শনিবার, ২০ জুলাই, ২০২৪

অরাজনৈতিক ভ্রম

রাজনীতি আসলে এক জমি

কৌশিক চক্রবর্ত্তী



 


অরাজনৈতিক শব্দটি কতটা যৌক্তিক? সব সিদ্ধান্তের পিছনে থাকে কোনো না কোনো অরাজনৈতিক ভ্রম। "আমি নিরপেক্ষ" এই শব্দবন্ধের প্রতিবন্ধকতা অনেক। আসলে আমরা নিঃশব্দে হেঁটে গেলে পায়ের শব্দ শোনা যায় না। কিন্তু আমরা হাঁটছি না সে কথা কতদূর প্রাসঙ্গিক? আপনি কোন সিদ্ধান্তকে রাজনীতির বাইরে রাখছেন? রাজনীতি অর্থে কী? রাজার নীতি? কদাপি না। রাজা শব্দটি বড় আপেক্ষিক। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে"। অর্থাৎ রাজ মনন অন্তরে। মুকুট পরলেই রাজা হওয়া যায় না। রাজা সন্ন্যাসীও হতে পারেন। আবার কপর্দকশূণ্য হাতে রাজা বনবাসীও হতে পারেন। আমরা জানি রাজা হরিশ্চন্দ্র ডোমের জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন। সেই অর্থে দেখতে গেলে আপনার রাজত্ব আপনার অধীনস্থ। আর সেই রাজত্বে সব সিদ্ধান্তই রাজনৈতিক। 

এই ধরুন বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনকে ধরা যাক। সংরক্ষণ আইনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন আজ ঢাকা, ময়মনসিংহ, বড়িশাল বা কুমিল্লার পথে পথে আগুনের লেলিহান সর্বগ্রাসী শিখার মত ছড়িয়ে যাচ্ছে, তা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আর একটি রাজনৈতিক লড়াই। ঝাণ্ডা রাজনীতির পরিচয়৷ তবে দেশের পতাকা হাতে রাজপথে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক কিভাবে নিজেকে অরাজনৈতিক ব্যক্তিসত্তায় পরিচয় করাতে পারে? রাজনীতি এক মঞ্চ। যে মঞ্চের মধ্যিখানে আমরা সবাই দক্ষ বা অদক্ষ কুশীলব। সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার সন্তান চিন্তা করছে কিভাবে স্কুলে পৌঁছে সম্পূর্ণ না হওয়া হোম ওয়ার্কের খাতা জমা দেবার হাত থেকে বাঁচতে হবে। একবার ভাবুন তো। এরমধ্যে কি রাজনীতির কোনো পাঠই নেই? আসলে রাজনীতি আমাদের আত্মায়। প্রতিদিন আমরা এক অরাজনৈতিক ভ্রমের আবহে বাস করি৷ অরাজনৈতিক শব্দটাই এক অবাস্তব বিভ্রম। সামাজিক পরিকাঠামোয় এর কোনো অস্তিত্ব নেই। অরাজনৈতিক সত্তা নেহাতই এক আস্ফালন। আর এই আস্ফালনের মধ্যে থাকে এক মোড়কের আস্তরণ। তার ভেতরে আমরা স্বচ্ছন্দে বাস করবার চেষ্টা চালাই৷ অথচ নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্বটুকু লুকিয়ে সমাজে নিজস্বতার মিথ্যে জাহির করে বেড়াই সাবলীল ভাবে৷ 

বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ছাত্র আন্দোলন বর্তমান সময়ে সব থেকে বড় রাজনৈতিক ইস্যু৷ দেশে সংরক্ষণ আইনের বিরুদ্ধে পথে নামে ছাত্রদল। কী তাদের রাজনৈতিক সত্তা? তারা ছাত্র। দল বিচার করলে তারা ছাত্রলীগ হতে পারে। কিন্তু এই লীগের বাইরে তাদের সবথেকে বড় পরিচয় তাদের ছাত্রসত্তা। আর ছাত্রাবস্থায় যে রাজনৈতিক পাঠ মস্তিষ্কের দখল নেওয়া শুরু করে, সেই মতাদর্শই সারাজীবন পরিচালিত করে আপামর জীবনের স্রোতকে। তাই ছাত্রাবস্থা হল রাজনীতির হাতেখড়ির সময়৷ কিন্তু সেই সময় যদি কোনো ছাত্রকে প্রাণ দিয়ে তার দাম দিতে হয়, তবে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক কিছু হয় না৷ ১৯৫২ থেকে ২০২৪। মাঝের এই সময়টায় অনেক বদলেছে ঢাকা। কিন্তু বদলায়নি ছাত্রদের রাজনৈতিক সত্তা৷ যে বল বুকে নিয়ে বরকতরা ছাত্র রাজনীতির পতাকা বহন করে পথ এটা ছিল ঢাকার রাজপথে, এই ক্ষেত্রে দলই আবু সাঈদের বেশে রাজনৈতিক সত্তাটুকু বাঁচিয়ে রাজপথে বুক চিতিয়ে গুলি খেল। এবং সেই রাজনৈতিক সত্তার ক্ষমতাটুকুর বলে হয়ে গেলে গুলি খাওয়ার পরেও দাঁড়িয়ে থাকে হাজার মানুষের মধ্যিখানে। রাজনীতি আসলে এক জমি৷ যে জমির উপর দাঁড়িয়ে মানুষ কথা বলতে পারে, যে জমির উপর দাঁড়িয়ে মানুষ হিসাব চাইতে পারি। আর ব্যক্তি সত্তায় এই হিসাবটুকু চেয়ে নেওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। রাজনৈতিক সত্তা বুকে নিয়ে শহীদ হবার ঘটনা আজ প্রথম নয়। ক্ষুদিরাম বসু যদি এই প্রথার পুরোধা ব্যক্তিত্ব হন, তবে তার রাজনৈতিক সত্তার অহংকারই তার শহীদ হওয়ার শক্তি। রাজনীতি জীবনকে নাড়া দেয়৷ একটি ভোট একটি গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের মঞ্চ৷ আর সেই ভোটের আড়ালে মিশে থাকা মনন আকাশচুম্বী। সেখানে অনেক লড়াই, অনেক আন্দোলন। 

প্রতিটি মানুষের জন্য সবার প্রথমে দরকার মঞ্চ। সে সাংসারিক পরিমণ্ডলেই হোক, বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অথবা কর্মক্ষেত্রে৷ রাজনৈতিক মঞ্চ বেঁধেই আমরা হেঁটে যাই প্রতিটা দিন। রোজকার লড়াইয়ে স্বীকৃতির জায়গাটাই তো রাজনীতির সহজ পাঠ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

  প্রচ্ছদ ঋণঃ-  অদিতি সেনগুপ্ত