রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম বিত্তশালী পরিবারে হলেও তিনি কিন্তু আদতে জমিদার ছিলেন না। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারে সবার জন্য হাতখরচ বেঁধে দিয়েছিলেন। ঠাকুর বাড়ির তৎকালীন খরচের ক্যাশবই থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনীর জন্য মাসোহারা ধার্য ছিল মাত্র ২৫ টাকা আর রবীন্দ্রনাথের জন্য বরাদ্দ ছিল ১০০ টাকা মাত্র। এই টাকা খরচ করেই চলতে হয়েছে তাঁদের। ফলে নিজস্ব সংসার চালাতে রবীন্দ্রনাথকে প্রচুর অর্থকষ্টের মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে। আর্থিক সংকট তাঁর ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনকে বিপর্যস্ত করেছিল বারবার। পারিবারিক ও সাংসারিক ব্যয়ভার বহনে তিনি অনেকটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। উপায়ন্তর না পেয়ে বাধ্য হয়েই তিনি বন্ধু-বান্ধবের কাছে টাকা ধার করেও সংসার চালিয়েছেন – এ তথ্য অনেকের কাছেই অসঙ্গত বিবেচিত হলেও বিস্ময় প্রকাশের কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথের জন্য জমিদারির দায়িত্ব দেয়ার পরে বরাদ্দ করে দেন মাসিক ৩০০ টাকা। জমিদারি পরিচালনা, সংসার চালানো, অতিথি আপ্যায়নসহ সকল খরচ ঐ ৩০০ টাকার মধ্যেই তাঁকে করতে হতো। এ কারণে তিনি অর্থ খরচের দিক থেকে খুবই মিতব্যয়ী ছিলেন। প্রয়োজনের বাইরে কোনো খরচ তিনি করতেন না। অত্যন্ত সাদামাঠা জীবন ছিল তাঁর। রবীন্দ্রপুত্র রথীন্দ্রনাথের কথায় সে চিত্রই ফুটে ওঠে- ‘অন্যদের মতো বাবা তখন দুশো টাকা মাসোহারা পেতেন। তাতেই তাঁকে সংসার চালাতে হতো। জমিদারির ভার বাবার ওপর যখন দেয়া হলো তখন মহর্ষি তাঁকে আরও একশ টাকা মাসোহারা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। বহুকাল ধরে এই তিনশ’ টাকাই বাবার মাসিক বরাদ্দ ছিল’। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আদতে ছিলেন অবৈষয়িক মানুষ। ফলে বিশাল জমিদারিত্ব পরিচালনায় তাঁর কবিচিত্ত অল্পদিনের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে ওঠে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তিনি পাটের ব্যবসা শুরু করেন। এখানকার পদ্মাপাড়ের মানুষের জীবন, প্রকৃতি ও জীবনবোধ তাঁর কবি হৃদয়ে সাহিত্য সৃজনের উপাচার হিসেবে ধরা দিয়েছিল কবির অজান্তেই। এ কারণেই তাঁর ব্যবসার প্রসার হয়নি এবং ক্ষতিও হয়েছিল বিস্তর। তিনি বুঝলেন ব্যবসা তাঁর জন্য নয়। ইতিমধ্যে সংসারে এসেছে পাঁচটি ছেলেমেয়ে। ফলে রবীন্দ্রনাথ আরো মিতব্যায়ি হয়ে উঠলেন, একদম আমাদের মত ঘোর সংসারী। ব্যয় সংকোচনের উদ্দেশ্যে তিনি সস্তা ও কমদামী পণ্য সামগ্রীই ব্যবহার করতেন ও করতে বলতেন। ছেলেমেয়েদের কিনে দিতেন সাধারণ জামা, জুতো, পোশাক-পরিচ্ছদ ও সস্তায় বইখাতা। দাম বেশির জন্য ছেলেমেয়েদের কখনো দাঁত মাজার পেস্ট কিনে দেননি। তার পরিবর্তে দিয়েছেন কম দামের সস্তা দন্তমঞ্জন। মেয়েদের সুগন্ধি তেলের বদলে কিনে দিয়েছেন সস্তা নিমের তেল।
বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে লেখা একটি চিঠিতে কবির এ আর্থিক দুরবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন- ‘প্রতিদিনের খুচরা খরচ প্রায় ধার করে চালাতে হয়’। অন্য একটি পত্রে তিনি লিখেছেন- ‘আমি তোমাকে সত্য বলচি এখন আর আমাদের কারো হাতে এক পয়সা নেই। আমার একমাত্র মহাজন হচ্চেন সত্য, তার কাছ থেকে ইতিমধ্যে ২০০ টাকা ধার নিয়ে সংসার চালিয়েছি।… আমাদের পরিবারে আজকাল এমনি দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছে যে, সে দূর থেকে তোমরা ঠিক উপলব্ধি করতে পারবে না।… দেনা যে ক্রমে কত বেড়ে যাচ্চে সে বলতে পারিনে।… আমার বয়সে আমি কখনো এমন ঋণগ্রস্ত এবং বিপদগ্রস্ত হইনি’। নিত্য অভাবের তাড়নায় ধার করতে করতে বাড়ছিল ঋণের বোঝা। মহাজনী কায়দায় উচ্চ হারে সুদ দিয়ে ঋণ গ্রহণ করা ছাড়া তাঁর কোনো গত্যন্তর ছিল না। ১৯০১ সালের ১৪ মার্চ তারিখে কবির লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায়। কবি লিখেছেন- ‘দোহাই তোমার সুদটা যাতে ১০ পার্সেন্টের বেশি না হয় সেই চেষ্টা কোরো।…নিতান্তই অসম্ভব হলে ১০ পার্সেন্টেই শিরোধার্য করে নিতে হবে।’ সংসারের অভাব কোন স্তরে পৌঁছালে রবীন্দ্রনাথের মতো একজন মানুষ চড়া সুদে ঋণ নিতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এর পরেও ছিলো মেয়েদের বিয়ে। সব মেয়েদের পাত্রস্থ করে রবীন্দ্রনাথ আক্ষরিক অর্থে প্রায় ফতুর হয়ে গেলেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে তাঁর সংগৃহীত পুরাতন বই তিনি বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন এবং তাঁর রচিত গ্রন্থের কপিরাইট পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন।
তাই যখন রবীন্দ্র বিরোধীরা লেখেন, - ‘থাকতো যদি টাকা পয়সা / থাকতো জমিদারি / রবির মতো কবি হতে / লাগতো নাকো দেরি’। তখন সত্যি সেইসব মানুষজনের জন্য করুণা হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন