বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০২৪

ছোটগল্প

ম‍্যানিকুইন
অদিতি সেনগুপ্ত



maniqueen




সারবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ম‍্যানিকুইনের দল। প্রি-পূজা স্টক ক্লিয়ারেন্স চলছে শপিং মলের প্রতিটা শোরুমে। অক্সেমবার্গ আর টার্টেলের শোরুমের মাঝে নতুন একটা শোরুম। রথযাত্রার দিন খুলেছে। নামজাদা ব্র‍্যান্ড, কিন্তু প্রি-পূজা সেল আর ওপেনিং ধামাকা মিলিয়ে বেশ মোটা অঙ্কের ছাড় চলছে এখানে। আর তাই সকাল থেকেই ভীড় উপচে পড়ছে এই শোরুমে। ম‍্যানিকুইনগুলোর গায়ে সাঁটা নানান মূল‍্যের প্রাইস ট‍্যাগ। দেখতে দেখতে কাঁপা হাতে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢোকে রাখি। অনেকক্ষণ ধরে এটা সেটা ধরে ধরে দেখতে থাকে। ওর চোখেমুখে কিসের যেন একটা খোঁজ! সস্তার আধময়লা জামাকাপড়ের মোড়ক ওকে আলাদা করে দিচ্ছিল ক্রেতাদের থেকে। স্টোর ম‍্যানেজার বেশ কিছু সময় ধরে নজর করছিল রাখিকে।


-- কী চাই এখানে?


কানের কাছে আকস্মিক প্রশ্নবাণে চমকে তাকায় রাখি। শোরুমের লোগো আর আইকার্ড দেখে বোঝে ব‍্যক্তিটি এই শোরুমের সঙ্গেই যুক্ত। আমতা আমতা করে বলে,


-- আআ আমি মানে। আমার একটা কাজের খুব দরকার। সেজন্যই শোরুম গুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আসলে পুজোর আগে তো অনেক লোক নেওয়া হয়, তাইই...


-- হুম। তা কোথা থেকে আসা হচ্ছে?


-- শীতলা গাঁয়ে আমার বাড়ি স‍্যার। বাবার কারখানায় লকআউট। ভাইবোনগুলো ছোট ছোট। মা তিনটে বাড়িতে রান্নার কাজ করে। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়ে চলেছে ওই টাকায় প্রায় না খেয়েই কাটাতে হচ্ছে। যা হোক কিছু কাজ দিন স‍্যার। আপনি যা বলবেন আমি তাইই করার চেষ্টা করব...


-- আরে থামো থামো। একসুরে বলেই চলেছে...! শোনো...


-- হ্যাঁ হ্যাঁ স‍্যার...


-- এই প্রত‍্যেকটা ম‍্যানিকুইন দেখছ তো, এগুলোতে যে জামাকাপড় পড়ানো আছে, এগুলো প্রতিদিন সকালে খুলে সব ঝেড়ে মুছে আবার পরিয়ে দিতে হবে। এছাড়া সমস্ত জায়গা পরিস্কার করতে হবে। রাত দশটার আগে কিন্তু ছুটি নেই। কি? পারবে এতো সব?


-- হ্যাঁ স‍্যার পারব স‍্যার, খুব পারব। কিন্তু এতো রাত্রে ফিরব কী করে, না মানে বাস তো তখন...


-- সে তো জানিনা। তবে তুমি এসো। তোমার দ্বারা হবে না।


-- না না স‍্যার পারব স‍্যার। বাবার সাইকেলটা নিয়ে আসব স‍্যার।


-- হুম...শোনো, প্রতিদিন দুশো টাকা করে পাবে আর একবেলা খাওয়া। এছাড়া দুবার চা। রাজি থাকলে কাল থেকেই চলে এসো।


-- রাজি স‍্যার। আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো!


-- ঠিক আছে ঠিক আছে ওসবের দরকার নেই। শুধু কাজে ফাঁকি দিওনা আর কামাই কোরোনা। আর শোনো, কাল আসার সময় দুকপি পাশপোর্ট সাইজ ফটো আর আধার কার্ডের ফোটোকপি করিয়ে আনবে।


★★★★★★


-- স‍্যার দশটা বেজে গেছে এবার আমি বেরোবো?


-- শোনো বাপু এই উইকএন্ডে এতো হিসেবমতো বাড়ি যাওয়ার তাড়া লাগালে চলবে না। এমনিতেই আজ স্টাফ কম আছে। তারওপর আজ আবার মালিক এসেছে। এখন যাওয়া চলবে না। কাজ করো চুপচাপ। দরকার হলে পৌঁছে দেওয়া হবে।


প্রায় মাসখানেক হয়ে গেলো এখানে কাজ করা। সেই সকাল দশটা থেকে রাত দশটা একফোঁটা বসা নেই! বাড়িতে ফিরে যখন বিছানায় যায় মনে হয় ওর নিম্নাঙ্গ বলে কিছু নেই! কিন্তু তবুও সংসারের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁতেদাঁত চিপে কাজটা করে যায়।


রাখি বাড়িতে মাকে ফোনে জানায় যে আজ ওর ফিরতে আরও রাত হবে। তারপর আবার কাজে লেগে পড়ে। একে সকলেই বাড়ির পথ ধরে। শুধু রাখি অপেক্ষায় থাকে কখন ওকে পৌঁছে দেওয়া হবে। আরও বেশ কিছু সময় পরে ম‍্যানেজার ওকে বলে ওই যে কালো রঙের যাইলো গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে ওতে উঠে পড়তে। রাখি ব‍্যাগ গুছিয়ে পা বাড়ায় গাড়ির দিকে। দরজাটা খুলতেই একটা ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে ঝাপটা মারে ওর। কোনোরকমে উঠে এককোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়ে রাখি।


"আরে চিকনি চামেলি ছুপকে আকেলি পুয়া চড়হাকে আয়িইই..."


আরেএএএ ইয়ে দ‍্যাখো ইয়ার ইয়ে তো সচমে চিকনি চামেলি ছুপকে বইঠি হুয়ি হ‍্যায়!


চার পাঁচজন ছেলে হুড়মুড়িয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। মদের ঝাঁঝালো গন্ধে এসি গাড়ির কাচবন্ধ ডিব্বাটায় দম আটকে আসছিল রাখির আর সেইসঙ্গে একটা হিমশীতল ভয়ের স্রোত নামছিল শিড়দাঁড়া বেয়ে।


-- আরে জানেমন, কুছতো বোলো ইয়ার! পুরো কুড়িহাজার টাকা তুলে দিয়েছি তোমার ওই ম‍্যানেজারের হাতে। আজতো গোটা রাত মস্তি হবে তোমাকে নিয়ে। উফফফফ কেয়া ফিগার হ‍্যায়। উউউমমমাহহহ পুরা মাক্ষন।


-- আআ আমাকে প্লিজ ছেড়ে দিন। আমার বাড়িতে আমি ছাড়া দেখার কেউ নেই। আমার বাবা...


আর কিছু বলার সুযোগ মেলেনা রাখির...


মুখে ঢোকানো কাপড়ের ডেলাটা ধীরে ধীরে শ্বাসরোধ করে ফ‍েলে ওর। কিন্তু তারপরেও মুক্তি মেলেনা! প্রাণহীণ শরীরটার উপরেই পালা করে চলতে থাকে পৌরুষ প্রদর্শন।


সকালে রাখির বাড়িতে থানা থেকে ফোন যায়,
-- আপনার মেয়ে মদ‍্যপ অবস্থায় সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ট্রাকের সামনে চলে আসে। স্পট ডেড। আপনারা আসুন বডি শনাক্ত করে নিয়ে যান।


তারপর আরও একটা ফোন যায় পূর্তমন্ত্রীর কাছে,
-- হ্যাঁ স‍্যার কেসটা সামলে নিয়েছি। মদ খেয়ে অ‍্যাক্সিডেন্ট করেছে বলে দিয়েছি। বাড়ির লোক আসছে। দাহকার্যটা চটপট মিটিয়ে ফেলাতে পারলেই নিশ্চিন্ত!


শপিং মলের ম‍্যানিকুইনগুলোর প্রাইসট‍্যাগ বদলে যায়। ৭৮ তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে আজ পুরো ৫০ শতাংশ ছাড়! মাইকে তারস্বরে বেজে চলেছে,


"আজা আজা দিল নিচোরে রাতকি মটকি ফোড়ে..."

৯টি মন্তব্য:

  1. বাস্তব চিত্র। বড়ো বেদনায় বুকে বাজলো গল্পটি।

    উত্তরমুছুন
  2. এ কোন দেশে বাস করছি আমরা। যাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা তারাই ওকে ভুল জায়গায় পাঠিয়ে দিচ্ছে?

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. সত্যিই তাই। জানিনা আরও কত ভয়ানক দিন দেখতে হবে!

      মুছুন
    2. কি ই যে বলব জানি না। বুকের ভেতর থেকে একটা ভয় সাপের মত হিলহিল করে উঠল। তোমার লেখনীকে কুর্নিশ।

      মুছুন
  3. ভালো। কঠোর বাস্তব।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. জাগো ক্রোধ, জেগে থাকো ক্রোধ... আমাদের এই প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে হবে।

      মুছুন

  প্রচ্ছদ ঋণঃ-  অদিতি সেনগুপ্ত