রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরকালীন চিরবিস্ময়। অজস্র সৃষ্টিপ্রাচুর্যের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সৃজনকৌশল এবং ব্যক্তিজীবনের নানামাত্রিক স্তর । তাঁর নাটক আজও গবেষণার বস্তু। কিন্তু তাঁর অভিনয় দক্ষতা নিয়ে চর্চা কিছু কম। আজ সেই বিষয়ে কিছু প্রাসঙ্গিকতার অবতারণা করি।
অন্যান্য শাখার মতো নাটক রচনায়ও রবীন্দ্রনাথ উৎকর্ষের পরিচয় দেন। নিজের রচিত নাটকে অসাধারণ অভিনয়ও করতেন তিনি। অভিনয় শিল্প সম্পর্কে তার অভিনিবেশ, চর্চা ও অনুশীলন প্রকারান্তরে তার সৃষ্টিকেই সমৃদ্ধ করেছিল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অনেক সদস্য অভিনয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। মূলত পারিবারিক নাট্য ঐতিহ্য রবীন্দ্রনাথকে নাট্যাভিনয়ে উৎসাহ জোগায়।
১৭৯৫ থেকে ক্রমান্বয়ে ধারাবিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বাংলা নাটকের পরিণতি পর্বে , পেশাদার নাট্যগোষ্ঠীর আবির্ভাবেও সৌখিন নাট্যচর্চা থেমে থাকেনি বরং পেশাদার নাট্যগোষ্ঠী তৎকালীন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত চিত্তের দাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়। ফলে ঠাকুরবাড়ির শখের থিয়েটার চর্চা যেমন বন্ধ হয়নি তেমনি, ঠাকুর পরিবারের থিয়েটার-চাহিদা ও অভিনয়ে প্রশংসারও ঘাটতি পড়েনি।
সেসময় মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবকদের সান্ধ্যবিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ১২৯৯ বঙ্গাব্দে ‘সঙ্গীত সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সঙ্গীত সমাজের উদ্যোগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটক অভিনীত হলেও রবীন্দ্রনাথ সংগঠনটির সঙ্গে জন্মলগ্ন থেকে জড়িত ছিলেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘এই সময়ের অভিনীত নাটকের অধিকাংশ নায়ক-নায়িকার উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, অঙ্গভঙ্গি ভালো ছিল না। এসব দেখার দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথের ওপর বর্তেছিল।’
ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধায় ‘সেকালের কথা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- জোড়াসাঁকো-নাট্যশালার দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হয় রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে। ঠাকুরবাড়ির দ্বিতীয়পর্বের শুরুতে ‘বিদ্বজন সমাগম সভা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয় ১২৮১ বঙ্গাব্দের ৬ বৈশাখ। সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের পর বার্ষিক অনুষ্ঠানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘পুরুবিক্রম’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ। মাত্র তের বছর বয়সে এই নাটকে অভিনয় করে উপস্থিত দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেন তিনি।
অনেকে মনে করেন ‘সঙ্গীত সমাজ’ এর উদ্যোগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রহসনমূলক ‘এমন কর্ম আর করব না’ নাটকে অলীকবাবুর ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ প্রথম অভিনয় করেন। ‘অলীকবাবু’ চরিত্রটি ফরাসি নাটক থেকে নিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। কিন্তু অভিনয়ের পূর্বে রবীন্দ্রনাথ এই চরিত্রটিকে অনেক অদলবদল করে ফরাসি গন্ধ দূর করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের বন্ধু প্রিয়নাথ সেনের মন্তব্য তুলে ধরেছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়- ‘এমন সুন্দর অভিনয় কখনও দেখি নাই। … যাঁহারা রবিবাবুর অভিনয় দেখিয়াছেন- তাহারা জানেন যে কবিবর শুধু আধুনিক বঙ্গ সাহিত্যের শিরোমণিই নহেন, নট চূড়ামণিও বটে।’ প্রিয়নাথ সেনের এ মন্তব্যে রবীন্দ্রনাথের অভিনয় প্রতিভা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। কৈশোরে দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নিজের নাট্যভাবনা ও অভিনয় প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন তিনি। মূলত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহ রবীন্দ্রনাথের নাট্যজীবনে ব্যতিক্রমী ধারার সূচনা করে। ‘মানময়ী’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ ‘মদন’ চরিত্রে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘ইন্দ্র’ এবং কাদম্বিরী দেবী ‘উর্বশী’ চরিত্রে অভিনয় করেন। এ নাটকটি বাংলা নাট্যসাহিত্যে গীতিনাট্যের প্রথম প্রয়াস হিসেবে স্বীকৃত। ‘বিদ্বজন সমাগম সভা’য় রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকের বাল্মীকি চরিত্রে অভিনয় করেন। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভাদেবীও এ নাটকে সরস্বতীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের অভিষেক ঘটে পরিবারের বাইরে সাধারণ দর্শকদের সামনে। ব্যাপকভাবে দর্শকনন্দিত হন রবীন্দ্রনাথ। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র অভিনয় সাফল্যের পর তিনি ‘কালমৃগয়া’ নামে একটি গীতিনাট্য রচনা করেন। ঠাকুরবাড়ির তিন তলার ছাদে এই নাটকটি প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়। কোলকাতার বহু সম্ভ্রান্ত ও গণ্যমান্য ব্যক্তির সামনে প্রদর্শিত এই নাটকে রবীন্দ্রনাথ ‘অন্ধমুনি’ চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের আপ্লুত করে দেন। পরবর্তীতে তিনি শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় পারিবারিকভাবে অভিনীত নাটকে অভিনয় ছেড়ে দেন।
অভিনয় দক্ষতায় নাটকের চরিত্রের বলিষ্ঠতা যথাযথভাবে প্রমাণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। শব্দ প্রক্ষেপণের ভঙ্গি, সাজ ও চরিত্রের অন্তর্নিহিত বক্তব্যটি যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতেন বলেই তার অভিনীত নাটক তৎকালীন সময়ে খুব জনপ্রিয় ছিল। ১৩০৩ বঙ্গাব্দে ‘সঙ্গীত সমাজ’ আয়োজিত ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই নাটকে নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ অভিনয় করেছিলেন। কেদারের সাজপাট ও ঢিলেঢালা মেকআপে রবীন্দ্রনাথ এমন কপট বিনয়ের অবতারণা করেছিলেন, এতে চরিত্রের মূলভাবটি অনায়াসে দর্শকরা বুঝতে পেরেছিলেন।
এছাড়া শান্তিনিকেতনে অভিনীত প্রহসন নাটক ‘বিনে পয়সার ভোজ’ এ যাদুকরী অভিনয় দিয়ে দর্শকদের অভিভূত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মূল উদ্দেশ্য ছিল অভিনয়ের মাধ্যমে বাংলা নাটকের উন্নয়ন। একই সঙ্গে নাটকের সঙ্গে সাহিত্যের সব শাখার সমন্বয় সাধন। তিনি যেমন ঠাকুরবাড়ির অগ্রজদের নাটকে অভিনয় করতেন তেমনিভাবে নিজের রচিত নাটকেও অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের রসসিক্ত করতেন। রবীন্দ্রনাথের ৬৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নৃত্যনাট্য ‘নটীর পূজা’ অভিনীত হয় শান্তিনিকেতনে। এ নাটকে ‘ভূপালি’ চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এ নাটকের দর্শক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২২ সালে কোলকাতার আলফ্রেড ও ম্যাডান রঙ্গমঞ্চে ‘শারদোৎসব’ নাটকে সন্ন্যাসীর ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেন- “শারদোৎসব এর অভিনয়াঙ্কিকের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যৎ নাটকসমূহের অভিনয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাইয়াছিল। রবীন্দ্রনাথের নাট্যাভিনয় ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হইয়াছিল, ‘শারদোৎসব’ অভিনয়ের মধ্য দিয়াই তাহার প্রথম সূচনা দেখা দিয়াছিল।”
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্র জীবনী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁহার বাল্যকালে নাটক ও অভিনয়ের যে দৃষ্টান্ত ও আদর্শ সৃষ্টবোধের অগোচরে উপলব্ধি করিয়াছিলেন, তাহা সম্পূর্ণ ইউরোপের আদর্শে গড়া থিয়েটারের অনুকরণে রচিত নাটকের অভিনয়। এই সব অভিনয়ের ক্ষীণ স্মৃতিকণিকাগুলি বালকের অবচেতনে মনের স্তরে সঞ্চিত ছিল এবং উত্তরকালে তাহাই পূর্ণাঙ্গ আর্টরূপে কবির জীবনে প্রকাশ পায়।’ শেষ জীবনে এসে তিনি নৃত্যনাট্যের ওপর জোর দিয়েছিলেন। নৃত্যকলার মাধ্যমে উচ্চাঙ্গ অভিনয় দক্ষতা অর্জনে তিনি দেহের প্রতিটি অঙ্গকে কীভাবে অভিনয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায় সেদিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। যে কারণে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য আজো দর্শক শ্রোতার মননে গভীর রেখাপাত করে। এ প্রসঙ্গে নৃত্যশিল্পী শান্তিদেবী ঘোষ বলেছিলেন- ‘নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের অভিনয় একা তিনি শিখিয়েছেন পাখি পড়ানোর মতো করে। প্রত্যেকটি কথার সঙ্গে কোথায় কিভাবে ঝোঁক দিতে হবে, কিভাবে স্বরের বৈচিত্র্য আসবে, সবই তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খুরূপে দেখিয়েছেন।’
বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ নাটক রচনার মতো অভিনয়েও নতুনত্ব ও আধুনিকতার বিস্তার ঘটিয়েছেন। বহুমাত্রিক ব্যবহারে নাট্যাঙ্গনকে বহুমাত্রিকতা ও বিশিষ্টতা দান করেছেন। রবীন্দ্রত্তোর বাংলার দর্শকসমাজে বাংলা নাটকের যে সমাদর তার বীজ রবীন্দ্রনাথের হাতেই প্রোথিত। বাংলা সাহিত্যের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ যেমন প্রাসঙ্গিক তেমনি তার উন্নত রুচি ও অভিনয় ঐশ্বর্য নাট্যমুগ্ধ বাঙালির হৃদয়েও চিরভাস্বর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন