শুক্রবার, ২১ জুন, ২০২৪
কবিতাভিত্তিক | আসিফ আলতাফ

আয়ু রেখা ভাগ্য রেখা নিচয়
হস্তরেখা
মানে আমার হাতের রেখায় হেঁটে যাচ্ছেন কে ?
কে,
কে আপনি? প্রতিদিন হেঁটে গেছেন
হেঁটে যাচ্ছেন
হেটে যাবেন
আমার কররেখায় কী কোনো প্রেমিকার গোপন
পথ পেয়েছেন ?
যখন খুশি আপনি সেজেগুজে ভাগ্যরেখা ধরে হেঁটে যাবেন
বসবেন
জিরোবেন
গল্প করবেন
আবৃত্তি করবেন জীবনানন্দ দাশের শঙ্খমালা
গাইবেন রবীন্দ্রনাথ
আর
আর?
আর যখন মন চাইবে ভাগ্য রেখা পিছনে ফেলে
সো~~~জা চলে যাবেন আয়ু রেখায়
আমি তো আপনাকে চিনি
জানিও তো
জানিনা?
পারেন তো চোখের দিকে তাকিয়ে ঠিক উত্তর দিন
আয়ু রেখায় গিয়ে আপনি কী করবেন তাও বলতে পারি
আচ্ছা আমার আয়ু রেখা কী গণসম্পত্তি
যার খুশি সে দখল নিয়ে নেবে
এবার পাণিনি হব।
ভাগ্য রেখা বদলে গেলে আয়ু দেখা
এমনিতেই বদলে যায় ।
কবিতাভিত্তিক | সৈকত মাজী
গণতান্ত্রিক
একটা সংবিধান মন্থন করে
জড়ো করেছি কয়েকটা কর্তব্য
আর আমার গুটি কয়েক অধিকার...
নাটক শুরু হলে, আমরা শুরু করি উৎসব
আমাদের আঙুল সিংহাসন সাজায়
রাজাভিষেকের নাটক শুরু হয়
ভূমিকা অনুসারে
আমরা বাটি হাতে ভিখারী হয়ে যাই রাজদরবারে,
পাতে পাতে পড়ে শ্রী আর সাইকেল,
অথবা টাকা দিয়ে কিনে নিতে হয় নিজের পাতের ভাগ,
যার ভূমিকা চাটুকারের
সে সংবিধান বোদ্ধা
তার ঠিকানা হয় রাজপথ।
অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র ,
কাপড় বেঁধেছে চোখে গান্ধারী,
যদু-মধু গারদের শিক গোণে
আর অনাক্রম্যতা ভোগ করে রাজ-পরিবার।
বিদুর প্রতিবাদী হলে
রাজপাটে নেমে আসে বিপদ,
শকুনির পাশার চালে
কেউ গদিচ্যুত কেউ দ্বীপান্তরবাসী।
কবিতাভিত্তিক | নিশীথ ষড়ংগী
রক্ষা
আপাতত নির্বিকার কৃষ্ণচূড়া রাধাচূড়া গাছেদের
মাথায় মাথায়
হলুদ রঙের জিন্স লালকুর্তি কারা যেন নিঃশব্দে
টাঙিয়ে দিয়ে গেছে
অনুৎসাহী রোদ আজ রাস্তাঘাট, লোকজন চির-
অস্থিরতার ওপরে
শিশু-আকাশের দিকে দেখেও দেখছে না --
দার্শনিক হাওয়ায় হাওয়ায় কাঁপে তোমারই ঘন্টা,
মিনিট
ভেতরের স্রোত এসে ভিজিয়ে দিয়েছে খুব মনের
দোতারা
এসবই চিত্রকল্প; পংক্তির দুই তীর সজল, সজীব করে
রাখা
আসলে সমস্ত ক্ষয়,ধ্বস ও ক্ষতের থেকে রক্ষা দিয়ে
যাওয়া.....
কবিতাভিত্তিক | অর্ক বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রজাপতি
লাল টকটকে সূর্য গেঁথেছি বঁড়শিতে,
অভিমানগুলো প্রজাপতি হয়ে ফুল খোঁজে।
আরাম কেদারা; হেলান দিয়েছি বারবেলা…
তুমি যে রয়েছ; আয়োজনে তবু আলসেমো।
আজ কিছু কথা আমিও বরং বলবো না;
সেই শূন্যতা মিটিয়ে দিতে তো দিগন্ত।
ফসলি জমিতে ছড়িয়ে দিয়েছি বীজ আগে
মাটি জল দেবে, আর যা কিছু সম্ভবে।
যা কিছু ঘুমিয়ে, মন্ত্রে বলেছি ‘জেগে ওঠো’
যদি বা ওঠেও, বাকি খেলাটুকু আমার না…
ওরা খেলোয়াড়। আমি তো নিপাট শিল্পী লোক।
ওদের ভেতরে মন আছে, আছে স্নিগ্ধতা।
কবিতাভিত্তিক | রুমকী দত্ত
ক্লান্ত অনাঘ্রাত
পেটের মধ্যে আগুন জ্বলছে,এক পৃথিবী ক্ষুধা
এক টুকরো রুটিই দিও, তাইই প্রেম সুধা ।
সুধার বদলে বিষ যদি দাও,তবুও কল্পতরু
আঘাত প্রাপ্ত ভালোবাসা গ্রীষ্মে তপ্ত মরু ।
বুকের মধ্যে ঝড় বইছে, ভীষণ যন্ত্রণা
মাথার ওপর হাত রাখলে? আশিস মন্ত্রণা?
মন্ত্র তন্ত্র জানি না কিছুই,আলোক খুঁজে ফিরি
পথিক যদি কুটিরে আসে,দেবো কাঠের পিঁড়ি ।
দেখতে দেবো অশ্রু শ্রাবণ,বানভাসি হই যদি
সঙ্গে নেব এক ছায়াপথ, নাম না জানা নদী ।
নদীর নাম সে কী যেন ছিল? ভুলেই গেছি কবে
ইছামতী?রূপনারায়ণ? করতোয়াই হবে ।
সাজবো আমার মনের মতো,খোঁপায় দেবো ফুল
ও হো,
খোঁপা তোমার পছন্দ নয়,খুলেই রাখবো চুল ।
নয়ন জুড়ে নামবে নেশা,ক্লান্ত অনাঘ্রাত
রাধার সাজে একলা জাগে জোছনা মাখা রাতও ।
সম্মিলন | শিশির আজম
মধ্যবিত্তের কবিতা
আমি চাই আপনি আমার কবিতা পড়ুন আর সন্দেহ করুন কবিতাকে
আমি চাই
আপনারা পড়ুন আমার ঋতুরক্তমাখা কবিতা
তাজা মৃতদেহের পাশে
আমি চাই
আপনারা আমার কবিতার ওপর থুতু ফেলুন
কুচি কুচি কাটুন
জ্বালিয়ে দিন আমার বিষদাঁতের কবিতা
না হলে
অন্তত অস্বীকার করুন যে এটা কবিতা
একুশ
'একুশের ওপর কেন তোমার এতোটা বিশ্বাস,' জিগ্যেস করলাম সুকান্তকে
সুকান্ত
সুকান্ত ভট্টাচার্য
আমার বন্ধু,
'একুশের ওপর কেন তোমার এতো প্যাশান কোলাজ নির্ভরতা?'
'একুশ এক নিষ্কলঙ্ক সকাল,' বললো সুকান্ত,
শুরুরও শুরু আছে
কিন্তু একুশ থেকেই তো আমাদের সত্যিকার নিজেকে চেনা
নিজের দিকে ফেরা
আর অন্ধকার বিস্ময়ের তন্দ্রা মুছে একুশ এক গণগনে তারুন্য
এক আগ্নেয়গিরি
এক সূর্য
বিপুল তরঙ্গে সব হিংসা কলুষ কীটনাশকের শিশি ধুয়ে
ভাসিয়ে নিয়ে যায়
কেবল রয়ে যায় বিনোদিনী দাসীর হারিয়ে যাওয়া আংটি
কৃষ্ণচূড়া ফুলের রক্ত
কল্যাণ
আর হ্যা ভাল করে দেখো তোমার ভেতরেই একুশ
এটাই
এটাই তো ঠিক যে মায়ের গর্ভ থেকে টেনে বের করে এনে
একটা কঙ্কালের ভেতর আমাদের ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে
যেখানে কম্পিউটার আছে দর্জিঘর আছে
আর এতো বড় বড় হাসপাতাল
যে ৫/৭টা সূর্যকে অনায়াসে মেঝেতে গড়িয়ে
টেনে এমাথা-ওমাথা করা যেতে পারে
আমাদের আত্মার সামনে
যা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছে
এর পরের কাজটা তো ডোম আর ডাক্তাররা মিলে করে দেয়
বেসি স্মিথের বোন
তুমি এক নিগ্রো কন্যা
ধরে নাও
বোন
বেসি স্মিথের
তুমি
খুব দূরে নও
তোমার ভিতরে
আমি
না কি
আমার ভিতরে
তুমি
দেখো একদিন অসুখী তারাগুলো
ফিরবে
আমাদের টেবিলে
আর বধির টেবিলটাও সাহস পাবে
নিজেকে দেখার
মহাদেশের বিশাল বিশাল ক্ষত
আর খুঁত
ভবিষ্যৎ কারুশিল্প
সম্মিলন | রহিত ঘোষাল
দহনীয়
এক অবিরাম ঝড় বৃষ্টির রাত,
সব চোখ ক্লান্তিতে নিভে আছে,
তবে সব আগুন এখন কোথায়,
ব্যথা থৈ থৈ,
হই হই বিজলী সঞ্চার,
হে গুরুগম্ভীর গর্জন,
তুমি কখনো দগ্ধ রোদের মধ্যে,
কখনো বা বিকেলের ফাঁকা মাঠে, পথেঘাটে,
ক্রোধ ঢেলে দাও,
পানিতে ভেসে যাও শুকনো ঝরা পাতা,
বিস্ফোরণের মধ্যে এক জন্ম, অমরত্ব,
এসো তোমার ফিনফিনে শাড়িটুকু খুলে নেই,
তোমার নাভিকুণ্ডল মরালনিন্দিত,
তুমি তো জানতে আমি কী ভীষণরকম
দহনীয় ।।
আবহ
কাফনের উপর বৃষ্টি নেমেছে,
গিরিখাত থেকে এসেছে মেঘ,
আমাকে দূর দেশের ট্রেন ধরতে হবে,
অসংশোধিত সময় ছেড়ে
প্রবেশ করতে হবে কালরাত্রির ভেতর,
এই যে ছিনিমিনি খেলা,তৎপুরুষ,
রূপক, ভাসমান হালকা দেহ,
বীজমন্ত্র আবিষ্ট চন্দ্রাংশু,
আমাকে প্রায় দায়শূন্য করে যায়,
পরকীয়া প্রেমের তোড়ার মতো
তীক্ষ্ণধার ....
মৃত্যুর পাঁচালী
মৃত্যু মৃত্যু মৃত্যু
মৃত্যু মৃত্যু মৃত্যু
এভাবে আর কাউকে ভালবাসতে পারিনি,
তোমাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে
মুখ থুবড়ে পড়েছি,
মহাশ্মশান,
এসো আমি এই জীবন সাজিয়েছি,
ঈশ্বর নয়!
ঈশ্বর নয়; তোমাকেই দেবো লবণাক্ত খাদ,
মৃত্যু তুমি আমি একই সূত্রে গাঁথা
মৃত্যু মৃত্যু মৃত্যু মৃত্যু মৃত্যু ।।
কাঁটাগাছ ও গোলাপচারা
চোখ তুলে দেখি তোমার শরীর-
পাথরমূর্তি, তোমার পায়ের তলায় যে সমুদ্র-
হুটোপাটি, জিভে যে চুম্বন,
বালির খেলাঘরের মধ্যে
তুলকালাম সঙ্গম, শীতস্পৃহা,
ভারী হয়ে আসে ঘুমে,
দেয়াল উঠে যায়
ভাগাভাগি হয়ে যায় জ্বালাপোড়া,
বিনুনি থেকে নেমে আসে মীরার ভজন,
নীচু কলকাতা জল জমলে,
একতলা প্রায় ডুবে যায়-
বাল্মীকি উঠে আসে দোতলায়-
বিদ্যুৎ চলে গেলে আঁজলায়
করে দিও খতম লাইন, তক্ষকের গুচ্ছ প্রেম,
উশখুশ পাখিটার পোশাক খুলে যায়,
পোশাকের তলায় গ্রাম, ধানখেত, ঝর্না,
উপশিরা হু-হু করে, খৈনির ডিব্বা খালি,
মরণ ঘনিষ্ঠতা এখন ছয়লাপ।।
সম্মিলন | পিয়াংকী
কবিতা এবং বিক্রয়জাত ঝিনুক
(১)
ভ্রমরের পাশে যদি এসে বসে লাল কাঁকড়া
বৃষ্টি আর একটি স্বস্তিকচিহ্ন যদি ধুয়ে যায় একসাথে
তুমি কি কাঁদবে ?
অবশ্য, কান্নার চেয়েও দরকারী সঠিক পেইনকিলার
সলিউশনে ডুব দেবার ঠিক আগমুহূর্তে -
সমস্ত অধর্মকে জড়িয়ে অজস্র চুমু খেয়েছ সাবলীল...
(২)
সাবলীল সহজ ?
অতশত বুঝি না বলে চুপ থাকি।
ভাঙচুরের থেকে নি:শব্দ ভালো।
তার চেয়েও ভালো নিস্তার
ভাগ্যবানের হাতের তালু কিংবা চাঁদের চিহ্ন -
জনসমক্ষে এলে অধার্মিক
অপবাদ নেই।
বাদ দিতে শিখলে আসামীও ঈশ্বর...
(৩)
এযাবৎ কালের সঞ্চিত সর্বমোট পোখরাজ থেকে যদি খসে পড়ে ঘুঙুরঘর তাহলে ঠাঁই হয় নিজস্ব নদীতে। গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একসময় মানুষও যে গাছ হয়ে যেতে পারে সেই ধারণাটুকু জনসমক্ষে বিলিয়ে দিয়ে কি আদতেও জন্ম দেয়া যায় প্রসবঘরের দেওয়াল ? পাঁচিলের গায়ে এই যে স্যাঁতস্যাঁতে ভোর আর মৎস্য সংগ্রহকারীর হাতের ছাপ, এরা সত্যিই কি মাছ বিক্রির পর নৌকায় করে ভাসিয়ে দেন বর্জ্য আঁশ ?
উঠে এসো। গুটিবসন্ত গায়ে নাও।
(৪)
... অযুত প্রশ্ন ।
লজ্জাবস্ত্রের উদযাপন ।
রুদ্ররূপ তোমার। তুমি সর্বকালজ্ঞ
জটাতে ভরেছ সুপ্তিস্তব
কপাল জুড়ে অঙ্কতিল
ভিতরে অহরহ দৌড়ে বেড়ায় যে চঞ্চল হরিণটি
সে-ই কি সমগ্র?
গাঢ় হচ্ছে ত্রাণ
নাছোড় মায়া
অনাদি অসুখ
সমুদ্র প্রয়োজন। হাত পাতো।
(৫)
গায়ের বালি ঝাড়ার মুহূর্ত। যে বাড়তি ফেনাটুকু বা অতিরিক্ত স্নানজল, বীমা অনুযায়ী এসব দুরারোগ্য ব্যাধি। অভিশপ্ত ঘুম। কাকের পায়ে লেগে থাকা পাপ। কিছুটা দাগীক্ষয় কিছুটা ভষ্ম। চিনলে সঞ্চয় না চিনলে শকুন। সূর্য অস্ত গেল। নিশ্চিন্ত খর্গ। ঘোর গার্হস্থ্য। সংসারী বক।
প্রকাশ্যে সবাই নাবিক। আর নাবিকের থেকে এক ইঞ্চির দূরত্বে প্রত্যেকেই অযোনিসম্ভবা...
আনুপূর্বিক | তৈমুর খান
ব্যক্তিপ্রচ্ছদেই অনন্তের বিনির্মাণ
হাল্কা রোদ্দুরে পিঠ পেতে বসেছি। সকালের চাট্টি ভেজা ভাত খেয়ে কবিতা লিখব। একে তো শীতকাল। সূর্য কুয়াশার ভেতর বাঁশি বাজাচ্ছে। কী সুন্দর হলুদ বাঁশি। আমার চারপাশে গ্রামীণ জীবন। রোদ পোহানো, আগুন পোহানো সকাল। এসবই লিখব। লিখতে লিখতে নগর জীবনের জটিল আনন্দে আমি ঢুকে যাব। আহা, কী সুন্দর আনন্দ! মেয়েরা উড়ছে। উড়তে উড়তে এ ছাত ও ছাত ফুলের টবে টবে ফুটছে। আমি কিছুতেই ওদের ধরার মন্ত্র জানি না। আমি হাঁ করে গ্রামীণ মাটির দাওয়ায় বসে বসে লিখব ওদের।
নিবেদন কত দূর যাবে জানি না, এরকমই একটা সময় পেরিয়ে এসে আমি সেইসব কবিতাদের দেখতে পাই। আমার বদলে কেউ কেউ লিখে দিয়েছে। এই রক্তগঙ্গা বয়ে যাওয়া পৃথিবীতে এখনও কেউ কেউ পিঠ সেঁকে নিচ্ছে সূর্যের আলোয় আর মানবিক কবিতা লিখছে। ভবিষ্যৎ কুয়াশাময় তবু মানবিক সূর্যের বাঁশি শুনতে পাচ্ছে। নগর জীবনের জটিল প্রেমমুখর সময় থেকে গ্রামীণ জীবনের নির্জন ও কোলাহল কবিতায় মিশে যাচ্ছে। আমি তখন সেইসব কবির লেখায়, তাঁদের শব্দবোধে, তাঁদের আত্মিক নিবেদনে ডুবে যাচ্ছি। দুঃখের খই ফুটছে চারপাশে। হাত পেতে বলছি—তাই দাও—। আনন্দের তাকানো একবার দেখতে পেয়ে মনটা ভরে যাচ্ছে। কী সুন্দর চোখের দৃষ্টি। নীল ভুরু। পদ্ম পদ্ম মুখ। মুহূর্তকে ডেকে দেখাচ্ছি। হ্যাঁ, এখনও পৃথিবীর চায়ের দোকানে সুন্দরেরা আড্ডা দিতে আসে। রাজনীতি, ফলানানীতি, তস্যনীতি নিয়ে অনেক আলোচনার ঝড় ওঠে, তার মাঝেও সুন্দর চুপচাপ বসে থাকে। দেখলে মায়া হয়। তার পকেটে বাজারের ফর্দ। এত হৈ চৈ ভিড়ের ভেতরে থেকেও সে 'নতুন লেখা' খোঁজে—
"কীভাবে নতুন লেখা হবে ভাবি, আর
রোদ্দুর ঘুরে যায় ছাতের আলসেতে
দূরের স্টেশনে দেখি সন্ধ্যা নেমে আসে
সাত-পাঁচ ভেবেটেবে একটু বেরোই
কিছু দূরে পৃথিবীর চায়ের দোকান
পাড়ার বখাটে ছেলে, মাস্টার, দালাল...
বামকথা, রামকথা, অর্থকথা ওড়ে
পৃথিবীর ফর্দ ওড়ে বুকের পকেটে”
(পার্থপ্রতিম মজুমদার)
'হয়ত পিয়াল তুমি জান' কাব্যের এই কবিতাটিতেই কবি যে নতুন লেখার কথা বলেন তাঁর জীবন থেকেই নেমে আসা কোনও সকালের কথা। বেলা যাওয়া রাতের অন্ধকার নেমে আসছে। নানা কূটতর্কে এবং বস্তু চাহিদার ফর্দ নিয়ে আমাদের দিন চলে যাচ্ছে। এর মধ্যেই নতুন লেখা যেন নতুন ঈশ্বরের মতো। কেননা প্রকৃত নতুন লেখাতেই মননের উত্তরণ ঘটে। কবি নিজেকেই গড়ে নেন। র্যাঁবো কবেই বলেছিলেন "The poet makes himself a visionary by a long, immense and reasoned derangement of all the senses."
অর্থাৎ সমস্ত ইন্দ্রিয়ের দীর্ঘ, সীমাহীন এবং পদ্ধতিগত বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে একজন কবি নিজেকে স্বপ্নদর্শী করে তোলেন।
সুতরাং কবিদের অন্তর্দৃষ্টি ও বোধের নিরন্তর পরিবর্তনটি ব্যক্তির উপরেই নির্ভর করে। নতুন কবিতার ধারণাটিও তাই স্থির নয়। সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে তা পরিবর্তনশীল। উড়ে বেড়ানো মেয়ের মতোই ছাতে ছাতে কবিতাও উড়ে বেড়ায় – visionary by a long, immense তো এটাই। তা ফুলের টবে ও ঢুকে যায়। আকাশের পাখিও হয়ে যায়।
স্বয়ংক্রিয়তা বা Automatic Writing-ও কবিতা লেখায়। এক ঘোরের মধ্যে কবি চলে যান। তখন সমস্ত বিস্ময়ের পাশে বসে কবি হৃদয় খোলেন। অব্যক্ত কথাগুলি সংকেতের মেঘ, পাখি, নক্ষত্র, জেনাকি, আগুন হয়ে উড়তে থাকে। দু-একটি কথা দারুণ রাগিও হয়। তারা সাপ হয়ে ফণা দোলায়। নির্জনের মাঠে খেলা করে। জীবনানন্দ দাশের অব্যক্ত কথারা, অথবা বাসনারা তো 'ঘোড়া' এবং 'শিয়াল' হয়ে গিয়েছে। এইসবই একজন নতুন কবির কাছে নতুন ভূমিকা। তিনি ভাবেন—
"কীভাবে উন্নতি হবে আমার কবিতা ও গদ্যের;
এই কথা ভাবি আর শুয়ে শুয়ে কলম চালাই।"
(সুকৃতি)
কবি 'নাস্তিকের কাব্য' লিখতে গিয়ে প্রথমেই শুয়ে শুয়ে কলম চালানোর কথা বলেছেন। 'শুয়ে শুয়ে' Automatic Writing-এর-ই ইংগিত দেয়। কবিতার ও গদ্যের উন্নতি অর্থাৎ ভিন্নতা যে এভাবেই সম্ভব তা কবি জানেন। তাই 'বিচ্ছিন্ন চিন্তার নিচে ঢাকা পড়ে থাকেন। জীবন উদোম হয় সমস্ত ডানা খুলে। যেন প্রস্তুতি— "in a way approaching the condition of automatic writing." টি. এস. এলিয়টের এই কথাটি আজও সত্যি। সংকেতে বেজে ওঠা প্রেম, প্রেমের কষ্ট আজও জোরালো করে ধরে কবিতা।
নতুন কবিতা এবং নতুন কবি যেভাবে তাঁদের দৃষ্টি ও পথ পাল্টে নেন, অনুভূতি ও চিত্রকল্পের, ভাষা ও শব্দবোধের প্রয়োগও পাল্টে দেন তা সূক্ষ্ম ব্যাপার। নৈঃশব্দ্যের বাতাবরণে গভীর এক ব্যঞ্জনাময় ভাষাহীন ব্যাখ্যাহীন ঐশ্বর্য যেন বিরাট বিস্ময় নিয়ে দেখা দেয়। 'কবি'র পরিচয় দিতে গিয়ে অরিন্দম নিয়োগী তাঁর 'ভূপাখি ভস্মপাখি' কাব্যে লিখেছেন—
"আজ নৈঃশব্দ্যের শিখর বালি ও ছাই মেখে আছে
লোহা তার পড়ে রয়েছে রোমশ উঠানে
এখানে শ্রাবণ তবু ফিরে ফিরে আসে
বাউলের ভূমিকায়, ঝরে পড়ে চুল
চুলের ভেতর অন্তহীন বসে থাকা, বসে বসে
নির্ভার সিঁড়ির আলো ও ছায়ায় ক্রমশ ডুবে যাওয়া
যে জানে এইসব তন্ত্রের ব্যবহার,অবগাহনের মানে
সেই কবি, তার জন্য বজ্রনিশান,
সমস্ত পিপাসার বোবা আয়োজন"
কবিতাটিতে যে ভাবনার সন্নিবেশ ঘটেছে তা বাস্তবের কোনও সচরাচর বোধ থেকে আসা ভাবনা নয়, তীব্র নৈঃশব্দ্যে ডুবে গেলে যে অন্তর্দৃষ্টি জেগে ওঠে, নিজের যেভাবে ইচ্ছার বিনির্মাণও করে নেওয়া যায় এই তন্ত্রের ব্যবহারের কথা কবি বলেন। তাই ঝরে পড়া চুলের ভেতর অন্তহীন বসে থাকা, নির্ভার সিঁড়ির আলোয় উত্তরণ পাওয়া একজন কবিরই কাজ। তার জন্য বজ্রনিশান এবং সমস্ত পিপাসার বোবা আয়োজন অপেক্ষা করে থাকে। বজ্রনিশান এবং বোবা আয়োজন বিশেষণ দুটিতে আছে পরম বিস্ময় কিন্তু প্রখর এক ব্যাপ্তি, যা জীবন জুড়েই বিরাজ করে। কার্লাইল বলেছেন, "Silence is more eloquent than words." বিবৃতির ভাষণের চেয়ে নীরবতা অনেক বেশি অর্থব্যঞ্জক একথা কবি বোঝেন। তাই নৈঃশব্দ্য নিয়েই তাঁর যাত্রা শুরু হয়। ভূপাখি ভস্মপাখি পার্থিব জীবনেরই নির্জ্ঞান ব্যত্যয়—একথা ভুলে গেলে চলে না।
শীতের রোদ্দুরে চাট্টি ভেজা ভাত খেয়ে যে কুয়াশার বাঁশি শুনতে শুনতে কবিতার কথা ভাবছি সে-তো লেখা হচ্ছে। গ্রামীণজীবন থেকে শহুরে জীবনের অন্বয়গুলি প্রবৃত্তিরেখায় বেজে উঠছে। দৈনন্দিন জীবনচর্চার রুটিনে কিছুটা তফাত থাকলেও রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের স্রোতে সবাই ভাসমান। সেখান থেকেই কিছু মণিমাণিক্য তুলে এনে জীবন সাজাই। সাজো, সাজো জীবন। কবিতা তো এই সজ্জারই বাতাবরণ। বুক ফেটে তখন অর্জুন সিকদার 'প্রতিবাদের লেখাগুলি' ছুঁড়ে দেন আমার কণ্ঠে। কণ্ঠ বেজে ওঠে। হাওয়াও ওঠে। ঘোষণা হয়। যে নীরবতা স্তব্ধতার ধ্যান শেখাত, সেই নীরবতাও সরে গিয়ে আনে মুখরতা, উচ্চকিত ঘোষণা, ঘোষণার আবেদন—
"এস হে বজ্রনির্ঘোষের বসন্ত
একবার অন্তত লালন কর আমাকে
হাতে তুলে নি স্বপ্ন-সময়ের রাইফেল
সেফটি ক্যাচ অন্
পার হয়ে যাই ইতিহাসের চেকপোস্ট।"
বসন্ত বজ্রনির্ঘোষের হলেই তো সমারোহ শুরু হয়। সেখানেই লালিত হতে চাই। কুয়াশায় আছি বলেই তো বসন্তের আকাঙ্ক্ষা। হাতে স্বপ্ন-সময়ের রাইফেল তুলে নিয়ে হতাশা আর বেদনার সঙ্গে লড়াই করা যায়। সামাজিক-রাষ্ট্রনৈতিক অশুভর বিরুদ্ধেও দাঁড়ানো যায়। ইতিহাসের চেকপোস্ট পার হতে হলে তো লং-মার্চ করেই সৈনিক কবিকে পার হতে হবে। চাই উচ্চকিত অনুরাগ দরকার। না হলে তো জীবন সংরাগ ও মুখরিত হবে না। নতুন কবিকে চেকপোস্ট পার হতে দেখি। গতানুগতিক ঔচিত্যবোধ তাঁর থাকবে কেন? সে তো unrestrained।
এভাবেই দেখি ব্যক্তিজীবনের প্রচ্ছদের ভেতর নৈর্ব্যক্তিক জীবনের স্রোত মিশে যাচ্ছে। নিজেরই শীত ও বোদের বাঁশিতে যে জীবনের রূপ দেখেছি সেই জীবনে কত কত কণ্ঠম্বর, কত কত নীরবতা। ভেজা ভাত আর কুয়াশার খাদ্য খেয়েই বসন্তের উন্মুখ ঘোষণা। এভাবেই পরস্পর সময়-ছায়াগুলি হেঁটে গেছে। স্ববিরোধী আলোকে স্তব্ধতা ও মুখরতা বিরাজ করেছে। নিজেকে মনে হয়েছে জীর্ণ, বৃদ্ধ আবার তরুণ যুবকও। জীবন উৎস থেকে পরিণতি আবার পরিণতি থেকেই উৎসমুখে ফিরে এসেছে। শব্দে-ভাবে, কথায়-না-কথায় পেয়েছে মুক্তি। পৃথিবীময় এই মাটির দাওয়ায় বসে বসে দেখি একজন প্রাচীন প্রাজ্ঞ কবিও এই দশকের নির্ণীত তিরন্দাজ হয়ে যান—
….. কত ধ্বনি, জাগে চরাচরে—
কত বার্তা, হয় বিনিময়—
সেই বোঝে, বার্তা যার তরে;
উনজনে, উদাসীন রয়।"
(মন চল নিজ নিকেতনে)
অনির্বাণ ধরিত্রীপুত্র শহরের জটিল বিন্যাসে বসেও নিজ নিকেতনের এভাবেই অন্বেষণ করেন। তখন আমারও বোধ দীপ্ত হয়। এই শীতের সময়ে বার্তা বিনিময় করতে থাকি এক সত্তা থেকে আর এক সত্তায়। অব্যাহত দৌড় শুধু। দৌড়ের মাঝেই এক-একটা ভাবের জগৎ খুলে যায়। আমার মাঝেই আবার আমি জন্মাই। নতুন আমি জেগে উঠি। নতুন কবিকে দেখি। বহু প্রাচীন কবিতার ভেতর দিয়েই যেন নতুন কবিতা উঠে আসে। বিনির্মাণ চলতে থাকে। উৎস ও অনন্তে এই বিনির্মাণ।
কথাচিত্র | মণি ফকির
অঘোষিত - প্রথম অঙ্ক
কে? ওহ্ তুমি!! এতদিন পর হঠাৎ কি মনে করে?
কেন - কিছু মনে না পড়লে আসতে নেই বুঝি?
তা কেন। অবশ্যই আসতে আছে। তোমার জন্য সব সময় আমার অবারিত দ্বার। আশা করি তার প্রমাণ পেয়েছ?
বাজে কথা রাখ। দরজা বন্ধ না করা, পুরনো বদভ্যাস তোমার।
বদভ্যাস গুলো সাধারনত পুরনোই হয়। চা খাবে?
না থাক। এই অসুস্থ শরীরে আর এসব লৌকিকতা করতে হবে না।
বোঝো! আমি কখন বললাম নিজের হাতে চা করে খাওয়াবো? চট করে inference draw এর অভ্যেস টা গেলনা তোমার।
বকবক না করে বিশ্রাম নাও। এত বড় অসুখ টা বাঁধালে কি করে?
অসুখ! কার, আমার?
না আমার ছোট মেসোর। নিজে তো জানাওনি। লোকের মুখে শুনেছি।
বড্ড কঠিন কথা বললে। অসুখ। যাদের নেই, তারা কি সুখে আছে?
এই আঁতেল দার্শনিকতাই তোমার কাল হল। এই অবস্থায় কি লেখালেখি করছ দেখি?
আবার সেই poor observation। খোলা খাতা মানেই কি লেখা? পড়া হতে পারেনা? নিজের পুরনো কিছু লেখা পড়ছিলাম। কাঁচা কিন্তু নিখাদ। কোন আরোপিত বোধ নেই। তোমাকে নিয়ে লেখা অনেক আগের একটা কবিতা পেলাম।
কতদিন আগে?
তাও ধরো, প্রায় আঠারো বছর হয়ে গিয়েছে।
বাজে বোকো না। এতদিন আগে আমাদের পরিচয় ই ছিল না। কি লিখেছ দেখি।
শীতের দুপুরে
পড়ত রোদ এসে
আমার মনের ঘরে।
আজও সে ঘরের জন্য আমার
মনটা কেমন করে।
যে ঘরে প্রথম বিকশিত হল
আমার পুরূষ সত্ত্বা।
আমাকে প্রথম, চুমু খেয়েছিল
নিশ্চুপে সোমদত্তা।।
ইস্। বড্ড wanna be type. সত্ত্বার সাথে দত্তা মেলানো হয়েছে।
Wanna Be মানে।
মানে হতে চাওয়ানো হয়েছে এমন।
আচ্ছা ধর এরকম যদি হত - "যে ঘর আমাকে, দেখেছ যুবক হতে। খুব সাবধানে প্রথম আদর, উষ্ণ ভেজা ঠোটে।"
Much better. বেহতরিন
বোঝো! সোজা লিখলাম, পছন্দ হলনা। ঘুরিয়ে লিখলাম ভালো লাগলো। জান, আমরা না সবাই একটু জটিলতা পছন্দ করি।
প্রেম জিনিসটা ই জটিল - এরম সেকেলে উক্তি আশা কোরোনা। আর এটা যে আঠের আগের বছর আগের লেখা তার প্রমাণ নেই।
তা নেই। চা খাবে?
কে বানাবে?
তুমি বানাবে। এতদিন পড়ে এলে, এটুকু সুযোগ দেবনা?
তুমি মাইরি এক রকমই রয়ে গেলে।
তা বটে। আমার নিজেকে জীবন্ত জীবাশ্ম মনে হয়।
মুক্তপদ্য | ড. সুব্রত চৌধুরী
কঠিন সময় | সহজ পাঠ
লাজুক স্বভাব।
আর তুমি ভাবো এটাই আমার অলঙ্কার। অপলকে তাকিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠো। তবে কি জানো - কেউ তাকিয়ে থাকলে স্বচ্ছন্দে হাঁটতে পারি না। অন্ধকারে অবশ্য দূরন্ত স্মার্টনেস। অজস্র দুর্বোধ্য টার্মিনোলজি তখন মুখের চারপাশে ঘুরতে থাকে। স্পষ্ট নয় অনেক কিছুই নিজের কাছেও। তুমি প্রলুব্ধ হও চেনা পৃথিবীর অচেনা ঘূর্ণনে।
স্মার্ট হতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে পুরুষ হতেও। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জুড়ে পুরুষের লালসা আছে তবে কোথাও যেন সেই পুরুষ মানুষটি নেই। একলা ঘরে দুটো উজ্জ্বল চোখ নিয়ে তোমায় দেখতে ইচ্ছে করে। দেখতে ইচ্ছে করে নারীরূপ মানুষকে। ইচ্ছে হয় দেখি কেমন সে চুম্বকের উদাসীন অঞ্চল - যেথা নেই আকর্ষণ। তবে সেক্স সর্বস্বতার আড়ালে এ সবকিছুই সাময়িক।
ঠিক যেমন তোমার শরীরের স্পর্শে একদম অন্য মানুষ। নিবিড় উষ্ণতায় তখন বুনে যাই স্বপ্নের মায়াজাল। সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ে মনের বেলাভূমিতে। হয়তো তোমার কাছে এসব রোম্যান্টিক! বিমোহিত তুমি ভাবতে ভুলে যাও কঠিন ভবিষ্যৎ আর টিকে থাকার সহজ অ্যাসিওরেন্স। সময় গড়িয়ে প্রশ্রয়ের বিছানায় গভীর হয় মধ্যরাতের অনুভূতি - দুজনেই অসংখ্য উত্তরহীন। ততক্ষণে আদিম আলিঙ্গনে উন্মত্ত সেই পুরুষের যৌবন। কামনার বহ্নিশিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যায় নারীর ব্রহ্মনিষ্ঠ রূপ।
আসলে কি জানো, সব আয়রন সংকল্প কেবল চায়ের দোকানেই। তন্বী যুবতী স্নানঘরে গেলেই ভালো থাকার অঙ্গীকারগুলো ডিলিটেড হয়ে যায়। ভিড়বাসে মহিলার সান্নিধ্য বারবার নিজের অধিকারকে ভুলিয়ে দেয়। আর তুমি ভাবো ডিসক্রিমিনেশন করা ঠিক নয়। আমার গাঢ় অন্ধকার তোমার চোখে নিছক কম আলো। নিঃশব্দে নিরন্তর উড়েই চলে পাশবিক পুরুষের নিশান। বুঝতে পেরেও তুমি ভাবো - ঠিক শুধরে দেবে। বলবে - ভেবো না কিছু, ইনফ্রাস্ট্রাকচার তো আছে! বিষাদের কঠিন খোলস একদিন সাবলাইম করবেই। গভীর সংকটেও তাই মায়াবী আলোর ইমোশন। স্লাগিশ মাদকতায় আচ্ছন্ন হয়েও গুডবয় হয়ে বেঁচে থাকার হাতছানি। অবক্ষয়ের ক্যানসার শরীরে নিয়ে তাই আজ তোমার " থিওরিজ অব বেটার লিভিং " এর স্রোতা।
তবে মিথ্যের আশ্রয়গুলো ভুলি কি করে! ওদের জন্যই তো আজ 'ভালো পৃথিবী' দেখার স্বপ্নে ভাসতে চলেছি। চোখ ঠিক খুঁজে নেবে লুকোনো অলিন্দে ফ্রেমবন্দি নিষিদ্ধ ভুবনের কোলাজ।
স্মৃতির দুয়ারে | শর্মিষ্ঠা ঘোষ
কুলিকপারের বৃত্তান্ত
আমি তো আজীবন কুলিক পারের কন্যা । যতবার স্মৃতির চড়া সম্ভবনা তারও বেশিবার প্লাবন। সূর্য ঢলে পড়ল জলে। চিকচিকালো কত অমলিন স্মৃতি । জলে নেয়ে উঠে তর্পণ করি প্রিয়জনের । এক আঁজলা জল নয় সে আমার হৃদি বৃন্দাবন। শহর চিরে গুমগুমে ধোঁয়া ওঠা কয়লার ইঞ্জিন ন্যারোগেজ রেল থেকে আজকের দুখানা প্ল্যাটফর্ম আর গোটা 2 এক্সপ্রেস। তাতে কারা চলে যায় শহর ছেড়ে । আমি বসে বসে দেখি । এক জীবনের গল্পের উপর ভিড় জমায় দ্বিতীয় তৃতীয় জীবনের গল্প। আমার পুনর্জন্ম সব। সময় শ্লথ করেছে এ শরীর। ছুঁতে পারেনি মন। রোদে জলে বিবর্ণ খোলস । মনটি দুরন্ত প্রজাপতি।
বেড়ে ওঠার পথে সময়ের সাথে বসবাস না বদলালে পাললিক স্মৃতি রয়ে যায়। জন্ম-কর্ম বেড়ে ওঠা একঠাঁই হলে সবকিছুই কন্ঠস্থ সেই শহরের। সে আমার সমস্ত বিচলন মুহূর্ত। সাফল্য বোকামি ভয় ভুল পাপ। স্মৃতি আর আমি পাশাপাশি বসি। চুলে পাক। চামড়ায় ফাটল । স্মৃতিরা ঝাঁ চকচকে। টগবগে তরুণ । উচ্ছল কিশোর । টিনেজ প্রেম । ইনফ্যাচুয়েশান। গোপন ক্রাশ । তারা পিটার প্যান। কত পুরনো চিঠি হারিয়ে গেছে । প্রথম প্রেমের রক্তে লেখা চিঠিটাও। পুড়িয়ে ফেলেছি আবেগী ডায়েরি। তারপরও স্মৃতি ছাড়ে না। যাদের জড়িয়ে স্মৃতি হয়তো তাদের মনে নেই আমিই শুধু বসে আছি স্মৃতি আঁকড়ে। নিতান্ত অকেজো। ব্যর্থ বুড়ো ভাম। বয়সের সাথে সাথে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্মৃতি বেশি করে আঁকড়ে ধরছি ।
উত্তর দিনাজপুর জেলা ঘোষণা এবং রায়গঞ্জ জেলা শহর হয়ে ওঠা দুটো ঘটনাই আমার কৈশোরের | চারপাশে একগাদা মণিমুক্তো নিয়ে বাস করতুম কিন্তু কোন হুঁশ ছিল না। যখন অনেকেই আর নেই, আমিও পরিণত তখন মনে হয় আরো খানিকটা মনোযোগ, সম্ভ্রমের দাবীদার ছিলেন বুঝি তাঁরা। গেঁয়ো যোগী টাইপ ব্যাপার। শক্তি চট্টোপাধ্যায় রায়গঞ্জকে কবিতার শহর বলেছিলেন। আমার দেখা প্রথম রক্তমাংসের কবি ও সম্পাদক বাবার কাজিন তপন কিরণ রায় | চিরকুমার এই জেঠু সাদা ধবধবে পাজামা পাঞ্জাবি পরে কাঁধে একটি ঝোলাব্যাগ নিয়ে বিজয়ায় আমার আম্মা অর্থাৎ তাঁর মাসিকে প্রণাম করতে এবং কখনো সখনো এমনিই আমাদের কুশল খবর নেবার জন্য আসতেন | অতি অমায়িক | তার সম্পাদিত "অভিযান" পত্রিকা দিতেন আম্মাকে। আম্মা ছিলেন নিবিড় পাঠক। দুপুরে খেয়ে একটা বই বা ম্যাগাজিন নিয়ে শুতে যেতেন। তখন জানতামই না পূর্ণেন্দু পত্রী অমিতাভ দাশগুপ্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় তারাপদ রায় হর্ষ দত্ত অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়রা এই জেঠুর বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন বহুবার | এসেছিলেন সমরেশ বসুও। আত্মীয় মহলের বাইরে ছোটবেলায় আরেক কবি দেখলুম নীরদ রায়কে | বাবার কলিগ আমার কাকু | বই বেরলে বাবাকে নাম লিখে গিফ্ট করতেন। সেটা চলে আসত আমার দখলে | তখন তিনি "দেশ"এ লিখছেন নিয়মিত। আমি যখন ক্লাস টেনে পড়তাম কাকু "আনন্দমেলা"র হয়ে আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলেন | গার্লসে পড়তে পেলাম সুনন্দা ম্যামকে | তখনো এত বুঝতাম না যে তিনিই প্রখ্যাত কবি সম্পাদক সুনন্দা গোস্বামী | নিয়মিত উত্তরবঙ্গ সংবাদে তার গল্প কবিতা বের হয়। পরে অনেক পরে ম্যামের ম্যাগাজিন "চৈতন্য"তে লিখতে লিখতে একদিন ঠাঁই পেয়ে যাব এর সম্পাদকমন্ডলীতে | ম্যামের সূত্রে পরিচয় হবে গল্পকার সম্পাদক কমলেশ গোস্বামীর সাথে। যার স্নেহ আমায় নিয়ে যায় আকাশবানী শিলিগুড়ির "প্রান্তিক" অনুষ্ঠানে। রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজে পাওয়া ব্রততী ম্যামই যে বিখ্যাত কবি ও সম্পাদক "উত্তরবঙ্গের প্রগতি" পত্রিকার তখন সেসব আলাদা করে ভেবেও দেখিনি | কতদিন পর যখন লিখলাম ম্যামের ম্যাগাজিনে চিনলাম বিখ্যাত ছড়াকার চিত্রশিল্পী প্রাবন্ধিক দিলীপ ঘোষ রায় মহাশয়কেও যিনি আমায় দেখলেই বাবার খোঁজ নিতেন, বলতেন , " একবার যাব তোমার বাবার সাথে গল্প করতে | বাংলাদেশে একই জায়গায় বাড়ি ছিল আমাদের |" বিখ্যাত গল্পকার ঔপন্যাসিক দেবেশকান্তি চক্রবর্তী বাবার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, তার অকাল প্রয়াত দাদা বাবার সহপাঠী ছিলেন। ক্লাসমেট লোপার বাবা কবি কান্তি সিংহের জুতোর দোকানে বসত সুপ্রাচীন শনিবারের সাহিত্য বাসর । সে আড্ডা ৫৫০ পেরিয়ে গেছে । বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ডাক্তার বৃন্দাবন চন্দ্র বাগচী দীপাবলী উৎসব এ আমার হাতে স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতার পুরস্কার তুলে দিয়ে যে আড্ডায় আমায় যেতে বলবেন কিন্তু স্বভাবদোষে যাওয়া হয়ে উঠবে না। আরও ছিলেন জীবেশ দাস, আমার ক্লাসমেট পামেলার বাবা। সকলেই কমবেশি যুক্ত ছিলেন রায়গঞ্জ ইনস্টিটিউট এর সাথেও তৎকালীন সাংস্কৃতিক পীঠস্থান বলা যায় যাকে। এখানকার গ্রন্থাগারের সদস্য ছিলেন আমার জেঠু। জেঠুর আনা বই এর প্রথম পাঠক আমি। "মৃচ্ছকটিক" বা "এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া " প্রাইমারি স্টুডেন্ট আমার নাগালের বাইরে রাখা হত। চুরি করে পড়তুম ।
এখন বদলে গেছে শহর। জোনাকির ঝোপ সাফ হয়ে উঠেছে বাড়ি । ডাহুকের জলা খেয়ে ফেলেছে জমি হাঙরে । চু কিতকিত কাবাডি কাবাডি মাঠ জমি নেই । নেই রাঙাজেঠুর কাছে সাইকেল শেখার মাঠটাও । কাটা পড়েছে চেনা মহীরুহ। জাহাজ বাড়ি জজ বাড়ি অতীত । এজমালি বাড়ি ভেঙে আবাসন । রঙ আর ডিজাইনের বাহার। উঠোন গন। লাউমাচা গোয়ালঘরও । পুরনো কত মানুষ শহর ছেড়েছে। অর্ধেক শহর নতুন মানুষে ভর্তি। বাকি অর্ধেকের অনেকেই তৃতীয় প্রজন্ম। কেউ চলৎশক্তিহীন। অসুখ অসুখ গন্ধ। কষ্ট হয় । নতুন মাল্টিপ্লেক্স। যে সিনেমা হলগুলোতে এক সময় গানবাজনা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সিনেমা দেখেছি বন্ধ হয়েছে তারাও। অলিতে গলিতে নতুন দোকান। আলোয় বিজ্ঞাপনে ঢেকেছে রাস্তা। চেনা দোকানপাট লোকেশান বদলে যায়। বদলে যায় মালিক কর্মচারী। বদলে যায় ডাক । আমাকে ডাক নামে ডাকার মতো বেশি লোক নেই। স্মৃতিতে শুনি প্রিয় ডাকগুলো। "ঐ মহাসিন্ধুর ওপার থেকে" আসা ডাকে এক নিশি পাওয়া প্রাণ গোলকধাঁধায় যেন ঘুরে বেড়াই ।
ডাকঘর | অদিতি সেনগুপ্ত
অর্নিদেশের চিঠি
বাপি,
জানি এ চিঠি পাঠানোর কোনও ঠিকানা হয় না। কিন্তু কি জানো তো আমি বিশ্বাস করি সন্তান হচ্ছে শিকড়ের মত, মাটির সঙ্গে যার যোগ অনেক গভীরে নিহিত থাকে। তাই আমার এই না পাঠানো চিঠিও তুমি ঠিকই পড়ে ফেলবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। জানোতো মা ইদানিং তোমার ছবির সঙ্গে ঝগড়া করছে! আমিই বলেছি মা কে তোমার যা যা বলতে ইচ্ছে করে তোমার বরকে, তুমি এই ছবির ভদ্রলোককেই বলে দিও নির্দ্বিধায়। আর জানোই তো মা আমার কথা একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে। কতবার তো এই নিয়েও তোমাদের মধ্যে ঝগড়াও বেঁধেছে যে, আমি যদি বলি সূর্য আজকাল পশ্চিমে উঠছে মা সেটাই সত্যি বলে মেনে নেবে। সেদিন শুনছি মা বলছে, "পরের জন্মে কিন্তু আমার এই গোটা পরিবারটাই চাই! একজনেরও বিকল্প চলবে না..."
এখনও অনেকেই জানেনা তোমার শারীরিক চলে যাওয়ার খবরটা। যত কম জন জানে ততই আমার ভালো। আসলে কী জানো যারা এখনও জানেনা তোমার শরীরের না থাকার খবরটা, তাদের কাছে তো এখনও তুমি পূর্ণাবয়বে জীবন্ত আর এই ভাবনাটাই আমার ভেতর থেকে তৃপ্তি দেয় যে অনেকের মস্তিষ্কে আজও তুমি একইভাবে ওই ঘরটায় বসে ছাত্র পড়াচ্ছো। আসলে আমার মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষেই তুমি ভীষণভাবে জীবন্ত। 'বাবা' মেয়েদের জীবনে একটা অতিরিক্ত ভালোবাসার জায়গা সেটা বৈজ্ঞানিক সত্য। কিন্তু আমার জীবনে মা থাকা সত্ত্বেও তোমার অস্তিত্ব বাবার সঙ্গে সঙ্গে মা হিসেবেও কিছু কম ছিল না। নিজের হাতে পরিপাটি করে সাজিয়ে তুলতে তুমি তোমার আত্মজাকে। এখনও বড় ইচ্ছে করে সেই ছোটবেলার মতো একহাতে গাল টিপে আরেকহাতে চুল আঁচরে দাও তুমি। ছোট থেকেই আমি একটু বেশিই অনুভূতিপ্রবণ। সেই যেবার তোমার কারখানার গেটে তালা ঝুলল, পুজোর সময় একটিবারও বলিনি একটা নতুন জামা কিনে দেবার জন্য। আমি ঘুমিয়ে পড়েছি ভেবে তুমি মাকে বলেছিলে, "কত বোঝদার দেখেছো আমার ডোডোতাতাই!" বলতে বলতে তোমার গলার স্বরে এক আশ্চর্য আলো ফুটে উঠেছিল। তুলোয় মোড়ানো আঙুর ফলের মত আগলে রেখেছো সর্বদাই। কিন্তু হিসেব মেলেনি শেষমেশ। এটা বুঝি যে আমার কঠিন জীবন যুদ্ধ তোমাকে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত অহর্নিশ বিদ্ধ করেছে। তবে কী জানো তো বাপি, আগুনের ওপরে হাঁটতে হাঁটতে আজ আর কোনো আঁচই পোড়ায় না আমায়। শুধু দিনের শেষে ঘরে ফেরার উৎসাহটা চলে গেছে। খেতেও ইচ্ছে হয় না তেমন! কী করেই বা হবে বলো, এখন তো কেউ সাত দিনে সাতরকম বাজার করে খাওয়ায় না আমাকে। "মাছটা কেমন ছিল রে" চোখে এই জিজ্ঞাসা নিয়ে, আর কেউ খাওয়ার সময় দরজার কোন থেকে উঁকিও দেয়না। জানি আগামীর চলাটা আরও কঠিন হলো! তবুও আমি থামব না। মনের ভেতরের তুমিটাই আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে নিরুদ্দেশের অন্তহীণ যাত্রায়...
নির্ভার হয়ে ভালো থেকো তুমি...
তোমার
ডোডো-তাতাই
গল্পাণু | পীযূষ কান্তি সরকার
পরীক্ষা বিপর্যয়
রিপোর্ট-এ চোখ বুলিয়ে ডক্টর বোস সাময়িকভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন। চশমা খুলে টেবিলের ওপর রেখে মুখ-চোখ রুমাল দিয়ে মুছে নিলেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে প্রসূনের দিকে তাকিয়ে বললেন, "লিভার-সিরোসিসেরও মেডিসিন আছে। তবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ব্লাড টেস্ট আর এণ্ডোস্কপি করতে হবে। আপাতত একটা মেডিসিন দেব। মাসতিনেক খেয়ে যান।"
বন্ধুর কথায় নতুন একটা টেস্টল্যাব-এ প্রসূন লিভারের ফাইব্রোস্ক্যান করিয়েছিল। সেখানের রিপোর্ট পেয়েই ডক্টর বোসের কাছে ছুটে এসেছিল সে।
পরপর কয়েকজনের এণ্ডোস্কপি করার আধঘণ্টা পর ফ্রেশ হয়ে চেম্বারে ফিরে এসে ডক্টর সব কয়টি রিপোর্ট সামনে রেখে মিলিয়ে দেখলেন। তারপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, "কই আপনার লিভার সিরোসিসের 'স' ও তো দেখতে পাচ্ছি না।"
রসবেদন | সঞ্জয় ঘোষাল
নাসিকা গর্জন
ঘর ৎ ঘ ঘরোত ঘৎ.. ঘ…… ঘর ৎ ঘ ঘরোত ঘৎঘ !!
উরিবাবা রে বাবা ! কি নাক ডাকা রে বাবা ! তড়বড় করে দুটি ঠ্যাং ছিটকে উঠে বসলুম - একটু ঘুমাবার জো নেই !!
সবে রাতের ঘুমটা লেগেছিলো - দিল ব্যাটা ভাঙিয়ে। যেন ডবল ইঞ্জিনের- ডবল ডেকার বাস চলছে।
আর দাদা বলবেন নি ! গিয়েছিলুম একটু অফিসের কাজে এক কলিগের সাথে - রাতে ব্যাটা যা ব্যাটিং করলো পুরো রাতটা কাবার করে দিল মাইরি !
সকালে মহাশয়কে বললাম রাতের অভিজ্ঞতা -উনি তো ব্যাপারটা গায়েই নিলে না। মহাশয় বোধহয় তক্কে তক্কে ছিল - পরেরদিন রাতে ঘুমাবার ভাণ করে পড়ে ছিল - যেই আমি ঘুমিয়েছি ব্যাটা পুরো দশ মিনিটের ভিডিও করে ছড়িয়ে দিলো মাইরি !!
সকালে আমার ঘুম ভাঙলো একটা মেসেজ নোটিফিকেশনে - দেখলুম আমার নাসিকা গর্জনের ভিডিওটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে তারই একটি নোটিফিকেশন এসেছে - আমার নাসিকা গর্জনের তরঙ্গিত প্রবাহের ঢেউয়ে আমার আল্হাদের নধর ভুঁড়িটা উঠছে আর নামছে, কি তার নাচন !! নিজেই নিজেকে দেখে লজ্জা পেলুম -তারপর থেকে আমি এক্কেবারে স্পিকটি নট এই ব্যপারে যতই প্রলয় হয়ে যাক না কেন আমি আর কাউকে নাসিকা গর্জন নিয়ে চুলকাব না !! নো নেভার !!
আমার নাসিকা গর্জন নিয়ে আমার বন্ধুমহলে ও পরিবারে বেশ সুনাম আছে। একবার তো শীতের মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে দেখি আমার অর্ধাঙ্গিনী বিছানায় নেই---- হাওয়া - গেল কোথায় রে বাবা !! দরজা বন্ধ গেল কোথায় ?
দেখি ম্যাডাম কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে খাটের তলায়- কি কান্ড বলুন তো ??
অনেক চেষ্টা করেছি আমার এই সুঅভ্যাসটাকে যদি চেঞ্জ করা যায় একবার তো চুলের ক্লিপ নাকে ঠেসে লাগিয়েছিলুম মানে ট্রাই করেছিলুম আর কি ! নিঃস্বাসটাই বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল - এক্কেবারে যাই যাই অবস্থা।
নাকের মধ্যে বেশ কয়েকবার লিকুইড মেডিসিন চালান করে দিয়েছি কিন্তু তা গলে গিয়ে গলা দিয়ে পাকস্থলীতে পৌঁছে আমার হজম শক্তি বাড়িয়ে তুলেছে কাজ কিছু হয়নি - ভেবেছি এবার অম্বল হলে ডাইজিনের বদলে এটাই সবাইকে প্রেসক্রাইভ করব –
যাইহোক দাদা এই গরমে এইভাবেই চলে যাচ্ছে !!
এখন এই রোগ নিরাময় করতে না পেরে আমি আমার নাসিকা গর্জন নিয়ে বেশ অহংকার বোধ করি। কোথাও এই রকম কোনো - মানে এই - নাসিকা গর্জনের -প্রতিযোগিতার কথা জানা থাকলে, জানাবেন প্লিজ।।
একবার ট্রাই করবো -- মনে থাকবে তো ??
উপন্যাস | শুভাঞ্জন চট্টোপাধ্যায়
বসতভিটা
পর্ব- ১
তারাপীঠ ধাম দর্শনের কথা ছিল সেই দিনই। সে আর হল না। রবীন্দ্র প্রান্তরে হাতড়ে বেড়ানো বোলপুর শান্তিনিকেতনের প্রাণময়তা টুকু সম্বল করে রামপুরহাট স্টেশনে যখন এসে পৌঁছলাম সন্ধ্যার ছায়া তখন বেশ দীর্ঘ।
নভেম্বর মাসের শেষ দিক। লেপ, কম্বলের সময় না এলেও হাওয়াটা আমাদের ওদিককার চেয়ে বেশ খানিকটা শিরশিরে। হালকা র্যাপারের মতো গায়ে জড়ানো শীতের আগমন বার্তা।
প্ল্যাটফর্মে মানুষ জন বেশ কম। ট্রেন আসার সাথে সাথে আমাদের মতো যাত্রী কজন নামলো বটে, আবার নিমেষে কে কোথায় মিলিয়েও গেল হেমন্তের চুপচাপ চলে যাওয়ার মতো।
ফাঁকা স্টেশন চত্বরের একটা বেঞ্চে বসে আমরা স্থির করে নিলাম এখন এত দেরী করে তারাপীঠের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে আর লাভ নেই।
রাখাল মানে আমার ছেলের মেসোশ্বশুর… সে এই বীরভূমের লোক। মূলত তারই উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় ছেলের বিয়ের ছমাস পর বেয়াই-বেয়ান, তস্য বেয়াই মিলে সপরিবারে আমাদের এই বীরভূমের মাটিতে পা দেওয়া। রাখাল অনেকদিন ধরেই বলে আসছিল “আমাদের বাড়ি কবে যাবেন তাহলে? শীত আসছে... কালিপুজোর পর চলুন ওই সময়টাতে ঘুরে আসি...আমার তো এবার আর পুজোতে বাড়ি যাওয়া হল না...সবাই মিলে তাহলে চলুন না...তারাপীঠ দর্শনও হয়ে যাবে, আমাদের বাড়িটা দেখে আসাও হয়ে যাবে...তার আগে বিকেল বিকেল বোলপুর...শান্তিনিকেতন....কি দাদা, তাহলে মা তারা এক্সপ্রেসে টিকিট কাটবো নাকি?”
আমার বেয়াই মশাইটি তো এককথায় রাজি।
“কাটো কাটো...কালই অনলাইনে বুকিং করে নাও...কি দাদা, একসাথে সবাই মিলে ঘুরে আসা যাবে কী বলেন? ছেলে মেয়ে ওরা ওদের মতো না হয় ঘুরবে বেড়াবে...গ্রামের দৃশ্য দেখবে...রাখাল এত করে যখন বলে তখন সক্কলে মিলে চলুন ওর বাড়িটা একবার দেখেই আসা যাক...যাবার মধ্যে আমিই শুধু একবার যা গেছি...সে কি আজকে...রাখালের বিয়ের সম্বন্ধের কথা বলতে...মাসীমা মানে ওর মায়ের আতিথেয়তা বড় ভালো লেগেছিল..!”
রাখাল যোগ করে... “দুশো বছরের বোধহয় বেশিই হবে আমাদের দেখুরিয়ার বাড়ির কালিপুজোর বয়স...প্রত্যেক বছর পাঁঠা বলি দেওয়া হয়...গতবছর নিয়ে এসেছিলাম মনে নেই?”
আমার বারো বছরের ছোট বেয়াই মশাই যাকে বলে একেবারে একইসাথে বন্ধুস্থানীয় ও ভ্রাতৃস্থানীয়, তাই জহর নামেই সম্বোধন করি আমি, সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “পুজোর সেই মাংস...কেমন খেয়েছিলেন দাদা?”
“ওই যে সেই...নিরামিষ মাংস...ওর মাহাত্ম্যই আলাদা..!”
রাখাল বলে, “দাদুর মুখে শুনেছি স্বয়ং বামাখ্যাপা আমাদের বসতভিটায় পা রেখেছিলেন…তখন থেকেই কালিপুজোর শুরু…কাপালিকের বংশধর ছিল আমাদের কোন এক পূর্বপুরুষ... নরবলি দিত...সে অনেক পুরোনো কথা....একটা রামদা আছে মন্দিরে...ওটা দিয়েই এতবছর ধরে বলিপ্রথা হয়ে আসছে....লাল শালুর কাপড় জড়ানো অবস্থায় মন্দিরে মায়ের পাশে রাখা থাকে...ও বহু পুরোনো রামদা...কত পুরোনো বাবাও ঠিক জানতেন না...বংশে রয়ে গেছে এই অবধি....হয়তো ওই রামদা দিয়েই এককালে নরবলি হত....খুব জাগ্রত...বলতে পারেন আমাদের রায় বংশের ওটা একটা সম্পদ...তবে যখনকার জিনিসই হোক, আড়াইশো বছরের বেশি বৈ কম নয় ওর বয়স...এটুকু বাবা শুনেছিলেন দাদুর মুখে....দেখুরিয়া গ্রাম তখন বেশিটাই ঘন জঙ্গলে ভরা...দিনমানে শিয়াল ডাকতো...কোনো কোনো সময় হয়তো বাঘেরও দেখা পাওয়া যেত...অজয় নদী দিয়ে সাঁতরে ভেসে আসতো....তারাপীঠের মহাশ্মশান থেকে, পথ পেরিয়ে, নদীর তীর বরাবর জঙ্গল ধরে কোথাও একটা যাচ্ছিলেন খ্যাপা বাবা...পথমধ্যে কোনো কারণে আমাদের আড়াই শো বছরের সে বসতভিটায় পদধূলি পড়েছিল তাঁর শ্রীচরণের....ওঁর মতো সিদ্ধাচারীর সেই পদধূলিকে স্মরণে রাখতেই প্রথম শুরু হলো মায়ের পুজো....বলি দান... আড়াইশো বছর আগেকার সে মন্দির ছিল মাটির মন্দির...এখন যে মন্দিরে পুজো হয় সেও মাটির...তবে অনেক পরেকার...দুশো আড়াইশো বছরের কোনো চিহ্ন আজ আর কোথাও নেই... আছে কেবল ওই শানানো রামদাটা...কত যুগ পেরিয়ে গেছে...কত বলি যে হয়েছে ওতে...প্রতি বছর পুজোর দিন সন্ধ্যায় রেওয়াজি খাসিকে জল আর ঘি দিয়ে স্নান করিয়ে,কপালে সিঁদুর দিয়ে, মায়ের চরণে উৎসর্গ করে তারপর হাঁড়িকাঠে পাঠানো হয়...কত লোক যে আসে পুজো দেখতে...গ্রামের সুপ্রাচীন পুজো কিনা...তারওপর খ্যাপা বাবার মহিমা বলে কথা...আমার দুই ভাই বেঁচে থাকলে আরো কত বড় করে পুজো দিত...নেহাৎ অকালে ছেলে দুটো চলে গেল...এখন পুজোতে বাড়ি গেলে মনে হয়, কোথায় যেন আনন্দের একটা ভাঁটা পড়েছে...আচার উপাচার,লোক সমাগম সবই আছে...তবু কোথায় যেন কি একটা নেই...বড় খারাপ লাগে...পুজোর ঐ সময়টা ভাই দুটোর জন্য মনটা খাঁ খাঁ করে... গত কদিন ধরেই বুকের ভেতরটা বড় যাই যাই করছে...তাহলে কালই টিকিট বুক করে ফেলি কি বলেন? নভেম্বরের এই সিজনটাও বেশ ভালো...দিদি তো কতদিন থেকে বলেন তারাপীঠ দর্শনের কথা...নতুন বেয়াই বেয়ানকে নিয়ে চলুন সদলবলে ঘুরে আসি...”
রাখালের সম্পর্কিত দিদি মানে আমার বেয়ান রমা, সে আবার বড়ই ঠাকুর ভক্ত। নতুন জামাইকে নিয়ে সপরিবারে সাধনপীঠ দর্শনের এমন সুযোগ সেও হাতছাড়া করতে রাজি নয়।
নৈহাটি স্টেশন থেকে ভোরবেলা মা তারা এক্সপ্রেস ধরে শনি-রবি দুদিনের জন্য বেরিয়েই পড়লাম রাখালের কথায় 'সদলবলে।'
রামপুরহাট স্টেশনের কাছে হোটেল বা লজ বুকিং করে পরদিন ভোর থাকতে সবাই মিলে তারাপীঠ রওনা দেবো...পরিকল্পনাটা বাতিল করতে হল মূলত রাখালের অনুরোধেই। এখান থেকে রিক্সা করে দেখুরিয়ার বাড়িতে আজ আমাদের না নিয়ে গিয়ে সে কিছুতেই ছাড়বে না। ওখানে রাত্তিরটা থেকে পরেরদিন ভোরে তারাপীঠ মন্দিরে পুজো দিয়ে হোটেলে খেয়েদেয়ে দিব্যি বাড়ি ফিরে আসা যাবে। তাদের পরিবারের এক দুসম্পর্কের আত্নীয় মন্দিরের সেবায়েত। রাখাল তার জ্যাঠতুতো দাদাকে দিয়ে সেই লোকটিকে আমাদের আসার কথা বলেও রেখেছে।
“চলুন দাদা… তিনটে রিকশা নিলেই হয়ে যাবে...।”
বললো রাখাল।
“তোমাদের বাড়ি..! এখন এই অসময়ে...না, না… সে কালকে পুজো দিয়ে একবার ঘুরে আসা যাবেখন...”
অসহিষ্ণুতার সঙ্গে বলে উঠলো আমার বেয়ান অর্থাৎ বোনের মতো বয়সী রমা।
“কাল আর কখনই বা যাবেন দিদি...” খানিকটা বিমর্ষ হয়ে গেল রাখালের মুখখানা যেন… “তারাপীঠে পুজো… তারপর ফেরবার তাড়া...একবার তারাপীঠ পৌঁছোলে সেখান থেকে দেখুরিয়া গ্রাম...অনেক সময়ের ব্যাপার…আর তাহলে কাল বাড়ি ফেরাই হবে না...আমার পরশুদিন অফিস...যে করেই হোক কাল ফিরতে না পারলে..!”
রমার ছোট বোন মানে রাখালের স্ত্রী… সেও আজ রাত্রে তার গ্রামের শ্বশুর বাড়িতে সকলকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল।
“তাহলে সেটাই বরং ভালো হয়...আজ রাতটা অন্য কোথাও না থেকে রাখালদের বাড়িতেই না হয়…”
কথাটা বলে আমি আমার বেয়াই য়ের দিকে তাকিয়ে আস্তে স্বরে বলি, “ছেলেটা যখন এত করে বলছে..অসুবিধে তো কিছু নেই…”
কিরকম যেন অসহিষ্ণু ভাবে আমার সামনে এসে চাপা কন্ঠে রমা বলে, “নীলিমা মানে আমার ছোট বোন যে কবার ওদের বাড়ি এসে রাত কাটিয়েছে...ফিরে এসে জানেন কী বলেছে? বলেছে, --দিনের বেলায় কিংবা পুজো পার্বনে লোক সমাগমের মাঝে একরকম করে কেটে যায়...কিছু বোঝা যায় না... অন্য সময় রাত-বিরেতে বুকের ভেতরটা কিরকম ভার হয়ে আসে...গা ছমছম করে...থাকার মধ্যে ওই তো তিনটে প্রাণী...ছোটো দ্যাওরের বিধবা বউ..ছেলে...সেও তো প্রায় থাকেই না...নিজের কাজকম্ম নিয়ে ব্যস্ত…আর ওই বুড়ি শাশুড়ী...ওরা ওই পরিবেশে থেকে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে... তাই হয়তো কিছু মনে হয় না... এসব কথা বলতে তো আর পারি না কাউকে... কখন সকাল হবে আর পালাবো এই অপেক্ষায় রাত জেগে থাকি... দু চোখের পাতা এক করতে পারি না...কি জানি হয়তো আমারই সব মনের ভয়...যদি তা ই হয় তাহলে আমিই বা কি করবো...--
বলুন দাদা, এসব কথা শুনলে তারপর রাতে ওই বাড়িতে কখনো থাকতে ইচ্ছা করে? দু দুটো জোয়ান মদ্দ ছেলে অপঘাতে শেষ হয়ে গেল... কতদিনই বা হয়েছে...পিন্ড দান করেছে কি করেনি কে জানে… সাধে কি আর এখন ও বাড়িতে না যেতে চাইছি দাদা... আপনি তো জানেন, আপনার বউমার প্রকৃতি... মেয়েটা আমার একেই ভীতু...নতুন বিয়ে হয়েছে ওদের...মন্ত্রপুত তাবিজ মাদুলি রয়েছে....কোন ভরসায় যাবো..যেতে মন চায় কখনো...নীলিমা এখন মুখে যতই বলুক, --সকলে একসাথে যাচ্ছি, কোনো অসুবিধে হবে না... বাড়িতে ওদের বলা আছে আগে থেকে...আসছি শুনলে আনন্দই পাবে ওরা…--
আনন্দ পাবে…অসুবিধে হবে না...সব না হয় বুঝলাম...বেড়াতে এসে মেয়েটা আমার কোনো কারণে যদি ভয়টয় পায়...যেখানে তুই নিজেই স্বামী আর মেয়েকে নিয়ে একরাতের বেশি থাকতে পারতিস না.... ভাবুন একবার..কেন, পরে কি ঘুরে আসা যেত না...”
“এসব অহেতুক ভাবনার কোনো ভিত্তি আছে দেখুন তো দাদা..! যেমন তোমার বোন তেমন তুমি...এসব কথা রাখাল শুনতে পেলে বেচারী কি ভাববে..!”
পাশে দাঁড়িয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে জহর।
একটু হেসে বললাম, “আরে আমরা তো যাচ্ছি সবাই....গল্প করে দিব্যি রাত কাটিয়ে দেওয়া যাবে...”
রাখালের দুই তরতাজা ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনা এর আগে একদিন জহরের মুখেই শুনেছি আমি। বড় ভাই রেল লাইন পেরোতে গিয়ে নলহাটির কাছে বিভৎস ভাবে ট্রেনে কাটা পড়ে। তার বছর খানেকের মাথায় রাখালদের বাড়ির কালিপুজোর পরেরদিনের বাসি খিচুড়িপ্রসাদ খেয়ে বিষক্রিয়া জনিত কারণে আন্ত্রিক রোগে আকস্মিক ভাবে মারা যায় ছোট ভাইটি।
...”মর্মান্তিক মৃত্যু....এক বছরের মাথায় দুটো তরতাজা প্রাণ কিভাবে চলে গেল...!”
বলেছিল জহর।
সেদিন কথাগুলো শুনেছিলাম মাত্র। হয়তো মনের হাজারো ভীড়ে হারিয়েই যেত এতদিনে...যদি না চারিপাশের এই প্রায়ান্ধকার পরিবেশ পরিস্থিতি নতুন করে আর একটা অন্যরকম মুহূর্তকে জাগিয়ে তুলতো।
কাছে দূরে ইতিউতি দুএকটা দোকান প্রদীপের আলোর মতো জ্বলছিল৷ সে শিখাগুলোর দিকে তাকিয়ে কেন জানি না মনে হলো, এসেছি যখন একবার ঘুরে যাবো না? এরকম শিরশিরে হাওয়া, ধোঁয়াশায় ভরা সন্ধ্যা, সকলের একত্রিত হওয়া...এমন সুযোগ সত্যিই যে বড় একটা আসে না জীবনে!
** ক্রমশ **
গল্প | প্রদীপ কুমার অধিকারী
ফেস্টুন
এখনও তেমন করে ভোরের আলো ফোটেনিI রিক্সাটাকে শিশুগাছের নিচে দাঁড় করিয়ে জগন্নাথ এসে বসে কালির চায়ের দোকানের বেঞ্চিটাতেI প্রতিদিন আসে এবং প্রতিদিন এই ভাবেই বসেI পিচ রাস্তার ধারে, কুসুমগ্রাম বাস স্ট্যান্ডI পাশ দিয়েই তো পিচ রাস্তা ভোর বেলা থেকেই শুরু হয়ে যায় বাসের যাতায়াত, একদিকে বালাসোর, কটক, পুরি, মেদিনীপুর, মেচেদা, বাঁকুড়াI অন্যদিকে কলকাতা, হাওড়া, হলদিয়া, কোলাঘাটI কালী তার চায়ের দোকান ভোর বেলাতেই খুলে দেয়I বাসের জন্য অপেক্ষমান যাত্রীরা চা বিস্কুট খায়I জনার্দনও কালির দোকানের বেঞ্চিতে বসে চা খায়I চা শেষ হলে একটা বিড়ি ধরায়I বাস যাত্রীরা নামলেই ডাক পড়বে তারI রিক্সা নিয়ে সে পারি দেবে-- বাজারপাড়া, চরদীঘি, বড় ঠাকরুন মায়ের মন্দির, এই রকম নানা জায়গায় যাত্রীদের ফরমাশ অনুযায়ীI শীত-গ্রীষ্ম- বর্ষা বারোমাস এই রুটিন মাফিক জীবনI মাটির ভাঁড়ের চায়ে চুমুক দিয়ে জনার্দন শিশু গাছটার দিকে তাকিয়ে পাতার ফাঁক দিয়ে সূয্যি ঠাকুরের উদয়ের প্রস্তুতি দেখতে পায়I আর তখনই ও দেখে নেয় ফেস্টুনটাকে, এখনও ঠিক আছে হওয়ার দাপটে ছিঁড়ে যায় নিI জনার্দন অবশ্য আগেই দেখে নিয়েছে ফেস্টুনটা শিশুগাছের সঙ্গে এমন ভাবে বাঁধা আছে যাতে সরাসরি হাওয়া ফেস্টুনটার ওপর ঝাপ্টা না দেয় I জগন্নাথ যখন ছোট ছিল তখন দেখেছে, রাজনৈতিক দল গুলো তাদের প্রচার করতো খবরের কাগজের উপর লাল আলতা দিয়ে লিখতো I এখন দিন বদল হয়েছে, এখন উন্নয়নের জোয়ার! যার প্রতিফলন তাদের প্রচার পত্রেও, দল নেতার রঙিন ছবি সহ, ফ্লেক্স পেইন্টিং-এ ব্যানার ফেস্টুন I একদিকে ভালোই তার খড়ের চাল ঢাকতে পলিথিন সিট বেশ উপযুক্ত I
সুযোগ বুঝে ওটাকে বাড়ি নিয়ে যাবে I ভোট অনেক দেরী ততদিন অপেক্ষা করা যাবে না I পার্টি অফিস থেকে অনেক ফেস্টুন ব্যানার পাঠিয়ে ছিল, এরমধ্যে ওই ফেস্টুনটাই সব থেকে মজবুত এবং বড় I মাঝেমধ্যেই খেয়াল রেখেছে আর কারোও নজর পড়েনি তো ফেস্টুনটাতে I
গত বর্ষায় ওর ঘরের খড়ের চাল দিয়ে জল পড়েছিল I খড়ের আর দোষ কি, চার বছর চালে এক আঁটি নতুন খড় গোঁজা হয় নি,পচে গিয়েছে বোধ হয় I এইবারটা না টিকিয়ে রাখলে, মাটির দেয়াল ধসে পড়বে আর মেঝে ভেসে যাবে বর্ষার জলে I বাজারের অবস্থা দিন কে দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে I
জগন্নাথের মনে পড়ে গেলো বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় বৌ বলে ছিল- লতার শরীরটা ভালো নয় একটা ভালো ডাক্তার দেখনো দরকার I বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল জ্বরটা ছাড়ছে না I দুঃসময় যেন তার পিছু ছাড়ছে না I
অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত তার অবস্থা এমন ছিল না, কিছুদিনের মধ্যেই চোখের সামনে ঘটনা ঘটে গেলো! কি একটা ভারী শিল্পের যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা করার জন্য এলো, জমিটমি সব দেখে গেলো I তার মত জমির মালিকের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো I আজও মনে আছে, যখন প্রথমে বহুজাতিক সংস্থাটি কারখানা গড়ার জন্য জন্য গ্রামে এসে রাস্তার ধারে সমস্ত জমি কিনে নেবার প্রস্তাব রাখলো তখন সে কি উন্মাদনা গোটা এলাকা জুড়ে I কোম্পানিটা বড় উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে I সেই সময় বেশ আলোড়ন পরে গিয়েছিলো এলাকাটায় I রাস্তার ধারের জমিগুলো এক লাফে অনেক দামে বিক্রি হতে শুরু করেছিল I কারখানা যেখানে গড়ে উঠতে উঠতো, সেখানেই এক কথায় ওর জমিটা লিখে দিয়েছিলো জগন্নাথ, ওরা ছেলেটার একটা চাকরি দেবে বলেছিলো আর সঙ্গে কিছু টাকা I তার পর কোম্পানিটা কেন যেন চুপ মেরে বসে গেলো I সব ঠিকঠাক থাকলে ওর আজ এই অবস্থা হতো না I কাজ শুরু হবার কিছুদিনের মধ্যেই কি জানি কোনো এক কারণে গোলমাল আরম্ভ হল, ততদিনে কারখানার পাঁচিল দেওয়া হয়ে গিয়েছে I জগন্নাথ একদিন দেখে এসেছিলো, চেনাই যাচ্ছিলো না জায়গাটা I লরি, পে-লোডার, ট্র্যাক্টর, মাটি কাটার মেশিন এস্কাভেটর, ফ্যাক্টরি শেড তৈরির জন্য বড় বড় করোগেট শেড I তারপর শুরু হলো মহা গণ্ডগোল I দফায় দফায় কত নেতা এলো, মিটিং করলো, মিছিল করলো, অবরোধ হলো I সবই নাকি জমির মালিকের স্বার্থে I
দুপুর বেলায় বাস স্ট্যান্ডটা বেশ নির্জন হয়ে যায়, এক ফাঁকে জনার্দন শিশুগাছ টায় উঠে নামিয়ে নিয়েছিল দশফুট বাই আটফুটের ফ্লেক্সের ফেস্টুন, ভালো করে মুড়িয়ে চার পাঁচ বার ভাঁজ করে, ঢুকিয়ে নিয়েছিল রিকশার সিটের নিচে I মনে মনে খুব খুশি হয়েছিল, মালা দেখলে খুশিই হবে I বেচারা কয়েকবার বলেছে- “খড়ের চালের একটা ব্যবস্থা করো, না হলে এবার বর্ষার জলে ভেসে যাবে ঘরের দেয়াল, ভেঙেও পড়তে পারে I একখানি তো ঘর, ছেলে-মেয়ে কে নিয়ে কোথায় যাবো বলো দেখি”I
সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে, হাতের ফ্লেক্সটা দেখায় মালাকে, বলে ভোটতো শেষ হতে দেরী আছে তার আগেই কেউ যদি ঝেঁপে দেয় তাই এটা খুলে নিয়ে এলাম I
মালা বলল -খবরদার কাউকে বোলো না, কেউ দেখেনি তো? পাড়ায় গণ্ডগোল শুরু হয়েছে, কোন পার্টির দেয়াল লেখা ছিল কে বা কারা তার ওপর গোবর লেপে দিয়েছে I তোমার হাতের এই ফেস্টুনটা দেখলে আর রক্ষে থাকবে না, এরপর পুলিশ আসবেই তোমাকেই ধরবে I জনার্দন মন থেকে সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে বলে - এক গ্লাস জল দাও তো দেখি, তেষ্টায় গলাটা একেবারে শুকিয়ে গিয়েছে I "জনার্দন বাড়ি আছো নাকি" - বাড়ির বাইরে থেকে তার নামের ডাক শুনতে পায়। হঠাৎ বুকের ভিতর ছ্যাঁৎ করে ওঠে অজানা একটা আশঙ্কা মনের ভিতরে উঁকি দেয়।জগন্নাথ মনকে শক্ত করে। কাঁধের গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে বাইরে এসে দাঁড়ায়, বাইরে এসে দেখে কানাই। কানাই পার্টির হোলটাইম কার্যকর্তা। আগে রিকশা টানতো এখন টোটো চালায় I কানাই বলে -"আজ বিকেলে বাস স্ট্যান্ডে পার্টির মিটিং আছে, সময় মতো পৌঁছে যাবে কিন্তু"I লড়াইটা এবার শুধু এক জনের নয়, তোমার আমার সবার লড়াই I কথাটা বলে অতি ব্যস্ত ভাবে বলে সাইকেলের সিটে উঠে বসে I জগন্নাথ ভাবে, কথাটার মধ্যে ঝাঁজ আছে, আধপেটা অবস্থায় রক্ত গরম করে দেয় I জনার্দন তো কোন ছাড় গ্রাম প্রধানের আদেশ অমান্য করার সাহস কারোও নেই I বিকেল বেলায় ঠিক সময় জনার্দন হাজির হয় বাস স্ট্যান্ডে I অনেক লোক জড়ো হয়েছে। কানাইয়ের পাশে গিয়ে বসতেই ভক করে মদের গন্ধ পায় I সকলের থেকে আলাদা একটা জায়গা খুঁজে নেয় জগন্নাথ, এবার শুনতে পায় গ্রাম প্রধানের বক্তব্য- এবার জমি ফেরত নয়, কারণ ওই জমি এখন চাষের অযোগ্য হয়ে গিয়েছে, চাষের জন্য ওই জমি তৈরী করতে চাই টাকা I কারখানা আর হবে না তাই জমি ফেরত চাই আর সঙ্গে টাকা এবং প্রাপ্য টাকার ওপর সুদ সমেত প্রাপ্তির আশ্বাস I বহুদিন পর একসঙ্গে এতগুলো টাকার দাবি শুনে সকলেই বেশ চনমনে হয়ে উঠেছিল কিন্তু দেয়াল লিখনের ওপর গোবর লেপে দেবার প্রসঙ্গ আসায় সকলেই কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠলো। এই সূত্রে মিটিংয়ে আচমকা ফেস্টুনের প্রসঙ্গটা উঠবে সেটা কল্পনাও করেনি জগন্নাথ I গ্রাম প্রধান বলে – গত কালকেও শিরিষ গাছে আমাদের ফেস্টুন ছিল, আজ নেই I যেই এই কাজ করুক তারা কিন্তু কেউ পার পাবে না I আমাদের দলের ব্যানার ছিঁড়ে আমাদের আন্দোলন বন্ধ করতে চাইছে, সেটা আমরা কিছুতেই হতে দেব না I জগন্নাথের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করে I গামছা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিয়ে প্রধানের বক্তব্যে মন দেয় I হঠাৎ কানাই টালমাটাল অবস্থায় উঠে দাঁড়িয়ে জগন্নাথের কাছে এলো এবার একেবারে সমানে সমানে চোখে চোখ রেখে বলল – শা...লাআ.... ঘাঘু... ম...আ....ল I ভে,,,বে,,,ছ ডুবে ডুবে জ..অ...ল খাবে, শি..ই..বে..র বাবাও টের পাবে না I জমি ফেরত নেবে, পয়সা ফেরত নেবে সুদ সমেত আর আমাদের পতাকা ছিঁড়র...বে, ভাগ শালা I কানাইয়ের কোমরে গোঁজা পিস্তল দেখতে পায় জগন্নাথ I বক্তব্যের মাঝে আরো কিছু কাঁচা খিস্তি দেয় I মদের গন্ধ সহ্য করতে না পেরে মুখ সরিয়ে নেয় জগন্নাথ I মিটিং যেন আক্রমনাত্বক রূপ নেয়, জগন্নাথ সরে আসে সেখান থেকে I
বাসস্ট্যান্ডের মিটিং শেষ, সন্ধ্যা নেমেছে বেশ কিছুক্ষণ আগেই I শিশু গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে, বিড়ি ধরিয়ে অনেকক্ষন বসে থাকে জগন্নাথ I জগন্নাথ দেখে, দূরে বন্ধ কারখানার মাঠে অনাবিল কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছে I কারখানার অর্ধ নির্মিত শেড, যথেচ্ছ ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ভারী ভারী মেশিন, জায়গায় জায়গায় গজিয়ে ওঠা বুনো ঘাসের জঙ্গল I নির্জন কারখানা চত্তর অন্ধকারে পরে থাকে সারারাতে I এমনটা যে হবে তা কে জানতো I কালির চায়ের দোকানের সামনে অপরিসর তন্দ্রাচ্ছন্ন অন্ধকার, তারপাশে পার্টি অফিস তার মতো শুধুই অতীত I দুধসাদা ফ্রক পড়া ছোট্ট অসুস্থ মেয়েটার মুখখানি মনে পড়ে I মেয়েটাকে ডাক্তার দেখানোর অসহায় বৌয়ের কাতর অনুনয় কানে ভেসে আসে I আর মনে পড়ে ফেস্টুনটার কথা I জগন্নাথ উঠে দাঁড়ায়, আধ পোড়া বিড়ি ফেলে দেয় মাটিতে, পরনের লুঙ্গি কোমরের গামছা শক্ত করে বেঁধে নেয় I রওনা দেয় বাড়ির দিকে I
প্রথমে জমানো কিছু টাকায় সংসারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু মেয়েটার শরীর খারাপ হয়ে যেতেই ডাক্তারবদ্যি, হাসপাতাল, নানান টেস্ট... সঞ্চয়ের ঘরে টান পড়লো I এইসব রোগ কী জগন্নাথের ঘরে মানায়? যেতিস বাবা অবস্থাপন্ন লোকের ঘরে, তা নয় I জগন্নাথ ভেবে কুল কিনারা পায় না I
চিকিৎসা করাতে মেয়েটার শখের হারমোনিয়ামটা বাজারে 'মডার্ন মিউজিক' দোকানে বিক্রি করেছে। সে আর কত ! মেরে কেটে দু হাজার, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট হতে হয়েছিল জগন্নাথকে I
দু বছর আগে চোদ্দোহাজার টাকায় কলকাতা থেকে কিনেছিলো ওটাI বড় কষ্ট হয়েছিল সেদিন I মেয়েটা করুন চোখে তাকিয়ে দেখেছিলো তার বাবার হারমোনিয়াম নিয়ে যাওয়া, বাধা দেয়নি, প্রতিবাদও করেনি, নিস্পলক চোখের কোন দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে দেখে জগন্নাথ মাথায় হাত দিয়ে বলেছিল সুস্থ হয় ওঠ, আবার কিনে দেব I
এসব ভাবনার মাঝে বাড়ির কাছে পৌঁছে যায় জগন্নাথ। কাছাকাছি আসতেই দেখতে পায় বাড়ির সামনে অনেক লোক আর আগুনের লেলিহান শিখা বাড়ির চাল থেকে আকাশে উঠছে I মাচানের বাঁশ আর খড় পট পট আওয়াজ করে ধু ধু করে জ্বলছে I বাড়ির উঠানের একপাশে মালা মেয়েকে নিয়ে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে I জগন্নাথকে দেখে হা হুতাশ করে কেঁদে উঠলো দুজনেই, ছেলেটা বালতি নিয়ে জল ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে I যদিও আজ মিটিং-এর বক্তব্য অনুযায়ী অনুমান করেছিল এক অশুভ সংকেত I তবে প্রতিঘাতটা যে এমনভাবে আসবে সেটা কল্পনা করেনি I বুকের ভিতরটা যেন খড়ের চালের আগুনের মত হু হু করে জ্বলতে লাগলো I আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, হাঁটু মুড়ে আঙ্গিনায় বসে পড়ল I তার একমাত্র সম্বল মাটির দোচালা মাটির ঘরখানি সেটাও চোখের সামনে পুড়ে শেষ হয়ে যেতে দেখল I বুকের ভিতরটায় যেন বাইরের আগুনের চেয়েও তপ্ত আগুনের শিখা I চোখ মুখ ফুলে উঠেছে, অভিমানে রাগে দুঃখে ক্ষোভে ভিতরে ভিতরে ফেটে পড়ল I এত কিছুর মধ্যে ফেস্টুনটার কথা মনে ছিল না I হঠাৎ তার মনে পড়ল, এবার উঠে ফেস্টুনটাকে রিকশার সিটের নিচ থেকে বের করে এক টান মেরে ছুঁড়ে দেয় জলন্ত খড়ের চালে I ফ্লেক্স বড় জ্বলনশীল পদার্থ I সামান্য আগুনের ছোঁয়া পেতেই দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল দ্বিগুণভাবে I এইভাবে কতক্ষণ কেটে গেল কে জানে I হঠাৎ স্কুটারের আলো দেখা দেয়, অনিরুদ্ধ মহান্তি, আগে শাসক দলের কর্মী ছিল, কারখানার জমি কেনা বেচার বখরা নিয়ে গোলমাল হয়ে দল ছেড়ে এখন বিরোধী পক্ষের সঙ্গে আঁতাত করেছে I স্কুটারের স্টার্ট বন্ধ করে বলে – "শোন কাল পার্টি অফিসে আসবি, একটা দরখাস্ত করবি, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় নাম লিখিয়ে দেব I"
দেখতে দেখতে ছোট খাটো একটা ভিড় জমে যায় জগন্নাথের বাড়ির সামনে I জগন্নাথের ঘরের আগুন লাগানোর প্রসঙ্গটা ক্রমে উধাও হয়ে গেল সমবেত ভিড়ে I আলোচনার বিষয়বস্তু ঘাঁটিগাড়ে বাংলার বাইরে অন্য দেশে, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, পাঞ্জাবে I আধঘন্টা পর অনিরুদ্ধ মহান্তি বিদায় নেয় যথাচিত সাহাযের আশ্বাস দিয়ে I
তখন অনেক রাত, বাড়ির কারোও আজ কিছু খাওয়া হয়নি, তারও পেটে পড়েনি কিছু I খড়ের চালের আগুন নিভে গেলেও নিভে যাওয়া চাল থেকে সরু সুতোর মত সাদা ধোঁয়া অল্প অল্প বের হচ্ছে আর উঠে যাচ্ছে আকাশে, মিলিয়ে যাচ্ছে I খড় বাঁশ পোড়া গন্ধটা তখনও ছড়িয়ে আছে বাড়ির চার পাশে I বাড়ির চারিপাশে একটা গাঢ় অন্ধকার আর একটা ভয়ংকর অন্ধকারের কথা মনে পড়িয়ে দেয় I
"জিতে জী" না মরার সিদ্ধান্ত নেয় জগন্নাথ I বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে আজ প্রানের চেয়ে ফেস্টুনে-এর দাম অনেক বেশি I জগন্নাথের কিছুটা সময় লাগলো সিদ্ধান্তটা নিতে I মালা আর লতা, বাইরে উঠোনের এক কোনে শুয়ে পড়েছে I বউ আর মেয়ে কে ডাক দেয় I মালা ও মালা...I ছেলে মেয়ে দুটোকে ওঠাও দেখি I
অবাক বিস্ময়ে মালা জগন্নাথে দিকে তাকায়, কিছু বোঝার আগেই জগন্নাথ বলে – চল আমারা এই পোড়া দেশে আর থাক...ব... নি, চলে যাব, আর থাকব নি এখানে I মালা ঘুম চোখে বলে – কোথায় যাবে? জগন্নাথ ধরা গলায় বলে – যে দিকে দুচোখ যায়, সে দিকেই চলে যাব, এখানে আর থাকব নি, আর থাকব নি I
-
প্রচ্ছদ ঋণঃ- দেবদুত মুখোপাধ্যায় সূচীপত্র ----------------------- প্রচ্ছদ ------------------ দেবদুত মুখোপাধ্যায় সম্পাদকীয় কলাম ------------...