াতে চাই না। কি জানি, হয়তো একটা ইনসিকিউরিটি...যেটা বোধহয় এ বয়সে আরো বেশি কাজ করে ভেতরে...পঁয়ত্রিশ বছরের পেশাদারি অভিজ্ঞতায় বহু ডিভোর্স কেস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছি...জীবনকে বেশি আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে সে নিজেই না শেষমেশ ছেড়ে চলে যায়.. এই লাস্ট স্টেজে এসে আর একটা যন্ত্রণার ধাক্কা...জানি না, মন হয়তো সত্যিই আর নিতে পারবে না...।'
কথা থামিয়ে অরূপ বাবুর পিঠে হাত রাখলেন গৌর দা। 
' আজ তাহলে উঠি। কি জানো ভাই, বয়স যত হয় আবেগ ততো বাড়ে। অনেক কথা বলে ফেললাম। কত দিন পর এভাবে গল্পও করলাম..!'
গৌর দার হাতে হাত রেখে অরূপ বাবু বললেন,' ওদের একবার দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। কখনোও যদি এদেশে আসে...।'
গৌর দার মুখে আগের মতোই সেই মৃদু হাসির একটুকরো রেশ যেন এখনো রয়ে গেছে। 
' সবাই কি আর আসতে চায় বলো? নাকি আসতে পারে? কেউ চায়, কেউ চায় না। কিংবা চাইলেও পারে না। তাছাড়া কেনই বা আসবে। এদেশে ওদের কিসেরই বা বন্ডিংস..। তবু তুমি বললে, ভালো লাগলো। সুইট হার্টের একটা ছবি অবশ্য আমার কাছে আছে। অল্প বয়সের। একা দূরে কোথাও গেলে ছবিটা সাথে করে নিয়ে যাই। বেশিদিন না দেখে থাকতে পারি না যে। দিনের শেষে যত্ন করে বানানো ব্ল্যাক কফির কাপটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে আমার কাঁধে হাতখানা রেখে যখন পাশে এসে দাঁড়ায়, অনেক পথ পেরিয়ে আসার পর তখন এটাই মনে হয়,আজ এই মুহূর্তে জীবনে পিছুটান বলে যদি কিছু থেকে থাকে সে আমার উইলো। ইনফ্যাক্ট, বই লেখার আইডিয়াটা উইলোই প্রথম আমার মাথায় ঢুকিয়েছিল। নিজের জন্য ব্যস্ত থাকায় আমাকে হয়তো সেভাবে সময় দিতে পারে না ও, কিন্তু আমাদের মতো সাব কন্টিনেন্টের ডিফারেন্ট কালচার সম্পর্কে জানতে  উইলো যথেষ্টই আগ্রহী। বিশেষ করে ও যে প্রফেশনের সঙ্গে যুক্ত, সেখানে দাঁড়িয়ে ডাইভার্স কালচারের মানুষের সঙ্গে ওকে ডিল করতে হয় হামেশাই। যে সোসাইটিতে ডিভোর্স,এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্স কিংবা লিভ টুগেদারের মতো কনসেপ্টগুলোর কাছে বিয়ে নামক ম্যারিটাল স্টেটাস ব্যাপারটা নেহাৎই গৌণ, সে সোসাইটিতে বর্ণ অ্যান্ড ব্রট আপ হয়েও উইলোকে আমি মেলাতে পারি না তার সঙ্গে, কিছুতেই পারি না। ও স্বাধীন চেতা, নিজের ডিসিশানে স্ট্রিক্ট..কিন্তু ভীষণভাবে সৎ। শ্রদ্ধা, রেসপেক্টের জায়গাটা এমনি এমনি কি আর তৈরি হয়...ইনফ্যাক্ট ক্যাথরিন আমায় যে জায়গাটা দিতে পারে নি, উইলো সেটাই... যাক সে কথা... বাই দি বাই, একবার মাসিমার সঙ্গে দেখা করে যাই। একদিন এসো আমাদের বাড়ি। ছবিটা দেখাবো। আমি এখন বেশ কয়েকমাস এখানে আছি। কাজ মিটিয়ে তবে ফিরবো।'
বেলা গড়িয়ে এসেছে। ঘরের জানলা দিয়ে কমলা বিকেলের খানিকটা আভা গৌর দার ডান হাতের অনামিকার আংটির পাথরের গায়ে বিচ্ছুরিত হয়ে ফিরে ফিরে যাচ্ছে বারবার, অন্য এক পথে। যে পথ মিশে গেছে অনেকদিনের অচেনা এক ধূলো মাখা পথের মায়াবি স্পর্শে..বেলা শেষের ছায়ার আড়ালে। 
' জীবনের লাস্ট স্টেজে এসে আর একটা যন্ত্রণার ধাক্কা... ' কথাটা আরো একবার কানে বেজে উঠলো অরূপ বাবুর। কী বলতে চাইলেন গৌর দা? উইলো জীবনে আসার আগে ক্যাথরিন নামক কোনো মেয়ের সঙ্গে তবে কি...জিজ্ঞাসা করা হলো না আর। সব কথা জিজ্ঞাসা করা যায়ও না।

' এ পরবাসে রবে কে হায়...' দোতলায় মৃণালিনী দেবীর  ঘর থেকে রেডিওতে গানের আওয়াজ ভেসে আসে। ঘুম থেকে উঠে শেষ বিকেলে এক মনে রেডিওতে গান শোনেন তিনি। অনেক দিনের অভ্যাস। রীণাই চালিয়ে দেয় রেডিওটা। গান শুনতে শুনতে চুল বেঁধে দেয় মায়ের। 
অরূপ বাবুর পেছন পেছন দোতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়েও সহসা দাঁড়িয়ে পড়েন গৌর দা। 
' গলাটা কার বলো তো?'
' রাজেশ্বরী দত্ত। মায়ের ঘরের রেডিওতে...।'
' ইয়েস। আমার কাছেও এ ক্যাসেট আছে। ওখানকার বেঙ্গলি ইউথ ক্লাব থেকে সংগ্রহ করেছিলাম বেশ কিছু...আমার ফেভারিট রবীন্দ্র সংগীতের মধ্যে একটা..। কাঞ্চনজঙ্ঘা সিনেমা দেখেছো নিশ্চই? সেই মার্ভেলাস সিকোয়েন্সটা মনে পড়ে? ভোরবেলাকার ফগি ওয়েদার... চারিদিক ধোঁয়াশাচ্ছন্ন...দার্জিলিংয়ের প্রকৃতির কোলে এক অদ্ভুত নীরব নিস্তব্ধতার মাঝে গান গাইছেন করুনা ব্যানার্জী..." এ পরবাসে রবে কে হায়.."
ধোঁয়াশার মধ্যে থেকে উঠে আসছে সে সুর...গান তো নয়...এ যেন  অন্তর্লীন হয়ে যাওয়া...অতলে অবগাহন...কিসের খোঁজে জানো? পিস...হ্যাপিনেস...জীবনের একটাই পরম আকাঙ্খিত পথ...কজনই বা খোঁজ পায় সে পথের...বিভ্রান্তি নিয়েই কাল কাটিয়ে দেয়...যেভাবে শেষ দৃশ্যে এসে ছবি বিশ্বাসকে তাঁর যাবতীয় স্নবারি আর অ্যারিস্টোক্রেসির আবর্তে বিভ্রান্ত হতে দেখা গেছে...বিশ্ব চরাচরে " পিস" শব্দটা সত্যিই বড় মূল্যবাণ হে...ঝলমলে কাঞ্চনজঙ্ঘার মতো...যত তুমি সমর্পণ করবে নিজেকে, ততই কুয়াশা কাটবে...ক্রসিং দ্য বার...' 
অন্যমনস্ক মনে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে এগিয়ে চলেন ভদ্রলোক....
'তোমাদের বাড়ির চৌকাঠে পা দেওয়া ইস্তক বহু পুরোনো একটা স্মৃতি পিছু পিছু ভেসে উঠছিল বারেবারে...সেই একগাল হাসি ভরা মুখ...." গৌর এসেছিস....বোস বাবা..."
কত পথ পেরিয়ে এসে দিনান্তের এই শেষ সিঁড়ির কাছে এসে কি মনে হচ্ছে জানো? মনে হচ্ছে মেশোমশাই নেই...মাসিমা তো আছেন....জীবনে প্রণাম করার মতো মানুষ পৃথিবীতে আজ বোধহয় ঐ একজনই....রেকর্ডের সুরটুকু মুছে যায় নি এটাই তো বড় কথা....!'
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন অরূপ বাবু। বলা আর হলো না। গৌর দা এগিয়ে যাচ্ছেন.... শেষ সিঁড়ি পেরিয়ে...চৌকাঠ পেরিয়ে... মৃণালীনি দেবীর ঘরের দিকে...সহসা থমকে দাঁড়িয়ে পড়েন দরজার মুখে এসে....
'ও..ও..ও..কে?'
জড়ানো গলা। অতি ক্ষীণ আওয়াজ।
গৌর দা তাকিয়ে থাকেন। পলকহীন দৃষ্টি যেন। 
অরূপ বাবু এগিয়ে যান। 
' মা, আমাদের সন্তোষ মেশোমশাইয়ের ছেলে গৌর দা...চিনতে পারছো? কাঁচরাপাড়া..রজনী বাবু রোড..।'
আস্তে আস্তে ঘরে এসে বৃদ্ধার জরাজীর্ণ হাতে নিজের হাতখানা স্পর্শ করেন গৌর দা। চোখের দৃষ্টি এখনো স্থির। আজকের এই ছবির সাথে প্রায় হুবহু মিলে যাওয়া বহু বছর আগে হারানো আরো একটা ছবি যেন ভেসে  উঠছে একটু একটু করে...যে নাড়ির টান আজও কথা বলে ফিসফিস করে, একান্তে..জীবনের তরঙ্গায়িত পথ ধরে। 
ভ্রূ কুঞ্চিত, শীর্ণকায় মুখখানা কোটরাগত চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে নীরবে। কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে এলোমেলো পথে..প্রাণপণে ছুঁতে চাইছে কাকে... প্রক্ষিপ্ত সময় ধূসরতার মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে ততবারই। 

'এ পরবাসে রবে কে.. ' প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল শব্দ গুলো তখনো..ঘরের কোণায় কোণায়... জীবন থেকে জীবনের মাঝে। 

নীচের বৈঠকখানায় বহুকালের পুরনো গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে আওয়াজ ভেসে আসে, আজও একই সুরে...সান্ধ্যকালীন ঘন্টার আওয়াজ।। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Kobitar Alo October Sankhya 2025

  প্রচ্ছদ ঋণঃ-  অদিতি সেনগুপ্ত