বুধবার, ৮ মে, ২০২৪

কবির সাথে রবিকাল | নীলম সামন্ত

 দীর্ঘ এই দুপুরে জানালায় রোদ ঝাঁপিয়ে পড়লে আমি রূপকের হাত ধরি। রোদের নাম হয়ে যায় রাজা। আলগোছে স্পর্শ। নরম আদর। হঠাৎ ঘুমভাঙা চোখে সিগারেটের আগুন। কত কিই যে জ্বলে যায়, মিটিমিটি চোখে ভবঘুরেরা জড় হয়। তাদের মধ্যে যারা বিদেশযাত্রায় গিয়ে চিঠি লিখত তারা রবীন্দ্রনাথ৷ অক্ষরগুলো যেন নতুন কবিতা শোনা কাদম্বরী-চোখ। আহা রে, অমন অমলতাসের পথে কত রোদই না এসেছিল। আজকাল রাস্তায় সেসব ঝুলে আছে দেখে মেয়েরা গয়না বানিয়ে গলায় পরে৷ হলুদ পাপড়ি বুকের ওপর নরম হয়ে লুটিয়ে থাকে৷ আমি গুনগুনিয়ে উঠি, 'রোদন ভরা এ বসন্ত'...


বসন্তের পাঠ চুকে গেলেও ছায়া ঝুলে থাকে পাতার কিনারায়।  যারা নির্মাণ বুঝে পৃথিবীকে দু'হাতে তুলে ধরতে চেয়েছে তারাই ধ্বংসের বীজ গর্ভে ধারণ করেছে৷ কবোষ্ণ যোনীপথে আকণ্ঠ বাঁশি-সুর। শাড়ির কুচিতে ধরে রেখেছি সুররিয়ালিজমের বালিঘড়ি৷ রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, শুনতে পাচ্ছেন, আমি আপনাকে তুমি করে বলতে চাওয়ায় সোনামুগ বিকেলে কারা যেন আতপের গন্ধে আবির মিশিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ যে ভরা গ্রীষ্ম! আপনার 'আকাশ ভরা সূর্য তারা'য় কত খিদে ঝুলে আছে। বসন্তে ফুল হল, শস্য হল, তাও খিদে কেন মেটে না? বলতে পারেন নীলপাখি নাম দেওয়ার সময় কবি কতবার আপনার দিকে তাকিয়েছেন? বহু দীঘল ওই সবুজ, যারা বসেছে তারাও বৃক্ষ হয়ে আঁকড়ে আছে অসুস্থ প্রাণেদের। কবির দিকে তাকিয়ে থাকি, অনন্তবীথি, বাদামী প্যাস্টলকে দেখাই চুম্বনের প্রকারভেদ। 



এবেলায় বরং ফিরে যাই। আমার তো কবি হওয়া হল না। শুধু তোমার গানের লাইনগুলোয় হাত বুলিয়ে অনুভব করেছি নিবিড় শঙ্খসুর। কবি বলেছিলেন, দক্ষিণমুখী হতে। অনর্গল কবিতা পড়ে যাবে আর আলতা পরতে পরতে বেলা ফুরিয়ে আসবে৷ আপনি কি বলেন রবীন্দ্রনাথ এ কি গভীর প্রেম? কি হল বলুন? এতো মৌনতা! টিকটিক ঘড়ির শব্দে গোপন করছি হোঁচটের ক্ষত, তাই হয়তো কৃষ্ণচূড়া বেড়ে উঠেছে৷ ফুলের ভেতর বসে আছে মধ্যযামের নীলপাখি। আমার হঠাৎ হঠাৎ খিদে পায় কেন বলুনতো? আপনার শহরের সবুজ বাড়িটায় একদিন হেলান দিয়েছিলাম, পেট ভর্তি কচুরি, ছানার জিলিপি ও ট্রাফিক সিগনালের রবিগান৷ সামনেই একটা মেয়ে পদ্ম বিক্রেতা। আমারও গালগুলো গোলাপি হয় রোদ শুতে এলে। অপূর্ব মেয়েটি আমার গালের মতোই নিরস্ত্র। আমি জানি তার ভেতর অজস্র সাপ ঘুমিয়ে আছে। কার কখন ঘুম ভাঙে। কিন্তু পৃথিবী রসাতলে তলিয়ে যাবার আগেও পুরনো মোমবাতির ছবিতে মেতে থাকবে ধুলোর এক্সিবিশন৷ মেয়েটি তখন হয়তো সাপের বিন বিক্রেতা৷ 


এই সাত পাঁচের ভেতরেই আমি শব্দহীন। চারপাশে জল ভরে গেলে পাতারা ভেসে ওঠে। জলের ভেতর বিবস্ত্র হলে স্বীকার করি আপনি আমার প্রতিবেশী বন্ধু। আসবাবপত্রের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাই স্থির পটচিত্র, যেখানে আপনার চোখের ওপর কাচ ফুটে আছে। নাকে ইঁদুর পালানো পায়ের ছাপ। সাহস করেই এগিয়ে যাই। আসলে আমার দরকার একটি খেলনাবাড়ির। রবিঠাকুর, আপনার সৃষ্টির রঙে প্রতিটা দেওয়াল লাবণ্য হয়ে উঠলে আমার প্রয়োজনীয়তা গুলিয়ে যাবে৷ নীলপাখি তখন অমিতের খোঁজে অশ্লীলতার সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করবে মানুষ খোয়ানো জ্যোৎস্নাদের। ফুলের মতো তাদেরও নাম করণ করবেন? 


তা করতেই পারেন। তবে আজ আপনার জন্মদিন৷ আজ একটি জাতির জন্মদিন। জাতি সাদা লালে মেতে উঠবে ভেবে বিনা শর্তেই আমি আবার জানালামুখী হব। খানিকটা দেখতে পাবেন। উরুতে হাজার প্রজাপতি। আমিও মনে মনে ওড়ার পরিকল্পনাই করছি৷  তারপর কোনদিন ভুলে যাব আমার শরীরে অনেক ঘর৷ এক একটাতে এক একজন। আপনি মাঝের ঘরে৷ আপনার সৃষ্টি করা প্রতিটা প্রেমিকই তখন পাঞ্জাবীর শেষ বোতাম আটকে নিচ্ছে। জানালায় কাঠবেড়ালি দেখে আমি উঠে যাই বিস্কুটের খোঁজে। ছুটে যাই পথ পেরিয়ে। আপনাকে, আপনাদের  পেরিয়ে অস্থির নদীজলের দিকে৷ আপনি অপেক্ষা করুন। আমি স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে আসছি, ধুপ জ্বালানোর সময় হয়ে গেল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Kobitar Alo October Sankhya 2025

  প্রচ্ছদ ঋণঃ-  অদিতি সেনগুপ্ত