(১)
শহরের এক সরকারি হাসপাতালের বেঞ্চে ব’সে প্রহর গুনছে গুল্লু। উদ্বিগ্ন চোখে বারবার দেখে নিচ্ছে দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটা। প্রতিটা কাঁটায় খেলা করছে তার বাবার জীবন-মৃত্যু।
“এখানে গুলশন শর্মা কে আছেন?”
“ডাক্তার বাবু, হামি আছি।”
“আপনার বাবাকে এখানে ফেলে রাখবেন না। রেফার করে দিচ্ছি, এখনই কলকাতার কোনও সুপারস্পেশালিটি হসপিটালে নিয়ে যান। এখানে নিউরো সার্জেন কেউ নেই। আর ব্রেইনের ব্যাপার, সময় নষ্ট করাটা ঠিক হবে না।”
গুল্লু কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ডাক্তার বাবু হামি এতো টাকা কোথায় পাব! পেরাইভেট আসপাতাল তো বহত খরচ আছে। হামি সামান্য লাপিত…”
“আচ্ছা ঠিক আছে, কেঁদো না। তোমার সেলুনে তো অনেক বড় মানুষও আসেন মাঝে মাঝে! তুমি তাঁদের বলো, আর এদিকে আমিও একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। তাহলে মনে হয় আপাতত ট্রিটমেন্ট করতে অসুবিধা হবে না।”
ডাক্তার সেনের কথাগুলো শুনে গুল্লু মনে করার চেষ্টা করল কে কে তার সেলুনে আসেন। বিদ্যুৎ গতিতে একটা মুখ তার চোখে ভেসে উঠছে। এই এলাকার বিশিষ্ট সাংবাদিক, দেবব্রত রায়। তিনি একটি বিখ্যাত দৈনিক খবরের কাগজের অনেক পুরোনো সাংবাদিক। গুল্লুর কাছে মাঝে মাঝে আসেন চুল-দাড়ি কাটতে। গুল্লুর হাতের কাজ নাকি শহরের অনেক বড় বড় পার্লারকেও টেক্কা দেয়! তাই, এখানে তিনি আসেন, গুল্লুর হাতের নৈপুণ্যের কারণে। গুল্লু এক মুহূর্তও ব্যয় না ক’রে ফোন করল দেবব্রত রায়কে। ফোন ব্যস্ত বলছে। এখন দেবব্রত বাবুর ব্যস্ততার থেকেও গুল্লুর বাবার জীবনের দাম বেশি। দেবব্রত বাবুর ব্যস্ততার তোয়াক্কা না ক’রে গুল্লু আবার ফোন করল দেবব্রত রায়কে। এবার রিং হচ্ছে ফোনে…
(২)
সকাল আটটার সূর্য রশ্মি বোর্ডের ওপর পড়লেই, খুলে যায় ‘গুল্লু হেয়ার কাটিং শপ’। এলাকায় সাত-আট বছর ধ’রে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে গুল্লু। উত্তর প্রদেশ থেকে সেই কোন কালে সীতারামপুরে উঠে এসেছিলেন গুল্লুর বাবা, চিনু শর্মা। তারপর, ইট ভাটায় দিন মজুরের কাজ ক’রে সামলেছেন নিজেকে নিয়ে দশজন সদস্যের ভরা সংসার। গুল্লুর জন্ম এখানেই। তাই, টেনে টেনে হলেও ভালো বাংলা বলতে পারে সে।
“এই গুল্লু, কজন আছে রে?”
“সমীর দা’র পোরে আরও দুইজোন।”
“দে, আজকের পেপারটা দে। যতক্ষণ আমার নম্বর আসছে, ততক্ষণ পড়ি।”
“কোনটা দিব? বাংলাটা না আংরেজিটা?”
“বাংলাটাই দে। সকালে ইংরেজি নিয়ে বিশেষ বসি না…”
শিবদাস বাবুর কথা শুনে গুল্লু আয়না দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসল। এখানে সবাই গুল্লুর সাথে হাসি-ঠাট্টার সম্পর্ক রেখেছে। গুল্লুর বয়স বত্রিশ-তেত্রিশ হলেও, সে প্রায় তার বাবার বয়সী লোকেদের সাথেও মিশে যেতে পারে অনায়াসে।
“না, বাংলাটায় সেই একই খবর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, আর যতটুকু আছে সেটাও বিজ্ঞাপনের দয়ায় অল্প জায়গা ক’রে নিয়েছে। তুই বরং আমায় ইংরেজিটাই দে”- কথাগুলো বিরক্তিভরা মুখে ব’লে উঠলেন শিবদাস বাবু।
গুল্লু মুচকি হেসে এগিয়ে দিল ইংরেজি সংবাদপত্র। সে বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি তিনটে ভাষার কাগজই রাখে। দোকানে কাস্টমার না থাকলে সে নিজেই পড়ে হিন্দিটা, মাঝে মাঝে ইংরেজিও। চেষ্টা করে বোঝার। অল্প শিখেছিল স্কুলে পড়ার সময়। তাই, একেবারে অজানা ভাষা নয় এটা তার কাছে।
“ছেলের রেজাল্ট বেরিয়েছে মাধ্যমিকের। এইট্টি ফাইভ পার্সেন্ট মার্কস পেয়েছে। এই নে মিষ্টি খা…” --সামনের মিষ্টির দোকানের লাল্টু দা এক প্যাকেট কালাকাঁদ নিয়ে এসেছে গুল্লুর জন্য। সন্তানের সাফল্যে বাবারাও বাচ্চাদের মতো আনন্দ করেন। এইরকম নির্ভেজাল আনন্দ দেখতে বেশ ভালোই লাগে!
“বাহ! দারুণ বেপার আছে লাল্টু দা’। তোবে, শুধু মিষ্টিতে চোলবে না। মুর্গা খাওয়াও একদিন।”- গুল্লুর চোখেও খুশি ঝিলিক দিচ্ছে।
গুল্লুও মাধ্যমিক দিয়েছিল। টিউশন ছিল না তার। বাবার সামর্থ্যে কুলোয়নি। কিন্তু, কোনও গাইডেন্স ছাড়াই সে ফার্স্ট ডিভিশনে পাশ করেছিল। স্কুলের শম্ভু মাস্টার অবশ্য খুব সাহায্য করেছিলেন তাকে। পাশ করেই সে স্যারকে প্রণাম করতে গিয়েছিল। স্যার বলেছিলেন, আরও পড়তে। সাহায্যও করতে চেয়েছিলেন গুল্লুকে, কিন্তু সে নিতে রাজি হয়নি। স্যারের নিজেরই তিনটে বড় বড় মেয়ে ছিল। তাদের বিয়ে দিতেই স্যারের অবস্থা খারাপ। তাই, গুল্লু নিজের বোঝা স্যারের কাঁধে চাপাতে চায়নি।
হাতের কাজ শেষ করে টিফিন খেতে বসল গুল্লু। দুপুর বারোটার আগে কোনোদিনই সকালের খাওয়া জোটেনা তার। সবই কপাল! কিন্তু, এত দুঃখের মাঝেও যখন সে নিজের মেয়েকে পড়তে দেখে, শান্তি পায় ও। কষ্ট ক’রে হলেও সে নিজের মেয়েকে পড়াবে। ডাক্তার বানাবে। গুল্লুর জীবন রুটির পোড়া অংশের মতো হলেও, সে তার মেয়ের জীবন করবে সাদা অংশটার মতো; ঝকঝকে এবং মসৃণ।
(৩)
“ধুর, এই মাল কেন আবার ফোন করছে? এই বিপিএল ক্যাটাগরিগুলোর জন্য হয়েছে যত জ্বালা। সুযোগ খুঁজতে ওরা ব্যস্ত থাকে।”-এই কথা গুলো মনে মনে ব’লে রাগে গজগজ করতে করতে গুল্লুর ফোন তুলল সাংবাদিক দেবব্রত রায়।
“হ্যালো…কে?”
“দাদা, হামি গুল্লু আছি। হাপনার সোঙ্গে কোথা ছিল…”
“হুম গুল্লু, বল…”
“দাদা, হামার বাবুজির এক্সিডেন্ট হ’য়ে গিছে। বাইকে ধাক্কা লেগে গিছে। মাথায় চোট এসেছে। সরকারি ডাক্তারবাবু বলছে পেরাইভেটে নিয়ে যেতে হবে কলকাত্তায়…আপনি রিপোর্টার আছেন, কিছু একটা বেবস্থা কোরেন…”
কথাগুলো বলতে বলতে ফোনেই কান্নায় ভেঙে পড়ল গুল্লু। দেবব্রত রায় তাকে বরাবর বলেছেন তিনি তার পাশে আছেন। সেই ভরসাতেই দেবব্রতবাবুকে ফোন করেছে গুল্লু।
“গুল্লু, আমার রেফারেন্সে কী হবে বল! তুই বরং এসডিও অফিস থেকে চিঠি নিয়ে আয়। ওঁরা বললে যে কোনও নার্সিং হোম ভর্তি ক’রে নেবে। টাকা নিয়েও চাপ হবে না। সেরকম হ’লে তুই পাঁচ-দশ হাজার আমার থেকে নিয়ে নিস পরে।”
দেবব্রত রায়ের এই কথাগুলো শুনেই গুল্লু বুঝল সব মিথ্যে। সাংবাদিকরা নেতাদের বিরোধিতা করলেও, এঁরা ওঁদেরই মতো। এঁদেরও পাল্টি খেতে দুদিন লাগেনা।
“হাপনি একটা চিঠি লিখে দিবেন দাদা? নইলে, এসডিও অফিস হামাদের হোটাৎ ক’রে ঢুকতে দিবেনা। দয়া কোরেন মাই বাপ হামার। বাবুজি মরে যাবে নইলে!”
নাহ, গুল্লুকে এড়ানো যাবে না। একটা চিঠি লিখে দিলেই যখন আপদ বিদেয় হবে, তাহলে খুব একটা অসুবিধে নেই। তারপর তার বাবার চিকিৎসা হোক বা না হোক কে দেখতে গেছে? সামনে ইলেকশন, সেই নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। সেটা বেশি ইম্পর্টেন্ট - কথাগুলো ভেবে নিয়েই দেবব্রতবাবু বললেন, “ঠিক আছে, এসে নিয়ে যা বাড়ি থেকে। আধঘণ্টার মধ্যে আয়। নাহলে, আমায় পাবিনা।”
আধা ঘণ্টার মধ্যে কোথাও যাওয়ার নেই দেবব্রতবাবুর। গুল্লুকে এড়িয়ে যেতেই এই কথাগুলো বলা। তবে, গুল্লুও নাছোড়বান্দা, আধা ঘণ্টার আগেই পৌঁছে গেছে দেবব্রতবাবুর বাড়ি।
তাকে এত তাড়াতাড়ি দেখে একটু চমকেই গেছিলেন দেবব্রত রায়। বুঝেছিলেন গুল্লুর দরকারটা। তাই, বেশি কথা না বাড়িয়ে চিঠিটা দিয়ে দেন তাকে। এবার বুঝে করুক গুল্লু। আর কোনও দায়িত্ব নেই দেবব্রত রায়ের। ইলেকশনের জন্য মুখ্যমন্ত্রী আসছেন জেলায়, তাই নিয়ে তাঁকে আর্টিকেল লিখতে হবে খবরের কাগজের জন্য। সেটা নিয়ে ব্যস্ত হ’য়ে পড়াতেই বেশি আনন্দ। গুল্লু নিজেরটা বুঝে নিক…
(৪)
মিডিয়া লেখা চার-চাকা গাড়িটা এসে দাঁড়ালো গুল্লুর দোকানের সামনে। গুল্লু দেখেই বুঝতে পারল কে এসেছে, কিন্তু চুল-দাড়ি কাটার থেকে মন সরালো না। গাড়ি থেকে নেমে এলেন একজন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক। এই এলাকার বিখ্যাত সাংবাদিক দেবব্রত রায়। গুল্লু একটু নড়েচড়ে দাঁড়াল। কারণ, এইরকম পেল্লায় শ্যুট-বুট পরা কেউ এলে তাঁরা লাইনে বসতে চান না। তাঁদের ভিআইপি পরিষেবা দিয়ে আগে সেবা করতে হয়। আর, দেবব্রত রায় এই এলাকার বেশ বড় নাম, তিনি গুল্লুর দোকানে আসেন সেটাই গুল্লুর ভাগ্য, তাঁকে বসিয়ে রাখা কোনোদিনই উচিৎ না। দেবব্রত রায় কিছু না ব’লে গম্ভীর হ’য়ে বসলেন। ঘাড়টা এদিক-ওদিক একটু ঘুরিয়েই গুল্লুর দিকে উদ্দেশ্য ক’রে বললেন, “চুলটা সাইড থেকে ছেঁটে দিস আর দাড়িটা…” তিনি কথা শেষ করতে না করতেই গুল্লু ব’লে উঠল, “হাঁ স্যার, হামার মালুম আছে হাপনার ইস্টাইল। দু-মিনিট বোসেন স্যার, আমি ইনাকে ছেড়েই হাপনাকে ধরছি।”
আজ কিছু উপরি ইনকাম হবে গুল্লুর। সত্তর টাকার চুল-দাড়ি ছাড়াও আরও কিছু টাকা টিপ হিসেবে দেন দেবব্রত বাবু। বড়লোকেরা যত ছড়াবেন, তত গুল্লুর মতো মানুষদের লাভ। মেয়ের জন্য জ্যামিতি বাক্স, আঁকার বই, পুতুল ইত্যাদি কেনা যায়।
“তোর হাতে জাদু আছে রে, গুল্লু। তাই তো এখানে আসি।”
“ই হামার ভাগ্য আছে স্যার। হাপনার পায়ের ধূলি পড়ছে হামার দুকানে…”
“নে, রাখ একশো টাকা। বাড়িতে যাওয়ার সময় মিষ্টি নিয়ে যাস।”
গুল্লু জানত এইরকম হবে। দেবব্রত রায় মানেই এক্সট্রা ইনকাম। আজ মেয়েটা খুব খুশি হবে। অনেকদিন ধ’রে জ্যামিতি বাক্স চাইছিল। এবার সে সেটা পেয়ে স্বর্গ পাবে। মেয়ের হাসি মুখটা মনে পড়তেই গুল্লুর মন আনন্দে ভ’রে উঠল।
“আর, কখনও কিছু লাগলে বলিস।”
“হাঁ স্যার, একদম বোলব…”
মুদির দোকানের ভোলা সবটা দেখে দৌড়ে এল গুল্লুর কাছে। এক্সট্রা ইনকাম দেখলেই তার মদ খাওয়ার ধান্দা চলতে থাকে। কিন্তু, আজ গুল্লু এটা দিয়ে মদ খাবে না। এই টাকা আজ তার মেয়ের জ্যামিতি বাক্সের জন্য বরাদ্দ। নিজের ফুর্তির চেয়ে মেয়ের ভবিষ্যৎ বেশি গুরুত্বপূর্ণ গুল্লুর কাছে।
(৫)
এসডিও অফিসে প্রচুর ভিড়। দুনিয়ার সমস্ত বিপদ আজ এসে জড়ো হয়েছে মানুষের জীবনে। গুল্লু দাঁড়িয়ে আছে চাতক পাখির মতো। চোক-মুখ ব’সে গেছে ক্ষিদে-তৃষ্ণায়। গুল্লুর নম্বর দশ। ন’ নম্বর মানুষের সাথে দেখা করছেন এসডিও শুভ্র মজুমদার। ন’ নম্বর লোকটাকে বেরিয়ে আসতে দেখেই গুল্লুর আনন্দ হল। এইবার তার নম্বর।
“এই দাঁড়াও, এখন আর হবে না। এবার কাল।”- এক লম্বা চওড়া দারোয়ান গুল্লুকে প্রায় ধাক্কা মেরে এই কথা বলল।
“হামার আজ দোরকার আছে, হামার বাবুজিকে নার্সিংহোম লিয়ে যেতে হোবে…”
“আরে, এসডিও সাহেব এখন অফিসের কাজে বাঁকুড়া যাবেন। আজ আর হবে না।”
“আজ না হ’লে, হামার পিতাজি মরে যাবে…দয়া করো মুঝে। অন্দর জানে দো মুঝে…”
“হ্যাট, আজ আর হবে না, ভাগ এখান থেকে। শালা, বুড়ো মরলেও কী আর বাঁচলেও কী! যেন জোয়ান ছোকরা…”
প্রায় ধাক্কা মেরে গুল্লুকে মাটিতে ফেলে দিল দারোয়ান। গুল্লু তার সাথে শরীরে পারবেনা। গুল্লু নিজের মাতৃভাষা হিন্দিতে, “মুঝে জানে দো, মুঝে জানে দো”- বলতে বলতে কেঁদে ফেলল। বিপদের সময় মুখে মাতৃভাষা নিজের থেকেই চ’লে আসে, তা হয় তো গুল্লু সেই সময় খেয়াল করেনি! হাক্লান্ত হয়ে গুল্লু সরকারি হাসপাতালে ফেরত এল। দেবব্রত রায় আর ফোন তুলছেন না গুল্লুর। ডাক্তার সেনের দয়ায় এখনও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে তার বাবার। কিন্তু, বেশিক্ষণ এখানে ফেলে রাখলে বুড়ো বাপের প্রাণটা চ’লে যাবে।
“কোনও সুবিধা হল?”-ডাক্তার সেনের এই প্রশ্নের উত্তরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠা ছাড়া আর কিছু করণীয় ছিল না গুল্লুর। ডাক্তার সেন সব বুঝে ঘড়ির দিকে তাকালেন। সন্ধে সাতটা বাজে। খুব বেশি হ’লে আর চার ঘণ্টা। তারপর…চিনু শর্মার অবস্থা একদম শেষের দিকে চ’লে যাবে।
(৬)
জ্যামিতি বাক্স নিয়ে বাড়ির দিকে পৌঁছাতেই গুল্লু ভিড় দেখল। সে ভাবল হয় তো কেউ মদ খেয়ে মাতলামি করছে বা বমি করছে! বস্তি অঞ্চলে এগুলো খুবই সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু, আজকের জটলাটা অন্যরকমের। কান্নাকাটির আওয়াজে চতুর্দিক ভ’রে গেছে।
গুল্লু সাইকেলটা নিয়ে একটু এগোতেই দেখল, তাঁর বাবা চিৎ হ’য়ে পড়ে আছে মাটিতে। মাথার পেছন দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে রক্ত। সত্তরের কাছাকাছি বয়সের চিনু শর্মা অচৈতন্য অবস্থায় মাটিতে শুয়ে।
“বাবুজি, ক্যায়সে হুয়া ইয়ে সব? রেশমা, এ রেশমা, ইয়ে সব ক্যায়সে?”- গুল্লু চিৎকার ক’রে জিজ্ঞেস করল তার স্ত্রীকে।
তার স্ত্রী বাকরুদ্ধ হ’য়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির দরজায়। গুল্লু আসার দু-মিনিট আগেই ঘটেছে ঘটনা। তাই, তাকে ফোন করার সময় পায়নি রেশমা। চিনু শর্মার পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার নাতনি রিঙ্কি। সে কেবল তার দাদাজিকে উঠে বসার অনুরোধ করছে। দশ বছরের মেয়ে হতবাক এইরকম অবস্থা দেখে। চিনু শর্মা রাতের খাওয়ার পর হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। তখনই তিনজন যাত্রী সওয়ার একটা বাইক ফুল স্পিডে এসে তাকে ধাক্কা মারে। ব্যাস… তারপর সেই আওয়াজ শুনে লোকজন ছুটে আসে। কিন্তু চেষ্টা করেও কেউ বাইকটাকে আটকাতে পারেনি। আর, রাতের বেলা আলো কম হওয়ায় নম্বর প্লেটটাও দেখে উঠতে পারেনি কেউ। গুল্লু বুঝেছে এগুলো কোনও মাতালের কাজ। মদ খেয়ে ফেরার সময় ঘটিয়েছে এই দুর্ঘটনা। এই এলাকাটা মাতাল আর চরিত্রহীনে ভ’রে গেছে। বাবাকে একা বেরোতে দেওয়াই তাদের ভুল হয়েছিল। কিন্তু, তার বাবা তো নিজেই সব কাজ করতে ভালোবাসেন, তাই তাঁকে বাধা দেওয়া যায় না কোনোকিছুতেই। তবে, আজকের ঘটনার জন্য নিজেকেই বারবার দোষ দিল গুল্লু।
পুঁটিরাম খুব তাড়াতাড়ি কোথা থেকে ভ্যান জোগাড় ক’রে এনেছে চিনু শর্মার জন্য। বস্তিতে মাঝেমধ্যে ঝগড়া হলেও, বিপদে সবাই সবার পাশে দাঁড়ায়। অ্যাম্বুলেন্সের জন্য তারা অপেক্ষা করে না। তারা গায়ে-গতরে খেটে বিপদের মোকাবিলা করে বিপদের।
গুল্লু তার বাবাকে নিয়ে ভ্যানের পেছনে চেপে বসল। আর, পুঁটি চালিয়ে নিয়ে গেল পলাশপুর সরকারি হাসপাতালে।
(৭)
সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ এগিয়ে আসেনি গুল্লুর জন্য। তার পাশের দোকানদারেরা, তার বস্তির লোকজন এবং তার পরিবার আছে বটে, কিন্তু গুল্লুর সমস্যার সমাধান তাদের সামর্থ্যের বাইরে। ডাক্তার সেন অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু জুনিয়র ডাক্তারকে এখনও সমাজের উচ্চবিত্তরা সেইভাবে পাত্তা দেন না!
“শালা, দোগলা দুনিয়া…হারামি শালা…দোগলা ইনসান…”-- হঠাৎ গুল্লু নিজের মনেই এই কথাগুলো আওড়ালো।
তার পাশে বসা পুঁটিরাম গুল্লুর কাঁধে হাত রাখল। গুল্লু আশা ছেড়ে দিয়েছে। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে। চিনু শর্মার মৃত্যু এখন সময়ের অপেক্ষা। ডাক্তার সেন রক্ত জোগাড় করার জন্য এদিক সেদিক দৌড়োচ্ছেন। কিন্তু, শেষ রক্ষা করা গেল না। চিরপুরাতন নিয়মে টাকার অভাবে, ক্ষমতার অভাবে শেষ হ’য়ে গেল একটা প্রাণ। বয়স যতই বেশি হোক, এইভাবে মেরে দেওয়ার অধিকার কেউ কী দিয়েছে সমাজকে? আর জোয়ান ছোকরা হলেও কী সমাজ বদলে দিত নিজের নিয়ম? নাহ, কখনোই না। সমাজ বরাবরের ভণ্ড। সামনে এক, পেছনে আরেক। ডাক্তার সেন একটা শববাহী গাড়ি ঠিক ক’রে দিলেন। মনে মনে ভাবলেন, “চিনু শর্মা মারা গেলেন গরীবের মতো, কিন্তু সৎকারটা অন্তত রাজার মতো হোক।”
গুল্লু তার বাবার ব্যান্ডেজে জড়ানো মাথায় একটা চুমু খেয়ে বলল, “আপকা ইস হারামি অউলাদ কো মাফ কর দিজিয়ে, বাবুজি। শালা, দোগলা দুনিয়া আপকো জিনে নেহি দিয়া।”
তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার ক’রে বলল, “উন সব কো ভি চ্যায়েন সে জিনে নেহি দেনা ভগওয়ান।”
কাঁদতে কাঁদতে বাকরুদ্ধ গুল্লু এবং তার সহমর্মীরা চলল চিনু শর্মার শব নিয়ে। এই মৃত্যু তাদের কথা কেড়ে নিয়েছে। শুধু, কিছুজনের মুখে অস্ফুটে বেরিয়ে এল, “রাম নাম সত্য হ্যায়”।
পথেই পড়ল দেবব্রত রায়ের বাড়ি। হঠাৎ, গুল্লু ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে মাটি থেকে তুলে নিল ঢিল। তারপর, সেই ঢিলে নিজের ঘেন্না ভরা থুতু দিয়ে ছুঁড়ে মারল ঢিল দেবব্রত রায়ের বাড়িতে। জানালা খোলা থাকায় ঢিল দোতলার ঘরের ভেতরে ঢুকে ভেঙে দিল কাচের আয়না। ঝনঝন শব্দে কেঁপে উঠল ঘর। প্রথমে দেবব্রত রায় বুঝে উঠতে না পারলেও, পরে বাইরে বেরিয়ে এলেন, “কোন স্কাউন্ড্রেল?”, বলতে বলতে। কিন্তু, আচমকা এই ঘটনা ঘটায় আর দেবব্রত রায়ের নিজেকে সামলে বেরিয়ে আসতে সামান্য দেরি হওয়ায়, ভিড় মিশে গেছিল দূরে। দেবব্রত রায় খুব ভালোভাবে বুঝতে পারেননি ব্যাপারটা। শুধু, সেদিন গুল্লুর ছোঁড়া ঢিলে ভেঙে গেছিল একটা আয়না। দেবব্রত রায়ের আয়না আসলে এই ভণ্ড সমাজের দর্পণ। এই আয়নাই বিভেদ ক’রে রেখেছে উঁচু-নিচুর। আর তাই এটাই ছিল গুল্লুর প্রতিবাদের প্রকাশ। কারণ, নাপিতের সাথে আয়নার সম্পর্ক যে খুব গভীর। এর বেশি আর কীই বা করতে পারে গুল্লু? পরের প্রজন্ম ওরই ভরসায় ব’সে আছে যে!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন