কবিতার ভাল-মন্দ
শ্রীমন্ত সেন
প্রাক্ কথন
কবিগুরু তাঁর ‘ঐকতান’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘শুধু ভঙ্গি দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ’। দুঃখের বিষয় আজকাল সেই ভঙ্গিসর্বস্ব কবিতা লেখার প্রবণতা বড় উৎকটভাবে দৃশ্যমান। এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃত কাব্যজগতের অনুসন্ধানে আমাদের অবশ্যই ব্রতী হতে হবে। এখানেই কবিতার ভাল-মন্দ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তাই আজ বাইশে শ্রাবণে কবিগুরুর মহাপ্রয়াণদিবসে সেই আলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক। তাঁকে স্মরণের মাধ্যমে এই প্রসঙ্গে আলোকপাত করে নিজেই ধন্য হই।
প্রথমেই স্বীকার করি যে আমি সেই অর্থে কবি নই, তবে আমি বরাবরই কাব্য সরস্বতী-র এক নগণ্য অনুরক্ত মাত্র। যেহেতু সারস্বত অঙ্গনে প্রাণের টানেই পড়ে আছি এবং বয়সও কম হয়নি, তাই কবিতা কী, কোনটা ভাল কবিতা ও কোনটাই বা খারাপ কবিতা—সে সম্বন্ধে সুস্পষ্ট না হলেও একটা অস্পষ্ট ধারণা অন্তত হয়েছে। উপরন্তু সারস্বত পত্রিকা ‘কবিতার আলো’-র সন্নিধানে এসে সেই কিঞ্চিত হলেও ধারণা-ঋদ্ধ হয়েছি। সেই ধারণাকে সম্বল করেই আমার আজকের এই আলোচনা। মনে হতেই পারে যে এ অনধিকারীর আলোচনা—হতেই পারে। আমি প্রথমেই তাই মাফ চেয়ে নিচ্ছি।
‘কবিতার আলো’-র পর্যবেক্ষণ
এ কথা অনস্বীকার্য যে আজকাল কবিতা প্রচুর পরিমাণে লেখা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাদের বেশির ভাগই ‘কবিতা পদবাচ্য’ নয়। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন –‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ যে সব তথাকথিত কবিতা লেখা হচ্ছে তাদের বেশ কিছু বিবৃতি, প্রতিবেদন বা রিপোর্টিং মাত্র, যা সাংবাদিকের কাজ, কবির নয়। কিছু কিছু তথাকথিত কবিতা তো স্লোগান ছাড়া কিছুই নয়।
আবার কিছু ছন্দোময় কবিতার নামে ছন্দোহীন বা ছন্দসামঞ্জস্যহীন রচনা। তেমনই কিছু কবিতা ‘আধুনিক গদ্যকবিতা’-র নামে যথেচ্ছাচার, তা না কবিতা না গদ্য। মনে রাখতে অনেকেই ভুলে যান যে গদ্য কবিতায় চাক্ষুষ ছন্দের দোলা না থাকলেও, অন্তর্লীন ছন্দস্পন্দন তো থাকারই কথা, যেমন রবীন্দ্রনাথেরই গানে আছে ‘নয়নসমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’। এ ছাড়া ভাবসৌন্দর্যের দোলা তো থাকেই।
একটি অনলাইন পত্রিকার ঘড়ি বিষয়ক লেখা আহ্বানের প্রেক্ষিতে এক কবি লিখলেন ঘড়ির আকার, অবয়ব, তার কী কী যন্ত্রাংশ থাকে অর্থাৎ কটি কাঁটা ইত্যাদি, যুগে যুগে তার আকারের বিবর্তন প্রভৃতি নিয়ে কবিতা। আর একজন লিখলেন—
মহাকালের ঘড়ি
এখানে সময় দ্যাখে আপনার মুখ,
এখানে ক্রমশ জমে দুরাশার ছায়া,
এখানে সময় রাখে সব সুখ-দুখ,
এখানে প্রতি পদে আগামীর ছায়া।
পিছুটান ভেঙে চলা মানুষের মাপে,
উৎসুক বিশ্বের অফুরান ডাক,
মহাকাল জেগে থাকে নিমেষের খাপে,
নশ্বর জীবনের সীমানা ছাড়াক। (মাত্রাবৃত্ত ছন্দে)
প্রথম কবিতাটি একটি প্রতিবেদন বা রিপোর্ট ব্যতীত কিছুই নয়। কিন্তু দ্বিতীয় কবিতাটি কবিতায় সময়কে ধরে রাখতে সক্ষম হল। মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক রচিত হল। ‘পিছুটান ভেঙে চলা মানুষের মাপে।’ … ‘মহাকাল জেগে থাকে নিমেষের খাপে’। যা নিয়ে কবিতা, তাকে ছাড়িয়ে অন্যমাত্রায় পৌঁছে যাওয়ার মধ্যেই কবিতার সার্থকতা—নিমেষ তখন শাশ্বতে পরিণত হয়।
উল্লেখ্য যে বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভায় বলা হয়েছিল-- সামনে একটি শুকনো কাঠ পড়ে আছে—এই ভেবে মুখে মুখে একটা শ্লোক রচনা করতে। এক কবি বললেন, ‘শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠত্যগ্রে (‘তিষ্ঠতি+অগ্রে’) -–মানে ‘সামনে একটি শুকনো কাঠ পড়ে আছে’। তিনি আক্ষরিক অর্থে ভাবকে কবিতায় ধরলেন। আর মহাকবি কালিদাস বললেন, ‘নীরসঃ তরুবরঃ পুরতো ভাতি’—অর্থাৎ তরুদের মধ্যে বরণীয় এক নীরস তরু সম্মুখে বিভাসিত হচ্ছেন—এইখানে তিনি তরুতে মনুষ্যত্ব আরোপ করে সম্মানিত করলেন—ভাবকে প্রকাশের উত্তুঙ্গ মাত্রায় নিয়ে গেলেন। এইখানেই ভাল ও মন্দের কবিতার পার্থক্য।
‘কবিতার আলো’-র অভিমত
‘কবিতার আলো’-র মতে ‘সৌন্দর্যই কবিতার মূল গঠনবৈশিষ্ঠ্যের ধর্ম ও বক্তব্য’। কাব্যময় শব্দদ্যুতি পাঠকের মনকে বিভাসিত করে তোলে, ভাবকে তার অব্যর্থ লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে কবিতা স্থবির নয়, তার প্রকাশভঙ্গিও অটল অচল অপরিবর্তনীয় কোনও বস্তু নয়। আগেকার কবিতা আর এখনকার কবিতার অভিমুখ, ভাব আর প্রকাশ এক নয়। এটা আমাদের মানতেই হবে। কিন্তু তথাকথিত অনেক কবিই তা মানেন না, ফলে তাঁরা পুরনো কাব্যধাঁচেই পড়ে আছেন, যা এ যুগে শুধু বেমানানই নয়, হাস্যকরও কোনও কোনও ক্ষেত্রে। যুগ বদলাচ্ছে কিন্তু কবিতা বদলাবে না—এ তো হতে পারে না। তাই কবিতায় যুগযন্ত্রণার প্রকাশ অবশ্যম্ভাবী এবং তা অবশ্যই সাম্প্রতিক কবিতাভাষায়।
কবিতার ভাব ও প্রকাশ
সব ক্ষেত্রেই যেমন, কবিতার ক্ষেত্রেও তেমনই থাকে কালের দাবি। সেই দাবি মানতে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ কালোত্তীর্ণ কবিরা তা মেনেছেন, তাই তাঁদের স্বকাল পেরিয়ে তাঁদের কবিতা আজও ভাস্বর। কিন্তু তাই বলে তাঁদের অনুসৃত ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি আজও অনুসরণযোগ্য—এ কথা সত্য নয়। সে যুগের ক্ষেত্রে তা যথাযথ থাকলেও এ যুগে তা অচল—এ কথা স্বীকার করার মধ্যে কোনও গ্লানি নেই।
যেমন তখনকার প্রাসঙ্গিক কিছু শব্দ বা শব্দবন্ধ এই যুগের কবিতায় অচল। যথা—‘তরে, মম, তব, নেহারি, অয়ি, লো, দিঠি, মোর পরে, ভ্রমি, উছলি, আজি, উচ্ছ্বসি, মোর, মোরে, দোঁহে, দুঁহুঁ, তেঁউ, তোরে, আমারে, তাহারে, কারে, কাহারে, যারে, যাহারে, বিসরি, পাশরি, জলকে, কী পরি, আজিকে, উথলি, মাঝে, সনে, সাথে, লাগি, স্মরি, জনমে, ত্যজি, নারি (পারি না অর্থে), হেরো, সিনান, অবগাহি, মরমে মরি, লভিনু, বরিনু, মাঝারে’ ইত্যাদি শব্দ বা শব্দবন্ধ আজকের যুগের কবিতায় ব্যবহার না করাই শ্রেয়।
একই কারণে ‘ডাবল ৭মী বিভক্তি’-ও পরিত্যাজ্য। ‘ঘরেতে, বনেতে, মনেতে, সাঁঝেতে, বসনেতে, সাগরেতে’ ইত্যাদি ডাবল-৭মী বিভক্তিযুক্ত শব্দ না ব্যবহার করাই ভাল। যেখানে ‘ঘর’ শব্দের ৭মীর একবচন ‘ঘরে’ বললেই মিটে যায়, সেখানে আবার ৭মী বিভক্তি ‘তে’ ব্যবহার করে ‘ঘরেতে’ করার কোনও যুক্তি নেই। তাই যুগের প্রয়োজনে এই সংশোধন। কিন্তু আজকের যুগেও বহু কবিই তাঁদের কবিতায় এই জাতীয় শব্দ অক্লেশে ব্যবহার করে চলেছেন। ফলে সেই কবিতাগুলি প্রকাশের দিক দিয়ে খারাপ কবিতা-র শ্রেণিতে গণ্য হচ্ছে। আমরা অগ্রসর হব সামনের দিকে—পিছনের দিকে নয়। অবশ্যই পিছন ফিরে তাকাব—সে আমাদের ঐতিহ্যময় অতুল রত্নভাণ্ডারের মণিমাণিক্যের আকর্ষণে—পথের দিশা নির্ধারণে।
ছন্দ-কবিতা/ পদ্যকবিতা
দুঃখের বিষয় অনেকেই ছন্দ না জেনেই ছন্দ-কবিতা বা পদ্য কবিতা লিখে থাকেন। তাঁদের কবিতায় পর্ববিন্যাস তথা মাত্রাবিন্যাস করা যায় না। প্রতিটি ছন্দের আলাদা নিয়ম ও চলন আছে। সেগুলি অনেকেই জানেন না বা জেনেও মানেন না। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে অন্ত্যমিলই বুঝি ছন্দ-কবিতা বা পদ্য কবিতার একমাত্র লক্ষণ বা পরিচয়। তাই তাঁরা ছন্দের চলনের তোয়াক্কা না করে যেমন-তেমনভাবে লিখে শেষে অন্ত্যমিল দিয়ে ভাবেন যে বুঝি সব দায় সারা হয়ে গেল। কিন্তু মনে রাখতে হবে অন্ত্যমিল ছন্দ নয়। তাই কবিতা লিখতে হলে (এমনকী গদ্যকবিতাও) আগে ছন্দ শিখতে হবে, তাদের চলন জানতে হবে, পর্ব/মাত্রাবিন্যাস জানতে হবে, তাল ও লয় জানতে হবে এবং বিভিন্ন ছন্দের পার্থক্যও জানতে হবে।
আবার অন্ত্যমিলেও হাস্যকর অসামঞ্জস্য লক্ষিত হয়। যেমন—ভরা/তোড়া, গন্ধ/বন্ধু, চুপ ক’রে/ আর ঘরে, ঘাটে/লোটে, হোলি/তুলি, যাই/কেউ-ই, খেলা/(বালুকা)বেলা, বেড়ে/দূরে, ধরে/দূরে, আকৃতি/প্রশান্তি, ডালি/হোলি, লিখি/পাখি, বিনিদ্রা/তন্দ্রা, বাহানা/মাহিনা, ভাজা/মজা, শ্রেষ্ঠ/কষ্ট, যাই/কেউ-ই ইত্যাদি।
এখানে উল্লেখ যোগ্য যে একমাত্র শেষ অক্ষরের মিলই অন্ত্যমিলের মণিকাঞ্চনযোগ নয়। অন্তত শেষ দুটি অক্ষরের সাদৃশ্য ভদ্রগোছের অন্ত্যমিলের সহায়ক। এখানে ‘ভরা’-য় ‘ভ’ অকারযুক্ত, আর ‘তোড়া-য় ‘ত’ ওকারযুক্ত। ‘গন্ধ’-এ ‘ন্ধ’ অকারযুক্ত, ‘বন্ধু’-তে ‘ন্ধু’ উকারযুক্ত। ‘খেলা’-য় ‘খে’ ‘বিকৃত’ বা ‘অর্ধ-বিবৃত’ একার যুক্ত, উচ্চারণ ‘খ্যা’ আর ‘বেলা’-য় ‘বে’ ‘স্বাভাবিক’ বা ‘অর্ধ-সংবৃত’ একারযুক্ত, উচ্চার ‘বে’... ইত্যাদি। এইদিকে অবশ্যই দৃষ্টিপাত আবশ্যক।
গদ্যকবিতা
মনে রাখতে হবে যে যুগের প্রয়োজনেই গদ্যকবিতার জন্ম হয়েছে। কিন্তু ছন্দের মধ্যে থেকেই ছন্দ ভেঙেই তার জন্ম। এই জন্ম হয়েছে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মুক্তক থেকে—তা আবার দুই প্রকার—ক) সমিল মুক্তক ও খ) অমিল মুক্তক। মুক্তক-এর অর্থ-- সব পঙক্তিতে সমমাত্রার পর্ব থাকে না। কোনও পঙক্তিতে হয়তো ‘৮—৬—২’ মাত্রার পর্ব। আবার কোনও পঙক্তিতে ‘৬—৪—২’ মাত্রার পর্ব।
সমিল মুক্তকে অন্ত্যমিল থাকে কিন্তু অমিল মুক্তকে অন্ত্যমিল থাকে না। এই মুক্তক থেকেই গদ্যকবিতার জয়যাত্রা শুরু। সেখানে এইসব পর্ব বা মাত্রার বিষয়টি সেভাবে না থাকলেও একটা অন্তর্নিহিত ছন্দের দোলা থাকেই। তাতেই কবিতা প্রাণস্পর্শী হয়ে ওঠে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, অনেক গদ্যকবিতায় সেই ছন্দের অন্তর্লীন দোলাটুকু অনুপস্থিত থাকে। তাই তা নিষ্প্রাণ শব্দগুচ্ছ ব্যতীত আর কিছুই নয়—কবিতা তো নয়ই, খারাপ কবিতাও নয়।
কবিতার ভাল-মন্দ
ভাল কবিতা তখনই হয় যখন তার ভাব ও প্রকাশ দুই-ই ভাল হয়। কেবল ভাব ভাল—কিন্তু প্রকাশ তদনুরূপ নয়, সেক্ষেত্রে সেটি ভাল কবিতা হতে পারে না। আবার ভাব ভাল নয়, কিন্তু প্রকাশ খুব ভাল—সেক্ষেত্রেও তা ভাল কবিতা বলে বিবেচিত হবে না।
একটি সার্থক গদ্যকবিতার উদাহরণ—
ছায়া
শ্রী কৌশিক দাস
“সে আমাকে একটি গাছের ছায়ায় দাঁড় করিয়ে রেখে চলে
গিয়েছিল একদিন।
গাছ নেই, কেবল ছায়াটি আঁকড়ে আমি পড়েছিলাম নিযুত বছর।
একদিন বিকেলবেলা ছায়াটি ছাই রঙা পাখি হয়ে উড়ে যেতে
যেতে বলে গেল—
“প্রেমিক, বাড়ি যাও! ছায়ারা চিরদিন পলাতক।”
দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরি! দরজা অবধি অনার্য ঘাস। কেবল তুলসী
তলায় আমলকি গাছের নীচে একটি ন্যূব্জ ছায়া মুছে যেতে যেতে
বলে গেল—
“খোকা, এত দেরি করলি!” (‘কবিতার আলো’-য় প্রকাশিত)
এখানে ছায়ার প্রতীকের আড়ালে এক অমোঘ সত্যকে কত রঙে এঁকে দিলেন কবি। আমাদের মনও ছায়ামেদুর হয়ে ওঠে অনায়াসে।
উগ্র আধুনিকতার নামে উগ্র যৌনসর্বস্বতা
অতি আধুনিকতামনস্ক কিছু কিছু কবি ভাবেন উগ্র যৌনসর্বস্বতাই বুঝি ভাল কবিতার একমাত্র বৈশিষ্ঠ্য। কিন্তু তাঁরা ভুলে যান যে তা আমাদের দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে সুসমঞ্জস নয়—কাব্যসরস্বতীর সঙ্গে তো নয়ই। কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে যৌনতার উদগ্র নিদর্শন—এতে তাঁদের যৌন প্রদর্শনবাতিকের স্ফুর্তি হয় বটে কিন্তু কাব্যসরস্বতীর আত্মিক অস্বস্তি বাড়ে বই কমে না। অথচ উগ্র যৌনতার প্রদর্শন না করেও মানব-মানবীর প্রেম সুস্নিগ্ধভাবে বর্ণনা করা যায়। আমি সেই অর্থে কবি নই, তবু আমার একটি কবিতায় বিনম্রভাবে তা দেখাতে চেষ্টা করেছি—
‘চুম্বন-ক্ষণ’
কোথায় ছিল তোমার দীপ্র সাহস-ভরা মন?
নাওনি কেন এতদিনেও একটিও চুম্বন?
বিষের ভয়ে? কোলাহলের উদগ্র দর্শন
কেড়েই নিল এ দুজনার অলীক কিছু ক্ষণ?
আর কি এসে সেই পাখিটা তাকাবে জুল জুল!
আর কি ঝুঁকে পড়বে ঝরে কুমারী বকুল!
ভেসে যাওয়া প্রতি নিমেষ ছিল সমুৎসুক,
বৃথাই দিলে বেচারীদের অভাবিত দুখ।
হত না হয় একটি নিমেষ অজর চিরন্তন,
হত না হয় কালের বুকে ছায়াপথের ধন।
বাইরে না থাক, ও বসন্তের এবুকে অবস্থান,
অন্তত চুম্বনে তাকেও এইটুকু দাও মান।
টলুক গিরি, উঠুক ঝঞ্ঝা, প্রবল জলোচ্ছ্বাস,
একঘেয়েমির আঁস্তাকুড়েও আসুক না বিভাস।
নব যুগের কবি লিখুন ‘গীতগোবিন্দম্’,
নতুন রবি বর্মা আঁকুন আভাস মনোরম।
এটি ভাল না মন্দ কবিতার মধ্যে পড়ে, সে বিচারের ভার আপনাদের উপরই ছেড়ে দিলাম।
পুরাতন প্রকরণে ভাব ও প্রকাশের আধুনিকীকরণ
পুরাতন রীতিকে যুগোপযোগী করে নতুন ভাবের বৈভবে রসস্থ করেও অনায়াসে প্রকাশ করা যায়। তাতে অতীত বর্তমানের দ্বারে এসে সুরম্য হয়ে ধরা দেয়। যেমন—বিশিষ্ট কবি ও ‘কবিতার আলো’-র সম্পাদক শ্রী বৈজয়ন্ত রাহা মহোদয়ের রচিত নীচের সনেটটি—
স্বপ্ন
যেভাবে অধর তোলে বিষাদের আলো
প্রেমিকার দেশ থেকে উৎসের খোঁজে
জলের মিনার জানে সেভাবে ঘনালো
নদীর ভিতরে নদী, ভুলে চোখ বোজে,
অকারণে দূর চায় নিকটের দূর,
সাঁজবেলা লুফে নেয় রাতচোরা স্তব
হেরে যাওয়া বাঁশি শোনে রাখালিয়া সুর
ঘরে ঘরে ঘোরে নদী, মরা উৎসব
জল তাই চুপ চাপ নীচে বয়ে যায়
শিয়রে বসেনি আলো, ঘুম স্মৃতিহীন
কাছের মানুষ শোনে সাঁকো-বাহানায়
নদীর উপর নদী ভেসে থাকে ক্ষীণ
চিবুকে আঙুল রাখি, চোখে রাখি চোখ
আজ থেকে সব কষ্ট শুধু আমি হোক
আমরা বিস্মিত না হয়ে পারি না কী ভাবে অধুনা প্রায় অব্যবহৃত একটি প্রকরণে ভাষা মাটির কাছাকাছি এসে বুকে নাড়া দিয়ে গেল “আজ থেকে সব কষ্ট শুধু আমি হোক”—এটি সত্যিই ভাবে ও প্রকাশে একটি ভাল কবিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
ভাল কবিতা নিয়ে কিছু কথা
শ্রী রাহার মতে কবির মননের স্তরই কবিতায় ফুটে ওঠে। ভাল কবিতা এক এক বার পড়লে এক এক রকম ভাব ফুটে ওঠে।
কবির হৃদয়ে কল্পনা এবং কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তশক্তির সহাবস্থান। কোনও কিছুর সঙ্গে আত্মিক সংযোগ-স্থাপনই হল ভাল কবিতার জন্মের উৎস। পথের পাশে একটি বুনোফুল পড়ে আছে। কেউ তা লক্ষ করেন কেউ বা করেন না। যিনি ওই বুনোফুলের সঙ্গে আত্মিক সংযোগ স্থাপন করতে পারেন এবং তাঁর কবিতায় তাকে অনুভবের সঙ্গে প্রকাশ করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত কবি। আর প্রকৃত কবি ক্ষণজন্মা প্রাণ।
ভাল কবিতা পড়লে বা শুনলে মন আনন্দে রিন রিন করে বেজে ওঠে, তার প্রভাব অনেক দিন পরেও রয়ে যায়। কবির যন্ত্রণা কবিতার আঁতুড়ঘর। কবি তাঁর যন্ত্রণাকে আস্বাদ্যমান এবং রসময় করে কবিতায় প্রকাশ করেন। ব্যক্তিগত আনন্দকেও আস্বাদ্যমান ও রসময় করে সার্বজনীন করে প্রকাশ করেন। বেদনার অনুভূতিকে দ্রষ্টা হয়ে বিশ্বজনীন করে তোলেন।
কবির অলৌকিক ক্ষমতা আছে, শব্দ দিয়ে অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারেন। কবি শুধু কবি নন। কবি দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, অদ্ভুত মনের অধিকারী। কবি আল মাহমুদ বলেছেন যে কবি পারেন নিজের সংস্কৃতি, বিশ্বাস, ঐতিহ্য, উপলব্ধি ও অনুভবগুলিকে সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে কবির নিজের মনে নিজস্ব সাম্রাজ্য আছে। এর সঙ্গে বাস্তবজগতের সত্যের কোনও মিল নেই। তাই কবিতার সঙ্গে বাস্তবজগতের মিল খুঁজতে গেলে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কবির বয়স হয় না। কবিতায় কবিকে চেনা যায়। কবিতা যখন প্রকৃত অর্থে কবিতা হয়ে ওঠে, তখন আর ভাল কবিতা ও খারাপ কবিতা বলে কিছু থাকে না। কবিতা তখন সব কিছুর ঊর্ধ্বে ভাস্বর ও বাঙ্ময় হয়ে ওঠে।
উপসংহার
প্রকৃত ভাল কবিতা লিখতে গেলে আগে আত্মস্থ হতে হবে, ভাবের অনুভবে মনকে ঋদ্ধ করে প্রকাশের যুগোপযোগী দিশা খুঁজে নিতে হবে। তবেই রসময় সুন্দরের আবির্ভাব হবে—অক্ষরে অক্ষরে তার রসঘন অবস্থান ঘটবে। এটি সারস্বত সাধনার পৌনঃপুনিক অনুশীলনের ফলেই সম্ভবপর হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন