শনিবার, ২০ জুলাই, ২০২৪

উপন্যাস

চেনা ভয় অচেনা আপোষ 

অয়ন দাস





পর্ব - ১

বছরের ঠিক মাঝখানে আমি দুম করে আমার অতদিনের ভালো চাকরিটা ছেড়ে দিলাম।কিছু ছাড়তে গেলে এরকম দুম করেই ছাড়তে হয়।আসলে দুম করে বললেও ঠিক দুম করে নয়।আমার মনের ভিতর ছেড়ে দেওয়ার ভাবনাটা সঞ্চারিত হয়েছিল বেশ কিছুদিন আগেই।অনেকদিন আগেই কাজের জায়গা থেকে আমার মন উঠে গেছিল।

তখন আমি কোভিডে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতে শুয়ে রয়েছি।গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে।এদিকে আমার রিজিওনাল ম্যানেজার ও জোনাল ম্যানেজার আমাকে ক্রমাগত ফোন করে যাচ্ছে,আজ ব্যবসা কত হবে।কতখানি অমানবিক হলে এটা সম্ভব! দুদিন বাদেই আমি একটি মেল পেলাম যেখানে লেখা রয়েছে আমার দুটি পারফর্মিং হেড কোয়ার্টার আমার থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে এবং একটি নতুন নন পারফর্মিং হেড কোয়ার্টারকে আমাকে দেওয়া হয়েছে।সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিই যে আমি ছেড়ে দেব এই চাকরি। 

একজন বিকৃত মনস্ক মানুষের কাছাকাছি থাকলে অন্য মানুষটির ব্যক্তিত্বতেও তার আঁচ পড়ে। আমিও ক্রমশ যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম।

এক সর্বগ্রাসী ভয় আর অনিশ্চয়তা আমাকে ক্রমশ চেপে ধরছিল।

এখন মুশকিল হল চাকরি ছেড়ে দিলে আমার চলবে কি করে! মাসের এক তারিখে আমার মোবাইলে টুং করে একটা শব্দ হয় এবং একটি বিরাট অঙ্কের টাকা আমার একাউন্টে ঢোকে,চাকরিটা চলে গেলে সেটার কি হবে?

সুতরাং নতুন একটি চাকরি না পেয়ে এই চাকরি ছাড়ি কি করে?

মানুষ দু'বার চাকরি ছাড়ে।যেকোনো কাজই মানুষ দু'বার করে। একবার যখন সে সিদ্ধান্ত নেয় এবং আরেকবার যখন সে সিদ্ধান্ত এক্সিকিউট করে।

একটা চাকরি ছাড়া মানে তো শুধু একটা চাকরি ছাড়া নয়,একটা চাকরি ছাড়া মানে দীর্ঘ দিনের একটি অভ্যাসকে পরিত্যাগ করা।দীর্ঘদিনের একটি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার যন্ত্রণাকে সহ্য করা এবং সর্বপরি একটি অজানা অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে চলা।

এক এক দিন খুব ভোরে আমার ঘুম ভেঙে যেত।একসঙ্গে চা খাওয়ার পর আমি এবং রুমা, আমাদের মেয়ের একটি খাতা আর পেন নিয়ে হিসেব কষতে বসতাম।ঠিক কত টাকা রোজগার হলে আমাদের সংসার চলে যাবে।আমাকে মাসের মধ্যে তিনটি সপ্তাহ বাইরে বাইরে কাটাতে হত।রুমা ভীষণভাবে চাইছিল আমি ঘরে থাকি।

এবার আমি হিসেব করতে বসলাম আমার জমানো টাকা কত।কত টাকা ফিক্সড ডিপোজিট করলে কত টাকা সুদ পাবো।

সত্যি বলতে কি এতদিন শুধু গাধার মত পরিশ্রম করে গেছি।কলু'র বলদের মত কোম্পানির বেগার খেটে গেছি।আর কিচ্ছু চিন্তা করিনি।

আকস্মিকভাবে খেয়াল করলাম আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডে আমার একাউন্ট নম্বর ভুল থেকে গেছে,এতদিন খেয়াল করিনি।শুরু করলাম একনাগাড়ে ফলো আপ।

কোনো জায়গা থেকে মন উঠে গেলে সেই জায়গাটা বড় অসহ্য হয়ে যায়।আমার ইচ্ছে করছিল চাকরি নামক বস্তুটিকে দুই হাতের মধ্যে নিয়ে এসে গলা টিপে মেরে ফেলি এবং মেরে ফেলার আগে তার মুখে পেচ্ছাপ করে দিই কিন্তু সেটা পারছিলাম না কারণ আমার পেটের ভাত ওই চাকরির  টাকাতেই চলে।চাকরিটা ছাড়বো ছাড়বো করে কিছুতেই আর ছাড়া হচ্ছিল না।

বহরমপুর গেছি অফিস ট্যুরে, দুদিন পরেই মিটিং, একগাদা পেপার ওয়ার্ক্স। হোটেলের ঘরে বসে সেই পেপার ওয়ার্ক্স গুলো করতে গিয়েই আমার মনের ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠলো, এনাফ ইজ এনাফ।চলো এবার সম্পর্কটা শেষ করে দেওয়া যাক।

আমার দু একজন বন্ধু'কে ফোন করলাম। যা করছি ঠিক করছি তো? হাতে কোনো চাকরি নেই।একটা বিরাট রিস্ক হয়ে যাচ্ছে না তো?

পরেরদিন বহরমপুর থেকে বাড়ি ফিরে এসে মা,বাবা ও স্ত্রীকে একসঙ্গে বসিয়ে আমার সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করলাম।তিন জনেই বলল,এক্ষুনি এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসো।মা বললেন, তুই আগে চাকরি ছাড়,বাকিটা আমি বুঝে নেব।বাবা বললেন, যে চাকরি তোকে মানসিক যন্ত্রণা দিচ্ছে কী লাভ সেই চাকরি করে।স্ত্রী বলল,কিছু একটা ঠিক হয়ে যাবে,তুমি আগে চাকরি ছাড়ো।

পরের দিন রেজিগ্নেশন লেটার পাঠিয়ে দিলাম। মেইলটা করার পর আমার বুক থেকে যেন এক পাষাণ ভার নেমে গেল।আমার নিজেকে মনে হতে লাগল মুক্ত বিহঙ্গ। আমি নদীর তীরে চলে গেলাম।কোনো কারণ ছাড়াই একটি নৌকা ভাড়া করে গঙ্গার এপার থেকে ওপার পর্যন্ত গিয়ে আবার ওপার থেকে এপারে এলাম।তারপর আবার এপার থেকে ভেসে যেতে লাগলাম ওপারে।

এদিকে আমার সিনিয়র'রা একটানা আমাকে ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু একটা ফোনও আমি রিসিভ করছি না।অনেক গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ অর্ধেক হয়ে পড়ে আছে।ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট কিছু অ্যাসাইনমেন্ট আছে আজ।দুদিন পরে রিভিউ মিটিং, তার প্রস্তুতি আছে।

খবরটা ছড়িয়ে গেছে, আমার ফোনে একের পর এক ফোন আসছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। 

আমাকে ফোন করছেন আমার ইমিডিয়েট বস,তার বস,তারও বস।মোবাইলে একের পর এক হোয়াটসঅ্যাপ আসছে।

আমার মাথার উপর অনন্ত আকাশ,দুপাশে সবুজ বনানী, নদীতে এখন জোয়ার, আমি ভেসে চলেছি সেই স্রোতস্বিনী গঙ্গার উপর দিয়ে। 

আমি অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। মনে মনে বললাম, এতদিন আমাকে নিয়ে অনেক খেলেছো তোমরা। 

এবার আমি খেলবো।


ক্রমশ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

  প্রচ্ছদ ঋণঃ-  অদিতি সেনগুপ্ত