বসতভিটা
পর্ব -২
শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
শেষমেশ নীলিমার অনুরোধ ফেলতে না পেরে এবং কতকটা আমাদের কথায় একপ্রকার রাজী করানো গেল রমাকে।
আমি আর জহর হলাম চায়ের পোকা। পাঁচ দশ মিনিট দেরী হয় হোক,বেড়াতে এসে খোলা আকাশের নীচে চায়ের দোকানে না ঢুকলে বেড়ানোর মজাটাই যেন তেতো হয়ে যায়। একএক সময় জহরও মজা করে বলে..' দেখেছেন দাদা, জহুরি ঠিক আর এক জহরকে চিনে নেয়...পেয়েছি বটে আপনাকে...!'
হয়তো অনেকটা এ কারণেই আজ আমার বেয়াইটি শুধু যে আমার পরম আপনজন তা ই নয়, এমনতরো মনের মিল সচরাচর বোধহয় খুঁজে পাওয়া ভার। এর মাঝে অবশ্য আমাদের দলে যদি রাখাল এসে পড়ে, তাহলে বেড়ানোর আনন্দ ষোলো আলার মধ্যে আঠারো আনাই সফল।
স্টেশনের একধারে ফেন্সিংএর পাশে টিনের ছাউনি দেওয়া গুমটির ভেতর এক বুড়ো চা বিক্রি করছিল। আমরা এগিয়ে গেলাম।
রাখাল ব্যস্ত হয়ে বললো,' তাড়াতাড়ি ছয় কাপ চা বানান। দেখুরিয়া যাবো। প্রায় এক ঘন্টার কাছাকাছি পথ..'
খক খক করে করে কাশতে কাশতে বুড়োটা জিজ্ঞেস করলো..' দেখুরে গ্রাম? কিসে যাবেন? অটো, ট্রেকার আজ আর হয়তো কিছুই চলবে না...কি জানি। ঐ খানকতক রিকশা দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যান্ডে। দোকানপাটই তেমন একটা খোলে নি তো যানবাহন...'
' এরকম অবস্থা কেন গো আজ?'
জিজ্ঞেস করলো রাখাল।
' যদু শ্যাকরা মরে গেছে...রামপুরহাট পরিবহন, ব্যাবসায়ী সমিতির বহু পুরোনো লোক...গাড়ি ভাড়া খাটাতো, আবার দোকানও চালাতো.. কত আয়োজন করে ফুল চন্দন দিয়ে সাজিয়ে শ্নশান ঘাটে নিয়ে যাওয়া হলো...সেই কারণেই বারো ঘন্টার বাজার বন্ধ। এই তো ছটার পর আবার খুললাম...কি করবো, আমরা তো আর যদু শ্যাকরা নই...যা দুচারপয়সা ক্ষুদকুরো আসে তা ই লাভ...এসে তো দেখছি সত্যিই মরা বাজার...অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছি....শেষবেলায় কটা লোকই বা আমার মতো ঝাঁপি খোলে...আপনাদের দিয়ে বউনি করলাম...রিকশা পেয়ে যাবেন...কপাল ভালো থাকলে ট্রেকার...কোত্থেকে আসছেন বাবারা?'
চা পান শেষে ধূমপানের আমেজ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি শুনশান না হলেও আশপাশে লোক বেশ কম। কিছু দোকানপাট খোলা। তারা বলতে গেলে মাছি মারছে...বেশিরভাগ ঝাঁপিই বন্ধ। চা ওলা বু্ড়োটা ভুল বলে নি। বাজার অঞ্চল বলেই হয়তো স্ট্যান্ড থেকে চারটে রিকশা পেয়ে গেলাম। অটো বা ট্রেকারের জন্য অযথা সময় ব্যায় না করে আমরা এক একটা রিকশায় দুজন করে উঠে পড়লাম।
স্টেশন সংলগ্ন এলাকা ধরে কিছুটা যাবার পর গ্রামের রাস্তার দিকে মোড় ঘুরলো আমাদের রিকশা। একটু আগেও যা দুচারজন মানুষ যাতায়াতের পথে চোখে পড়েছিল এখন আর জনপ্রাণী নেই বললেই চলে। খেত খামার, ধূ ধূ মাঠ, গাছপালায় ঘেরা ছোট ছোট গ্রামকে দুপাশে রেখে মাঝবরাবর আলের মতো পিচঢালা রাস্তা চলে গেছে বহুদূর...ঝোপঝাড়, গাছগাছালির ভেতর থেকে দূরে দূরে টিমটিমে আলো জ্বলা ছোট ছোট কুঁড়েঘর, মনুষ্য বসতি...রেল স্টেশনকে পেছনে ফেলে এসেছি অনেকক্ষণ... শুধু দূর থেকে ট্রেনের হুইসিলের ক্ষীয়মাণ আওয়াজ ভেসে আসে কানে...জ্যোৎস্নার আলো চিকচিক করছে পুকুর, বাঁওড়ের জলে, বাঁশ ঝাড়, লতাপাতায়, ক্ষেতের আলে, আমাদের পথ চলার আগে আগে....অনেকক্ষণ পর পর একটা কি দুটো ভ্যান রিকশা,পথচারী ছায়াশরীরের মতো চলে যায় পাশ দিয়ে....ধূ ধূ মাঠ, ধানক্ষেত পেরিয়ে আসা শিরশিরে হাওয়া গায়ে লাগছে বেশ...একরাশ কুয়াশার মতো ধোঁয়াটে বাতাস উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক সেদিক...সেই ধোঁয়াশার আড়ালে ঢাকা দূরের গাছপালাগুলো আবছায়া অবয়বের মতো যেন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে আমাদের দিকে...অদ্ভুত সব অবয়ব যেন...যার মাঝখানটা কুয়াশায় ঘেরা...শুধু মাথাগুলো উঁকি মেরে চেয়ে রয়েছে...
আমি আর জহর একই রিকশায়। যেতে যেতে সে আমায় বলে,'আমার রেডিয়াম ডায়ালে বলছে সবে রাত আটটা। তেমন জোড়ালো শীত না পড়তেই চারিপাশ কিরকম নিশুতি হয়ে গেছে দেখছেন...নভেম্বরের এই সময়টা থেকে কুয়াশার মতো ধোঁয়া গুলো এসে জড়ো হয় মূলত ফাঁকা পল্লী অঞ্চলে...বেশ থ্রিলিং কি বলেন?'
' যা বলেছো?'
' হালকা চাদর টাদর নিয়ে এসেছেন তো? বেশ বেশ...। ভোরবেলা রাখাল, আমি, আপনি মিলে নদীর আশপাশটা ঘুরে আসা যাবে...যাকে বলে অ্যাট দ্য ডন...ঐ সময়কার দৃশ্য, সে আর একরকম..ও ভাই, আর কত পথ বাকি?'
ভোরবেলাকার গ্রাম দেখার ঔৎসুক্যটা আপাতত অবদমিত রেখে অন্তরাত্মা যেন নৈশ প্রকৃতির মাঝেই ডুব দিল আবার। জোয়ান রিকশা চালক অন্ধকারে যতটুকু জোরে চালানো যায় হয়তো তার চেয়ে কিছু বেশি জোরেই টেনে নিয়ে চলেছে আমাদের। একবার মনে হলো,জিজ্ঞেস করি..আর কতক্ষণ। বললাম না। সময়টুকু ফুরিয়ে গেলেই তো গেল। এমন মুহূর্ত খুব বেশি বোধহয় পাওয়া যায় না....
পেরিয়ে যাচ্ছে ছায়া ছায়া গ্রাম, বন ঝোপ, জোনাকি জ্বলা আলের ক্ষেত, তাল,নারকেল,বাঁশ গাছের সারি, আরো কত কি....সামনের তিনটে রিকশা আমাদের ছাড়িয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছে...একাকি গ্রাম্য পথে চাঁদের আলো ছাড়াও আরো একটা জিনিস আমাদের সঙ্গ নিয়েছে অনেকক্ষণ ধরে.... সেটা হলো আঁকা বাঁকা রাস্তা ধরে ছড়িয়ে থাকা উড়ো খই...পিচ ঢালা রাস্তাকে পেছনে ফেলে যখন থেকে আর একটা মেঠো রাস্তায় মোড় ঘুরেছে রিকশাটা তখন থেকেই রাস্তা জুড়ে এই খইগুলো লক্ষ্য করে আসছি...চাঁদের আলোটুকু না থাকলে হয়তো চোখেও পড়তো না....যেতে যেতে হঠাৎ সেই বুড়ো চা ওলার মুখে শোনা যদু শ্যাকরার মৃতদেহ নিয়ে যাবার কথাটা সন্ধ্যাকাশে যেন হাওয়ায় উড়ে এলো মনে...অন্য কারো শবদেহও তো যেতে পারে...তবু কি জানি কেন ঐ অচেনা অজানা নামটুকুই ঘুরপাক খেলো বেশ কয়েকবার, ধোঁয়াশায় ঘেরা নিঃস্তব্ধতার মাঝে।
চা খেতে খেতে রাখাল বলছিল, তাদের গ্রামের দুটো গ্রাম আগে যদু শ্যাকরার বাড়ি...অনেক কালের পুরোনো ব্যাবসায়ী...রাখালের বাবা ছেলে মেয়েদের বিয়ের গয়না সব ওর কাছ থেকেই...
খই ছড়ানো সরু রাস্তাটা একটু পরেই ঝুপসি অন্ধকারে গাছপালার আড়ালে মিশে গেল। আমাদের রিকশা গুলো ও রাস্তায় না গিয়ে একটা লাল মাটির পথ ধরলো। সামনের রিকশা থেকে রাখাল বেশ জোরে বলে উঠলো..' আর পাঁচ মিনিটের রাস্তা বেয়াই....'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন