মাদ্রীর চিঠি
অদিতি সেনগুপ্ত
মহাভারতের একটি অবহেলিত চরিত্র মাদ্রী। তাঁর অব্যক্ত কথনকে ব্যক্ত করার চেষ্টা করলাম কুন্তীকে লেখা তাঁর এই চিঠির মাধ্যমে।
দিদি,
এই চিঠি যখন আপনার হাতে এসে পৌঁছবে তখন আমার নশ্বর শরীরটা পুড়ে একমুঠো ছাই হয়ে গেছে! অন্তরে কিছু কথা জমে পাহাড় হয়ে আছে বহুকাল যাবত। সেগুলি সঙ্গে নিয়ে যদি চলে যাই তাহলে আমার আত্মার মুক্তি ঘটবে না। তাই এই চিঠি রেখে গেলাম। স্বামীর চিতায় সহমৃতা হওয়ার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আমার। জীবনে অন্তত এই একটা বিষয়েই হয়তো আমার ইচ্ছে গুরুত্ব পেলো। আসলে আপনার সঙ্গে মহারাজের বিবাহ মন থেকে মেনে নিতে পারেননি ভীষ্ম, কারণ আপনি ছিলেন বেদব্যাসের পছন্দ। আর গোড়া থেকেই ব্যাসদেব এবং ভীষ্মের অন্তর্দন্ধ সর্বজনবিদিত। এরই ফলস্বরূপ আপনার স্বামী আমারও স্বামী হল! মদ্রদেশের নিয়ম অনুসারে কন্যাপণ দিয়ে আমাকে একপ্রকার কিনেই নিলেন মহান ভীষ্ম। মদ্ররাজ শল্যের সাহসও ছিল না তাঁর এই প্রস্তাবের অন্যথা করার। কারণ তাঁর স্মরণে ছিল কাশীরাজকন্যাদের বিবাহবিভ্রাট। যাই হোক বিবাহ সুসম্পন্ন হল এবং অষ্টাদশী আমি এলাম কুরু বংশের বধুরূপে। যদিও আমার অন্তর জানত যে, এ বিবাহ কখনই সুখকর হবে না। কেননা কোনো নারীই তার স্বামীর অধিকারের বিভাজন মেনে নিতে পারে না। আমার এই বৈবাহিক অসুখের মূল হোতা ছিলেন ভীষ্ম, ধীরে ধীরে উপলব্ধি করেছি কুরু বংশের রাজা না হয়েও যাবতীয় ক্ষমতা ছিল তাঁরই কুক্ষীগত। আসলে রাজপরিবার গুলোতে রাজকন্যাদের সঙ্গে এমনটাই হয়ে থাকে! গান্ধার রাজকন্যাও ছিলেন এর শিকার। নিজেদের অহং সন্তুষ্ট চরিতার্থ করতে আমাকে বেচাকেনার এক সামগ্রীতে পর্যভূষিত করা হল। কোনো আত্মসচেতন নারীই কী এটা মেনে নিতে পারে আপনিই বলুন! তবে হ্যাঁ... এ বিবাহ কূটনৈতিক চালের ফলাফল হলেও একথা অস্বীকার করব না যে আমি মহারাজকে অন্তর থেকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম!কেননা স্বামী হিসেবে তিনি ছিলেন উদার। এক প্রকৃত বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছিলাম আমি তাঁর মধ্যে। হয়তো শারীরিক সুখ দিতে না পারার অপারগতায় মনকেই সুখের আধার করে তুলেছিলেন তিনি। আর নারীর মনকে যে পুরুষ আশ্রয় দিতে পারে তাকেই ভালোবেসে ডুবে যায় নারী। ভেবে নিয়েছিলাম নাই বা হলো যৌন মিলন, স্পর্শসুখই বা কম কী? ভেদন নয়, প্রবল আশ্লেষের একটা চুম্বনও সুখের শীর্ষে পৌঁছে দিতে পারে। আমরাও তেমনই শারীরিক লিপ্সার আগ্রাসী খিদেকে নিষ্কাম ভালোবাসার উন্মুক্ত জমিতে মুক্তি দিয়েছিলাম।
কিন্তু এবং কিন্তু, আপনার যে অন্য ছক ছিল আর্যপুত্রকে নিয়ে! আর এই ছককে বাস্তবায়িত করতে উনিই ছিলেন আপনার একমাত্র অস্ত্র। নিজের জাগতিক বাসনাকে চরিতার্থ করতে কখনও দ্বিধাগ্রস্ত হননি আপনি। আবার ভাগ্য প্রতিকূল থাকলেও রাজমাতা হবার প্রবল ইচ্ছেকেও ত্যাগ করেননি কখনও। তবে একথাও ঠিক যে আপনার মধ্যে রাজমাতা হবার এই তীব্র আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিয়েছিলেন স্বয়ং কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। আসলে ভীষ্মের পরে কুরুবংশে বহিরাগত রক্তের প্রবেশ ঘটল। কেউই আর বিশুদ্ধ কৌরব রইল না। ধৃতরাষ্ট্র এবং আর্যপুত্র দুজনেই ছিলেন ব্যাসদেবের ঔরসজাত। কিন্তু অন্ধত্ব ওনার জ্যেষ্ঠপুত্রর থেকে সিংহাসন কেড়ে নিল। এখন যদি ধৃতরাষ্ট্রের সন্তান জ্যেষ্ঠ হয় তাহলেই সে রাজা হবে। এই আশংকা কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে দিচ্ছিল না ওঁদের জৈবিক পিতাকে। কিন্তু কেন! দুজনেই তো ওনার সন্তান! তাহলে উনি কেন চেয়েছিলেন পাণ্ডুপুত্রই সিংহাসনের উত্তরাধিকার লাভ করুক! আসলে এর নেপথ্যেও ছিল সেই গভীর অহং যুদ্ধ। যেহেতু ধৃতরাষ্ট্রের বিবাহের ক্ষেত্রে খাটেনি ব্যাসের কূটনীতি, তাই আর্যপুত্রের বিয়ে দিয়েছিলেন উনি নিজের পছন্দে। কিন্তু আর্যপুত্রের শারীরিক দুর্বলতা সত্ত্বেও উনি এই বিবাহ সংঘটিত করেছিলেন কেন? আসলে তিনি জানতেন দুর্বাশা মুনির থেকে প্রাপ্ত আপনার সেই বরের কথা, যে বরের জোরে চাইলেই আপনি হয়ে উঠতে পারেন দেবভোগ্যা এবং লাভ করতে পারেন তাঁদের ঔরসেজাত সন্তান।
আপনিই তো রাজি করিয়েছিলেন আর্যপুত্রকে ক্ষেত্রজ সন্তানের জন্য। মনে পড়ে আপনি তাঁকে বলেছিলেন, "এ পরিবারের এ রীতি নতুন কিছু তো নয়! মনে রেখো জীবনে জয়লাভ করাটাই মূখ্য, জয় কোনপথে এলো সেটা কেউ মনে রাখেনা, মনে রাখে জয়ীকে।" আপনার মানসিক দৃঢ়তা যে সাংঘাতিক তাতো বলাই বাহুল্য। তাইতো আপনি রাজপরিবারে থেকেও স্বামীর বর্তমানে আমাদের দেবর বিদুরের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। যদিও এইদুই ভাইয়ের থেকে বিদুর সর্বতোভাবে উপযুক্ত ছিল সিংহাসনের দায়ভার গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু শূদ্রা দাসীর গর্ভজাত হওয়ায় সে পেলোনা নিজের যোগ্য স্থান। মনে পড়ে সেই রাতের কথা? হঠাৎই দেখেছিলাম আপনাকে বিদুরের বাহুডোরে! মিথ্যে বলব না, শারীরিক সুখ না পাওয়া এই মাদ্রীর মধ্যেও সেইরাতে জেগে উঠেছিল অবদমিত কাম! তারপর সেই যেদিন শুনলেন যে ধৃতরাষ্ট্র পত্নী গান্ধারী গর্ভবতী, লহমায় নড়ে গেলো আপনার জমি। আর্যপুত্রকে সর্বতোভাবে বোঝালেন বনবাসে যাওয়ার জন্য এবং রাজিও করালেন তাঁকে। যাতে সকলের চোখের আড়ালে জন্ম দিতে পারেন দেবতার ঔরসজাত তাঁর সন্তানেরা। মুখচোরা স্বভাবের হলেও রাজ্য রাজনীতির গভীর নেপথ্য ষড়যন্ত্র বোঝার মত দূরদৃষ্টি আমার ছিল। আর্যপুত্রকে আক্ষেপ করে বলেছিলাম, আপনি না বললেও আমি জানি যে হস্তিনাপুর ছাড়ার কারণ দিদি। উনিই আপনাকে বাধ্য করেছেন একাজ করতে। কিন্তু আপনি কেন এই কাজ করেছিলেন সেটা উনি জানার চেষ্টাই করেননি। এরপর আর কী পরপর ঘটনাবলি এগিয়ে চলল আপনার লেখা চিত্রনাট্যের পাতা ধরে। জন্ম দিলেন কুরু বংশের উত্তরাধিকারের। জন্ম নিল আপনার আরও দুই পুত্র। তারপর একপ্রকার বাধ্য হয়েই আমার প্রতি সদয় হলেন আপনি। মা হলাম আমি। এরপর এক বসন্তের মনোরম সন্ধ্যায় এলো সেই অভিশপ্ত সময়। আর্যপুত্র এড়াতে পারলেন না আমার শারীরিক আকর্ষণ, ভুলে গেলেন নিজের মৃত্যুশাপ! সদ্য স্বামীহারা মাদ্রীর গগনভেদী কান্নার শব্দে ছুটে এলেন আপনি। মনের জ্বালা মিটিয়ে তিরষ্কারও করলেন। এই চুড়ান্ত কূটনৈতিক পরিবেশের মধ্যে যে আমি কখনও শান্তি পাবো না একথা আমি বুঝে গিয়েছিলাম। তাইতো নিজের সন্তানদ্বয়কে তুলে দিলাম আপনার হাতে। মিথ্যে বললাম যে, আপনার সন্তানদের মাতৃস্নেহ দিতে আমি অপারগ। আপনি যদিও সহমৃতা হওয়ার অভিনয় করেছিলেন, কিন্তু আমি জীবনে প্রথম মাথা নোয়াইনি আপনার সম্মুখে। যাইহোক সব নগ্ন সত্যিকে অন্তরে নিয়ে আমি চলে গেলাম। এবার হস্তিনাপুরে প্রত্যাবর্তনের পথেও আর তেমন বাধা রইল না। আসলে বেঁচে মরে থাকার চাইতে মরে বেঁচে যাওয়া শ্রেয়। তাই স্বামীর সহগামিনী হয়ে এই রাজনীতি আর অপমানের জীবন থেকে মুক্ত হলাম। তবে আমার রেখে যাওয়া এই চিঠি আপনাকে কখনও শান্তির যাপন দেবেনা। স্বস্তিও পাবেন না দিনান্তিকে।
বিদায়...
ইতি
মদ্ররাজকন্যা মাদ্রী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন