রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

Kobitar Alo September Sankhya 2025

 



প্রচ্ছদ ঋণঃ- অদিতি সেনগুপ্ত 


সূচীপত্র


কবিতা ভিত্তিক

সৌমিক ঘটক
অনীশ দাস
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
কেয়া নন্দী
সৌরভ দাস
পলাশ পাল 
ভাস্কর সরকার

সম্মিলন 

অনিন্দিতা সেন
শ্যামল রক্ষিত
ওয়াহিদার হোসেন

আনুপূর্বিক

হিমাদ্রি শেখর দাস
অর্ণব সামন্ত 
মানিক পন্ডিত

গল্প

বিপ্লব নসিপুরী
শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়।
রত্না দাস



কবিতাভিত্তিক


আবহ
সৌমিক ঘটক

আলোর ছটা পাল্টে যাচ্ছে, নীল আকাশে জমছে তুলো,
বাতাসে মিশছে কাশফুলের গন্ধ, শরৎ চলে এল।
গঙ্গা মাটি ব্যাকুল তাই, প্রান যে উঠছে গড়ে,
বছর ঘুরে উৎসব আবার, মা আসছে তার ঘরে।
“পুজোর পরে দেখা হবে”, বিদ্যালয় হচ্ছে ছুটি,
শৈশব মন হিসেবে মত্ত, করতে হবে যে অনেক হুটোপুটি।
গাড়ি বোঝাই বাঁশগুলো সব রাখা হচ্ছে পাড়ার মাঠে,
উৎসবের এই আনন্দে মেতে, রাস্তাগুলি সাজছে নানান আলোর রঙ্গে।
বন্ধুরা সব ফিরছে বাড়ি বিদেশ বিভূঁই ফেলে,
সপ্তমীতে বেরোতে হবে, নবমীতে গানের আসর বসবে নিচের ঘরে।
অষ্টমীতে ভরে উঠে মায়ের পায়ে অঞ্জলি খালি পেটে।
“মণ্ডপে আসিস কিন্তু, ওই নীল শাড়িটাই পরে।”
ঠাকুর দেখার লাইনে দাঁড়িয়ে পেয়েছে বেজায় খিদে।
নিয়মের সকল বাঁধন ভেঙে হাত বাড়াবো তাই ফুচকার ওই প্লেটে।
আনন্দ মজায় কেটে গেলো কটা দিন, দশমী নারল কড়া,
ঢাকের কাঠি শেষের দিকে, এল বিরহের পালা।
উৎসব কি সুধুই একটি পুজো, ফুল-ফল-মালা সহযোগে?
উৎসব মানে সম্পর্কে সম্পর্ক বাঁধে, হৃদয় যখন হৃদয়ে মেশে, সকল বিবাব ভুলে।
হাসি কান্নায় শোভাযাত্রায় বিদায় নিল মা,
সন্তানদের তুমি আগলে রেখো, ফিরো তাড়াতাড়ি দেরি করোনা।



জীবনের উৎসবে 
অনীশ দাস


আবছা আলোয় মুহূর্তের ব্যাপ্তি!
নিরপেক্ষতার সমাবেশ,
মিলনের সুমধুর সঙ্গীত,
আজও আছে;
                  কালও রবে।
আলিঙ্গনের পরিপূর্ণ আশ্বাস,
মজার ছলেই পেরোবে জীবন, 
উৎসবের মাঝেই;
         দৈনন্দিন মুক্তির অবকাশ।





উৎসব
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

কাদারাস্তার গান গাইতে গাইতে কখন যেন আশ্বিনের বাঁশি
বেজে ওঠে, অবাক হই, তবু সে নিয়মে বলে নির্ভুল সারেগামা
সেই সুরে বৈরাগীজ্যাঠার সিঙ্গল হারমোনিয়ামের জোরালো ধ্বনি
আর ফকিরকাকার বেহালা কী অদ্ভুতভাবে মিলে যায়
পঞ্চাশ বছর পরেও সেই না-বোঝার বিস্ময় কাটেনি।

শরতের হাওয়ায় বুঝি শিকড়ের গন্ধ লাগে ? কোন টান
টেনে আনে ধাইমা বুড়ি, চুড়োঠাকুমা বা অগ্রদানী জেঠিমার
আঁচলের মুড়ি আর টাটকা ঘোলের তৃপ্তি, তাও তো বুঝিনি।
সবাই আত্মীয় হয়ে যায়, মাটির দাওয়ায় বসে ভাত খায়,
খুশিতে জয়ধ্বনি করে, এসব সমৃদ্ধি দেখে নিজেদের ধন্য ভেবেছি।

আজ আর সেসব গল্প নেই, সাদামাঠা গৃহস্থমন, সংশয়মুখ
ডান ও বাঁয়ের মাঝে বিরাট গর্ত নিয়ে দাদুর গল্প ভাবি
পুজো এসে যায়, চিরকেলে টানাটানি, সীমাহীন অতৃপ্তি যেন
অচ্ছেদ্য টিউমারের দুঃস্বপ্ন, আর এভাবেই চলে যায় দিন
উত্তরণ থেকে অনেক দূরে অন্ধকার মেখে নিঃশব্দে বসি
জোনাকিঝোপের পাশে, ঝিঁঝির সানাইয়ে লাগে ঘুমহীন ব্যাঙের
ক্লান্ত মকমক। সেই মিশে যাওয়া অন্ধকারে পায়ের উপর
চলে যায় অনিবার্য গতি দুটো আনমনা সাপ, উৎসব রাতে।




কথাচিত্র
কেয়া নন্দী

আলমারীটা খুলে দাঁড়িয়ে থাকলে হবে?
দাঁড়াওনা, ভাবতে দেবে তো?

হুম্ ম, দাঁড়িয়ে ঘন্টাখানেক ধরে ভাবো ___ 
কোন রঙ টা দিয়ে যে শুরু করি ?

তা কেনার আগে ভাবো নি? 
   না - আ - আ 

যখন যেটা ভালো লেগেছে কিনে নিয়েছি ।
বেশ করেছো।

এখন দেখছি সব যেন বড্ড কাছাকছি হয়ে গেছে।
রামধনু  রঙ হয় নি?

নাহ্,  তোমার দেখছি খুব মজা লাগছে ! 
যেমন তোমার কীর্তি 

কি করবো, সেদিন ওর সাথে ময়দানে হাঁটছিলাম।
ফেরার সময় দুটো প্যাকেট হাতে ধরিয়ে চলে গেলো।

তারপর
তারপর আর কি ___ খুলে আলমারীতে রেখে দিলাম।

আর মনের আলমারী ? 
ধুস্ 

বা - আ - বা !! খুশি হও নি বলছো ?
না, সে কি আর বলতে ! 

দ্যাখো, দ্যাখো কি দিয়ে শুরু করবে ভাবো ? এরপরতো ড্রেসিং টেবিল টা বাকি আছে ____ ওর জন্যেও তো সময় রাখতে হবে।
সেই যা বলেছো 

আচ্ছা, আমারটা কিনেছো ? 
কিনেছি গো , কিনেছি

কই দ্যাখাও না ____ 
নাহ্ ,যখন তোমায় দেবো তখন না হয় দেখো।

ওই একই ধরনের? 
না, এবার লাল - সাদা টা একটু অন্য ধরণে আছে।দিলেই টানা - টানা চোখে দেখো।

হুম্ ম। বুঝলাম।
জানো, আমি আরো কিনেছি।

এরপরেও .....
না গো, ওই ছোটো ছেলেমেয়েগুলোর জন্যে। তা প্রায়
   জনা কুড়িটা হবে ___ সকলের এক রঙের ।
কেনার পর খুব আনন্দ হচ্ছিল। এগুলো পরলে না জানি কত খুশি হবে ওরা !!

সেই। এটা খুব ভালো কাজ করেছো ; ওরাও চায় একটু নতুন বেশে আনন্দ করতে।

সব মিলিয়ে এবার দেখছি বেশ জমজমাট আয়োজন।
হ্যাঁ গো, প্রতিদিন তোমার সঙ্গে কোথাও না কোথাও দেখা হবে। আর তুমিও আমার ___ 

হ্যাঁ বুঝেছি।গতিবিধি - রঙ ঢঙ সব দেখবো তাই তো ___
আরে শোনো , যাহ্ কোথায় গেলে ? 
চোখ টা এমন লেগে গিয়েছিল ......
( দূর থেকে ভেসে আসছে ) জাগো ,তুমি জাগো ......



শরৎকাল
সৌরভ দাস

শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ,
কাশফুলে দোলা।
আকাশ জুড়ে পেঁজা মেঘ,
মন করে ভোলা।
সকালবেলার সোনা রোদ,
শিশির ভেজা ঘাস।
পুজোর আগমনী বার্তা,
জুড়িয়ে দেয় শ্বাস।
নদীর ধারে সাদা কাশ,
মনোরম সে দৃশ্য।
এই শরৎ, তুমিই সেরা,
নিয়ে যাও সব বিষণ্ণ।
শারদ প্রাতের স্নিগ্ধ বাতাস,
জুড়িয়ে যায় মন।
মা আসছেন, আনন্দ অপার,
জেগে ওঠে সবারই জীবন।
শিউলি ঝরে পাতায়,
কাশ দোলে হাওয়ায়।
পূজার সাজে সেজেছে ধরা,
আনন্দের সুর ছড়ায়।
দূরের মাঠে সাদা মেঘের ভেলা,
আকাশেতে ওড়ে চিল।
শরৎ তোমার রূপে মুগ্ধ,
সবারই মনে খুশির নীল।



লজ্জা 
পলাশ পাল 

কঠিন পথ আর 
না পাওয়ার লজ্জা এখন 
তোমার বস্ত্রহীন ফুটপাত 
দেখে হাসে 
নতুন থেকে নতুনতর হয়ে ওঠা
মায়ার আবাহনে
পথের বাঁদিকে সম্পর্কের দ্রাঘিমায় 
ঝলসানো প্রেমের স্পর্শ
নিভে যাওয়া আগুনের গন্ধের 
কি এখনো লজ্জা?
রণরঙ্গিনী কেন বলে আজ 
ঘুমন্ত বীজের গল্প...?



টিকটিকি
ভাস্কর সরকার

টিকটিকির গায়ে বুকেতে কী একটা পিচ্ছিল লেগে আছে 
দেয়াল এখন তাকে আর আটকায় না 
বারংবার খসে পড়ে যাচ্ছে 
আসলে সে কোনোদিনই কাঁদেনি 
পিচ্ছিল সরে গেলে 
ঈশ্বর আপনা আপনি টুক করে কাছে টেনে নেয়




সম্মিলন


বৃষ্টি কাব্য
অনিন্দিতা সেন

(১)
নীরার কাছে যেতে চেয়েছিলে তুমি
চলে গেলে....
ফিরিয়ে দিয়ে বই, খাতা, কলম
ডায়েরির ছেঁড়া পাতা
চাবির রিং...পুরোনো ছবির মলম!
ফুরিয়ে গেল সমস্ত অর্বাচীন শর্তেরা
মানভাঙ্গী সাতকাহন
আদরের লেখনি পুরান!
অথচ, এক্টিনোমাইসিসের গন্ধে মেশা
পুরুষালি ঘাম
তুমুল বৃষ্টির পরে
ফিরে ফিরে আসে আজো
প্রতিটি বানভাসি মুহুর্তে!

(২)
বৃষ্টি ভেজা নাকাল জনপদে...
আমি ছাড়া সবাই ভিজছে কেবল,
রোজনামচার দিন পেরিয়ে এমন
তো কথা ছিলনা কখনো!
নাই বা এল তুমুল ঝড়, 
নাই বা এল কষ্টের দিনলিপি...
লেপ কম্বলে বিরহ বাসা বাঁধে
হারিয়ে যায় ছোট হতে হতে
এ শহরে...ও শহরে!

(৩)
বৃষ্টির কাছে এখনো আমি ঋণী
বুকের ভিতর বাদলা হাওয়া,
জলস্রোতের তুমুল আহবানে
ভাসিয়ে নেয় যে মেঘহরিনী!
প্রকৃতির নিঝুম আবেগ ঘন
লেফাফায় মোড়া অরণ্যের চিঠি,
কুমারী বেলার বকুল কথা ছুঁয়ে
পরবাসে নিঃসঙ্গ হৃদয় খানি!
তেমনি উতল দিনের মোড়কে
লুকিয়ে রাখা জঙ্গলের ঘ্রাণ, 
বৃষ্টি জলের স্বপ্নকথাগুলো
 ফিরে আসে আচ্ছন্ন কোরকে।
মেটাই যত কষ্ট অভিমান
নষ্ট বাসার গুঁড়ো তুষার,
কাপাস তুলোর কোমল সুখে
জ্যোৎস্না চানের শব্দ শুনি।

(৪)
বর্ষার ঘোরে সুরমা চোখ 
বৃষ্টি পথের উড়ুক্কু গাছ 
বেহেস্তের ছবি
এভাবেই মাটির গন্ধ মাখি 
এভাবেই ভালো থাকি
থাকি
পুরোনো গানে শঙ্খ লাগে
রোদ নাশক মেঘের হয়ে 
আমিই না হয় বৃষ্টি দিলাম
টোল পড়া নিরালা কোনে
নদী-গল্পের উড়ান দিলাম
উড়ান দিলাম
দিলাম
বুকের ছেঁড়া পৃষ্ঠাগুলো আদর গলিয়ে 
ফাগুন জ্বালে
টুপুর টাপুর বৃষ্টি পড়ে ঝুল বারান্দায় 
শিহর তোলে
শিহর তোলে
তোলে!


শ্যামল রক্ষিতের কবিতা   
  
অধিবিদ্যা


আত্মহত্যার দুটি রাস্তা
                   একটি গঙ্গার পাড়ে
                   আর একটি বাড়ির উঠোনে

আমি সমস্ত সভ্যকে সেখানে এসে অপেক্ষা করতে বলেছি

অস্তিত্ব হে, প্রলয়কালে একবার আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসো ।



আত্মকথন

মজার কথা কী বলুনতো
আপনি কবিতা লিখতে জানেন না 

যে আয়নায় মুখ দেখছেন, জানবেন 
সে আয়না আপনার নয় ।



প্রাথর্না


আপনি মূর্খ
নিজেকে হত্যা করতে জানেন না ।



রহস্য


অস্বচ্ছ হও তুমি
অপ্রত্যক্ষে ডুব দাও 

বস্তুর ভাবভাবনায় রাখো
               প্রত্যক্ষ সংঘাত

বিরোধে ভাসাও
অধিবিদ্যার নক্ষত্রগুলি ।



ফসিল

ভাবখানা এমন আপনি উপন্যাস লিখছেন

চরিত্রগুলো পুঁতে রাখছেন মাটিতে
শস্য ফলছে

দেশটাকে দেখা যাচ্ছে না ।


ওয়াহিদার হোসেনের কবিতা

বেড়াল প্রিয় মেয়েটি

বেড়ালের গন্ধে সিঁড়ি উঠে গেছি স্বর্গালোক।সেখান থেকে নেমে আসার একমাত্র রাস্তা সেই পাইনগাছ।
আমি অনেকদিন ভেবেছিলাম একটা দীর্ঘ ঊ এঁকে দেব দুপুরের গা'য়,যেভাবে টিফিন সেরে বাচ্চারা স্কুল থেকে ফেরে।
ম্যাডাম বাড়ি ফিরে দরজা খোলে।আগন্তুকদের জিগ্যেস না করেই একদিন বৃষ্টি আসে
সেই মেয়েটি তুমুল ভেজে
তার তার প্রেমিক সুখে আছে। বেচে থাকার জন্য  যৌনতা ভীষণ প্রয়োজন।
বাড়ি ঘর টাকা পয়সা আর বউ।সেক্সি শাড়ির ভেতর আরেকটা নাদুস বেড়ালের যাতায়ত


কাজীর হাঁট

যেন মনে হয় কাজীর হাঁটে হারিয়ে যাই!
ডুডুয়ার ফেনিভ গন্ধ লেগে আছে আমার হাতে
মোচারু খালুদের বাড়ি থেকে হাঁটতে হাঁটতে
কতদূর নৌকা?
কতদূর পারাপারের উৎসব
অথচ তেমন মাঝি পেলাম কই!
নৌকার ফুটো দিয়ে খুচরো জল উঠছে
বাটি দিয়ে ছেকে ফেলা হচ্ছে সেই জল
ডুডুয়া পার হলেই কাঙ্ক্ষিত কাজীর হাঁট!


আনুপূর্বিক


গীতিকবির পুলকতা- স্মরণে ও শ্রদ্ধা 
হিমাদ্রি  শেখর দাস 

বাংলা ছায়াছবি যে বার সবাক হল, সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে দর্শক শুনল সুর, সেই বছরই বৈশাখি পূর্ণিমায় এক গীতিকারের জন্ম,দিনটা ছিল ১৯৩১, ২ মে।   তিনি হলেন গীতিকবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।

 স্কুল ও বাড়িতে গান, নাটক, আবৃত্তির অনুষ্ঠানে পুলক সক্রিয় ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর গান লেখার প্রতি এমন ঝোঁক ছিল যে একবার শরীর খারাপের দোহাই দিয়ে হাওয়া বদলে চলে যান বোনের বাড়ি ঘাটশিলায়। উদ্দেশ্য, লেখাপড়ার চাপ এড়িয়ে গান লেখা। এক মাস পরে যখন ফিরে এলেন বাড়িতে, সঙ্গে নিজের লেখা ২৫টি গান। ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন তিনি। একবার তাঁর লেখা একটি কবিতা আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হলো। সম্মানী হিসেবে মানিঅর্ডারে পাঁচ টাকা পেয়েছিলেন। কবিতার প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই তাঁর ‘গীতিকবি’ হয়ে ওঠা। স্থানীয় স্কুলে প্রাথমিকের পড়াশোনা শেষ করেন পুলক। এরপর কলকাতার নামকরা স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে নেন স্নাতক ডিগ্রি।
গানেই তো তাঁর প্রথম এবং শেষ পরিচয়। চার হাজারের বেশি গান লিখেছেন। কাঁচা বয়সেই নিজের লেখা গান নিয়ে কোথায় না যাবার কথা ভেবেছেন পুলক!
কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই প্রেম-বিরহের গান লিখে বাড়িতে বড়দের দেখানোরও সাহস পাননি তিনি। দেখালেন তুলনায় সহজ মানুষ, প্রযোজক জামাইবাবু সরোজ মুখোপাধ্যায়কে।
তত দিনে সরোজবাবুর ‘অলকানন্দা’, ‘মনে ছিল আশা’ ছবি রিলিজ করে গিয়েছে। হাত দেবেন ‘অভিমান’ ছবিতে। শ্যালকের লেখা গান দেখে, তাঁকে ছবির সিচুয়েশন দিলেন।
পুলক লিখলেন সে গান। সুর করেছিলেন বম্বের ‘বন্ধন’, ‘পুনর্মিলন’ খ্যাত রামচন্দ্র পাল। যেদিন প্রথম দেখা হল সুরকারের সঙ্গে গীতিকারের, সেও এক বিড়ম্বনা!
তার আগে তো কেউ কাউকে দেখেননি, পুলক গান পাঠিয়েছিলেন ডাকে। নলিনী সরকার স্ট্রিটে কলম্বিয়ার অফিসে ডেকে পাঠালেন গীতিকারকে। তার ঠিক ছ’ দিন বাদে পুলকের ম্যাট্রিক পরীক্ষার টেস্ট। তবুও গেলেন।
সে দিনের ঘটনার কথা লিখেছেন পুলক, ‘‘নাম বললাম। নাম শুনেই রামবাবুর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অস্ফুটে স্বগতোক্তি করে বলে ফেললেন, এত ছোট বয়স... একে দিয়ে কী হবে!’’
আসলে, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় যে অত অল্প বয়সের গীতিকার, সেটা কল্পনাতেও আসেনি রামচন্দ্রের!
সেই শুরু হল। সত্যিই কি এই কিশোর গান লিখেছে? নিশ্চয়ই অন্যের গান নিজের বলে চালাচ্ছে? পরে স্টুডিওতে বসেই গান লিখে দেখাতে হলো পুলককে।
কিশোর বয়সেই সিনেমার জন্য প্রথম গান লেখেন পুলক, ক্লাস নাইনে!
তবে কবিতার অনুরাগ সেই ছোট্ট বয়স থেকেই।স্কুলবেলায় আনন্দবাজার-এ তাঁর কবিতা ছাপে। মানি অর্ডারে পাঁচ টাকা হাতে পেয়ে, সারা দিন নতুন জুতো পরে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন।
বাবা, কান্তিভূষণ ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের ছাত্র। নির্বাক ছবির যুগের নায়ক।
নিউ থিয়েটার্সের ছবি, শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’র নামভূমিকায় তিনি অভিনয় করেছিলেন। সেই সূত্রে বাড়িতে সিনে-দুনিয়ার নক্ষত্রদের আসা যাওয়া ছিল।
তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শিল্পী দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, তুলসী বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরকার হীরেন বসু, চিত্র পরিচালক সুশীল মজুমদার...। নিত্য তাঁদের মজলিশ থেকে উড়ে আসত সেলুলয়েডের শব্দ-সুর-সংলাপ। আর সে সবই প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরত পুলকের কানে। একটু বড় হয়ে গোপনে গোপনে চলত গঙ্গার উদাসী হাওয়ার পিঠে মনকেমনের কথা বসানো।
একদিন সেই সুরের হাওয়ায় ভেসেই পাড়ি দিলেন বাংলা গানের সুর-সফরে।
উত্তর থেকে দক্ষিণ তখন দৌড়চ্ছেন বিখ্যাত সব সুরকারদের কাছে। কোনও একদিন।

এ প্রজন্মের পাঠকের কাছ হয়তো পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটা হঠাৎ শুনলে অচেনা মনে হবে। কিংবা চেনা চেনা, মনে হয় কোথায় যেন শুনেছি। ‘ক ফোঁটা চোখের জল’, ‘তুমি নিজের মুখে বললে যেদিন’, ‘পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সেই দিন’, ‘চিরদিনই তুমি যে আমার’, ‘বহু দূর থেকে এ কথা’, ‘ভালোবাসা ছাড়া আর আছে কী’, ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’, ‘আমার বলার কিছু ছিল না’, ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা’, ‘এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনার’, ‘আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব’, ‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে’,‘সে আমার ছোট বোন’...এই গানগুলো শোনেননি, এমন বাঙালি সংগীতানুরাগী মিলবে কম। এগুলো ছাড়াও বহু জনপ্রিয় বাংলা গানের গীতিকবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
জীবনের প্রায় প্রতিটি মুহূর্ত থেকেই যেন গানের কথা বের করে আনতেন পুলক।পরিস্থিতি এবং গানের সুর বুঝে অল্প সময়ে গান লেখা তাঁর বাঁ হাতের খেল! সে রকম কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা যাক। একবার এক আত্মীয়ের বাড়িতে ঘুরতে গিয়ে ভুলে অন্য বাড়ির কলবেল টিপে দিলেন পুলক। এক নারীকে হাসিমুখে বের হতে দেখে তিনি লিখে ফেলেন, ‘ও কেন এত সুন্দরী হলো, অমনি করে ফিরে তাকাল’! একবার দুর্গাপূজায় তিনি গিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন হেমন্তের বাড়িতে পৌঁছালেন, তখন হেমন্ত ছিলেন গোসলখানায়। বাড়িতে পুলক এসেছেন শুনে তড়িঘড়ি করে প্রায় ভেজা শরীরে সামনে এসে হাজির হলেন। বললেন, ‘কত দিন পরে এলে, একটু বসো, তৈরি হয়ে আসি।’ ব্যস, এই বাক্যগুলো মনে ধরে গেল পুলকের। হেমন্ত সেখান থেকে সরতেই খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়লেন পুলক। লিখলেন, ‘কত দিন পরে এলে একটু বসো, তোমায় অনেক কথা বলার ছিল, যদি শোন...।’
বিমানভ্রমণে এক নারীকে দেখে তিনি লেখেন, ‘ও চাঁদ সামলে রাখো জোছনাকে’। একবার এক অনুষ্ঠানে এক নারীর কান থেকে ঝুমকা খুলে পড়ে গেল। সেটি কুড়িয়ে নিয়ে তিনি তাঁর হাতে তুলে দিলেন। লিখে ফেললেন, ‘জড়োয়ার ঝুমকো থেকে একটা মতি ঝরে পড়েছে’। এভাবেই যেকোনো মুহূর্তকে অনুভূতির রঙে রাঙিয়ে গান লিখে ফেলতেন তিনি।
শুধু সময়কে ধরে নয়, সময়কে এড়িয়ে বিপরীত ভাবের গানও লিখতেন তিনি। খুব ফুটবল ভালোবাসতেন। ছিলেন মোহনবাগানের সমর্থক। মাঠে চলে যেতেন প্রায়ই, মোহনবাগানের খেলা মিস করতেন না। একদিন খেলা চলছিল, গ্যালারিতে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। বিরতিতে একটা কাগজ কুড়িয়ে লেখা শুরু করলেন, তবে খেলাসংক্রান্ত কিছু নয়। পরে মান্না দে সে গান গেয়েছেন, ‘হৃদয়ের গান শিখে তো গায় গো সবাই’। বিপরীত পরিবেশে বসেই লিখে ফেললেন রোমান্টিক গান। লতা মঙ্গেশকরের জন্য একটি গানের ক্ষেত্রেও এমন ঘটেছিল। এক রেস্তোরাঁর টিস্যুতে লিখেছিলেন, ‘রঙ্গিলা পাখিরে কে ডাকে ঘুম ঘুম…।’
কলকাতা বিমানবন্দর থেকে মান্না দেকে নিয়ে ফিরছিলেন। পথে মান্না একটি ঠুমরি গুনগুন করছিলেন। ঠুমরিটি মান্না দের চাচা কৃষ্ণচন্দ্র দের কাছে শেখা, ‘শ্যাম, ঘুংঘটকে পট খোলো।’ হঠাৎ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে মান্না দে বললেন, ‘এই রকম একটা গান লেখা যায় না।’ গাড়ি ততক্ষণে শ্যামবাজারে। পুলক বললেন, ‘গানটা এসে গেছে মশাই, চলুন, এখনই করে ফেলা যাক। কাছেই গানের স্কুল বাণীচক্র। সেখানে গিয়ে একটি ঘর চেয়ে নিয়ে হারমোনিয়াম আর খাতা–কলমসহ বসে পড়লেন দুই শিল্পী। তৈরি হলো নতুন এক গান ‘ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না’।
মান্না দে সেদিন একটা কাওয়ালি শুনিয়েছিলেন। কাওয়ালি শেষ হতেই পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘এর ঠিক ভাবটা কী, বুঝিনি, পাগল নাকি!’ মান্না দে বললেন, ‘কার ঘাড়ে কটা মাথা আছে যে আমায় পাগল বলবে।’ তবে হ্যাঁ, বলেই পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে তাঁকিয়ে বললেন, ‘আপনি বললে আলাদা কথা...।’ শুনে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো কথা না বলে লিখতে শুরু করেছিলেন। সেদিন লিখেছেন, ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে/তার প্রতিবাদ করি আমি/যখন তুমি আমায় পাগল বলো/ ধন্য যে হয় সে পাগলামি’।
সে সময়ের বোম্বের অনেক শিল্পীর প্রথম বাংলা গান পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা। লতা মঙ্গেশকর, কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, অলকা ইয়াগনিক, কিশোর কুমারের সঙ্গে দারুণ সখ্য ছিল তাঁর। তাঁকে পোলাও বাবু ডাকতেন কিশোর কুমার। মুম্বাইয়ে একবার কিশোর কুমারের গান হবে। ‘প্রতিশোধ’ ছবির গান। অনেক কষ্টে তাঁর শিডিউল পাওয়া গেল। মেহবুব স্টুডিওতে প্রথম গানটির রেকর্ডিং হলো ‘হয়তো আমাকে কারও মনে নেই’। গান শেষে কিশোর কুমার তড়িঘড়ি করে বের হয়ে যাবেন। এবার সিঁড়িতে তাঁকে আটকানো হলো। আরেকটি গান গাইতে হবে। মনের বিরুদ্ধে কিশোর কুমার আবার ঢুকলেন। গাইলেন, ‘আজ মিলন তিথির পূর্ণিমা চাঁদ মোছায় অন্ধকার। ওরে গান গেয়ে যা, যা সুর দিয়ে যা...।’ গান শেষে চোখেমুখে আনন্দ নিয়ে কিশোর কুমার বললেন, পোলাও বাবু গানটা দারুণ লিখেছেন, একেবারে তালমিছরির মতো মিষ্টি!

সে বার উস্তাদ আলি আকবর খান এসেছেন কলকাতায়। উঠেছেন হিন্দুস্থান মার্টে নিজের চেনা মহল্লায়। হৈমন্তী শুক্লা ফোন করলেন গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এমন ডাকের মানে জানতেন পুলকবাবু। খাতা-পেন নিয়ে হাজির হলেন। তখন বাংলা গানের জগতে হৈমন্তী ঝলমলে নাম। এক দিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় পুলকবাবুরই কাহিনি ও গান নিয়ে তৈরি ছবি ‘রাগ-অনুরাগ’-এ ‘কী গান শোনাব বলো/ ওগো সুচরিতা’ গানে সরগম গাওয়াচ্ছেন, আবার বিকাশ রায় ডাকছেন অ্যান্ডারসন ক্লাবে জল-নাটিকা ‘সমুদ্র মন্থন’-এ গাইতে। পুজোর গান নিয়ে উস্তাদজির কাছে আসা  । উস্তাদ সরোদ কোলে তুলে নিয়ে, চোখ বন্ধ করে বাজিয়ে চলেছেন রাগালাপ, থেমে পুলককে বললেন, ‘‘এ রাগ আমারই তৈরি করা। লিখুন এই রাগেই।’’ কিন্তু  কিভাবে গান লিখবেন,  খানসাহেব বাজনার সঙ্গে গুনগুন করে  যে কী গাইছেন, পুলকবাবু ও হৈমন্তীদেবী কিছুই বুঝতে পারছেন না। তারই মধ্যে সুরের চলন, বাঁক ধরে পুলক খসখস করে খাতায় লিখলেন গানের শুরুটা। গানের খাতায় চোখ যেতেই চমকে উঠলেন হৈমন্তী। উস্তাদ আলি আকবরের সুরে লেখা হয়ে গেল চিরদিনের বাংলা গান— ‘স্মৃতিই শুধু থাকে/ স্মৃতিই শুধু থাকে।’ পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় সে দিনের স্মৃতিতে লিখেছেন, ‘আমাকে কমপ্লিমেন্ট দিল হৈমন্তী, -"সত্যি পুলকদা, সুরের ওপর গান লেখার আশ্চর্য গুণটা আপনার আছে "।এই ভাবেই পর পর বেশ কয়েকটি গান সে বার লিখেছিলাম আলি আকবরের সুরে।’’
শঙ্খবেলা’ ছবির কাজ-শেষ, উত্তমকুমারের বাড়িতে রাত-পার্টি জমে উঠেছে । খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা -‘মহানায়কের কাছের লোকজন,শঙ্খবেলা’-র টিমের সদস্যরা আছেন।  হারমোনিয়াম সরে যাচ্ছে ‘উদয়ের পথে’-র অভিনেতা রাধামোহন ভট্টাচার্যের দিকে। রাত গড়াতে ঠুংরি, গজল। পরে উত্তম নিজেই হারমোনিয়াম  বাজিয়ে
শুরুতে রবিঠাকুরের গান, পরে ‘শঙ্খবেলা’র গান। লতা আর মান্নার সেই চিরদিনের ডুয়েট। ‘কে প্রথম কাছে এসেছি/ কে প্রথম চেয়ে দেখেছি।’ তারিফে জমে উঠেছিল আড্ডা
। হারমোনিয়ামের বেলো বন্ধ করতে করতে অননুকরণীয় ভঙ্গিতে হাসতে হাসতে উত্তম বললেন, ‘‘পুলকমামা দারুণ লিখেছে গান। কিন্তু নিজেই সর্বনাশ করেছে। আমার গলার সঙ্গে মান্না দে’র গলা মিলবে না। গানটা ফ্লপ হবে। দোষ কিন্তু আমার নয়, পুলকমামার।’’
 সকলে তাকিয়ে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে। পুলকবাবু তখন কী বলবেন ভেবে পাননি। পরে স্মৃতিচারণে বলেছেন,-- ‘‘যেন কোনও খুনের বিচার হচ্ছে এমন অবস্থা। কালুদা এক ফাঁকে কানে কানে বললেন, যা খুশি বলুক, শুনবেন না। গান হিট করবেই।’’
সে গান যে আজও হিট, বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘শঙ্খবেলা’ মুক্তি পাওয়ার পরে উত্তমকুমারের ভুল ভেঙেছিল।  নিজে পুলকবাবুর কাছ থেকে মান্না দে’র বোম্বের বাড়ির ফোন নম্বর চেয়ে নিয়েছিলেন। নিজের ছবি ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’তে গাইয়েছিলেন। পুলকবাবুকে বলেছিলেন, ‘‘উনি বড্ড আড়িতে গান করেন। লিপ দিতে সুবিধা হয়!’’

তখনকার উঠতি গায়িকা হৈমন্তী শুক্লার ক্যারিয়ার প্রায় ধ্বংসের পথে   ধরলেন, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তিনি নিয়ে গেলেন মান্না দের কাছে,যেখানে তাঁর লেখা দুটি গান ছিল।  পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আর মান্না দে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে গান দুটি হৈমন্তীকে দিয়েছিলেন । ‘আমার বলার কিছু ছিল না’ এবং ‘ঠিকানা না রেখে ভালোই করেছ বন্ধু’, হৈমন্তী গাইলেন, সংগীতজীবন প্রাণ ফিরে পেল  ।
১৯৮৭ সালে অক্টোবর মাসে কিশোর কুমার মারা গেছেন। কুমার শানু তখন মুম্বাইয়ে। তাঁর গুরু ছিলেন কিশোর কুমার। 
কুমার শানু  মুম্বাইয়ে জায়গা করে নেওয়ার  জন্যে সংগ্রাম করছেন । গুরুকে স্মরণ করে কিছু একটা করতে চেয়ে গেলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তাঁর জন্য পুলক লিখলেন ‘অমর শিল্পী তুমি কিশোর কুমার, তোমায় জানাই প্রণাম’। কুমার শানুর সাথে সেই গান সুপারহিট হয়েছিল । 
তাঁর লেখা গানগুলো শুনে সহজে বলা যায়, গানগুলোর বিশেষত্ব হলো প্রাণোচ্ছ্বাস। যেকোনো ঘটনাকে তিনি সুন্দর ছন্দে ফেলে গানে রূপ দিতেন। তাঁর গান শুনে বোঝা যেত, কতটা সাবলীল দৃশ্য বা পরিস্থিতি অনুযায়ী গান লিখতেন তিনি। অন্যের সুরের ওপর ছন্দ ফেলে গান লেখায় তিনি ছিলেন দারুণ দক্ষ। চলচ্চিত্রের গানের জন্য এটা খুব দরকার। এ কারণে হঠাৎ গানের দরকার হলেই ডাক পড়ত পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের।

বিখ্যাত সেই রাত-পার্টির গানের দৃশ্যটি টেক করা হবে।
গানের মাঝে, শব্দে সাজানো মেলোড্রামা, ‘আমি হাসি/ শুধু হাসি।’ ওই জায়গায় মাউথপিস হাতে  নায়িকা মর্মান্তিকভাবে হেসে উঠবেন, পরক্ষণে তাঁর অর্কেস্ট্রার সুরের কোলাহলে কান্না মিশে যাবে । নচিকেতা ঘোষের সুরে, নায়িকার নিজের আগ্রহে করা হাসি-কান্নার জায়গাটার ডামি টেপ শুনে, আশা ভোঁসলে  দারুন গেয়েছিলেন। 
 হঠাৎ শ্যুটিং ফ্লোরে  ডাক পড়েছিল গীতিকারের। ফোন করেছিলেন  ছবির নায়িকা।
সুচিত্রা সেন। 
গীতিকার নিদিষ্ট  সময়ে ফ্লোরে হাজির ।
তাঁকে দেখেই ছুটে এলেন মহানায়িকা, পুলককে সঙ্গে নিয়ে নিজস্ব মেক-আপ রুমের দিকে দৌড়ে চললেন । রাগে  তাঁর চোখ-মুখ লাল। চোখের কোণ চিক চিক করছে,  শ্বাসের সঙ্গে জোরে জোরে  বুক ওঠা নামা করছে । 
গীতিকার সে দিনের সাজঘরের গোপন-কথায় লিখছেন, ‘‘দেখলাম স্বল্প-বসনা ম্যাডামের হুঁশই নেই নিজের পোশাক সম্পর্কে।... মিসেস সেন দড়াম করে মেক-আপ রুমের দরজাটি বন্ধ করে দিলেন। ভেতরে আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে দেখলাম অনন্য সুচিত্রা সেনকে।’’
আড়ালপ্রিয়া মহানায়িকা  হাঁফাতে হাঁফাতে গীতিকারকে সেদিন অভিমান উজাড় করে দিয়েছিলেন । বলেছিলেন, ‘‘জানেন ওঁরা খালি সেটের ছবি তুলছেন। কোথায় ক্লোজ শট? আপনি লিখেছেন, ‘চোখের এই জল শুধু চেয়োনা, একে যায় না কেনা।’ আমি আমার চোখের তারায় এই গানের হাসি আর কান্না একসঙ্গে নিখুঁত করে দেখাব বলে কত দিন সাধনা করেছি! আর তা দেখাবার কোনও স্কোপ নেই!’’
প্যাক-আপ করে স্টুডিয়ো ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন সুচিত্রা।
টলিপাড়া থেকে হাওড়ার সালকিয়া হাউস অবধি  পথ পুলকের মনে হয়েছে, সুচিত্রা সেনের ক্লোজ-আপের কথা। পর্দাজুড়ে সুচিত্রার ক্লোজ-আপে ধরা ঠোঁটের লিপস্টিক, কথাবলা চোখের ছলবলি, ফেরানো মরাল গ্রীবা বিভঙ্গ আর নিজের গানের কথা। তাঁর ছবিতেই ক্লোজ-আপ নেই! পরে অবশ্য সুচিত্রার কথা মতোই ক্লোজ শট ছিল দৃশ্যায়নে।
 স্মৃতি সবই স্মৃতি! 

রাসবিহারী থেকে গড়িয়াহাট যাবেন বলে অপেক্ষা করছেন পুলক।দেশপ্রিয় পার্ক কাঁপিয়ে মোটরসাইকেল  নিয়ে পান-মুখে  এক নামী গায়ক হুকুম করলেন, ‘‘উইঠা বসো!’’
‘‘আমি!’’
‘‘আইজকালকার মাইয়ারা চাপছে। তুমি পারবা না!’’
পুলক ভয়ে জুজু!
রীতিমতো ধমক খেয়ে ইষ্টনাম জপতে জপতে চেপে বসলেন  পিছনে। চোখ বন্ধ,  ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ!
গতি বাড়তেই জড়িয়ে ধরলেন চালককে।  গড়িয়াহাটে নামিয়ে দিতেই ধড়ে প্রাণ ফিরল।  চির অমলিন হাসি বিলিয়ে ততক্ষণে বাইকআরোহী চলে গেছেন পার্ক সার্কাসের দিকে। পুলক জানেন,  চালক জীবনবিমা অফিসে হয়ে যাবেন  রিহার্সালে! পুলককে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন দেবব্রত  বিশ্বাস। 

একটা আক্ষেপের কথা পুলকের ছিলো,  আত্মজীবনী ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’–এ লিখেছেন, ‘আমি আধুনিক গানই লিখতাম। আধুনিক গানই লিখছি, আর যত দিন বাঁচব, তত দিন এই আধুনিক গানই লিখে যাব। আমি কবি ছিলাম কি না, জানি না, তবে কৈশোর থেকে বুঝে নিয়েছিলাম, গান লেখা কবিতা লেখারই অঙ্গ। বর্তমান  কবিগন আমাদের গীতিকার আখ্যা দিয়েছেন। যার ফলে আমরা গীতিকার হয়ে গেছি, কবি হতে পারিনি।’
তাঁর এমন  চলে যাওয়া কেউ বিশ্বাস করতে পারেননি।  ঘটনার দুই দিন আগে  লিখেছিলেন, ‘আমাকে একটু জায়গা দাও মায়ের মন্দিরে বসি’   বা -‘যখন এমন হয়, জীবনটা মনে হয় ব্যর্থ আবর্জনা/ ভাবি গঙ্গায় ঝাঁপ দি, রেলের লাইনে মাথা রাখি’। 

পুলক চলে যাওয়ার পর শোকে কাতর হয়ে পড়েন মান্না দে,-  ‘‘পুলকের মতো জীবনরসিক লোক আত্মহত্যা করবে এটা আমার জীবনের সবচেয়ে অকল্পনীয় অনুভূতিগুলোর মধ্যে একটা। এখন শুধু মনে হচ্ছে, বন্ধু, এত বড় ফাঁকি দিলে- আমার সঙ্গে ভাগ করে নিলে না তোমার যন্ত্রণা!.
‘ওই তো লিখেছিল, ‘ভাবি গঙ্গায় ঝাঁপ দিই’, তখন কি জানতাম- এটাই ছিল পুলকবাবুর মনের আসল কথা? ...ভবিতব্যকে পালটাতে পারতাম না জানি, তবু বলতাম, অন্তত এটুকু বলে যান কেন এ-রকম দুঃখের ভার বয়ে বেড়িয়েছেন আপনি দিনের পর দিন? কী ছিল আপনার দুঃখ?’’



তথ্যঋণ: --
১. ‘কথায় কথায় রাত হয়ে যায়’, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়,
২. ‘আনন্দধারা’, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, 
৩.  ‘জীবনের জলসাঘরে’, মান্না দে,
৪.  ‘মুখোমুখি মান্না দে’, অতনু চক্রবর্তী, 
৫. আনন্দলোক 
৬. পশ্চিমবঙ্গ বাংলা সঙ্গীত সংখ্যা
৭. কেন নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন পুলক--মাসুম অপু
৮. সুরের ওপর গান লেখার আশ্চর্য গুণ--আবীর মুখোপাধ্যায়
(২০ অগস্ট ২০১৭)
৯.  তুমি সুর আমি কথা:পুজোর গানের অবিস্মরণীয় জুটি মান্না দে-পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়-সপ্তর্ষি ঘটক
১০.  কথা দাও আবার আসবে- আবীর মুখোপাধ্যায় (আনন্দবাজার পত্রিকা)



মনের ভাষা ও ভাস্কর্য 
অর্ণব সামন্ত 

ও মন কখন শুরু কখন যে শেষ কে জানে। এ যেন কিছু জিনিস স্প্রিংয়ের মতন একদিকে গুটিয়ে অন্যদিকে কিছু জিনিস খুলে খুলে যাচ্ছে। বিগত সময় আগত সময়ের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে ও মন তুমি ভাবছ ? জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে বিবাদের মতো মন দ্রোহে বিদ্রোহে বিপ্লবের পথে হাঁটছে তো হাঁটছে ।শেষ যেন হয় না এই পথ পরিক্রমা । ইচ্ছেটাই তো কাল দাঁড়াল। নিরাকার নির্বিকার এক মন যদিও তখন সে মনহীন অবস্থায় ছিল বাদ সাধল বহু হতে গিয়ে। প্রকোষ্ঠে প্রকোষ্ঠে জমল কত সহস্র রঙ রূপ রস ও বাহার। তো এ বলে তো আমায় দ্যাখ , ও বলে তো আমায় দ্যাখ। সসেমিরা হয়ে যখন মাথা ঘুরঘুর বুক দুরদুর তখন একটি সাধু অবয়ব ধ্যানে বসে গেল। বলে উঠল , তরঙ্গ থামাও থামাও হে। ডুবুরি ডুবুরি হও সাগর সেঁচে মুক্তো তুলে আনো । তোমারই নাচদুয়ারে মণিমানিক্য গচ্ছিত তুমি তা' বাইরে খুঁজে বেড়াচ্ছ হে কস্তুরী মৃগের মতন। কি লজ্জা কি পরমাদ। নিজের ঘরই তুই চিনলি না হে উদাসী ? কি করে পারিস তুই ছলাৎছলে দিন কাটিয়ে দিতে ? ক্লীবতা হীনতা দীনতা হীনমন্যতা তোমার অন্ততঃ শোভা পায় সিংহ বিক্রম। স্বচ্ছ স্থির পুষ্করের আরশিতে দ্যাখো নি কি নিজেকে ? আরশিনগরের পড়শিকে চেনোনি কি সে কে তোমার হয় ? কি সম্পর্ক কি পরম্পরা ? নাকি নিজের স্বরূপ স্বরূপ তুমি সব ভুলে গ্যাছো ? ছিলে কি একদা সরল জলের মতো একা নির্ভুল নিষ্পাপ। সোরা সাইকোসিস সিফিলিস তোমার গায়ে জামা জামা হয়ে বসে গেল। তুমি পেলে না স্বাভাবিকতা সরলতা সহজতার হাওয়া। দাঁড়ালে না একা একা ভীষণ একা একা নিজেকে বুঝে নিতে যুঝে নিতে বিশালের মাঝখানে। নিজের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রকে জুড়ে দিতে বিশালে , আবহমানের স্রোতে । দ্যাখো ভায়া সংকোচনই মৃত্যু প্রসারণই জীবন। কুন্ডলীকৃত শক্তিকে মেলে দাও অব্যক্ত অনির্বচনীয় উল্লাস ডানায়। মুক্তিবেগে ছুটে যাক তা' আকাশ থেকে অন্য আকাশে , মাধ্যাকর্ষণের সীমা ছাড়িয়ে গ্যালাক্সিতে ব্ল্যাকহোলে। সেখান থেকে সুকঠিন প্রসবে নামুক প্যারালালি । খুঁজে নিক নিজের আসল নীড়।অণু পরমাণুতে ভাঙতে ভাঙতে তার মধ্যে খেলা করুক আগ্নেয়গিরি নীহারিকা আলো আলো আলো। সমস্ত অন্ধকার লজ্জা পেয়ে বিন্দু হয়ে যাক। আলোর নটরাজ নৃত্য শুরু হোক শুরু । ভাবো হে নিজেকে নিত্য শাশ্বত বুদ্ধ। হদয়ে থাকুক এক ব্রক্ষ্মান্ড ভালোবাসা । পারলে বাকি তিন পাদে ভালোবাসা। কেন্দ্রে থাকুক অখন্ড জ্ঞান। যে না থাকলে ভালোবাসাকে দেখবে কে । তার চোখ ফোটাবেই বা কে ? বড়ো কঠিন জটিল সময় হে এখন । অভিমন্যুর চেয়েও বড়ো হয়ে তবেই বেরুতে হবে । নিষ্ক্রমণ , মহানিষ্ক্রমণ। অনেক সময় এড়িয়ে যেতে হবে। অনেক সময় তীব্র মুখোমুখি হতে হবে। অগ্নি বাণের বিরুদ্ধে বরুণ বাণ ছুঁড়তে হবে। দীপ্তি হতে হবে সূর্যকিরণের মতো তেজী চন্দ্রকিরণের মতো স্নিগ্ধ।অভয়ের ঘরে ঠাঁই নিতে হলে কুয়োর ব্যাঙের মতো ঘরকুনো হলে চলবে না। অভিযানে অভিসারে যেতে হবে দুর্গম থেকে দুর্গমতর পথে। তুলোর গদিতে শুয়ে কেউ কবে মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণ করেছে। নিজেকে মেলে দিয়ে বিশালে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ো নিজেকে। বিশ্লেষণে এসো সমালোচনায় এসো প্রাণের হিল্লোলে এসো জয়ের উল্লাসে এসো। পেছনের ছায়াকে দেখো না মায়াকে দেখো না শুধু সমুখের পথ দ্যাখো। অবসাদে ক্লান্তিতে মুহ্যমান হলে পেছনের পথ দেখো নিজেকে নিজে বলো , আমি একাই পেরেছি এতটা পথ আসতে তাহলে আমিই পারব সমুখের পথে মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতে। এক ঘুম থেকে অন্য ঘুমে পড়ার আগে পর্যন্ত। শুধু কনসেন্ট্রেট করো সমস্ত শক্তিকিরণকে উত্তল লেন্সের মতো এক বিন্দুতে সংহত করতে , সংযম করতে । তাহলেই হবে সমস্ত সাফল্য। মনের ত্রাটক সিদ্ধিতে সমস্ত জগৎ হয়ে যাবে পুতুলের মতো। হৃদয় প্রিজমে আপতিত আলো যত রকমের রঙের রশ্মি হয়ে ফুটে উঠবে। সময়ে তা' একত্র হয়ে সাদা জ্যোতি হয়ে উঠবে। ফ্রয়েড মাথা চাড়া দেবে , পাভলভ রিফ্লেক্স অ্যাকশন করবে , ডারউইন শেখাবে যোগ্যতমের উদবর্তনের কথা। বিবর্তনে বিবর্তনে ছুটবে মননদীর স্রোত। পরিবর্তন যেখানে জীবনের একান্ত প্রতীকী। অভিজ্ঞতার পাতা পড়তে পড়তে তার চঞ্চলতা দূর হবে স্থির প্রত্যয়ে অনুভবে। যুক্তি তর্ক বিতর্কের উপস্থাপনা ঘুচে গিয়ে আসবে অথই জ্ঞান অদ্বিতীয় চেতনা। হাজার হাজার প্রতিফলনে হাজার হাজার মন ধরা এককের মনে এক পরামনে। এ যেন পথ চলতে চলতে নিজের সঙ্গে দ্যাখা। ওরে ভ্রমর সেই মনের মধ্যিখানে আস্ত জগৎবাড়ি । বাহির ভিতর এক হয়ে সেই ক্ষণে। সমস্ত মন লুকায় যখন এক মনে। সেই প্রভুত্ব করে তখন সবখানে। রাগে ক্ষোভে শান্তিতে মানে অভিমানে। সেই মনই তো দাপিয়ে বেড়ায়। অবাধভাবে অবাধ্য হয় মন জানে । কোয়ান্টামের স্তরে স্তরে কত যে তার রঙ ঢঙ সুর রূপ রস বাহার লাবণ্য। সত্যি জীবন যেন জীবন অধিক সেই জন্য। এক মনেতে পরিস্ফুট হাজার মন। এক জীবনে উপভোগ লক্ষ জীবন। সাজাও মন সাজাও মন চৌম্বকীয় মনের অনুগমনে। তাহলে আর কি থাকে অধরা এই ভুবনে। খেদ করে কেউ বলে না জীবন এত ছোট ক্যানে। ভালোবাসিবার মতো ভালোবাসিতে জানলে মিটে যায় সমস্ত সাধ। সাধ্যের করতলে আসে সাধ্যাতীত। মনের নাগালে আসে মনাতীত। মন হয়ে সরল স্বচ্ছ জলের মতো। মন হয়ে চিরস্থির এক আরশি। তাই বলি পাগলা মনটারে তুই বাঁধ। পাগলা অশ্বের মতন ওকে খানিক ছুটতে দে ছুটতে দে। একসময় সে স্থির শান্ত বসবে তোর পায়ের কাছে। সে হবে তোর চিরন্তন ভৃত্য ভালোবেসে ভীষণ ভীষণ ভালোবেসে। তারপরে সে নিজেই প্রভু নিজেই ভৃত্য। নিজেই রাজা আমির নিজেই প্রজা বান্দা। 

মন যেন সালভাদোর দালির মিরর রিফ্লেকশন বা ইমেজের উপরে নির্ভর করে আঁকা ছবির মতো । যেখানে মিরর হাউসে অনেক মিরর যত্রতত্র সেটিং করা আছে। তার যে কোনো এক জায়গায় একটি মানুষ দাঁড়ালে সমস্ত মিররে সেই মানুষের ছবি দেখা যাবে তবে ভিন্নধরনের প্রতিবিম্ব নিয়ে। এ যেন খন্ড খন্ড মন খন্ড খন্ড আমির ভেতর দিয়ে আসল বা পূর্ণ মন , আসল বা পূর্ণ আমির অনুসন্ধান আবিষ্কার করা । আংশিক আংশিক দর্শনের পর পুরোপুরি নিজেকে দেখা । সামগ্রিক দর্শন । যে মন দাঁড়ায় আরশিনগরের আরশির সামনে। আসল মনের খবর কে রাখে । 
ময়ূর মন যথা সময়ে যথাস্থানে নেচে ওঠে উল্লাসে।
হাজার রকমের রঙ রূপ রস বাহারে সে ফেটে পড়ে বিস্ফোরণে। মনের একপ্রান্তে মনের কিছু অংশ আলাদা করে তাকে প্রত্যক্ষদর্শী করে সরেজমিনে মনের বাকি অংশের কীর্তিকলাপ দ্যাখা আর মজা উপভোগ করা। যেন নীলাকাশ মন তার দৃষ্টিতে দেখছে বিভিন্ন রঙের মেঘমনগুলোর ভেসে যাওয়া । আর ভীষণভাবে তা' উপভোগ করছে সেই নীলাকাশ মন । এ যেন নুনের পুতুল হয়ে সমুদ্রকে বিচার বিশ্লেষণ করতে যাওয়া। পদ্মপাতায় টলমল জলবিন্দুর পুষ্করিনীকে পোস্টমর্টেম করতে যাওয়া। পরিধিতে প্রান্তিকে দাঁড়িয়ে গোটা বৃত্তের গতি প্রকৃতিকে বুঝতে যাওয়া । ভীষণ সোজা মনে হলেও ব্যাপারটা ভীষণ কঠিন।
মন তো প্রতিফলনপ্রিয়। যা দ্যাখে তাই ভাবে নিজেকে। ভাবতে ভাবতে প্রকৃত স্বরূপ বিস্মৃত হয়। অশান্ত অস্থির তরঙ্গঘন মনে সত্তার প্রতিবিম্ব পড়বে কিভাবে ? অহংকার বা ইড মনের প্রসারণ , পূর্ণবিকাশের প্রধান অন্তরায়। অতীতকে জাপটে ধরে থাকলেই তবেই না অহংকার মাথা চাড়া দেয়।তখন সে কুয়োকে মনে করে সমুদ্র। আবার জিরো ইড হলে মানুষ বাঁচতে পারে না। কোনো কাজই করতে পারে না। একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়তা এখানে কাজ করে। সবচেয়ে নিরাপদ অথচ মুক্তিপ্রবণ উপায় হল অহংকারকে রাখো কিন্তু তাকে স্থবির কঠিন করে রেখো না। রিজিডিটির পরিবর্তে তার মধ্যে মোবিলিটি আনো। অহংকারকে চূর্ণবিচূর্ণ করে করে ফ্যালো জলের মতো সরল স্বচ্ছ গতিশীল। যে কোন পাত্রে যে কোন আধারে তাকে রাখা যায় আর সে তখন সেই রূপ ধারণ করে। এটা শুনতে কিঞ্চিৎ সুবিধাবাদী সুযোগবাদী মনে হলেও ব্যাপারটা তা' কিন্তু নয়। আসলে অভিযোজিত হওয়া বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে। তাতেই বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সে চলে যায় বিবর্তনের পথে। সে চলে যায় সমস্ত কিছু বাধা বিপত্তি ওভারকাম করে জয়ের পথে সাফল্যের পথে। আর একটি ঝামেলার ব্যাপার আছে লিবিডো বা কামনা বাসনা। কামনা সঞ্জায়তে কামনাম্। একটি কামনা থেকে হাজার হাজার কামনা বাসনার জন্ম হয়। যেহেতু কামনা বাসনা থেকে আমাদের শরীরের জন্ম , মনের জন্ম। সুতরাং সেই শরীরে মনে কামনা বাসনা থাকবে এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু তা' মাত্রাছাড়া হলেই বিপত্তি। জীবন অবাধ অবাধ্য হলেও সে বাঁধা থাকে যখন একটি মাত্রার মধ্যে তখন কামনা বাসনা একটি মাত্রাবৃত্তের মধ্যে থাকা সমীচীন। তাই বলে প্রাণের স্ফুর্তিতে মাঝেমধ্যে লাগামছাড়া হবে সেটাই স্বাভাবিক। মনের প্রকৃতিই হল মাঝেমধ্যে যত্রতত্র উড়াল দিয়ে আবার চেনা জীবন যাপনের ছন্দে রুটিনে ঢুকে পড়া। তাতেই সে নিরাপদ সুরক্ষিত অনুভব করে। ল অফ অ্যাসোসিয়েশন - এ অনেক জটিল জড়িঘন্টি ব্যাপার উঠে আসতে পারে কিন্তু নিজেকে সচেতন হয়ে লজিক ঠিক রেখে সেইসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। মনকে করে দিতে হবে স্থির পুষ্করের মতো , যাতে সে নিজের মুখ নিজেই পরিষ্কারভাবে দেখতে পায়। মনের ইন সাইড আউট করে দেখতে হবে। মনকে করতে হবে সমুদ্রের মতো , যাতে জিজ্ঞাসার বুদ্বুদ ফেনা তৎক্ষণাৎ সেখানে সমাধিত হয় । ভাবনায় ভালো কিছু দিয়ে মন্দ কিছুকে প্রতিহত , ধ্বংস করে দিতে হবে। নিজের মনকে রাখতে হবে নির্ভার নির্বিকার নির্ভেজাল। যেমন পায়ে কাঁটা ফুটলে অন্য একটি কাঁটা দিয়ে তা' তুলে দু'টোই ফেলে দিয়ে বিন্দাস জীবন কাটাতে হয়। 
মনের পাতায় মনকে রেখে মন দ্যাখা। যে দ্যাখে সে জানে। কত কঠিন কত জটিল। তবু এ ছাড়া তো আর উপায় নেই। আংশিক আংশিক দর্শনের পর পুরোপুরি সমগ্র সমস্ত মনকে দর্শন করা। মনই ম্লেচ্ছ কুৎসিততম। আবার মনই সুন্দরতম। মন পাগলা হাতি হয়ে গেলে যেমন সমস্ত যাবে সর্বনাশে তেমন শান্ত স্থির হলে জগতের কোনো কিছু তার অধরা থাকবে না। তখন সে শুভ সাফল্য জয়ের প্রতীক।
ওরে মন তুই আমায় ডুবাইলি রে ভাসাইলি রে । অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে। গহীনগহন সে অথইয়ে হারিয়েও মজার অন্ত নেই। তাই তোকে আমি সব জাগয়ায় সর্বক্ষণ চাই। মন যেন আগুনের মতো সঠিক ব্যবহারে অনেক অনেক কাজে সাফল্য জয়। নাহলে ব্যবহার ঠিকঠাক না জানলে মুহূর্তেই পুড়ে ছারখার। কারণ মনই মানুষের পরম বন্ধু , আবার মনই মানুষের চরম শত্রু। তাই মন চল নিজ নিকেতনে। জগতের সমস্ত মূল্যবান মণিমাণিক্য তোমার মধ্যে আছে মন। তুমি পরের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়াচ্ছো । একবার মন ভরে মনভুলানিয়া মনকে দ্যাখো আর মগ্ন মুগ্ধ হয়ে যাও। মনের মধ্যে খুলে যাক সপ্ত নয় সপ্ত কোটি ভুবন। মনের সেই জ্যোতিতে প্লাবিত হয়ে যাক জগতের সমস্ত কিছু। বিরাট বিশালের ব্যাপ্তি পেয়ে সেই প্রতিভাত উজ্বলিত করুক জীবন যাপন। মনের তো শুরু নেই শেষ নেই। অনাদি অনন্তের মতো শুধু নিরবধি। আবহমান চেতনার স্রোত নিয়ে সে স্রোতস্বিনী।মনের অবাধ অবাধ্য নীরব চলায় বহির্জগতের প্যারালাল - এ মনে ফুটে ওঠে অন্তর্জগৎ। হে মানব তোমার মন নাই , মন নাই কেন ? তোমার মন চাই দুরন্ত প্রবল মন চাই। মনের স্রোতের তোড়ে ভেসে যাক সমস্ত জগৎ। ভাবজগৎ টইটম্বুর হলে আর কি চাই ! মনের সুখে মন বুঁদ থাকুক মগ্নতায় মুগ্ধতায়। জগতের সুখ শান্তি তখন তো তার করায়ত্ত ! ওরে মন তুই থাক না নিজের মেজাজে মর্জিতে নিজের মতন।
আয় মন মুখোমুখি একবার নয়ন ভরিয়া তোকে দেখি । সেজানের সাত স্তরে রঙ লাগিয়ে তোকে দেখি। রেমব্রান্টের আলো আঁধারির রঙে তোকে আবিষ্কার করি। আবিষ্কারে আবিষ্কারে উঠে আসুক চেতন অবচেতন অচেতন মনের কারুকার্য ভাস্কর্য কারুভাষা। কোলাজে মন্তাজে ফুটুক মনের নিজস্ব ভাষা। মনের সংকোচনই মৃত্যু , মনের প্রসারণেই জীবন। মনের ইচ্ছাশক্তিতেই জীবন যাপন , জগতের সমস্ত কিছু ঘূর্ণায়মান। কখন মন গেয়ে বন্দিশ ভৈরবীতে , কখনো দরবারি কানাড়ায় , কখনো ইমনকল্যাণে। মন কখনও পাহাড় পর্বত চূড়ায় জমা বরফ , কখনও স্রোতস্বিনী হ্রদ পুষ্করিনী সমুদ্রের জল , কখনও জলীয় বাষ্প আকাশে মেঘ আকারে , কখনও পতনশীল বৃষ্টি আকারে উপস্থিত ও দৃশ্যমান । পরিস্থিতিগত আকারগত আয়তনগতভাবে আলাদা আলাদা হলেও মূলগতভাবে তারা এক। যত মন তত পথ তত মুক্তি। এই জগৎ রহস্যের মতো মনের রহস্যও অবোধ্য , অধরা। স্থির মন যদি অস্থির মনকে শান্ত করতে পারে তবেই তার আরশিনগরের আরশিতে ফুটে ওঠে স্বরূপের প্রতিবিম্ব। প্রেমের মোড়কে প্রজ্ঞা এসে হাজির হয় তখন মনের আঙিনায়। মন ছুটে যায় মুক্তিবেগে পেছনে ফেলে সমস্ত পিছুটান সংস্কার আকর্ষণ মায়া মোহ । মন হয়ে যায় বিন্দাস নির্ভার নির্বিকার। তখন মনকে আর পায় কে ! সে তখন আলোঘনবিগ্রহ , থরে থরে সাজানো রাশি রাশি আলো আলো আলো আলো !




উৎসব কি ক্রমশ উৎ-শবের দিকে
মানিক পন্ডিত

 উৎসব কি-

       কোন অনুষ্ঠান যদি সে প্রাঙ্গনের সকলের মনে সুখ প্রসব করতে সক্ষম হয় তবে সে আয়োজনকে উৎসব বলা হবে। একজনও যদি সেই প্রাঙ্গনে ম্লানমুখে থাকে বা থাকতে বাধ্য হয়,কষ্ট পেয়ে ফিরে আসে তবে সে অনুষ্ঠান উৎসব হয়ে উঠতে পারে না। আমাদের দেশ ভারত বৈচিত্র্যময়, তা সে ভাষা সংস্কৃতি উৎসব যে ধরণের কোণ থেকে দেখা হোক। সম্প্রদায়গত বিভাজনে গরিষ্ঠতার দিক থেকে হিন্দু এবং মুসলমান এবং পরে পরে অন্যান্যরা রয়েছেন। কিন্তু ধর্ম ও সম্প্রদায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে বড় রকমের উৎসব বললে একদিকে দুর্গাপূজা অন্যদিকে ঈদ পাচ্ছি।
    একটাই সমাজের ভিতরে পাশাপাশি বসবাস সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দু আর মুসলমান। এখানে থাকে পরস্পরের ধর্মীয় এবং আচরণগত একটা দিক আর একে কেন্দ্র করেই উৎসব কিন্তু অনুভব আর সম্মিলিত প্রার্থনা মিলন এ গুণগত ফারাক বিস্তর। এসব দার্শনিক উপলব্ধি দিয়ে এবং বাস্তব বোধ দিয়ে বুঝতে পারলে নিজের আর যে সমাজটার ভেতর বাস করে আছি সেখান থেকে অনেক ভুল বোঝাবুঝি চির বিদায় নেবে।
 ধর্ম-ধর্মাচরণ
    ধর্ম শব্দের অর্থ বহুবিধ। তবু সংক্ষেপে ধর্ম বললে বুঝব মানব জীবনে সামাজিক সাংস্কৃতিক নৈতিক আধ্যাত্মিক উপাদানগুলোর একটি সমন্বিত ধারণা যা ব্যক্তির বিশ্বাস আচরণ কর্তব্য ও জীবনদর্শনকে নির্দেশ করে। ধর্ম আচরণ বলতে বুঝব এই বিশ্বাস আর নীতির ভিত্তিতে ব্যক্তির প্রতিদিনের অনুশীলন কর্তব্যপালন আচার-অনুষ্ঠান নৈতিকতা এবং সমাজকল্যাণমূলক কাজ।
    ভারতীয় দর্শনে ধর্ম মানে আইন নিয়ম শৃঙ্খলা কর্তব্য আচরণ ও গুণাবলি যা মহাজাগতিক ও প্রাকৃতিক নিয়মে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অন্যদৃষ্টিতে ধর্ম হল কোনকিছু ধারণ করার বৈশিষ্ট্য বা স্বরূপ,যেমন আগুনের দাহ্য শক্তি,পানির ধর্ম তার সমোচ্চশীলতা,তাই স্রোত হয়,উপরিতল সমান হলে স্রোত আর থাকেনা। অন্যদিকে ধর্ম আচরণ শুধু আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি না,মানুষের সততা নিষ্ঠা ও আত্মিক উন্নতির চর্চা। ব্যক্তিগত ও সামাজিক ক্ষেত্রেও ধর্ম আচরণ বলতে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান উপাসনা প্রার্থনা পবিত্রতা রক্ষা সততা পরপোকারী কাজকর্ম এবং অনৈতিক কর্ম থেকে বিরত থাকা।

পূজা-উৎসব-উপাসনা-

  ঈদ এবং দুর্গাপূজার  উপাসনা ও ধর্মীয় অনুশাসনের পার্থক্য বেশ স্পষ্ট এবং তাদের মূল বৈশিষ্ট্য দুই ধর্মের ভাবনার আলাদা ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত। ঈদ ইসলাম ধর্মের,দুর্গাপূজা হিন্দু ধর্মের পীঠস্থানীয় উৎসব। ভারতে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতর উৎসব পালনের লক্ষ্যে মাটি দিয়ে মূর্তি গড়া এবং সেই মূর্তির পূজো করার পর তাকে পানিতে ফেলে দেওয়া বা বিসর্জন দেওয়া আবহমান কাল ধরে চলে আসছে। এই ফেলে দেওয়া বা বিসর্জনও উৎসবের অংশ হিসেবে পালন হয়। প্রশ্ন ওঠে শুধু আবাহন থাকলেই তো হোতো,বিসর্জনের মন খারাপের আবাহন কেন! বিপরীতে মুসলমান সম্প্রদায়ের উৎসবের কথা ভেবে দেখলে ওখানে কেবল আবাহন আছে, নেই কোন ধরণের মূর্তি পূজা,আর পানিতে তাকে ফেলে দেওয়া বা বিসর্জন।
      ঈদ : এখানে প্রতিমা বা বাহ্যিক চিত্রায়ণ নেই,কিন্তু সরলতা ও নিঃস্বার্থতার ধর্মীয় মানসিকতা গুরুত্বপূর্ণ। প্রধানত নামাজ ও দোয়ার মধ্যদিয়ে উদ্ যাপিত হয়। ব্যক্তিগত আত্মশুদ্ধি সংযম ক্ষমা ও সামাজিক সমতা সূচিত হয়। দান (যাকাত বা ফিতরা) ও ভ্রাতৃত্ববোধ এই ভক্তি-ভাবনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সামাজিক এবং চেতনার অভিব্যক্তির বিবেচনায় ঈদ উৎসবকে দেখলে এখানে মুসলমান সম্প্রদায়ের একত্রিত হয়ে সামাজিক বন্ধন,ক্ষমাশীলতা এবং মানবতার প্রতি ভক্তি প্রকাশই প্রধান। মূর্তি নিয়ে মাতামাতির মতো কোলাহল নেই,নিরাকার পাথর-পাষাণের বিমূর্ত অনুভব। আকাশের দিকে তাকিয়ে কেবল প্রার্থনা,সে প্রার্থনায় থাকে আত্মশুদ্ধির জন্যে অনুশাসন,থাকে শান্তির জন্যেও মুনাযাত (আরবি দু’আ এর প্রতিশব্দ হিসেবে বাংলা ভাষার শব্দবন্ধ)। এ সম্প্রদায়ে সকলেই ব্রাহ্মণ হয়ে উঠতে পারে,এখানে নেই বাহ্মণ্যবাদ।
        উপাসনা : ঈদের মূল উপাসনা নামাজ। ইদগাহে বা মসজিদে সম্মিলিতভাবে ঈদ-উল-ফিতর বা ঈদ-উল-আজহা’র বিশেষ সালাত অনুষ্ঠিত হয়। নামাজ শেষে কোলাকুলি,ঘরে ঘরে ভ্রাতৃত্বের প্রকাশ এবং আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়।
    অনুশাসন : ঈদের আগে রমজান মাসে অনবরত রোজা পালন,এটি আত্মসংযমের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঈদের দিনে ফিতরা বা জাকাত দান করা বাধ্যতামূলক- এ হল সমাজের দরিদ্র্যের প্রতি সহানুভুতির প্রকাশ। সম্মিলিত আনন্দ খাওয়া দাওয়া নতুন জামাকাপড় পারস্পরিক ক্ষমাসুন্দর মনোভাব ঈদের অনুশাসনের অন্যতম অঙ্গ।
    দুর্গাপূজা : দেবী দুর্গার শক্তিকে কেন্দ্রে রেখে তার সন্তান-সন্ততিসহ প্রতিমা স্থাপন,মন্ত্রোচ্চারণ, অঞ্জলি এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির সমাবেশ ঘটে। ব্যক্তি এবং সমাজের দুর্বলতা-অশুভ শক্তিকে নিবৃত্ত করার উদ্দেশ্যে পূজনীয় দেবী ভক্তির পাশাপাশি শক্তি ঐক্য এবং পরিবেশের প্রতি শ্রদ্ধাবোধে উদ্ যাপন। পূজা-অর্চনার নান্দনিকতা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য দলবদ্ধ ভক্তির উচ্ছ্বাস এখানে প্রধান বিষয়। এখানে ভক্তি শুধুমাত্র ধর্মীয় বিষয় নয়-এটি সামাজিক ও সংস্কৃতির বৃহত্তর মিলনক্ষেত্র হয়ে ওঠে যেখানে ভ্রাতৃত্ব বোধ এবং জীবনের ইতিবাচক শক্তিরও উদ্ যাপন হয়।
      উপাসনা-অনুশাসন : পারিবারিক পূজা দূর্গাদালানে,বারোয়ারি দুর্গাপূজা শুরু প্যান্ডেলে। দেবী দুর্গার প্রতিমা স্থাপন ও পাঁচ দিন ধরে (ষষ্ঠী থেকে দশমী) ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির পৌরহিত্যে মন্ত্রোচ্চারণ,আয়োজক এবং সংশ্লিষ্টদের অঞ্জলি প্রদান, আরতি, কুমারী পূজা, বিশেষ পূজার আয়োজন এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি উপাসনারই অঙ্গ। মহালয়ার ভোরে মন্ত্রপাঠ, ব্রতপালন ষষ্ঠী- সপ্তমী- অষ্টমীতে নিরামিষ খাদ্যগ্রহণ উৎসবে নতুন পোশাক পরিধান ইত্যাদি। শুভ্রতা পরিচ্ছন্নতা শৃঙ্খলা নিরাপত্তা, প্রসাদ বিতরণ ইত্যাদি অনুশাসনেরই অঙ্গ।
কালের পরিবর্তনে উৎসব
    সময়ের গতি রেখে যাচ্ছে শুধুই পরিবর্তন,টিকে থাকছে কেবল স্থান-কাল-পাত্রের সম্পর্কের নিরবচ্ছিন্নতাটুকু। প্রকৃতি এবং রাষ্ট্রের পরিবর্তনের সঙ্গে সামাজিক ও নাগরিক জীবনে পরিবর্তন অনিবার্য। এই অনিবার্যতায় সংস্কৃতি পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অনুভবেরও পরিবর্তন ঘটে চলেছে। তবু উৎসবের সংস্কৃতির ভিতর আমাদের ভাবজগত জুড়ে রয়েছে ধর্মীয় আবেগের ঘনঘটা এবং সংগীতের সমাহার।
      কালের পরিবর্তনে হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব পালনের আবহে বিশেষত বারোয়ারি পুজো আয়োজনে ভাব-ভক্তি ক্রমশ বিদায় হয়ে টিকে যাচ্ছে শুধুই বিনোদন। আর এই বিনোদনের প্রকৃতি উৎসবের দেখনদারি বাহুল্যের জন্য চাঁদা আদায়ের জলুম ইত্যাদি হাঁটছে হাত ধরাধরি। বাইরের আভরণে আধুনিকতা আর ভোগবিলাসের যেসব গ্লোবাল টাচ্ তা পূর্বেকার পূজোর যেকোনো রকমের অভিজ্ঞতাকে নেতিবচক আবরণে ঢেকে দিচ্ছে। মেলা খেলা সাংস্কৃতিক আয়োজন এবং খাদ্যর অভ্যাসে পর্যন্ত নিত্যদিনের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
উৎসব কি  উৎ-শবের দিকে 
          হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম উৎসব দুর্গাপূজা,অন্যদিকে মুসলমান সম্প্রদায়ের ঈদ। ভক্তি ভাবনার আচার-আচরণগত প্রশ্নে ফারাক বিস্তর। ঈদ উৎসবের আয়োজনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগেনি,কিছু গোঁড়ামী অন্ধবিশ্বাস সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মীয় আচরণ মিলিত প্রার্থনা ইত্যাদিকে তা গ্রাস করেনি। এখানে মূল উৎসব সবটাই বারোয়ারির আঙ্গিকে,নেই চাঁদার জুলুম। তবু ধর্ম আচরণ এবং উৎসব হারিয়ে ফেলতে উদ্যত উৎসবের আসল চেহারা। আশঙ্কা হয় উৎসব কি ক্রমশ উৎ-শবে পরিণত হয়ে পড়ছে! হাঁ-ধর্মীয় অন্ধত্ব আর গোঁড়ামীর কারণে উৎসব হিন্দু বা মুসলমান দুটি সম্প্রদায়ের ভিতর উৎসব পরিবর্তিত হয়ে পড়ছে উৎ-শবে।
          উৎসবের  উচ্ছ্বাসের পরিবর্তে অন্ধ ধর্মীয় গোঁড়মি আর গুজবের জেরে হাড় হিমকরা সব দাঙ্গা আর অকারণ মৃত্যুর ইতিহাস ভাসছে চোখের সামনে। স্মরণ করুন,আগস্ট ১৯৮০ ঈদের দিন উৎসব প্রাঙ্গনে একটি শুয়োরের ঢুকে পড়া এবং একে কেন্দ্র করে ঘটে গেল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ভাংচুর অগ্নি সংযোগ এবং প্রাণ গেল ৮০ জনের। উৎসব তখন উৎ-শবের চেহারায়।
          ২০১৬ উত্তর প্রদেশে, ঈদের সময়ে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ এবং- ৪ জনের মৃত্যু। ইতিহাসের ভাষ্যে পাওয়া যাচ্ছে ২০১৬ কাশ্মীরে, ২০২২ রাজস্থানের যোধপুর ঈদ উৎসবে পতাকা টাঙানো নিয়ে অশান্তি শেষমেশ সংঘর্ষ। ওই সালেই উত্তর প্রদেশে দুর্গাপূজার প্যান্ডলে আগুন,দগ্ধ হয়ে ১৭ জনের জীবন্ত মৃত্যু,৭৫ জনের আহত হওয়া। উৎসবের প্রাঙ্গনে আনন্দ কুড়োতে এসে  উৎ-শবের লাশে পরিণত হওয়া।  
          ২০২৪ এ  উত্তর ত্রিপুরায় চাঁদা সংগ্রহ নিয়ে সংঘর্ষ এবং ১ জনের মৃত্যু আহত ১৭ জন। কাশ্মীরে ঈদের সময় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ ২ জন যুবকের মৃত্যু। ১৩-১৯ অক্টোবর ২০২১ বাংলাদেশে কোরআন অবমাননার দায়ে মন্ডপে হামলা, মৃত ৮ আহত প্রায় ১৫০। ওই সালেই ওই দেশে কুমিল্লা হাজিগঞ্জ,নোয়াখালিতে মন্দির ভাঙচুর ৫ জনের মৃত্যু।

এ বাংলায় কেমন-

          পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজা বা ঈদকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বেশ কয়েকটি বড় অশান্তির ঘটনা ঘটেছে,যার মধ্যে কিছু ঘটনায় উত্তেজনা বা সহিংসতার মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১০ এ দেগঙ্গায় দাঙ্গা, ২০১৬য় ধূলাগড়ে সংঘর্ষ ঈদ এবং দুর্গাপূজার উৎসব ঘিরেই হয়েছে।
      ২০২৪ সালে হাওড়ার শ্যামপুরে উৎসব উপলক্ষ্যে একটি ড্রয়িং প্রতিযোগিতাকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক অশান্তি,পুলিশের উপর পাথর ছোঁড়া, দুর্গাপূজার প্যান্ডেল ভাঙচুর হয়। ঘটনার গভীরতার জেরে ইন্টরনেট ও মোবাইল পরিষেবা পর্যন্ত বন্ধ রাখতে হয়,জারি করতে হয় ১৪৪ ধারা।
         ২০২৫ এ ঈদ এবং রামনবমী চলাকালীন উসকানিমূলক পোস্টার এবং অশান্তির চেষ্টা। এইসব ঘটনা থেকে বোঝা যায় দুর্গাপূজা বা ঈদকে কেন্দ্রকরে পশ্চিমবঙ্গে পর্যায়ক্রমে বড় বা ছোট অশান্তির জেরে উৎসব উৎ-শবের দিকে অগ্রসর হতে চেয়েছে। প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষের সংবেদনশীলতার অভাব ,অলক্ষ্যে থাকা সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সু্প্ত রাজনৈতিক স্বার্থ,উৎসব-ধর্ম-রাজনীতির মিশ্রণ উৎসবগুলিকে ঠেলে দিচ্ছে সহিংসতার পথে এবং উৎসব ঢলে পড়ছে উৎ-শবের দিকে। 

জয় হোক উৎসবের

তবু.উৎ-শবকে ঢেকে দিতে হবে উৎসবের আবরণে-আভরণে। “প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র,দীন একাকী,কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ…” । উৎসব মানেই স্মৃতি হাসি খুশি আর সম্পর্ক নির্মাণের গল্প। সময়ের ক্লান্তি দুঃখ মুছে দিতে উৎসবের প্রাঙ্গনে মিলন মেলা খুঁজতে হবেই মানুষকে। জয় হোক উৎসবের-




ছোটগল্প

তিতিক্ষা 
বিপ্লব নসিপুরী

পঁচাত্তর  বছরের শীর্ণকায়া কুঞ্চিত চর্মের আল্পনা দেবী আজ অনেকদিন পরে উনুনের দ্বারে এসেছেন।রান্নার ঠাকুর দেখছে কীভাবে অভ্যস্ত হাত অব্যবহারে অনভ্যস্ত হয়ে গেছে।
একমাত্র নাতির মুখে কাঁপা কাঁপা হস্তে তুলে দিচ্ছেন পরমান্ন।আর দুঃখক্লিষ্ট মনখানি পরম আদরে কামনা করছেন নাতির পরমায়ুর।পাশে দাঁড়িয়ে বিষণ্ণ হৃদয়ে অনিকবাবু।বারবার ঘড়ি দেখছেন।চিড়িয়াখানা দেখার নামে ছেলেকে নিয়ে এসেছেন তার ঠাকুমার কাছে।সন্ধেবেলা জন্মদিনের বড়ো পার্টি হবে।গিন্নির ধৈর্যঘড়ি  একবার সর্তক করেছে ফোনের নিস্তব্ধতা ভেঙে।
খুদেটি পায়েস মুখে বললে  "দুর্গামা তো প্রতিবছর নিয়ম করে আসে।ঠাম্মি তুমি যাবে না।বাবা, তুমি ঠাম্মিকে নিয়ে চলো না।"
অনিকবাবুর চোখ ছলছল করে ওঠে।বৃদ্ধাশ্রমের বোর্ডের লেখাগুলো ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে আসে। বড়ো রাস্তার পাশে প্যাণ্ডেলে শোভিত বড়ো চোখের দুর্গাপ্রতিমার মুখখানি ঝাপসা লাগে।সেখানে স্পষ্ট হয় মলিন শাড়ি পরিহিতা তার মায়ের আদল।না সে চোখে কোনও হিংসার চিহ্ন নেই।




নৌকা
শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়

সে অনেককাল আগের কথা। মন্ডলপাড়া তখন আজকের মফস্বলী চেহারা নেয় নি। নদীর পাশ দিয়ে বেশিটাই ছিল বন বাদার আর জলা জঙ্গলে ভরা। দূরে দূরে ছাড়া ছাড়া কিছু লোকবসতি। সেসব পুরোনো লোকজন আজ আর নেই। খুঁজলে তাদের কিছু বংশধর হয়তো পাওয়া যাবে, যাদের সঙ্গে নতুন আসা মানুষের তেমন কোনো দৃষ্টিগত পার্থক্য চোখে পড়ে না। 

এ জায়গায় সুবল মাঝিদের বাস দুতিন পুরুষের। সুবলের দাদু চাঁদু মাঝি ইছামতীর বুকে নৌকা করে মাছ ধরতে গিয়ে তার এক শাগরেদ রমজান মিঞাকে নৌকায় অপেক্ষা করতে বলে কি ভেবে সুন্দরবনের জঙ্গলে ঢুকে পড়ে মধু চুরি করতে। পেছন থেকে আচমকা এক বাঘ এসে তাকে তুলে নিয়ে চলে যায়। রমজান মিঞা প্রাণের ভয়ে নৌকা করে  চম্পট দেয়। চাঁদু মাঝি না ফিরলেও তার সাধের নৌকাখানা কিন্তু ফিরে এসেছিল অক্ষত  অবস্থায়। 
সুবলের বাপ ডোমন মাঝি দূর সমুদ্রে ডিঙি নৌকায় পাড়ি দিয়ে ঝড়ের মুখে নিখোঁজ হয়ে যায়। গাঁ ময় খবর রটে যায়, ''চাঁদুকে খেয়েছিল বাঘে, ডোমনকে খেয়েছে জলে।'
দাদুকে সুবল চোখে দেখে নি। এর ওর মুখে গল্প শুনেছে। ডোমনের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার কথা খুব আবছা তার মনে পড়ে। বয়স যত বেড়েছে ততই সে বিশ্বাস করতে শিখেছে, জল তার বাপকে খায় নি। যদি খেত বাপ তার ঠিক ফিরে আসতো। লাশ হয়ে ফিরে আসতো। 
মায়ের মুখে বাপের গল্প শুনেছে সুবল। আরো কতজনের মুখে শুনেছে! বাপকে নাকি কত খোঁজাখুঁজি করা হয়েছিল! কেউ কিছু বলতে পারে নি। কারো কাছে বাপের কোনো খবর মেলে নি। ডিঙি নৌকার মতোই নাকি তলিয়ে গিয়েছে বাপ! তারপর একদিন ডিঙি সমেত সমুদ্রটাই গল্প হয়ে গেল। গল্প শুনতে শুনতে সুবলও কত বড় হয়ে গেল! নৌকা বাইতে শিখলো। বাপ, দাদু গল্প হয়ে গেলেও ওদের নৌকাটা গল্প হয় নি, যেটা এখন সুবলের পারাপারের সঙ্গী। নৌকাখানা খুব যত্ন করে রাখে সে। মাঝে একবার ফুটিফাটা হয়েছিল। ভুবন চাচা সারিয়ে দিয়েছে। নৌকা মেরামতির কাজ করতে করতে গল্প করছিল চাচা...এ নৌকা সুবলের দাদু নিজের হাতে বানিয়েছিল...ইছামতী পেরিয়ে রাতের অন্ধকারে বাংলাদেশ সীমান্তে ঢুকে চুরি করে ইলিশ ধরে আনতো...বলতো পয়া নৌকা...শেষে ঐ নৌকাই একা একা একদিন তীরে এসে ভিড়লো...নৌকার গায়ে চাঁদু মাঝির হাতে করা সদ্য কাঁচা রঙের গন্ধ তখনো যায় নি....দাদুর হাত ধরে নৌকার কাজ শিখেছিল ডোমনও...বলেছিল নৌকায় ভটভটি মেশিন লাগাবে...তার দুদিন বাদেই সমুদ্র সারা জীবনের দায়ে ডেকে নিয়ে গেল...।
ফুটিফাটা নৌকাটা ভুবন চাচা সারিয়ে দিয়েছিল বটে, ততক্ষনে সুবলের চোখের সামনে দিয়ে নতুন ভটভটি মেশিন লাগানো নৌকা ছুটে চলেছে। বসে বসে বাপ, ঠাকুর্দার গল্প শুনলে তো আর ও নৌকা কেউ ধরে এনে দেবে না। ওকে ধরে আনা চাচারও কম্ম নয়। ধরতে গেলে পয়সা লাগে। এ দুনিয়ায় পয়সা দিয়ে সাহায্য করার লোক তার কেউ নেই। বাপ যখন ছিল, ছিল। এখন আর নেই। এখন শুধু গল্পে আছে। ইশ, কিছু পয়সাও যদি রেখে যেত বাপ, ওগুলো জড়ো করেও মেশিনপত্র গুলো...। উপার্জনের ভাগ্য সুবলের তেমন যে একটা খারাপ, তা নয়। ডোমন মাঝির আমলে ইছামতীর বুকে যে কটা নৌকা বাইতো, এখন তার দ্বিগুণ চলে। গতি বেড়েছে, লোকের চাপ বেড়েছে, জল গভীর হয়েছে তত। মাঝদরিয়ায় বাপের মতো ভেসে গেলে হাত ধরার আর কেউ থাকবে না। সংসারটা ভেসে যাবে।  ডোমন নিজে চলে গেলেও সুবলকে ভাসিয়ে দিয়ে চলে যায় নি। নিজের ছেলেকে কোনোভাবে ঠিক মাঝির জীবনে পৌঁছে দিয়েছে। যা সম্বল করে সুবল আজ যেটুকু করে খাচ্ছে। তখনই সুবলের কেন জানি না মনে হয়, বাপের সবটাই গল্প নয়। গল্পের বাইরে যেটা রয়ে গেছে সেটা এই নৌকাখানার মতোই দারুণ সত্যি! একে নিয়ে এগিয়ে যেতে না পারলে ফেরীঘাটের সুবল মাঝির বেশিদিন আর টিকে থাকা হবে না। ছোটবেলা থেকে দেখে আসা নদীর জল আর এই জল এক নয়। ইউনিয়ন আর রাজনীতির পাঁকে আজকের এ জল কর্দমাক্ত। হিস্যে খোর মোটা গোবিন্দের মতো কিছু গভীর জলের মাছ তাতে খেলা করে। ভেরী, মোটর লঞ্চ, ভুটভুটি নৌকার অঘোষিত মালিক। এই কিনার ঘাটের আগেকার হালহকিকত বদলে দিয়েছে কতই না! 
সুবলের মা বলতো, ' তোর বাচ্চাবয়সে তোর বাপ তোরে নৌকায় চড়াইয়া মাঝদরিয়ায় ঘুরাইয়া আনতো...তুই বাপের কোলে বইয়া থাকতিস...মোমিন চাচা আর খয়ের চাচা মিলে হাল ধরতো...'
ভুবন চাচার কথায়, ' ঐ দিন গেছে গিয়া…'
সত্যিই গেছে। আর গেছে বলেই কেউ জলের টানে সমুদ্রে চলে যায় আরো বড় নৌকার খোঁজে।  কেউ ডাঙায় উঠে আসে। মোটা গোবিন্দরা হলো ঐ ডাঙায় উঠে আসা লোক। মায়ের কাছে গল্প শুনে সুবলের মনে হয়েছে, বাপ যখন ছিল, তখন আর যাই হোক জল এত গভীর ছিল না। মোটা গোবিন্দদের দেখে সে এখন বুঝতে পারে, মাঝদরিয়ায় তার নৌকার যাত্রাপথ দিনদিন কত টলমলে আর কষ্টবহ হয়ে উঠছে! ইউনিয়ন অফিসে মোটা অপেক্ষা করে থাকে। হিস্যের অপেক্ষা। জল থেকে উঠে আসা ডাঙার মাছ। ধরা কঠিন। ধরার চেষ্টা করা আরো কঠিন। খেয়ামাঝি সুবল নৌকাখানা জাপটে ধরে তত। পেটের ভাত জোগানোর মতো বাপ এই একটা জিনিসই রেখে গেছে তার জন্যে। খেয়াপারের মিটিং মিছিলে চোঙ মুখে করে বুক ফুলিয়ে মোটা বলে, ' মানুষকে সার্ভিস দেওয়াই আমাদের কাজ...'
মোটা গল্প দেয় না। গল্প দিলে দিন চলবে না। 
' কি ভাবোস কি?'
ভুবন চাচা জিজ্ঞেস করে। 
' নৌকায় ভটভটি মেশিন লাগাবো চাচা...'
' ঐ মেশিন? যা লাগা গিয়া। তোর বাপও স্বপ্ন দ্যাখছিল...'
কথাটা যেন কানে এসে ধাক্কা মেরেছিল সুবলের।
' আমি ঘুমায় ঘুমায় কথা বলছি না চাচা..'
বলেছিল সুবল। 

সেদিন ছিল বর্ষাকাল। সকাল থেকে অঝোরে বৃষ্টি। ভরা বর্ষার জলে উপচে পড়ছে নদী তীর। থমকে পারাপার। ঘাটের কাছে বসেছিল সুবল। কখন বৃষ্টি কমে। খেয়ার অপেক্ষায়। বসে বসে ভুবন চাচার কথাগুলো ভাবছিল সুবল। বৃষ্টিতে ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গিয়েছে ওপার। আবছায়া। দেখা যায় না প্রায়। সেই সঙ্গে সোঁ সোঁ হাওয়া। আনমনে একটা ঢিল ছুঁড়ে মারলো সুবল। হাওয়ার তোড়ে ঢিলটা বেঁকে কিছুদূরে জলের ঘূর্ণির মধ্যে পরে ঘুরপাক খেয়ে কোথায় যে তলিয়ে গেল...! সমুদ্রের জল হলে  ঢিলটা কি ফিরে আসতো? একই প্রশ্ন ভুবন চাচাকে করেছিল সুবল। এমনই করেছিল। মনের খেয়ালে।
....' অত খবর রাখি না...বড় জিনিস হইলে ঠিক ফিরে আসে জানি...মানুষ, পশু কত কি দ্যাখলাম ফেরৎ আইতে...তোর বাবারেই আইতে দ্যাখলাম না...তবে ভাইসা তো উঠছেই...আরো দূর দ্যাশের কোনো ঘাটে গিয়া উঠছে হয়তো....কেউ হদিশ পায় নাই...এ কি  ইট পাটকেল নাকি যে আল্লার নামে ছুইড়া মারলে পর ভাইসা উঠলেও আর পাইবো না...অত বড় মানুষটা, অত বড় দেহখান....হাঙর, কামটে খাইলেও হাড় মাংসগুলা তো আইতো...! এ পাড়ে দীঘা, ঐ পাড়ে চট্টগেরাম...মাছ ধরতে ধরতে কাছাকাছি চইলা আইছিলাম একবার...নৌকার পাশে বইসা কেডা জানি কইলো, চাচা আর আউগ্গাইও না...সামনে কক্সবাজার...আর একটু হইলেই পুলিশগো খপ্পরে পড়তাম গিয়া...কে জানে, হয়তো ঐহানেই কোথাও ভাইসা উঠছে, বেওয়ারিশ লাশ হইয়া...তোর বাপের কপাল খারাপ, তাই ঝড় তুফানে গিয়া পড়ছে...কোথায় গিয়া পড়ছে কে জানে... সাগরে কেউ তলায় না...যাবি নাকি আমার লগে? '
' কোথায়?'
ভুবন চাচার দিকে খানিক অবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল সুবল। 
' বাপেরে খুঁজতে। '
কথাটা খট করে কানে এসে বিঁধেছিল সুবলের। সেই ছোটবেলার মতো। যেদিন প্রথম এই ভুবন চাচার মুখে শুনেছিল,  সাগর সব কিছু ফিরিয়ে দেয়...বাপ হারায় নি...আছে কোথাও...।
সেদিন থেকে কেন জানি না  এক অন্যরকম ভরসা জন্মেছিল সুবলের, ভুবন চাচার প্রতি। কিন্তু এতদিনে সুবল আর সেই ছোট ছেলেটি নেই। বাপ নিখোঁজ হোক, মরে যাক...সে আর কোনোদিন ফিরবে না। যদিও এই ফিরবে না কথাটা সুবল নিজের মুখে কখনো বলেনি। তার চারপাশের পরিবৃত্তে কেউই বলেনি।  বাপের কথা এখন আর কেউ বলে না। তার ফেরা না ফেরা নিয়ে কারই বা কি দায়? মা বলতো, '  বাপ তোর ঠিক ফিরে আসবে...তোরে ফেলে কোথায় যাবে...শুনেছি সে অনেক দূরের রাস্তা....অতখানি পথ, তাই ফিরতে দেরী হচ্ছে...একদিন দেখবি তুই ঘুমায় আছিস, মাথার ধারে বাপ দাঁড়িয়ে... '
সে অনেকদিন আগের কথা। এখন আর বাপরে নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে না সুবল। মা ও বলে না। শুধু মন বলে, বাপ আর কোনোদিন....।
ভুবন চাচার কথা শুনে বেশ খানিক অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল সুবল। ছোট থেকে চাচাকে দেখছে সে। চাচা তাকে হাতে ধরে নৌকা বাওয়া শিখিয়েছে, গভীর জলে ভেসে থাকা শিখিয়েছে, কোথাও একটা সন্ধান এনে দিয়েছিল ডুবে যাওয়া বাপের...কেউ যা পারে নি....। আজ সেই চাচার মুখের কথাগুলো বাপের ছবিটাকে যেন নতুন করে ফিরিয়ে দিল সুবলের চোখের সামনে। এরকমভাবে নিজের বাপকে বহুদিন যেন সে দ্যাখে নি! সেই বহুদিনটা কতদিন সুবল নিজেও জানে না। বাপকে তো সে ভুলেই গেছিল। অত ছোটো কালের ছবি মনে থাকে নাকি? আবার কেন ফিরিয়ে আনলো চাচা? বাচ্চাবয়সের আবেগ ছুঁয়ে যায় সুবলের চোখে মুখে। 
' কি রে তাকায় আছিস ক্যান? যাবি আমার লগে?'
' কোথায়?'
আবার জিগ্যেস করে সুবল।
কানের কাছে মুখ এনে ফ্যাসফেসে গলায় বলে ভুবন...
' সাগরে মাছ ধরতে...বচ্ছরে দুই বার...নৌকাটারে খেয়াঘাটে বাইন্ধা চল দুই মাসের জন্যে...হুরহুর করে ট্রলারে যখন মাছ ওঠবে তখন আর বাড়ি ফেরতে ইচ্ছা করবে না....এর নাম হইলো টান...সাগরের টান! না গেলে বুঝবি কি!'
খেয়াঘাটের সুবল মাঝি।  জল তার কাছে যতটা চেনা, সাগর যে ঠিক ততটাই অচেনা! শুধু গল্পই শুনে গেছে কত! ঢেউয়ের গল্প, ভেসে যাওয়ার গল্প, ফিরে আসার গল্প....
জীবনের সত্যি মিথ্যা, বিশ্বাস অবিশ্বাস সবকিছু ছাড়িয়ে চোখ দুটো চকচক করে ওঠে সুবলের, রোদে ভেজা রূপোলী ইলিশের মতো। সামনে দিয়ে ছুটে চলে যায় ভটভটি নৌকা। সেদিন মাদারির হাটে মেশিন পত্রের খোঁজ করতে গিয়েছিল সুবল। তাও অনেক পয়সা। আয় বাড়াতে গেলে, পারাপারে গতি আনতে গেলে দূরে যেতে হবে। বলতেই বলে, পয়সাকে দূর থেকে ধরে আনতে হয়। পয়সা নিজে থেকে কখনো কাছে আসে না।
ধোঁয়া ধোঁয়া বৃষ্টিতে ঘাটে বসে সেসব কথা ভাবতে ভাবতে বুকের ভেতর বাপের রক্ত যেন কথা বলে ওঠে সুবলের। 

ইছামতীর পার ঘেঁষা সাবেকি আমলের দোতলা বাড়িটা দেড়শো বছর আগেকার। বাইরে রঙচটা স্যাঁতসেঁতে দেওয়ালের গায়ে নেমপ্লেটে মল্লিক ভিটা নামটা ঝাপসা হতে হতে আজ শুধু ভিটা টুকুই বেঁচে আছে। সেই বাড়িরই ওপরের একটা ঘরে একা বাস করেন বিধু ভূষণ মল্লিক, মল্লিক বংশের সম্ভবত শেষ প্রতিনিধি। কুড়ি বছরের বিপত্নীক জীবন। একই সাথে অন্তরীণ জীবনও।
সাংবাদিক মহিলাটি মাইক্রোফোন এগিয়ে ধরে।
' আজ দীর্ঘকাল পর ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রিতে আপনার সাড়া জাগানো কামব্যাক...কিভাবে দেখছেন?'
' চা না কফি? এতদূর থেকে আমার বাড়িতে যখন এসেছেন, একেবারে কিছু না খেয়ে তো...ওকে, রামহরি কফি নিয়ে এসো..'
একসময়ের সাড়া জাগানো অভিনেতা। দিন চলে গেলেও স্বরের গাম্ভীর্য আর মাদকতা এখনো হারানো দশকের চরিত্রাভিনেতা বিধুভূষণকে মনে করিয়ে দেয়। মহিলা সাংবাদিক উত্তরের অপেক্ষায়। 
টোবাকো পাইপে অগ্নিসংযোগ করে পাইপটা ঠোঁটের কোণায় রেখে সাহেবি কায়দায় বললেন বিধুভূষণ, ' নাথিং। সুধীর আমাকে রিকোয়েস্ট করেছিল...না করতে পারি নি...ওর পরিচালনা বলেই হয়তো আরো পারিনি...তারাশঙ্কর বাবুর দুই পুরুষে প্রথম অভিনয় করি কলেজ লাইফে...সেটা ছিল নাটক...অভিনয় করে ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম, সেটাই বড় কথা নয়...সে ছিল আমার প্রথম আত্মবিশ্লেষনের জায়গা...যেরকমটা চেয়েছিলাম ঠিক তেমনটা যেন করতে পারি নি...আরো ধারালো হতে হবে...আরো সাউন্ড...এক বন্ধুর সৌজন্যে ছবি বিশ্বাস অভিনীত দুই পুরুষ নাটকের রেকর্ড শুনলাম...মন ভরলো না...দেখা আর শোনার মাঝে যে বিস্তর প্রভেদ...শুনলাম ওটা নিয়ে সিনেমাও হয়ে গিয়েছে...ছবি বিশ্বাসই করেছেন...সে যুগান্তকারী অভিনয় দেখার যখন সৌভাগ্য হয়, তখন আমি চারের কোটায়...সেখান থেকে উত্তম বাবুর দুই পুরুষ হয়ে আজ এই অধম বিধু মল্লিকের কাছে অফার....সুধীর যেদিন অনুরোধ নিয়ে এলো, ভেতরটা হঠাৎ যেন ছটফট করে উঠলো...সেই কলেজ লাইফের স্মৃতি...স্মৃতি তো নয়, জ্বলজ্বলে। বর্তমান। সেদিনের নামভূমিকায় আজকের বিধুভূষণ। বুঝলাম, কিশোর বেলার সে খচখচানিটা, না সে এখনো লাঘব হয় নি...সময়ের কিছু প্রলেপ পড়েছিল মাত্র...নাটক থেকে রূপোলী পর্দা, বয়স, কাল, পরিস্থিতি..সব দিক দিয়েই এ অভিনয় আমার কাছে চ্যালেঞ্জিং...দুই পুরুষ তো নয়, দুই পৃথিবী। '
মহিলা সাংবাদিক ঔৎসুক্য ভরে জিজ্ঞেস করে, ' স্যারের কাছে একটা বিষয় জানতে খুব ইচ্ছে করছে...'
তাকিয়ে আছেন বিধুভুষণ। স্থির চোখ। 
' জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকতে থাকতেই হঠাৎ করে সিনেমা জগৎ থেকে সরে যাওয়া...শুধু সরে যাওয়াই নয়, কলকাতার সঙ্গে বলতে গেলে সব যোগাযোগ ছিন্ন করে সুদূর এই বাসভূমিতে ফিরে আসা...সুদীর্ঘ বছরের এই যে স্বেচ্ছা নির্বাসিত জীবন...  চিত্র মহলে এমন কথাও চর্চিত হয়েছে, স্ত্রী বিয়োগের ঘটনা এবং তাকে কেন্দ্র করে আপনার একাকিত্বই আপনাকে এ পথে...'
' আই ইনটারাপ্ট।'
কথাটা এলো বেশ জোড়ের সঙ্গে। সাংবাদিক মহিলা চুপ করে যায়। সংযত হন মল্লিক মশাই।
কফি এসে পড়ে।
' প্লিজ টেক ইট। সময় থাকতে সরে আসা কিংবা থামতে জানাটাও একটা আর্ট। একজন শিল্পীর জীবনে সেলফ রিয়ালাইজেশান। এই বাড়িটা আমার বাসভূমি নয়। ইট’স মাই বার্থ প্লেস। '

ইছামতীর হাওয়া আসছিল বিধুভূষণের  ঘরের খোলা জানলা দিয়ে। নদীর পারে বুড়ো বট গাছের পাশে একটা নৌকা উল্টানো অবস্থায় পড়ে রয়েছে। গায়ে গায়ে সবুজ শ্যাওলার জমা আস্তরণ। কয়েকটা বাচ্চা খেলা করছিল নৌকার এদিক সেদিক। রোজ এইসময়ে ওরা খেলতে চলে আসে মাঠে। ওদের মধ্যে একটা আদুল গায়ের রোগা লিকলিকে বাচ্চা ছেলে খেলতে খেলতে মুখখানা কেমন করে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কাল রাত্তিরে বাচ্চাটা যখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, তখন ওর বাপ ফোন করেছিল। সকালে উঠেই মা বলেছে, ’কাল তোর বাপ আসবে, সাথে করে ইলিশ নিয়ে... '
বাপের নৌকাটাকে ছোট্ট দুহাতে জড়িয়ে ধরে ছেলেটা। অন্যদের মতো করে নয়। নিজের মতো করে। এতদিন ফোন করোনি কেন বাপ? ভুবন খুড়ো কবে চলে এসেছে! তুমি আর এলে না। মাকে নাকি বলেছে বাপ, ’ সে অনেক কথা। ফিরলে পর বলবো নে...’
ঘাটের পথ ধরে হেঁটে আসে একটা লোক। মানিক চাচা। হাতে ধরা ভেরীর মাছ। 
' কি রে, সুবল আইছে নাকি?'
যেতে যেতে চোখ টেরিয়ে জিজ্ঞেস করে মানিক বাচ্চাটাকে। কি যেন বলতে যায় বাচ্চাটা। অপেক্ষা না করে নিজের তালে চলে যায় মানিক।
ইছামতীর জল আজ বড়ই উতলা। 
বাপ কখন আসবে ? ইলিশ আনতে এতক্ষণ লাগে? 

ভুবন চাচা বলতো, ওপারে গ্যালে চট্টগেরাম পড়বে।
তিনবছর ধরে খুঁজে আসছে সুবল। অনেক খুঁজে আসছে। খুঁজতে খুঁজতে কোথায় চলে গেছে নিজেও জানে না। ভুবন চাচা সতর্ক করে... ' ও মাঝি, আর আউগ্গাইও না, সামনে কক্সবাজার.... '
জেলে সুবল ফিরে আসে...দুচোখে রুপোলী ইলিশের গন্ধ... ফিরে আসে  ডাঙার মানুষ হয়ে...যে পথে সমুদ্র আর নদী একাকার হয়ে মিশে যায় শিশুর চোখে। 
কখন আসবে বাপ? ইলিশ আনতে এতক্ষণ....!  

' একটা শেষ প্রশ্ন ছিল স্যার..'
' বলুন।'
কফি খেতে খেতে খানিকটা যেন  ইতস্তততার সুরে প্রশ্নটা এলো...
'সব বিতর্কের পথ পেরিয়ে এই যে অপ্রত্যাশিত কামব্যাক, সেদিকে তাকিয়ে আমরা কি আশা করতেই পারি ভবিষ্যৎ ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রি অভিনেতা বিধুভূষণ মল্লিকের হাত ধরে আরো অনেক নতুন ছবি উপহার পেতে চলেছে? '
মল্লিক মশাই নিশ্চুপ। আস্তে আস্তে জানলার বাইরে ফিরে তাকান। চোখের দৃষ্টি ঘুরে বেড়ায় বাচ্চাদের খেলার সাথী পরিত্যক্ত নৌকাটার দিকে।
জানলাটা খুললে আজকাল যেন বেশি করে চোখে পড়ে নৌকাখানা। 
কিছুদিন আগে হাঁটতে হাঁটতে মাঠের ওদিকটায় চলে গিয়েছিলেন বিধুভূষণ। সেদিনও খেলা করছিল বাচ্চাগুলো। 
...' এই নৌকোটা কে রেখে গেছে রে, জানিস?'
এমনিই বেখেয়ালে কথাটা বেরিয়ে এসেছিল বিধুভূষণের মুখ থেকে। 
’ আমার বাপ।’
’ চালায় না বুঝি এখন আর? ’
’ বাপ তো নাই গো। ’
’ নেই?  কোথায়?'
’ অনেক দূরে। মাছ ধরতে। ’
’ নাম কি তোর?’
’ পচা।’
আরো দুটো বাচ্চা এগিয়ে এসে দাঁড়ায় সামনে।
’ অনেকদিন হলো গো।  আসে না। ফোনও করেনা। জানো দাদু, আমার চাচা বলে, পচার খুড়ো মাছ ধরতে গিয়ে সাগরে ডুবে গেছিল...’

সেদিনের পর থেকে বাচ্চাটা আর খেলতে আসে নি। হয়তো এসেছিল। না না, বিধুভূষণ নিশ্চিত, ও আর আসে নি। আজ এসেছে। হ্যাঁ, ঐ ছেলেটাই তো... অনেকের মাঝে, ঐ যে দূরে...! 
ফিরেছে কি লোকটা?
জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর ছাপিয়ে হঠাৎ করে যেন বড় হয়ে উঠেছে এই জিজ্ঞাসা।
মাউথপিস হাতে মহিলা সাংবাদিক তাকিয়ে রয়েছে উত্তরের অপেক্ষায়। হয়তোবা ফেরার অপেক্ষায়। ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়া তাদের অভ্যাস।
হাওয়ায় জড়ানো টোব্যাকো পাইপের আনমনা ধোঁয়া। 
শেষ বিকেলের আলো পড়ে দুই পৃথিবীর বুকে।।





কিন্নরী
রত্না দাস

শৈলশিখরের মনে পড়ে যাচ্ছে সেইদিনের কথা, যেইদিন একরাশ রাগ ও ঘেন্নার সাথে কমলিনীর মুখের ওপরে বলে উঠেছিলেন, তুমি #কিন্নরী! ছিঃ...
কমলিনীর মুখটা থরথর করে কাঁপছিল, চোখ ভেসে যাচ্ছিল কিন্তু কোনো কথা ছিল না।

      তীব্র আগুনের হল্কা ছিটকে বেরোচ্ছিল শৈলশিখরের গলা থেকে, কমলিনী পুড়ে যাচ্ছিল ।কেন তুমি প্রথম দিনেই আমাকে তোমার আসল সত্যিটা বলোনি, তবে তো আমাদের রিলেশনটা এতদূর গড়াতো না! কাঁপা কাঁপা গলায় কমলিনী বলেছিল, তোমার চোখে ভালোবাসার ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম তাই সাহস হয়নি। ভেবেছিলাম আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে ঠিক বাঁধতে পারব।

      ভালোবাসায় কী শুধু মন ধুয়ে জল খায়, আর অন্যকিছুর প্রয়োজন হয় না! দুজন সমকামীও তো একসাথে ঘর বাঁধে কোনোমতে বলে কমলিনী। গে পার্টনার ব্যাপারটা আলাদা কিন্তু হিজড়ে! চাবুকের বাড়ি পড়ে যেন কমলিনীর পিঠে! ছোট থেকেই একথা শুনে শুনে কানে জ্বালা ধরে গেছে।

      কিন্তু ওর জন্মে তো ওর কোনও হাত ছিল না। আর মন তো শেকলে বাঁধা নয়, সে তো কাউকে বাঁধতে চাইতেই পারে। সে অধিকারও কী থাকতে নেই! চোখের জল মুছতে মুছতে চলে গিয়েছিল কমলিনী।

      চুপচাপ রেলিঙে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শৈলশিখর। আজ মনে হচ্ছে, অত কঠিন না হলে কী চলছিল না! আজও তো সে কাউকে পায়নি অমন আপন করে ভালোবাসার জন। কতজন মা হতে পারে না, কারও ইরেক্টাইল ডিসফাংশন থাকে তবে! দুটো জীবন শুধু ভালোবাসায় কী বাঁচতে পারে না! কাঁচাপাকা চুলগুলো উড়ছে শৈলশিখরের সাথে উড়ছে ভাবনা।

      "দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলো না, সেই যে আমার নানারঙের দিনগুলি"...

1 টি মন্তব্য:

Kobitar Alo October Sankhya 2025

  প্রচ্ছদ ঋণঃ-  অদিতি সেনগুপ্ত