প্রচ্ছদ ঋণঃ- পিনাকী রায় (কণিষ্ক)
সূচীপত্র
-----------------------
প্রচ্ছদ
------------------
পিনাকী রায় (কণিষ্ক)
সম্পাদকীয় কলাম
-----------------------------
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
-----------------------------
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
কবিতা ভিত্তিক
------------------
------------------
অঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়
সুশান্ত সেন
প্রদীপ সরকার
গোবিন্দ মোদক
সম্মিলন
------------------
রূপক চট্টোপাধ্যায়
উৎপল দাস
শাশ্বত বোস
স্মৃতির দুয়ারে
------------------
কেতকী বসু
ডাকঘর
------------------
মেনকা সামন্ত
মুক্তপদ্য
------------------
সৌরভ বর্ধন
শংকর ব্রহ্ম
ঋদ্ধি ঘোষ
কথাচিত্র
------------------------------------
দীপাঞ্জন চাকলাদার
সম্পাদকীয় কলাম
-----------------------
সবেমাত্র শেষ হলো কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা। এখনো পর্যন্ত তার রেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমরা। বইমেলা মানেই প্রচুর নতুন বইয়ের সমাহার। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে বইমেলা বাঙালির বারো মাসের চোদ্দতম পার্বণ। আর বইমেলা শেষ হওয়ার পর আমরা হাজির হলাম কবিতার আলো ফেব্রুয়ারি ওয়েবজিন সংখ্যা প্রকাশের মুহূর্তে। কবিতার আলোর কর্মকাণ্ড সম্বন্ধে আপনারা ইতিমধ্যেই অনেকে জেনে গেছেন। আমরা কবিতার আলোকে উত্তর আধুনিক সাহিত্য চর্চার আলোকের অভিমুখে নিয়ে যেতে শুরু করেছি। কবিতার বিগত একশো বছরের যাত্রাপথকে মানদণ্ড ধরে বর্তমান সাহিত্য পথের দিশা খুঁজে পাওয়াই আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। আর সেই দিক থেকে আমরা কিছুটা সফলও বটে। কারন যে পরিমাণ লেখা আমরা আপনাদের থেকে গ্রহণ করছি, তা থেকে বোঝা যায় আপনারা কবিতার আলো'কে কিভাবে গ্রহণ করেছেন। লেখা বাছাই পর্বে আমাদেরকে রীতিমত বেগ পেতে হয়। কারণ অসংখ্য ভালো লেখা থেকে কয়েকটি লেখাকে বেছে নেওয়া বড় কঠিন একটি কাজ। কিন্তু সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে হলে এই দায় যে কাঁধে তুলে নিতেই হয়। কবিতার আলো সেই দিক থেকে বর্তমানে সমৃদ্ধ এবং পরিণত।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। তা হল আমাদের ফেব্রুয়ারি মাসের সংখ্যা প্রকাশিত হচ্ছে৷ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিনে। ভাষা দিবসের এই দিনে কবিতার আলো প্রকাশ হওয়ার বিষয়টি যদিও ইচ্ছাকৃত নয়। কারণ আপনারা জানেন আমরা প্রতি মাসের ২১ তারিখ একটি করে ওয়েবজিন সংখ্যা আপনাদেরকে উপহার দিই। কিন্তু ২১ তারিখ দিনটি আমরা পছন্দ করেছিলাম ভাষা দিবসের কথা মাথায় রেখেই। আর তাই ফেব্রুয়ারি মাসের এই দিনেই আমরা আপনাদের কাছে এই মাসের সংখ্যাটি তুলে দিচ্ছি। যে ভাষা দিবসে সারা পৃথিবীতে বাংলা ভাষার গায়ে লেগে আছে বরকত, রফিক, জাব্বারদের রক্ত, আমরা সেই দিনটি একটি নতুন সংখ্যার মাধ্যমে উদযাপন করব বলে প্রস্তুত হয়েছি। তাই আজকের সংখ্যার বিষয় শুধুমাত্র ভাষাদিবসের উপর না হলেও এটিকে উৎসর্গ করলাম সেই এগারো জন মহান ভাষা শহীদদের স্মরণে। তাই ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখে প্রকাশিত হওয়া আজকের এই সংখ্যাটি যে একটি বিশেষ তাৎপর্য রাখে তা অস্বীকার করা যায় না। আজ এই মহান দিনে সেই এগারো জন ভাষা শহীদদের চরণে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করলাম।
কবিতার আলো বেশ কিছুদিন ধরে ওয়েবজিন সংখ্যা প্রকাশ করে আসছে। আমরা যেমন বিষয়ভিত্তিক কাজ করেছি, ঠিক তেমন সাধারণ সংখ্যাও বহুবার বের করেছি। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হল বাংলা কবিতার আলোকে পাঠকদের আলোকিত করা। এইবারের সংখ্যায় বাছাই করে বিশেষ কিছু লেখাকে আমাদের ওয়েবজিনের পাতায় রাখা হলো। ই-পত্রিকার প্রসার বর্তমানে কতটা প্রবল তা আপনারা জানেন। বর্তমান নেটিজেনদের মধ্যে এই পত্রিকার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। তাই সেই জনপ্রিয়তাকে মাথায় রেখে এবং বর্তমান প্রজন্মের পাঠকদের কাছে আমাদের কাজ সহজে পৌঁছে দেওয়ার জন্য আমরা মূলত ই-পত্রিকার কাজ শুরু করি। তারপর তা ধীরে ধীরে আজকের জনপ্রিয় জায়গায় পৌঁছে যায়। আজ যে সংখ্যাটি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি তা মূলত উত্তর আধুনিক কিছু লেখার উপর ভিত্তি করে প্রকাশ করা। বর্তমানে যারা লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন তাঁদের প্রত্যেকের কাছ থেকেই ভালো এবং মৌলিক কিছু লেখা আমরা পেয়েছি। যাঁদের লেখা এই সংখ্যায় রাখতে পারিনি তাঁদের কাছে আবার পাঠানোর অনুরোধ রইলো। আর যাঁদের লেখা এই সংখ্যায় রইল, তাঁদের কাছে অনুরোধ করব সম্পূর্ণ পত্রিকাটি পড়বার এবং সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং মিডিয়ার মাধ্যমে পত্রিকার লিংক সকল পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার। পত্রিকার ঘোষিত নিয়ম অনুযায়ী দয়া করে কবিতার স্ক্রিনশট নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করবেন না। আমাদের কাজকে মান্যতা দিতে এইটুকু অনুরোধ নিশ্চয়ই আপনারা মেনে চলবেন বলেই বিশ্বাস।
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
সম্পাদক
কবিতার আলো
কবিতাভিত্তিক
---------------------
নিছকই ভাবনা
অঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়
সিগারেটে দুটো সুখটান দিয়ে,
নিজের ভিতরের কিছু দুঃখকে,
টেনে বার করতে চাইছিল অনিমেষ।
কিন্তু ধোঁয়াটাও যে বড্ড বেঈমান,একঘেয়ে।
সেই একই ভাষা,একই গন্ধ,একই আবেগ।
কলকাতার সবচেয়ে উঁচু ফ্ল্যাটের,
দশ তলা থেকে,
যখন নিচের শহরটাকে সে দেখে,
তার মাথায় তখন বিভিন্ন রং এর,
লুকোচুরি খেলা চলে।
হটাৎই পাশ থেকে সিগারেটটা,
একপ্রকার ছিনিয়েই নিল ভাবনা।
প্রশ্ন আসে - " কি ভাবছ এত?"
"ভাবনা...ভাবনা তো প্রচুর আসে।
কিন্তু ভাবতে তো মন চায় না।
তবে পুরনো স্মৃতিকে,
বড্ড আগলে রাখতে চেয়েছিলাম।
তাই বোধ হয় আজ সুখ টান দিয়ে,
তাদেরই ভুলতে চাইছি।"
"তা ভুলে যাচ্ছ না কেন?"
"নিচের আলোগুলো কি নিস্তব্ধ তাই না"?
"আমার তো নিস্তব্ধতা ভালো লাগে না"।
"জানি...কোলাহল প্রিয় কাকুলি তুমি"।
"আর সেই কোলাহলের কারন তো তুমি"।
"বোধহয়"।
"বাবু খাবার তৈরি হয়ে গেছে"।
সিগারেটের ছ্যাঁকায় হাত থেকে সেটা,
সোজা দশ তলা থেকে নীচে গিয়ে পড়ল।
এক কথায় পড়ে বেচেঁ গেল।
হকচকিয়ে শুধু এটুকুই মনে এল,
সে নিছকই ভাবনা ছিল।।
------------------
সভ্যতা
সুশান্ত সেন
সভ্যতাকে বহুতল দিয়ে গুলে
একটু উড়ানপুলের রস মিশিয়ে
ঢকঢক করে খেলাম,
যানবাহনের জট চিবিয়ে চিবিয়ে
প্রাতরাশ খাবার পর।
বেশ কয়েকবার ঘূর্নিবায়ুর উদগার উঠলো
জেলুসিল এর বড়ি দিয়ে
বাঁধ বানিয়ে জলস্রোত আটকাবার চেষ্টা করলাম
একটা না দুটো না
চার চামচ।
তবু দেখি পেটের অসস্তি আর থামে না।
------------------
ভেবে দেখতে পারো
প্রদীপ সরকার
এভাবেও ভাবতে পারো
ধরো বিচার মানেই রাষ্ট্র যা ভাবছে
তার প্রতিফলনের আলোয়
সংহিতা নতুন নতুন রং-এ সাজছে;
শৃঙ্গার তো আর আইন অমান্য নয়!
বিক্ষোভ ও অস্থিরতাবিহীন যাপন
সমর্পণেই নিহিত,সেটা মেনে নাও
তুমি বিন্দাস,রাষ্ট্র নিরুদ্বিগ্ন শান্তি যন্ত্রম
সুখে শান্তিতে দিন কেটে যায়।
দু একটা প্রতিবাদী গান কানে এলে
মাঝরাতে ঘুমটা ভালোই হয়
গানে স্লোগানে নিন্দুকদের মুখে ছাই
জয় গণতন্ত্রের জয়।
না হে বটকৃষ্ণ! এ রাষ্ট্র স্বৈরতন্ত্রী নয়
তবে ভারসাম্য বিচারে বা অধিকারে
এমন কথা অর্বাচীনেই কয়।
------------------
যে ভালোবাসা দিয়েছিলে
গোবিন্দ মোদক
যে ভালোবাসা দিয়েছিলে
কিংবা দেবে বলে অঙ্গীকার করেছিলে
তার কোনও ব্যাকরণ ছিল না।
বইতে মুখ ডুবিয়ে অপাঙ্গে দৃষ্টি হেনে
ইঙ্গিতের যে রহস্যময়তাকে
তুমি তুলে ধরেছিলে
তার কোনও তুলনা ছিল না।
তবু সময় ভুলে যাওয়া বর্ষার রাতে
অথবা শীতার্ত ঘুমপ্রহরে
নিবিড় এক স্পর্শ
গাঢ় আলিঙ্গনের মতো বেজেছিল
নূপুরে নূপুরে।
তারপর ক্রমশঃ একা হওয়ার পালা
আর অস্তগামী সূর্যের মতো লাবণ্যময় হয়ে
নিশ্চিত একটা ভোরের জন্য অপেক্ষা।
যে ভালোবাসা দিয়েছিলে –
কিংবা দেবে বলে অঙ্গীকার করেছিলে
তার কোনও ব্যাকরণ ছিল না।
সম্মিলন
------------------
রূপক চট্টোপাধ্যায়
দেখে দেখেই লিখছি
(১)
জিরাফের চেয়েও দীর্ঘ গলার রাত হয়!
ডারউইন একথা জানতেন না।
সুলেখা দি জেনেছিলেন।
সুলেখা দি তার বর কে নিয়ে হাসপাতাল
পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন,
রাত তখনও বাকি।
শশ্মাণ পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলেন
রাত তখনও বাকি।
আজ নিঝুম বারান্দায় বসে বসে
সোঁদালী গন্ধ মাখানো পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে
এখনো বিড়বিড় করেন -
'বিভাস রাত কি এখনো শেষ হয়নি?'
(২)
আর একদিন অন্তত ভালোবাতে দিও,
আর একদিন অন্তত আলো আসতে দিও,
টেবিলে রাখা গীতবিতানের ওপর!
ওই তো আমার একমাত্র নৌকা। ভরাডুবির।
ওই তো আমার একমাত্র সন্তরণ। লবন হ্রদের।
জড়িয়ে রাখার শেকড় বাকড় ছিঁড়ে
ব্রহ্ম থেকে টসকে পড়েছি।
কাম হীন শরীরে দেবীকে দেখেছি
অভ্রনদীর জলে উন্মুক্ত আলোর চেতনায়।
লজ্জাহীন মীন জন্মে আমিও পুরুষ হতে পারি!
তারপর থেকেই এ সমাজের কাছে
ব্রাত্য আমি। অভিশপ্ত। ঈশ্বর হীন কৃতদাস।
একবার, অন্তন একটি বার
গীতবিতান আঁকড়ে আমিও তোমাকে পার হতে চাই।
একূল ছেড়ে চলে যেতে চাই বিক্ষিপ্ত বৃষ্টি পাতের দেশে, ভালোবাসার মৃতদেহ হতে,
ঘেন্নার কৃমি জন্ম ফেলে কৃষকের ছদ্মবেশে!
(৩)
ঘেন্নার ভেতর কৃমি জন্ম ফেলে এসেছি।
চেতনার আবছায় দাঁড় টানে
কৃশকায় পুরুষ। তার মুখে অস্পষ্ট মধ্যযুগ।
শরীরে এখনো কাঁচা পৃথিবীর শ্যাওলা জড়িত হৃদয়।
সজনে ডালে কুহু ডেকে ওঠে। মাঠ থেকে সাঁঝ পথে
ফিরে আসে কিষাণীর রণ-ক্লান্ত শরীর।
এই পর্যন্ত আমাদের জীবন লেখা থাকেলেও চলে।
আমরা বেঁচে আছি শেকড়ে সোহাগে।
বেঁধে আছি মাটিতে মায়াতে।
এর বেশী পদাবলী, হয়না জলে অন্নে আর
রাধাবিনোদিনী এর বেশি কাঁদতে পারে না হে
নওলকিশোর!
(৪)
অনাহার জড়িত স্নায়ুরজ্জুর জঁট খুলে
শেষ পর্যন্ত জলকাদা মাখানো
প্রত্নতাত্ত্বিক বিকেলটা উদ্ধার হলো।
খুব পরিপাটি করে
ধুয়ে মুছে তাকে বসানো হলো
মাঝের চেয়ারে। কাঁচের জনলার ওপার
ব্যস্ত শহরের প্রবাহিত জন কোলাহল!
সামনে ধূমায়িত কফিমগ।
চারপাশে জিজ্ঞাস্য চোখের স্থীরতায়
থমথম করছে চরাচর। কিছু তো বলুন এবার?
আপনার সেই সব অতীত চারাণ। দু চার কথা!
হঠাৎ একটা দস্যি মেয়ে নাচুনি আনন্দে ঘরে এসে
বললে - ' এই চল খেলতে যাবি!
সে বেরিয়ে গেলো। কোন উত্তর না দিয়েই!
------------------
উৎপল দাস
ঋতুমতী রোদ, ত্রিভুজের পরিবৃত্ত অথবা ঘোলাজলের সমীকরণ
- ২
অসংলগ্ন মৌনতার ভেতর সবুজ পুকুরে যে মাছ চরছে তার পেটে অসমাপিকা ক্রিয়া ঘুরে বেড়ায়, বিনীত দুর্বা ঘাসের সর্বনাম ৮/১০ বইপাড়া লেনে হাঁটতে গিয়ে নিরুদ্দেশ, কে কখন দ্বিবীজপত্রী ছত্রাকের বুকে দু-এক পশলা বৃষ্টি ও অক্ষর সাজিয়ে রাখে, বান্ধবীকে সেটাই বলছিলাম, কাঁচা-পাকা রোদ মেখে স্মৃতিরক্ষা কমিটি মাটন কষার পার্টি রাখে, ছদ্মবেশী বন্ধুর মুখোশ খুললেই বোঝা যায় গিরগিটির রঙ সমকোনী ত্রিভুজের মতো
- ১
ক্লাসিক জলতরঙ্গের ঢেউয়ে দুটো কিং-কোবরা জলকেলি করছে, উচ্চমার্গের হাইড্রেনে কচ্ছপ ভেসে যায়, তার বুকে নেমেসিস নামে, সংকীর্ণ সময়ের লঘু সালফিউরিক অ্যাসিড নিজের উগ্র স্বভাব পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয়, মৃত্যুর অব্যবহৃত কান্ড-শাখা-প্রশাখা অভিন্ন অন্ধকারে লোহাপোড়া ইস্পাত মানুষের মতো নিশ্বাস ফ্যালে, যুদ্ধের জটিল ফ্রেমে আঁশটে গন্ধযুক্ত ঝিরঝিরে চেহারার হাসি রোস্টেড-চিকেনের পানশালায় অযৌন রেনু পাচারে ব্যস্ত
০
মর্গের পচা লাশ লাভ রিয়্যাক্ট কূটনীতির অ্যালগোরিদিম বুঝতে পারে না, শত পুষ্প বর্ষণের মাঝে উলঙ্গ ভাষার লেখারা হাঁটছে, হাততালির পরিবর্তে গোপন চাটুকতা জমায়েত হয় সর্বোত্তম শীতের পিকনিকে, জলপাই রঙের শ্যাওলা রূপোলি নাশপাতির খুন থেকে প্লাজমার বায়বীয় তত্ত্ব ডিনাই করে, জরা-ব্যাধিহীন হৃদপিন্ডের সৈনিককে সমুদ্রমন্থনের জন্য ছয় ডিপ্লোমা কোর্সের সাজেশন দেয়, অথচ চতুর্দশপদী কবিতার দালানে ঘুমিয়ে থাকে স্বপ্নের ভেতরকার বাস্তবতা, বিদেশী পাখি এলেই শিকার করে নেয় গেস্ট হাউসের অষ্টক সূত্র অথবা হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি ফলত একই সাথে উন্নতি ও কোরাপশন করা সম্ভব না ইশারার ভুরিভোজে
১
৩৭৫ এমএল গলিত গলিত নক্ষত্রপুঞ্জের ক্রোধ বর্গাকার নর্তকীদের কর্মফলে লালবাত্তি ধরিয়ে পালায়, ইতিমধ্যেই জিরাফের স্রোত ও মাটির স্রোতকে শাস্তি ও অপরাধ শনাক্তকরণের আলাদা আলাদা উপায় জানায়, যে লোকটির আলুর দোষ আছে তার অপরিচ্ছন্ন মস্তক বিকেল ফুলের মতো কঠিন, সে দ্যাখেনি ফুল থেকে ফলের রূপান্তর, পরিচয় ও পৃথিবী নিটোল ঘূর্ণিঝড়ের মতো অসমতল পাটাতন বেয়ে একাকী দাঁড়িয়ে থাকে বামন গ্রহন হাতে নিয়ে, মসৃণ কোমল লেখাটির ভেতর চিন্ময়ী রূপ স্পষ্ট হয় ক্রমশ— যেন মন্ত্রমুগ্ধ সকল ভক্ত ও দর্শক দু হাত প্রসারিত করে মোক্ষ লাভের আশায়
২
আদ্যক্ষর-এর পায়ে স্মৃতি-শস্যের আঁচড়, তোমার স্পর্শক বরাবর কিছু গুল্মজাতীয় অসফল জোয়ার দ্যাখা যাক, সবকিছু যেন কংকালের মতো সেলাই করা, অপরিশোধিত দহন-খামারে অসুখগুলি আছড়ে পড়ে, চুনাপাথরের গম্বুজ মেখে নতজানু স্বভাব বলে ভিক্ষা দাও, বশ্যতা মেনে নেওয়া হাঁসটির মতো গভীর নিঃস্বতার বিরুদ্ধে বজ্রের ধ্বনি গর্জে ওঠে রাজপাথ পার করে আসা সীমারেখা, গায়ে গা লাগিয়ে ফুটন্ত ম্যাগমার দেবীকে মিঠা জলের সরোবরে নিয়ে যায়, কার্তেসীয় স্থানাঙ্ক অনুসারে ইয়োলো অর্গান দ্রুত অভিযোজনমূলক পরিসংখ্যান জাহির করে, কেন-না ভেঙে যাওয়া নদী চোখে অরাজনৈতিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি কোনো না কোনো অপদার্থের নাম ভাঙায় যদিও মানুষ আদতে রাজনৈতিক জীব
শাশ্বত বোস
চুম্বন ও জ্যোতিষ্ক
সমান্তরাল দুটো চোখেনেমে এসেছে, কালান্তক রাত। ঊষর জমিতে সেদিন ছায়া ছিল না, সঘন চুম্বনে সেখানে এঁকে দিয়েছিলাম, রাত জাগা মাতাল বসন্ত। আজ ভাঙাচোরা নোনতাদাগগুলো থেকে বেরিয়ে আসা কুৎসিত ক্ষোভ, নিদাগ হয়ে ঘোরে জন্ম থেকে জন্মান্তরে।
সমান্তরাল দুটো চোখে
নেমে এসেছে, কালান্তক রাত।
ঊষর জমিতে সেদিন
ছায়া ছিল না,
সঘন চুম্বনে
সেখানে এঁকে দিয়েছিলাম,
রাত জাগা মাতাল বসন্ত।
আজ ভাঙাচোরা নোনতা
দাগগুলো থেকে
বেরিয়ে আসা কুৎসিত ক্ষোভ,
নিদাগ হয়ে ঘোরে
জন্ম থেকে জন্মান্তরে।
এক নির্গুণ প্রেমের ইস্তেহার
একটা ভীষণ রকম বিভাজিকা প্রেম চাই।একটা পুরোনো ভাঙা জলফড়িং সেফটিপিন,একটা ভীষণ ভালো মানুষের ভেঙে আসামুখের গাংচিল জ্যামিতি। একটা ভয়ধরা চোখেরউপবাসী সমীকরণ, একটা বেড়াজাল ফসফরাসেরগায়ে লেগে থাকা নিকোটিনেরনীলচে মিথোজেনিক বিষক্রিয়া।বাগানে একটা পাতা ঝরার বিষন্নতা,একটা খড়কুটোহীন ভালোবাসা।এগুলোই হয়তো অনন্ত কোন এক অন্ধকারে,ডুবে যাওয়া নাবিকের মৃত্যু হয়ে, ঘুমন্ত শিশুরকাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে।শুভ হোক মাটি আর জলের হাত ধরাধরি করে,বৃত্তাকার গর্ভের পথে এগিয়ে চলা।আমার পেটের অন্তস্থ খিদে ছড়িয়ে পড়ুক,বাস্তুভিটে, পূর্বপুরুষ আর প্রেমহীন সীলমোহরের দাগে।
একটা ভীষণ রকম বিভাজিকা প্রেম চাই।
একটা পুরোনো ভাঙা জলফড়িং সেফটিপিন,
একটা ভীষণ ভালো মানুষের ভেঙে আসা
মুখের গাংচিল জ্যামিতি।
একটা ভয়ধরা চোখের
উপবাসী সমীকরণ,
একটা বেড়াজাল ফসফরাসের
গায়ে লেগে থাকা নিকোটিনের
নীলচে মিথোজেনিক বিষক্রিয়া।
বাগানে একটা পাতা ঝরার বিষন্নতা,
একটা খড়কুটোহীন ভালোবাসা।
এগুলোই হয়তো অনন্ত কোন এক অন্ধকারে,
ডুবে যাওয়া নাবিকের মৃত্যু হয়ে, ঘুমন্ত শিশুর
কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে।
শুভ হোক মাটি আর জলের হাত ধরাধরি করে,
বৃত্তাকার গর্ভের পথে এগিয়ে চলা।
আমার পেটের অন্তস্থ খিদে ছড়িয়ে পড়ুক,
বাস্তুভিটে, পূর্বপুরুষ আর প্রেমহীন সীলমোহরের দাগে।
পুড়ে যাও প্রিয়তমা
একটা আধপোঁড়া কালো হাড়ি, ভেতরেফুটন্ত একটা মেয়ে। তার বুকের কাছটায়কোমর, কোমরের নিচে স্তন।একটা খারাপ লোক ওকে নষ্ট করে চলেছে রোজ।যেমনটা স্মৃতির দাগে নষ্ট হয়, গভীর ডিমনেশিয়া।ভেতর ভেতর সেদ্ধ হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে দেব,বাড়া ভাত, সাথে একটু কচু সেদ্ধ আরকটা ঝরে যাওয়া গোলাপ।হাতের জায়গায় গজিয়ে ওঠা কানে কানে বলব,“আই লাভ ইউ প্রিয়তমা।”বোহেমিয়ান দিনযাপনে অভ্যস্ত,রোদ্দুরে ভেজা বালির ভেতর থেকে,সিরিয়াস গোছের শরীরটায় ডেকে উঠবে,এক নাম না জানা রহস্যের ইতিহাস।
একটা আধপোঁড়া কালো হাড়ি, ভেতরে
ফুটন্ত একটা মেয়ে। তার বুকের কাছটায়
কোমর, কোমরের নিচে স্তন।
একটা খারাপ লোক ওকে নষ্ট করে চলেছে রোজ।
যেমনটা স্মৃতির দাগে নষ্ট হয়, গভীর ডিমনেশিয়া।
ভেতর ভেতর সেদ্ধ হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে দেব,
বাড়া ভাত, সাথে একটু কচু সেদ্ধ আর
কটা ঝরে যাওয়া গোলাপ।
হাতের জায়গায় গজিয়ে ওঠা কানে কানে বলব,
“আই লাভ ইউ প্রিয়তমা।”
বোহেমিয়ান দিনযাপনে অভ্যস্ত,
রোদ্দুরে ভেজা বালির ভেতর থেকে,
সিরিয়াস গোছের শরীরটায় ডেকে উঠবে,
এক নাম না জানা রহস্যের ইতিহাস।
কালো চশমার এপার থেকে
ট্রাকের সামনের কালো সীমানাটাপেরোতে পারলে ফুটপাথের জীবনটা লাটে ওঠে।ওখানেই নাইটির ওপরের দুটো বোতাম খুলে,স্তনভারে নুয়ে পড়ে রান্না করা তরকারি আরমাছ-মাংসের গন্ধটা, কয়েকটা চিল শকুনেরগাঢ় নিঃশ্বাসের সাথে মিলে মিশে যায়।টিনের দরজাটার ওপাশে তখনআদিম নগ্নতা। একটা বাচ্চা ব্যাট দিয়ে লম্বা করেকালো রাস্তায় দাগ টানছে। ঠিক ঐখানে একটু পরওর শৈশব মিশে যাবে দুর্বল কৈশোর আর কামনারবয়ঃসন্ধিতে। ভেঙেচুরে থাকা ক্ষতটার গা বেয়ে চুঁয়েপড়া প্রিয় রং আর ঘামজ্বরের মুক্তাঞ্চল,পিটুলিগোলা রাস্তাটার গায়ে বেনিয়মেছড়িয়ে গিয়ে বিচ্ছিন্ন খড়িমাটির আল্পনা দেয়।
ট্রাকের সামনের কালো সীমানাটা
পেরোতে পারলে ফুটপাথের জীবনটা লাটে ওঠে।
ওখানেই নাইটির ওপরের দুটো বোতাম খুলে,
স্তনভারে নুয়ে পড়ে রান্না করা তরকারি আর
মাছ-মাংসের গন্ধটা, কয়েকটা চিল শকুনের
গাঢ় নিঃশ্বাসের সাথে মিলে মিশে যায়।
টিনের দরজাটার ওপাশে তখন
আদিম নগ্নতা। একটা বাচ্চা ব্যাট দিয়ে লম্বা করে
কালো রাস্তায় দাগ টানছে। ঠিক ঐখানে একটু পর
ওর শৈশব মিশে যাবে দুর্বল কৈশোর আর কামনার
বয়ঃসন্ধিতে। ভেঙেচুরে থাকা ক্ষতটার গা বেয়ে চুঁয়ে
পড়া প্রিয় রং আর ঘামজ্বরের মুক্তাঞ্চল,
পিটুলিগোলা রাস্তাটার গায়ে বেনিয়মে
ছড়িয়ে গিয়ে বিচ্ছিন্ন খড়িমাটির আল্পনা দেয়।
মৃত্যুহীন রূপান্তর
অভিসারের পথে উদ্বায়ী সর্বভুক কবিতাদের,আপাদমস্তক পড়তে চাওয়ার পাশাপাশি,এক দল ব্যতিক্রমী কুকুর ঝাউ ঝাউ করে ওঠে।ভোরের বেলা দিয়ে ততক্ষনে চলে গেছে,কোন অপাপবিদ্ধ শিশু। জীবনের যোনি বেয়েচুঁইয়ে পড়া অমাবস্যার প্রতিধ্বনি, যে কোনোকোলাহলের বসন্তে সতর্ক গাছের মত নীরবতাপালন করে। দুঃখময় জীবনটার সারা গায়েএক্সপেক্টেশনের গন্ধমাখা মৃত্যুর অবয়ব,যেন বিশ্বরূপের গন্ধে পাগল তোমার আয়না,সাবান, লিপস্টিক।তোমাকে পাইনিহয়ত তোমাকে পাবার ভীড়ে,মিশে যেতে চাইনি কোনোদিন।
অভিসারের পথে উদ্বায়ী সর্বভুক কবিতাদের,
আপাদমস্তক পড়তে চাওয়ার পাশাপাশি,
এক দল ব্যতিক্রমী কুকুর ঝাউ ঝাউ করে ওঠে।
ভোরের বেলা দিয়ে ততক্ষনে চলে গেছে,
কোন অপাপবিদ্ধ শিশু। জীবনের যোনি বেয়ে
চুঁইয়ে পড়া অমাবস্যার প্রতিধ্বনি, যে কোনো
কোলাহলের বসন্তে সতর্ক গাছের মত নীরবতা
পালন করে। দুঃখময় জীবনটার সারা গায়ে
এক্সপেক্টেশনের গন্ধমাখা মৃত্যুর অবয়ব,
যেন বিশ্বরূপের গন্ধে পাগল তোমার আয়না,
সাবান, লিপস্টিক।
তোমাকে পাইনি
হয়ত তোমাকে পাবার ভীড়ে,
মিশে যেতে চাইনি কোনোদিন।
বোধ ও বুদ্ধির কবিতা
প্রেমের কবিতা বোধ দিয়ে লিখতে চাইবোধহয়, বুদ্ধি দিয়ে নয়। বুদ্ধি খরচ করলেসেটা একটা লিমেরিক হয়ে যেতে পারেকিংবা এলিজি। তখন দুচোখ বন্ধ করলেশুধুই অন্ধকার। স্বপ্ন বলে আমার বাড়িরসামনের রাস্তাটা এলোমেলো, অমসৃণ অথচচোখ খুললেই সামনে কিলবিল করে ওঠে,যৌনাঙ্গবিহীন অযুত পোকা আর কৃমির দল।আমি ছাউনির মত আকাশটাকে ‘তুমি’ ভাবি।কল্পনা করে নিই তোমার দুই চোখ, নিখুঁত ঠোঁট।ঠিক দু'পা পিছলে তখন আমার ছায়া।ছায়ার সাথেই ঝগড়া করতে করতেসেই অদ্ভুৎ গানটার সরগম বেরিয়ে আসে।
প্রেমের কবিতা বোধ দিয়ে লিখতে চাই
বোধহয়, বুদ্ধি দিয়ে নয়। বুদ্ধি খরচ করলে
সেটা একটা লিমেরিক হয়ে যেতে পারে
কিংবা এলিজি। তখন দুচোখ বন্ধ করলে
শুধুই অন্ধকার। স্বপ্ন বলে আমার বাড়ির
সামনের রাস্তাটা এলোমেলো, অমসৃণ অথচ
চোখ খুললেই সামনে কিলবিল করে ওঠে,
যৌনাঙ্গবিহীন অযুত পোকা আর কৃমির দল।
আমি ছাউনির মত আকাশটাকে ‘তুমি’ ভাবি।
কল্পনা করে নিই তোমার দুই চোখ, নিখুঁত ঠোঁট।
ঠিক দু'পা পিছলে তখন আমার ছায়া।
ছায়ার সাথেই ঝগড়া করতে করতে
সেই অদ্ভুৎ গানটার সরগম বেরিয়ে আসে।
স্মৃতির দুয়ারে
------------------
বাবার ডায়রি
কেতকী বসুপুরানো বাক্সের ভিতর থেকে বাবার ডাইরিটা খুঁজে পেলাম, তাতে শুধু নামহীন হিসেবের অঙ্ক
জীবনের বেশ কিছু সময় ধরে যে অঙ্ক করেছিলেন তারই কিছু সংক্ষিপ্ত বিবরণ।অনেক দিন দেখেছি উঠোনের এক পাশে হ্যারিকেনের আলোয় বাবা কি যেন লিখতেন,
আমাদের দুই বোনকে রাতে যখন মা খেতে ডাকতেন তখন সেই লেখার খাতাটা একটা বাক্সের মধ্যে রেখে আমাদের সাথে খেতে বসতেন ।
বাবার এই রকম অনেক গুলো ডায়রি ছিল,
যখন অনেক রাত পর্যন্ত বাঁশি বাজাতেন তখন সেই খাতা খোলা থাকত বাবার সামনে। বেহাগ, ভৈরবী,কত রাগের সুর তুলতেন বাঁশিতে।
জোৎস্না রাতে যখন হ্যারিকেন জ্বলত না উঠোনে,তখন বাবার বাঁশির সুর শুনতাম আর মনের সমস্ত দুঃখ কষ্ট,সংসারের সমস্ত অভাব ধুয়ে যেতে সেই জোৎস্নার আলোয়।
বাবার আর একটা খাতা ছিল,সেই খাতা বাবা আমাকে দেখিয়েছিলেন ,তাতে কত কবিতা,আর গল্প।
রোজ কাজের থেকে এসে আমাকে শোনাতেন
তাঁর লেখা সমস্ত গল্প কবিতা ,বাবার সেই খাতাটা আজও যত্নে রেখেছি আমার কাছে,
একবার বাবার লেখা উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল,বাড়িতে সে কি আনন্দ,পাড়া থেকে কত মানুষ সেদিন বাবাকে অভিনন্দন জানিয়ে গিয়েছিলেন।সেসব এখনো আমার কাছে মুক্তর মালা হয়ে গেঁথে আছে।
আমার গানের যাত্রা পথও বাবার হাত ধরে,
বাবা ভীষন ভালো গান করতেন ,কিন্তু বাবার গানের খাতা গুলো আমি যত্ন করে রাখতে পারি নি,আমার অমনোযোগিতার ফলে সেসব আমি যে বাড়িতে রেখেছিলাম সেখান থেকে চুরি হয়ে যায়,জানিনা সেসব নিয়ে কি করবে তারা।
সময় বয়ে যায়,কালের নিয়মে,কিন্তু জলছবি হয়ে ধরা পড়ে কখনও কোনও সময়ে,আজ সেভাবেই পুরানো বাক্সের ভিতর থেকে বাবার লেখা সব ডায়রির পাতা গুলো পড়তে লাগলাম।
আর ভাবতে থাকলাম , বাবা কোনদিন সেই ডায়রিটা কেন সবার সামনে খুলতেন না।
সংসারের হিসেব লেখা ছিল সেই জমানো পাতায়,জীবনের ওঠা পড়া,ঘাত প্রতিঘাতের সমস্থ কথা লেখা ছিল তাঁর অব্যক্ত ভাষায়।
একা না হয়েও বড় একা ছিলেন ,আর তাই অনেক আগেই একা হয়ে চলে যেতে পারলেন।
ডাকঘর
------------------
মেনকা সামন্ত
প্রিয় বন্ধুরা,
আজকের এই খোলা চিঠির মধ্য দিয়ে তোমাদের কাছে জানাতে চাই আমার মনের কথা।ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম,টুইটার আর মেসেঞ্জারের ভীড়ে ব্রাত্য এখন আমি।এমন একদিন ছিল যখন আমার বুকেই শিহরণ তুলে বয়ে যেত কত প্রেমিক- প্রেমিকার মধুর মিলন গাঁথার সুরভিত বাতাস।কত বিরহ -বেদনা- বিচ্ছেদের বিষন্ন সুর আমার হৃদয় বীণার তারে মূর্ছনা তুলেছে বারে বারে।কত সুখ আর প্রাপ্তির বার্তা আমি মহানন্দে পৌঁছে দিয়েছি অনেকের ঘরে ঘরে।সেই আমার খবর আজ আর কেউ তেমন করে রাখেনা।কখনো, কদাচিত ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলার মত আমার দিকে চোখ পড়ে কারো কারো। চেনো কি আমায়?
ইতি
প্রায় হারিয়ে যাওয়া
সেই ছোট্ট নীল খাম।
মুক্তপদ্য
------------------
সশস্ত্র শান্তির দেশ
সৌরভ বর্ধন
গতকাল রাতে খুব বৃষ্টি হয়ে গেছে। আষাঢ়ের প্রথম মেঘেই যারপরনাই রাবীন্দ্রিক বৃষ্টিপাত --- সারারাত প্রসব যন্ত্রণায় কাতরে মরেছে। বেলা অবধি ঘুমোতে না পারার আক্ষেপ এখনও চোখেমুখে। তবু সাতসকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে খানিকটা পথ এসেছি, এমন সময় হঠাৎ নিজেকে খুব সুন্দর বলে মনে হলো, সুদর্শন পুরুষ যেমন হয় আরকি। সকালবেলার ফুলের মতো বিশুদ্ধ নয়, কিন্তু জৈবিক সত্যের মতো সুন্দর। তাই সকল গাছেরা তাকিয়ে আছে, গাছেদের আলো আমার গায়ে মেখে মেখে যাচ্ছে, ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে আমাকে ঘিরে। পরনের আড়ম্বর তেমন কিছু নয়, গায়ে একটা হালকা ডেনিম-ব্লু শার্ট, একটু পরেই খুব রোদ উঠে যাবে তাই ফুলস্লিভ, তার ওপর সাদা সাদা স্ট্রাইপ দেওয়া, সঙ্গে একটা ব্ল্যাক জিন্স; চোখে ব্রাউন কালারের সেমি-স্কয়ার শেপেড সানগ্লাস, ব্যাস্! এতেই বেশ সুন্দর লাগছে আমাকে। তবে এর আরেকটা কারণও থাকতে পারে, তা হলো, সকালের ঘুম স্যাক্রিফাইস করে কাজে বা অকাজে বাড়ি থেকে বেরোনো। এতে একটা অহং আসে মনে, মনে হয়, আমিও তো ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম। যাকগে, রাস্তায় এখন লোকজন অল্প, ছায়া ছায়া বনবীথির মধ্য দিয়ে গড়পড়তা গতিতে চলেছি, ভালো লাগছে। কিন্তু হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে যে এসব মনে-হওয়াগুলো টুক করে লিখে নেবো নোটপ্যাডে, সে উপায় নেই। এরপর কখন সময় পাবো আর কখন লিখবো, যখন লিখবো তখন অনেক কিছু মনেও থাকবে না। সত্যিই এখন এই মিনিট দশেকের ব্যবধানেই সিংহভাগ ভুলে গেছি। কিন্তু নিজেকে যে অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল তখন, সেকথা ভুলতে পারছি না। গায়ে লোম নেই, ছাল চামড়া দ্যাখা যায়, ঠিকঠাক খেতেও পাই না, কিন্তু সকালের এই ফুরফুরে হাওয়ায় নিজেকে গোল্ডেন রিট্রিভার মনে হচ্ছে, মনে হচ্ছে আমার সোনালী লোমগুলো ঝিরঝির করে উড়ছে, আমার কালো চোখগুলো সব প্রাপ্তির আনন্দে গদগদ হয়ে আছে। তেমন মাংসখেকো ভাব আর আমার মধ্যে নেই। একটা নির্লিপ্ত উন্মাদনায় আমি ছুটে চলেছি। একমাত্র আশ্চর্য হচ্ছি উত্তাপে, অতিলঘু সামর্থ্য নিয়ে সে কেমন প্রসারিত সমস্ত আকাশে। অথচ গতকাল রাতেই সুস্থির জীবনের মতো বিশাখা নক্ষত্রের পতন হয়ে গেছে, রূপ বদলে গেছে স্বকীয় চিন্তার খড়ে। আজকের এই বর্ষাস্নাত মাটিতে কিছু অর্বুদ, হয়তো এখনও নিজেদের মিড় ও গমক ধুয়ে ধুয়ে নিচ্ছে, গুলে যাচ্ছে নিজেদের স্বপ্ন শিকারে। হয়তো রাতচরা পাখির সমগ্র ফিসফিস ভেঙে-পড়া সঙ্গীতের সিঁড়িতে ক্রমাগত হারাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে ভেষজ উপায়ে সমস্ত স্বাভাবিক শিষ্টাচার। কেননা এই পথ নিঃস্ব হওয়ার, এই পথ সংগৃহীত শূন্যতার। এ আমার সশস্ত্র শান্তির দেশ ----- আনন্দের সাধনা ছাড়া জীবনের আর কোনো লক্ষ্য নেই এখানে। শুধু সত্য। সর্বস্বান্ত হয়েও সত্য আমি নিজেই। আমিই আমার ভবিষ্যৎ। আমিই আমার চূড়ান্ত বর্তমান। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। জন্মের জন্য আমি নির্দোষ। প্রেমের জন্য আমি কীটদষ্ট অভিমানের রণনকক্ষ। আনন্দ ভিন্ন আমার আর অন্য কোনো লক্ষ্য নেই। কিচ্ছু নেই।
কবিতাই পারে
শংকর ব্রহ্ম
গোদার ‘আল্ফাভিল’ ছবিটাতে একটা স্বৈরাচারী ব্যবস্থার মহড়া দেন। 'আল্ফাভিল' আসলে ভিন-গ্যালাক্সির একটা তারা। ‘আলফা-সিক্সটি’ নামে একটা সুপারকম্পিউটার সেখানকার সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। আর এই কম্পিউটারটা যিনি বানিয়েছেন সেই 'প্রফেসর ফন ব্রাউন'-ই বকলমে সেখানকারই শাসক।
ফন ব্রাউনের সে দেশে হাসি, কান্না, প্রেম - এ সব ফালতু আবেগের কোন স্থান নেই। স্ত্রীর মৃতদেহের সামনে বসে চোখের জল ফেলাও বারণ। কেউ ফেললে গুলি করে তাকে জলে ফেলে দেওয়া হয়। কম্পিউটার তার মর্জি অনুযায়ী নতুন নতুন শব্দ যোগ করে। ‘গ্র্যান্ড ওমেগা মাইনাস’ নামে যন্তর-মন্তর ঘরে লোকদের ধরে নিয়ে গিয়ে মগজধোলাই করে,তাদের অন্যগ্রহে বন্ধ, হরতাল, বিপ্লব ইত্যাদি ঝামেলা পাকাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
মানুষের মগজ দখল করাটাই প্রথম লক্ষ্য। তাই এদের মোকাবিলাটাও মগজ দিয়েই করতে হয়। এখানে প্রফেসর ব্রাউন আর তার কম্পিউটার-রাজ খতম করতে যে সিক্রেট এজেন্টটি আল্ফাভিল-এ পা রাখেন, একেবারে বন্ড-মার্কা এই লোকটি ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই-ঠাঁই করে পিস্তল চালাতে পারেন, সুযোগ পেলেই মেয়েমানুষের স্বাদ নিতেও ওস্তাদ, কিন্তু 'আলফা-সিক্সটি’র সঙ্গে এনকাউন্টারে তার হাতিয়ার কবিতা!
হ্যাঁ, কবিতা। কারণ, যুক্তি আর কার্য-কারণ বিশ্লেষণ দিয়ে সাজানো সুপারকম্পিউটারের প্রোগ্রাম-ভুবনে সেটা একেবারেই ‘ফোরেন মাল’! আবেগ-ফাবেগ, অনুভূতি-টনুভূতি, কী সব আজেবাজে অচেনা জিনিসে ভরা! সেই শত্রুকে বুঝে ওঠাই যেখানে অসম্ভব 'আলফা-সিক্সটি'-র পক্ষে,সেখানে তার মোকাবিলা করারও তাই কোন প্রশ্ন ওঠে না। ফলে তার সুপার-সিস্টেম পুরো ঘেঁটে-গুলিয়ে যায়। কম্পিউটারজী দেহ রাখেন।
‘আল্ফাভিল’-এর সঙ্গে খানিকটা মিল পাওয়া যায়, ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিটার। ওমেগা মাইনাস-এর মতো এখানেও ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালক যন্ত্র’, মগজ ধোলাইয়ের দৌরাত্ম্য। তবে ওই যন্ত্র আর তার এই মগজ ধোলাইয়ের যন্ত্রের কোনও মিল নেই। যন্ত্রের স্রষ্টা ‘বৈজ্ঞানিক’ও আপাদমস্তক পেশাদার, তার কোনও দল নেই। তাই গুপি-বাঘা তাকে হাত করে ওই যন্ত্রে রাজার মন্ত্র পুরে দিতে পারে! এবং ফ্যাসিস্ট রাজা ও তার গোটা পুতুল-ক্যাবিনেটের মগজ ধোলাইয়ের পর সব্বাই মূর্তির মাঠে জড়ো হয়। আর জনগণের সঙ্গে হাত মিলিয়েই রাজা ‘দড়ি ধরে মারো টান’ বলে নিজেই নিজের মূর্তি ভেঙে খানখান করে দেন।
নিজের মূর্তি টেনে নামানোর জন্য ফ্যাসিস্ট নায়কের হাতে দড়ি ধরিয়ে দেওয়ায়, কবিতার মতো মাস্টারস্ট্রোক সত্যজিৎ রায়ই দিতে পারেন।
একটা নিরালম্ব রাত ও নিষ্কলুষ স্বীকারোক্তি
ঋদ্ধি ঘোষ
‘ধুলোতে ধুলোতে ভেসে যায় শব
বেজে ওঠে--পূর্বরাগ...
এ মৃত্যু, স্বাভাবিক নয়
সম্পর্কের অপঘাত !’
সমস্ত অক্ষরবৃত্ত থেকে একটা নিরালম্ব রাত উড়ে যাচ্ছে... হয়তো উড়ে যেতে হবে বলেই। এই তো সত্য, নিষ্কলুষ স্বীকারোক্তি : আজকাল তারুণ্যে টগবগে ঘোড়া ছুটে আসে এ পথে। গোপন কুয়াশা ক্ষরণে, নিষিদ্ধ আকাঙ্ক্ষায় সিংহদ্বার খুলে দ্যায় গাছ। কতবার দীর্ঘশ্বাস ! নেশাচ্ছন্ন বাকল সরিয়ে, ডালপালা আর নাভি মেলে ধরে। তবু কী অন্ধ বিশ্বাসে, একপাক...দু-পাক...দশপাক লাল-সোনালি সুতোয় তারই শরীরে তাগা বাঁধে কেউ কেউ !
স্বপ্ন নয়, তবু স্বপ্ন ছাড়া এমন রাতের কোনও উপাচার নেই। প্রেত-কপালে চাঁদ নেমে আসে বারবার। বিষণ্ণ বাসরে ঠোঁট পুড়ে যায়। এমন একটা আঁধার কেটে কেটে কতবার গলে গ্যাছে চোখ আর নির্বাসনের মুহূর্তরা ! আঁচলের গিঁট খুলতে খুলতেই, কয়েকটা অশীতিপর নদী আর আশ্চর্য ঘুম ! নদী বললেও ভুল হবে। এ জলে চৈত্রকাকের পিপাসাও মেটেনা। বাসনা বাসরে তিরতির পারাপারের তরী...! ভুল নয়, দৃশ্যের ভিতরে আরেক দৃশ্য। কেউ কেউ মমি হওয়া পাখির পাখাতেই হয়তো ভেসে যায়.. যেতে চায়...।
আশ্চর্যজনক ভাবেই আচ্ছন্ন মেঘের ভিতর দিয়ে নেমে গ্যাছে যে পাথুরে পথ, তার নাম পথ নয়-- দিগ্বলয়... সেখানেই প্যাঁচানো নাগিনের বাগানবাড়ি, মেহফিল আর ঘুঙুরের ঢেউ...৷ তাই এ ভালোবাসা তাকে বারবার সন্দিহান করেছে !
ক্যানভাসের বুকে হয়তো শেষ সুসংবাদ-ই রেখে গেলেন ফিদা হুসেন...। গাঁথা রং, আলোদীপ, সৌম্যসুর...আর আজন্মের মেহেদি প্রেম ! তবুও মধ্যরাতে তর্জনী বেয়ে শূন্য দশকের খোলস শুষে নিচ্ছে মধুকৃষ্ণার মেঘ ! ভাঙা ত্রিভুজের মতো নিঃসঙ্গ। শুধু জানবে না কেউ,এ কুয়াশার ভিতরেই অনন্ত ক্ষরণ... কুয়াশা সরে গেলেই, উত্তরে হাওয়া...
কোন্---দিকশূন্যপুরে উড়ে যাবে একটা মৃত্যুর ব্লু-প্রিন্ট।
রাত ঘন হ'লেই, ঘরময় বেলী'র সুবাস। অধরা সত্যেও মধুরাত! পার হওয়া সিঁড়ি, আঙুলে জড়ানো কার পারিজাত আঙুল...কার্নিশে কার্নিশে আলোদীপ বন্যা...নিখোঁজ সম্ভ্রম খুলে দিয়ে ব'লে উঠি--
"অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে"
মনে পড়ছে...ভীষণ মনে পড়ছে, বছর ষাটেকের হিমাংশু মিত্র'র সেই বিড়বিড়ে কথা--
‘ভরা চৈত্রের মুখাগ্নি শেষ
বেনাগাছে জল
চল্ নদী,
আজ থেকে একা হাঁটি চল্...’
মাছের বাজারের আঁশটে চাতাল, আধলা ইটের বালিশ, শেকল পরা চুল আর গাঁজার ঠোঁটে থিকথিকে কালো মাছি। এসব বিস্ময়ে তাকাতে তাকাতে কতবার খুবলে গ্যাছে চোখ...! তবু আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকেছি। ছুঁতে চেয়েছি-- সুলেখা শিশি আর গড়ানো কালিতে ডোবা কয়েক দিস্তা কাগজ...
বছর ষাটেকের ডঃ হিমাংশু মিত্র'কে লোকে বদ্ধ উন্মাদ বলেই চেনে। ছড়ানো বিদ্রুপের হাসি আর নৃশংস উল্লাসে কেউ কেউ পাথর ছুঁড়ে থেঁতলে দ্যায় তার মাথা। তবু থ্যাঁতলানো যায়না তার সেই অক্ষরবৃত্ত...
‘ধুলোতে ধুলোতে ভেসে যায় শব
বেজে ওঠে--পূর্বরাগ...
এ মৃত্যু, স্বাভাবিক নয়
সম্পর্কের অপঘাত...’
কথাচিত্র
------------------------------------
মুখোমুখি মহারাজ
দীপাঞ্জন চাকলাদারস্বর্গতঃ স্বামী সোমেশ্বরানন্দ মহারাজের লেখা বিপুল জনপ্রিয় বই ‘লক্ষ্যে পৌঁছানো'। তাঁর এই বইয়ের প্রচ্ছদ আমাকে দিয়ে পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন প্রকাশক মশাই কে। সেই মতো প্রকাশক মশাই বইটির প্রচ্ছদ নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার কথা বললে পর এক রবিবার দুপুরে যখন তাই নিয়ে ভাবছি যেন মনে হলো মহারাজ স্বয়ং এসেছেন আমার মতো গড়িমসি করা ব্যাক্তিকে ধাক্কা মেরে সিধে করার জন্য। ওনার সঙ্গে আমার এই কাল্পনিক কথোপকথন ‘লক্ষ্যে পৌঁছানো' বইটা নিয়ে। এই কথোপকথনে বইটির লাইন টু লাইন মিল হয়তো পাবেন না কিন্তু নির্যাসটুকু যে পাবেন তার আশা রাখি।
মহারাজ : কি ব্যাপার ! আমাকে একদম ভুলেই গেছেন দেখছি !
আমি: স্বপ্ন দেখছি নাকি !! ম-ম - মহারাজ ! আপনি !
মহারাজ : ভয় পাবেন না। যদিও জানি এখন আমার ওপর থেকে শ্রদ্ধা চলে গিয়ে শুধু ভয় টুকুই টিকে আছে।কেননা ভুতদের আর কেই বা শ্রদ্ধা করে বলুন।
আমি: না না -মহারাজ এসব আপনি কি বলছেন। আমার প্রণাম নেবেন। আসলে আমি দারুন চমকে গিয়েছিলাম।
মহারাজ : হা হা হা আপনার সঙ্গে মজা করছিলাম। যেমন আপনি আমাকে নিয়ে করেন।
আমি: হি-হি-হি, দারুন বলেছেন।
মহারাজ : আমার এই ‘লক্ষ্যে পৌঁছানো' বইটা নিয়ে কি করছেন? পড়ছিলেন বুঝি?
আমি: আজ্ঞে, এই বইটার নতুন করে প্রচ্ছদ হবে আপনি বলে গেছেন -
মহারাজ : তাই বইটির কভারের স্কেচ মনে মনে আঁকছেন আর বাদ দিচ্ছেন। এরপর হাই তুলবেন এবং মন কে বলবেন আজ থাক কাল আবার ভাবা যাবে। অথচ স্কেচগুলো আপনি এখনই ড্র করে ফেলতে পারতেন এবং চেঞ্জগুলোও হয়ে যেত - তাই না?
আমি: না -মা- মানে -
মহারাজ : আপনি কি এই বইটার প্রথম লাইন টা ভালো করে পড়েছেন ? দেখুন লেখা আছে -'আপনার স্বপ্ন এবং আপনার সাফল্য - এই দুয়ের মধ্যে কি বিস্তর পার্থক্য ?' না পার্থক্য নেই। এই পার্থক্য তৈরী করে আপনার 'এখন না তখন, এখন মুড নেই , পরে করবো ' এই সব মানসিকতা।
আমি: কি করি মহারাজ বলুনতো। এগুলো তো ঝেড়ে ফেলতেই পারছিনা।
মহারাজ : আরে সেই জন্যেই তো এই বইতে লিখেছি যে বেদান্ত বলছে -
আমি: সরি, একমিনিট মহারাজ, আপনি প্রায়ই লিখেছেন বেদান্ত এই বলেছে, বেদান্ত ওই বলেছে। আচ্ছা বেদান্তর কথা আমরা চোখ বুজে কেন মানবো ?
মহারাজ : হুমম। ভালো প্রশ্ন। দেখুন ভাই, কোরানে লেখা থাকলে মুসলিমরা মানে, বাইবেলে লেখা থাকলে ক্রিষ্টানরা মানে অথচ হিন্দুরা বেদান্ত পড়তেও চায়না তাই মানতেও চায়না।
আমি: এর কারণ কি ?
মহারাজ : এর কারণ বলতে গেলে অনেক কিছু বলতে হয়। সংক্ষেপে বলা যায় হিন্দু ধর্ম রিজিড নয় তাই নিজের মত প্রকাশ করার জন্য অনেক স্পেস দেয়। যাইহোক আমরা বোধহয় মূল বক্তব্য থেকে সরে যাচ্ছি।
আমি: আরেকটু মহারাজ, ক্ষমা করবেন এই বেদান্ত বলতে ঠিক কি বুঝি যদি একটু বলেন-
মহারাজ : আপনার দেখি গোড়াতেই গলদ - বেদ কয় প্রকার এবং কি কি বলুন দেখি।
আমি: আজ্ঞে, বে- বেদ হোল গিয়ে -
মহারাজ : দেখুন আবার 'বেদের মেয়ে জোৎস্না' বলে বসবেন না যেন, কারণ ওটা সিনেমা।
আমি: হা হা হা, না না মহারাজ। বেদ চার প্রকার -ঋকবেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ আর অথর্ববেদ।
মহারাজ : ঠিক। প্রত্যেকটি বেদ আবার চারটি প্রধান ভাগে বিভক্ত: সংহিতা। মানে মন্ত্র ও আশীর্বচন। ব্রাহ্মণ। মানে ধর্মীয় আচার, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও যজ্ঞাদির উপর টীকা। আরণ্যক। অর্থাৎ ধর্মীয় আচার, ধর্মীয় ক্রিয়াকর্ম, যজ্ঞ আর উপনিষদ্ হোল ধ্যান, দর্শন ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান-সংক্রান্ত আলোচনা।
আমি: বাহ্। ধন্যবাদ মহারাজ খুব সুন্দর জানলাম।
মহারাজ : হুমম। আর এই চারটি বেদের নির্যাস ই হোল বেদান্ত। এর অর্থ ''বেদের অন্ত বা শেষ ভাগ"।
আমি: ধন্যবাদ মহারাজ, এতদিনে বিষয়টা ক্লিয়ার হলো।এবার তবে আমার ওই কাজের বেলায় গড়িমসীর ব্যাপারটায় আসা যাক।
মহারাজ : বেশ। তা যা বলছিলাম, আমার এই বইতে দেখুন বেদান্ত দর্শন বলছে নিজের দিকে তাকানোর কথা। আপনি একবার তাই করে দেখুন না।
আমি: কিন্তু মহারাজ, আমি তো প্রতিদিন নিয়ম করে দুবার নিজের দিকে তাকাই।
মহারাজ : তাই নাকি !!
আমি: হ্যাঁ মহারাজ। প্রথমবার যখন আয়নার সামনে চুল আঁচড়াই আর সেকেন্ড টাইম যখন আয়নার সামনে দাড়ি কামাই-তখন।
মহারাজ : হা-হা-হা, 'এই দেখাই সেই দেখা নয় গো ' - একটা বিখ্যাত গানের লাইন প্যারোডি করলাম।
আমি: হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি -'এ দেখাই শেষ দেখা নয় তো'। মান্না দের কণ্ঠে বিখ্যাত গান। কিন্তু মহারাজ, আপনি কোন দেখার কথা বলছেন ঠিক বুঝলাম না।
মহারাজ : আরে প্রায়ই দেখা যায় যে বছরের শুরুতে আপনি ঠিক করলেন যে, কিছু একটা করবেন। যেমন ধরুন আপনি আমার ওপর কার্টুনে কমিক্স করার কথা ভাবলেন, কিছুটা করলেনও। তারপর ফেসবুকে দিয়ে সবার ভালোবাসাও পেলেন। কদিন পরেই উদ্যম নষ্ট হয়ে গেল। আপনি আবার গতানুগতিক জীবন শুরু করলেন।
আমি: ইয়ে -মানে - সত্যিইতো কেন এমন হয় বলুনতো ?
মহারাজ : প্রথমত, আত্মবিশ্বাসের অভাব - নিজের প্রকৃত শক্তিকে না জানা। "আমি কাজটা শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারবো''- এই বিশ্বাসে দৃঢ় না থাকা।
আমি: মহারাজ, দেখছেন তো আমার এই প্যাকাঠি মার্কা বডি। এতে সে রকম শক্তি আসবে কোত্থেকে বলুন তো ?
মহারাজ : বিদ্যাসাগরের বডি কি হারকিউলিসের মতো ছিল না গামা পালোয়ানের মতো ছিল। শুনুন , স্বামী বিবেকানন্দ বারবার বলেছেন আত্মবিশ্বাসের কথা। বেদান্তেরও মূল কথা - তত্ত্বমসি -মানে তুমিই ব্রহ্ম, তোমার মধ্যে অসীম শক্তি লুকিয়ে আছে। এই শক্তি কে না জাগানোর ফলেই মানুষ নিজেকে দুর্বল ভাবে।
আমি: কিন্তু আমার ভেতর শক্তি তো মরণ ঘুম দিচ্ছে। ওকে জাগাবো কি ভাবে ?
মহারাজ : আরে দাঁড়ান। আমার কথা টা আগে শেষ করতে দিন। দ্বিতীয়ত হচ্ছে সুষ্ঠপরিকল্পনার অভাব। স্বামীজী এক জায়গায় বলছেন 'লক্ষ্য ও পথ দুটিই সমান গুরুত্বপূর্ণ '।
আমি: আমিও কিন্তু পরিকল্পনা মতোই এগুচ্ছিলাম। তবে ওটা সুষ্ঠ ছিল কিনা বলতে পারবোনা।
মহারাজ : বেশ। তারপর কি হলো ?
আমি: মহারাজ, আপনার মতোই গানে বলি, 'তার আর পর নেই, নেই কোনো ঠিকানা'।
মহারাজ : বুঝেছি। আপনি 'তাৎক্ষণিক সাফল্য' মানে যাকে ইংরেজিতে বলে 'ইনস্ট্যান্ট সাকসেস' তাই পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাই, ওই ভাবে তো হয় না। প্রধান লক্ষ্যে পৌঁছাতে গেলে তো ছোট-ছোট লক্ষ্যের মাধ্যমে এগুতে হয় আর সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থাও অনুসরণ করতে হয়।
আমি: আ-চ্ছা। কিন্তু মহারাজ ছোট-ছোট লক্ষ্য বলতে আপনি কি বোঝাচ্ছেন?
মহারাজ : যেমন ধরুন, এক নম্বর লক্ষ্য হলো, আপনার বেলায় স্ক্রিপ্ট লেখা কমপ্লিট করা, দুই নম্বর লক্ষ্য হলো ড্রয়িং সব করে রাখা, তিন নম্বর লক্ষ্য হলো বইটা ছাপার ব্যাপারে কোনো প্রকাশকের সঙ্গে আলোচনায় বসা ইত্যাদি। আপনি এসব না করে সরাসরি স্কেপগোট খুঁজলেন ।
আমি: স্কেপগোট মানে?
মহারাজ : মানে গোদা বাংলায় 'বলির পাঁঠা' করা। আপনি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে যেই পৌঁছাতে পারলেন না তখন 'বলির পাঁঠা' করলেন অফিসের কাজের প্রেসার কে অথবা সংসারের নানান ঝামেলা কে।
আমি: কিন্তু মহারাজ এগুলো তো সত্যি।
মহারাজ : না। এটা আপনার ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। আপনি আশা করছেন জীবনটা যেন বাধামুক্ত হয় কিংবা সমস্যাবিহীন হয়। সবসময় জানবেন জীবন কখনো সমস্যাবিহীন হয় না, যেটা শেখা দরকার তা হলো – সমস্যা সঙ্কুল পরিস্হিতিতে কিভাবে এগিয়ে যাবো। শুধু তাই নয়, প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও কিভাবে সুযোগ খুঁজে তার সদব্যবহার করতে হয় তা জানা দরকার।
আমি: খুব সুন্দর বললেন মহারাজ। কিন্তু বাস্তবে তা কি সম্ভব ?
মহারাজ : মানুষের তিন নম্বর হাতটার কথা জানেন তো ?
আমি: তিন নম্বর হাত!!
মহারাজ : হ্যাঁ দীপাঞ্জনবাবু। অজুহাত হলো মানুষের তিন নম্বর হাত। যখন ডান আর বাম হাতের থেকে এই তৃতীয় হাত মানে অজুহাত বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখনি মানুষের নানান সমস্যা, বিপর্যয় নেমে আসে।
আমি: তাই নাকি ! কি সর্বনাশ!
মহারাজ : যেমন আপনি প্রায়ই অজুহাত দেন -সময়ের অভাব বলে। এখন আপনার যদি টাকা কম থাকে তখন কি করেন ?বুদ্ধি করে টাকা খরচ করেন তো ? টাকার অপব্যবহার একদম করেন না - তাই না ? সময় সম্পর্কেও একই কথা।
আমি: কিন্তু মহারাজ অফিসে সত্যি ই দারুন কাজের চাপ থাকে। একদম গুল মারছিনা।
মহারাজ : আরে শুনুন, ডঃ রাধাকৃষ্ণন, বারট্র্যান্ড রাসেল,জগদীশচন্দ্র বসু র মতো ব্যক্তিরা আপনার মতো সংসারও করেছেন আবার সময়মতো অফিসও করেছেন। তাঁরাও আপনার মতো সারাদিনে ২৪ ঘন্টা সময় পেতেন। তবুও তাঁরা বিখ্যাত হয়েছিলেন। যদি আপনি সময়কে টাকার মতো মনে করেন তো দেখবেন আপনার কোনোদিনই সময়ের অভাব হবে না।
আমি: মহারাজ এইসব নমস্য ব্যাক্তিদের সাথে কি আমার তুলনা চলে ?
মহারাজ : নমস্যরাই তো পথিকৃৎ - তাঁরাই তো জীবনের আদর্শ। আসলে আপনার আর একটা প্রব্লেম -তা হল আলস্য। শারীরিক ও মানসিক আলস্য আপনাকে ক্ষতি করছে।
আমি: মহারাজ আমার কি হবে ? আমি এর থেকে কিভাবে মুক্তি পাবো ?
মহারাজ : দেখুন ভাই, আমি গণৎকার নই যে মাদুলি-তাবিজ দিয়ে বলবো এগুলো গলায় কিংবা হাতে পড়ুন মুক্তি পাবেন। সবার আগে জানতে হবে আপনার জীবন দর্শন কি?
আমি: আমার আবার জীবন দর্শন কি মহারাজ!
মহারাজ : তবে শুনুন, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজে তিন রকম ম্যানেজারের কথা বলা হয়েছে। এক, He who does not know what is happening - মানে, অফিসে বা কর্মক্ষেত্রে বাস্তবে কি চলছে তা তিনি জানেনই না -
আমি: তাজ্জব ব্যাপার তো! এমন অপদার্থ ম্যানেজার চাকরি পায় কি করে ?
মহারাজ : আরে বাবা পুরো কথা গুলো আগে শুনুন। কথার মাঝে কথা বলবেন না। দুই নম্বর ম্যানেজার হলো - He who sees things happen -অর্থাৎ ইনি জানেন কি চলছে, কিন্তু অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকেন শুধু। আর তিন নম্বর হলো, He who makes things happen - ইনি পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন।
আমি: বাঃ দারুণ তো!!
মহারাজ : তাহলে এবার প্রশ্ন - আপনি কোন ধরণের ম্যানেজার ? আপনি কিভাবে জীবন কাটাচ্ছেন ? আপনার কি তিন নম্বর ম্যানেজার হওয়ার ইচ্ছে আছে ? আজ থেকে আপনার জীবন কে আপনিই নিয়ন্ত্রণ করুন।
আমি: মহারাজ আমার কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
মহারাজ : বেশ আজ তবে এই পর্যন্তই থাক। বিষয় গুলো নিয়ে একটু ভাবুন। আরেকদিন আত্মবিশ্বাসকে, কি ভাবে জাগানো যায়, তাই নিয়ে বসবো - অবশ্য যদি আপনার ইন্টারেস্ট থাকে তবেই।
আমি: মহারাজ আপনি চাইলে এখনই বসতে রাজি আছি।
মহারাজ : বেশ, ভালোকথা। তবে আজকে যা নিয়ে আলোচনা করলাম সেগুলো কে নিয়ে একটু ভাবুন। আর হজম করার চেষ্টা করুন - নমস্কার - বাই।
আমি: যাহঃ সত্যিই তো উনি চলে গেলেন দেখছি!
স্ত্রী : হ্যাঁগো, বসে বসে ঘুমাচ্ছ নাকি ?
আমি: অ্যাঁ!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন