বুধবার, ২১ আগস্ট, ২০২৪

কবিতাভিত্তিক (কবিতা বিভাগ)

প্রতিবার এক-একটি মেয়ে
রহিত ঘোষাল

rohit ghoshal


শুধু কি একজন মরেছে
আমরা সবাই জীবিত...
ঠিক জানো একটি মেয়ে,
প্রতিবার এক-একটি মেয়ে
কখনো পাহাড়ে, কখনো থানায়
কখনো জলে-নর্দমায়
অকালে ঝরে পড়েছে,
ঠিক জানো একটি ঘটনা
ঘটেছে-ঘটে চলেছে,
নীল সে রক্ত চোখে দেখা যায়
চোখে দেখা যায় না
এই দ্বৈত ভূমিকায়
আমাদের রেখে ওরা চলে যায়
তারপর ঘুম-খিদে মরে যায়
আমরা মরি না
ঠিক জানো আমরা মরি না

কবিতাভিত্তিক (কবিতা বিভাগ)

গমক্ষেত
জয়িতা বসাক



gamkhet


এখনও গমক্ষেতে, শরতের বাতাস নীরবে
ফসলের ছেঁড়া শীষে শেষ চুম্বন রেখে যায়...
শিশিরের ফোঁটারা ভারী হয়ে নেমে আসে
রাতের নরম দু'গাল বেয়ে চুপিসারে...

ক্ষয়াটে একফালি জ্যোৎস্নার মাঝে মুখবুজে
রোজ পড়ে থাকে পরীদের অজস্র চিৎকার;
অন্ধকার ছিঁড়ে নেয় ডানা, ভেঙে দেয় মেরুদণ্ড
নক্ষত্র আলোয় মৃত শ্বাস ওড়ে, একান্ত গোপনে...

শুধু গর্ভবতী ক্ষেত জানে এ লজ্জার ইতিকথা...
প্রতিটি শস্যদানা, মাতৃগর্ভে বসে শোনে আর্তনাদ;

আজ, যে কোনো রুটির প্রতিটি টুকরো থেকে
একটা একটানা যন্ত্রণা, অব্যক্ত কান্না শুনতে পাই,
খিদের থালায় গড়িয়ে নামে রক্তক্ষরণের ইতিহাস...

কবিতাভিত্তিক (কবিতা বিভাগ)

চিকিৎসা
অম্লান বাগচী



chikitsaa


ওরা আমার কোন কথাই শুনলো না। আমি বারবার
বলা সত্ত্বেও ফিরিয়ে দিতে চাইলো আমাকে।

আমার কোন পরীক্ষায় ন‍্যূনতম উৎসাহ দেখালো না

দেখলো না আমার নাড়ি টিপে। ব্লাড প্রেশারের কোন
সমস‍্যা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলো না।
আমি দেখাতে চাইলাম রিপোর্ট
হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো

আমার সমস‍্যার কথা শুনতে ওদের কেন এত অস্থিরতা!

আমি বুঝতে পারছিলাম আমি সুস্থ নেই। বুঝতে
পারছিলাম আমার মেডিক্যাল অ‍্যাসিসটেন্সের খুব
দরকার। অথচ ওরা আমাকে তাড়ানোর জন‍্য
মরিয়া হয়ে উঠেছিল।

আমি জানি, ওদের মুখ দেখা যায় না। ওদের অদৃশ‍্য
গতিবিধি ধরা পড়ে না কোন সি.সি.টি.ভি. ক‍্যামেরায়।
অথচ ওদেরই খুব দরকার ছিল আমার।

একটা প্রশ্নের অসুখ যে আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো...

ওদের জিজ্ঞাসা করে ওদের কাছেই জানতে হ'তো ----

আসলে কার চিকিৎসার প্রয়োজন?

কবিতাভিত্তিক (কবিতা বিভাগ)

রূপকথার গল্প
পার্থপ্রতিম সেনগুপ্ত

Rupkathaar Galpo


গল্প লিখছি রূপকথার
রাক্ষসদের ভরা দেশ।
কন্যাশিশু, নারী শরীর,
চিবিয়ে খাচ্ছে নির্বিশেষ।

আমার গল্পে দিনের বেলায়
নিকষ কালো অন্ধকার,
মোমের আলো হচ্ছে ফিকে,
ভীড় জমছে রাত পোকার।

ভাবছো এবার আসবে বুঝি
দারুণ বীর এক রাজকুমার,
রাক্ষসদের মারবে ধরে,
যুদ্ধ হবে ধুন্ধুমার।

সত্যি বলছি আমিও চাই,
কিন্তু তাকে আনবে কে?
কালি আমার ফুরিয়ে গেছে,
গল্প লেখা বন্ধ যে!

কবিতাভিত্তিক (কবিতা বিভাগ)

তিলোত্তমা
শ্রাবন্তী বিশ্বাস

tilottamaa



সভ্যতার প্রদীপ নিভে গেছে-
নিঃশ্বাসে অবিশ্বাসী বিষ!
যতদূর গলা যায় চিৎকার করো,
ধর্ষকের আয়না আঙুল তুলুক।

ওরা,স্টেথোস্কোপ দিল স্তব্ধ করে-
রাতের আড়ালে অসুর সাজ...
যে মেয়েটির ফেরার কথা ঘরে,
সেমিনার হলে লাশ।

পূর্বাভাস কি কিছুই ছিল না–
শয়তানের আঁকা নকশায় ?
হয়তো ছিল বুকচাপা–
ষড়যন্ত্রের আভাস।

হিংসা লোলুপ নখের আঁচড়
ছেপেছো পূর্ণ শরীরে ।
পাশবিক যে হত্যালীলায়
রক্তপানি দু'চোখে ।

যৌনতা ভরা উদ্দামতায়
সব সীমা করল পার।
মানুষের বেশে খুনি ঘুরছে
আমাদেরই সমাজে।

যতবার তোমরা রাক্ষসরূপে,
ছিন্ন করো সম্ভ্রম
রাতের আঁধার সজাগ হলো
প্রতিবাদীর মোম...

উন্মুখ রাজপথে নির্যাতিতার মিছিল,
বিচারের বাণী গুনছে প্রহর
শাস্তি ক্ষমাহীন।

কবিতাভিত্তিক (কবিতা বিভাগ)

রাত দখলে সব নারীরা
সবুজ বাসিন্দা (সুপম রায়)

raat dakhale sab naariraa


সস্তা ভীষণ নারীর শরীর
যা খুশি তা করাই তো যায়,
হোক প্রতিবাদ রাত্রি জুড়ে
দখল করুক সব নারীরাই।

প্রমাণ লোপাট, গল্প ভিন্ন,
শরীর পড়ে লাশের ঘরে,
ধর্ষণ করে বলাই তো যায়
আত্মহত্যা কিসের তরে?

ভরসা কোথায় রাখবে মানুষ -
সরকার, পুলিশ, আইনী খাতায়?
হোক প্রতিবাদ শহর জুড়ে
রাত্রি জাগুগ সব নারীরাই।

১৪ই আগস্ট সাক্ষী থাকুক,
রাত দখলে সব নারীরা।
দেশটা সবার এমনটা হোক
শাস্তি পাক সব খুনীরা।

কবিতাভিত্তিক (কবিতা বিভাগ)

খোলাবাজারি রাত
কৌশিক চক্রবর্ত্তী

khola bazari raat


আজ ঘুমোনোর রাত নয়
ছিন্নভিন্ন যোনী অর্জন থেকে নিজের বিবৃতি প্রস্তুতি
একনিষ্ঠ জড়ো করা ঘুম বিকিয়ে যাচ্ছে জলের দরে
জমানো আদরের স্বপ্নে বিক্রয়মূল্য
দাবী করিনি আমি।


সবটুকু নিঃশেষ হবার পর খোলাবাজারে সাজিয়ে রেখেছি রাতের মোড়ক।
প্রদর্শনীতে দাঁড়ানোর শ্রেষ্ঠ সময় সকাল
তাই আজীবন সঞ্চয় করেছি অতিরিক্ত চাদরের কোণ।


না, আজ ঘুমোনোর রাত নয়
নিজেকে আষ্টেপৃষ্টে পুড়িয়ে নেবার রাত
সমস্ত স্বপ্ন ফুরিয়ে যাবার পর
পণ্য হিসাবে বিক্রির জন্য সাজিয়ে রাখব দগদগে পোড়া ঘা।


এরপর আর ঘুম আসেনি ছিটেফোঁটা
লাভক্ষতির অংকে খোলাবাজারি রাতকেই আমি একক ধরে এগিয়ে গেছি বাকি পথ।

সম্মিলন / গুচ্ছকবিতা

ধর্ষণ এবং
দেবশ্রী দে

dharshan ebong


১|
 
বিন্দু বিন্দু ঝরে পড়ছে ঘাম
খানিকটা রক্ত-ও কি?

মুখোশের ভেতরে মুখ নাকি মুখের ভেতর...

আমার কাপড় খুলে নিচ্ছে কাল
আমার শরীর খুলে নিচ্ছে কাল

আমার ভেতরে ঢুকে আসছে মুখ
কালের সে মুখ। কালো হচ্ছে ধীরে। কালো হচ্ছে

২|

এই খাদ ব্যক্তিগত

ইচ্ছেমত হাত রাখো। শিশ্ন রাখো। রাখো মাথা
পুরুষ-অবতার। আর কী কী রাখা যায়
খুঁজে দেখো নজরের এপার-ওপার

দাঁত থেকে দাঁতে রাখো পশুর মহিমা
লজ্জা পায়। লজ্জা পায়
বাবা-মা কোথায় রাখো মহাবীর্যবান

এই খাদ ব্যক্তিগত
ইচ্ছেমত নীচে রাখো আগামী তোমার

৩|
 
এত যে আঘাত আর
এত যে কামড় দিলে তবু কি আঘাত
দিতে পেরেছ কোথাও

নিজের আমি-তে কত কেটেছ যে দাগ
প্রতিবার। ইতিহাসে ইতিহাসে
হেসে হেসে উঠেছে সময়

আমাকে শরীর ভেবে যতবার
নগ্ন করেছ। করেছ যে পথে উল্লাস

সে উল্লাস অভিশাপ। সেই পথ আত্মঘাতী লাল

৪|

শেষ তবে। কতখানি খুশি হলে
কতখানি খুশি হলে ভুলে থাকা যায়

ভুলে থাকা যায় দুই চোখের নজর
যেখানে ভালোবাসা। যেইখানে স্নেহ ক্ষণেক্ষণ

এত স্বাদ! এত স্বাদ রক্তে আমার!
ভুলে থাকা যায় সব আলো-উচ্চারণ!

ভুলে থাকা যায় বুঝি! দ্যাখোনি তো তাই
ভিতরে ভিতরে কত নিভছে মানুষ

নিভে যাচ্ছে
নিভে যাচ্ছে
বাতিটি তোমার

৫|

দাঁড়িয়ে থাকবে ক'টি পা'য়

দ্যাখো, ওই জ্বলেছে মশাল
আমার প্রতিটি কোশে লেখা যে বারুদ
নরম জেনেছ, এবার উঠেছে জেগে

দাঁড়িয়ে থাকবে ক'টি পা'য়

যাও, ওই মেয়েটির গায়ে
হাত রাখো। চিনে নাও মেয়েকে তোমার
দেখে নাও কত দীর্ঘ পৌরুষ তখন

দাঁড়িয়ে থাকবে ক'টি পায়

আনুপূর্বিক (নিবন্ধ/প্রবন্ধ)

(১)

প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, প্রতিক্রিয়া
সায়ন চক্রবর্তী

Aanupurbik 1


খাস উত্তর কলকাতার বুকে একটা হাসপাতাল। এই হাসপাতালের অনতিদূরে খয়েরি ঘোড়ায় সওয়ার নেতাজি পাঁচমাথার মোড়ের দিকে নজর রেখে আসছেন আমার আজন্মকাল। পাঁচদিকে ছুটে চলা পাঁচটা পথ, কলকাতার ধমনী, শিরা, উপশিরা বেয়ে রক্তের মতো বয়ে নিয়ে গেছে শহরের স্পন্দন। নেতাজি কী কী করেছেন, কী কী পারেননি – সে আলোচনা আজকের পরিসরের নয়। তবু নেতাজির সম্পর্কে যে অসংখ্য ফোকলোর আজ এত বছর পরেও আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে, তার একটা আজ বড় প্রাসঙ্গিক মনে হল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই উত্তাল পৃথিবীতে মানুষের জীবনের মূল্য ছিল আজকের বাজারের মুরগির চেয়েও কম। পরিকল্পনার জন্য, সেই পরিকল্পনার রূপায়ণের জন্য হাজার হাজার মানুষকে আহুতি দিতে কেউই দুইবার ভাবতেন না। অবশ্য পুরোহিত কবেই বা যজ্ঞের বলির মহিষ গুনেছেন!!! পুরুষদের শুধু প্রাণ যেত, অথবা তাদের কায়িক শ্রম নিংড়ে বার করে নিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখা হত গোয়ালঘরের মোষের মতো, যাতে কাল আবার তারা হাল টানতে পারে।
কিন্তু নারী??? তারা যে শুধু দাসী নয়, যৌনদাসত্বও যে যুগে যুগে কালে কালে সকল অনিশ্চিত সময়ে তাদের কপালে লিখে দিয়েছে শিশ্নদর্পী পুরুষ। নারীর ভবিতব্য সে ভয়ঙ্কর জ্বলন্ত সময়ে কী হয়েছিল, তা যাঁরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে কিছুটা পড়াশোনা করেছেন, সবাই জানেন।
শোনা যায়, নেতাজী নাকি আজাদ-হিন্দ-ফৌজের সৈনিকদের ডেকে বলেছিলেন, কোনো অবস্থাতেই যেন তারা কোনো নারীর গায়ে হাত না দেয়। যদি কাউকে দিতে দেখে, তবে সে নিজের সৈন্যবাহিনীর হলেও তার নামে একটি বুলেট লিখে দিতে কেউ যেন দ্বিতীয়বার না ভাবে।
সেই নেতাজী ঘোড়ার অপর অসহায় বসে জানতে পারলেন, অনতিদূরে হাসপাতালে এক কর্তব্যরত নারী চিকিৎসককে তার নারীজন্মের চরমতম শাস্তি দিয়েছে মানুষের মতো দেখতে কিছু হায়নার দল। সেদিন সেই অপমানে সে মাথাও কি নেমে এসেছিল কিছুটা, যে মাথাকে ইংরেজ শাসন শত চেষ্টাতেও কখনো নোয়াতে পারেনি?


ধর্ষণ এ সমাজে নতুন নয়। সভ্যতার আদি থেকে তা আমাদের সঙ্গে রয়েছে। খবরের কাগজের ভেতরের বা বাইরের পাতায় মাঝে মাঝেই উঠে আসে বিভিন্ন ঘটনা। বহুক্ষেত্রেই মানুষ ভ্রূ কুঁচকে পরের পাতায় চলে যান, বা ফেবুতে রেখে যান নাগরিক কর্তব্যপালনের চিহ্নস্বরূপ একটি পোস্ট। তবে এবারের এই আর.জি.করের ঘটনায় মানুষের প্রতিবাদ এত তুমুল, এত ব্যাপক কেন? কেন এই অস্থিরতা, কেন এই তীব্র ক্ষোভ দানা বেঁধেছে, যার আঁচ পৌঁছে গেছে নবান্নের সর্বোচ্চ তলের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষেও? পার্ক স্ট্রিট, বারাসত, কামদুনিতে তো এমন ঘটেনি। মানুষ প্রতিবাদ করেছেন, সহমর্মিতা দেখিয়েছেন, কিন্তু পথে নামেননি। ইংরেজির দুটো শব্দ ব্যবহার করি- সিমপ্যাথি ছিল, এমপ্যাথি ছিলনা।
আসলে এই ঘটনা মানুষকে শ্রেণীচরিত্রের দিক থেকে আঘাত করেছে। মধ্যবিত্ত, বাঙালি পরিবারের একটি মেধাবী মেয়ে, যে ডাক্তারিতে সুযোগ পেয়েছে – এ আমাদের রাজ্যের আপামর নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শিক্ষিত পরিবারের এমন এক স্বপ্ন – যাকে ছোঁবে বলে একটি গোটা পরিবার যুদ্ধ করে। মেয়েটি বা ছেলেটি দিনরাত পড়াশোনা করে, তার মা ও বাবা সকল দৈনন্দিনতার যুদ্ধে নিজেদেরকে সামনে এগিয়ে দিয়ে মেয়েটিকে সেই সুযোগ করে দেন, যাতে মেয়েটি ধাপের পর ধাপে পা ফেলে সফল হয়ে উঠতে পারে। তাই যখন সেই উত্তরণের সিঁড়িতে উঠতে থাকা মেয়েটি ধাক্কা খায় – আমাদের শ্রেণীচরিত্র আহত হয়। নিত্যদিনের ঘষটা খাওয়া, শ্যাওলা ধরা একতলার পৃথিবী থেকে একদিন আলো-বাতাস যুক্ত তেতলার ঘরে এসে বসবার যে স্বপ্ন একটা গোটা শ্রেণী লালন করে, তার বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড উপড়ে আনা হয়।
তখন মানুষের রাগ দানা বাঁধে। একটি শিশুর রাগ হলে সে যেমন হাত ছোঁড়ে, পা ছোঁড়ে – কী করবে ভেবে পায়না, এমন এক ঘটনার পরে একটা গোটা শহর আঁচড়ে উঠতে চায় ক্ষমতার দেয়াল, কামড়ে ছিঁড়ে নিতে চায় দম্ভের মেদ।
ঠিক এই সময়েই ঝড় উঠেছে। মধ্যবিত্ত মানুষ, যারা সারাজীবন সব বিপ্লবের থেকে দূরে, সকল ঝড়ের মধ্যে নিজের ঘরের চালটুকু আগলে রাখতে চায়, আজ তারা হাত মুঠো করে এগিয়ে এসেছে। প্রতিবাদের উৎসবে গলা মিলিয়েছে চেনা-অচেনা, নারী-পুরুষ। যে রাতে শহর মধ্যরাতের দখল নিতে রাস্তায় নামল, আমাদের মধ্যের বেড়াগুলো যেন অন্তত এক রাতের জন্য মড়মড় করে ভেঙে পড়ার শব্দ পেলাম।


প্রশাসন কি এই আন্দোলন দমন করতে পারেনা? হয়তো পারে, হয়তো পারেনা। এর উত্তর সঠিকভাবে কেউ জানেনা। ইতিহাসে এর পক্ষে বিপক্ষে দুইদিকেই প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। যে সোভিয়েত গত শতাব্দীর পাঁচের ও ছয়ের দশকে একাধিকবার সামরিক ক্ষমতায় গণ-আন্দোলন দমন করেছিল, সে-ই কিন্তু আটের দশকের শেষে এসে আর পারেনি তা করতে। দিকে দিকে সোভিয়েতের এক সময়ের অংশীদারেরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল – হাঙ্গেরি, চেকোশ্লোভাকিয়া, কাজাখস্তানে – মস্কো থেকে কোনো ট্যাঙ্ক তাদের দিকে আসেনি, চলেনি কোনো গুলি। মানুষের দাবীতেই ক্রেমলিনের চুড়ো থেকে অপসারিত হয়েছিল সত্তর বছরের লাল পতাকা। আবার প্রায় একই সময়ে, চীন কিন্তু পেরেছিল তিয়েন-আন-মেন স্কোয়ার ঘটাতে। দেশের মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছের তোয়াক্কা না করে বন্দুকের নলের ওপর ভিত্তি করে রূপায়ণ করতে পেরেছিল এক-সন্তান নীতি – কোনো বিপ্লব সে শ্বাসরোধী শাসনযন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারেনি। তাই এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। শাসকের দমন বনাম মানুষের স্বপ্ন – এই যুদ্ধে এক এক প্রান্তরে এক এক পক্ষ জয়ী হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কথা ধার করে বলি, শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?


সাধারণ নাগরিক হিসেবে চিন্তার কোনো কারণ কি নেই আপনার-আমার? আছে আছে। গণ-আন্দোলনের চরিত্র এমন, মানুষকে ধরে রাখতে তাকে প্রতিদিন নতুন কর্মসূচীর জন্ম দিতে হয়। তাই মেয়েটির ন্যায়বিচারের জন্য যে আন্দোলনের সূচনা, তার চরিত্র এভাবে পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, যে এখন প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের রদবদলও দাবীর মধ্যে ধীরে ধীরে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের পরিবর্তন কিন্তু আমরা দেখছি, দেখেছি। বিপ্লবের শব্দবন্ধ মানুষের কাছে যতই রঙিন স্বপ্নের জন্ম দিক না কেন, মনে রাখতে হবে তা হয়তো বহুক্ষেত্রেই যুদ্ধের বীরগাথার মতো প্রশস্তিমূলক। যুদ্ধে শেষ অবধি থেকে যায় অগণিত মৃতদেহ, আহত সৈনিক আর বিচ্ছিন্ন পরিজন। বিপ্লব কিন্তু তার চেয়ে খুব দূরে নয়। আমাদের মতো সাধারণ যে মানুষ শহরের ট্রামে, বাসে ভীড় হয়ে ওঠে, তাদের হাতে দিনের শেষে থাকে শুধু একটা সংবিধান, আর তার দেওয়া কিছু অধিকার। সেই সংবিধানটি রক্ষা না করতে পারলে আমাদের হাতে শুধু পেনসিল থেকে যাবে। রাজনৈতিক দল পরিযায়ী পাখির মতো আসে এবং যায়, তাদের সুবিধাভোগীদের মুখ বদলায়, রূপ বদলায়না; কিন্তু পরিযায়ীরা যে হ্রদে এসে নামে, তার পাশের গাছের মতো সারাজীবন থেকে যাই আমরা। তাই দলের প্রতি ক্ষোভ থেকে সংবিধানকে অতিক্রম করা, পাখিকে নামতে না দেওয়ার জন্য হ্রদ শুকিয়ে ফেলার মতো আত্মঘাতী। ফরাসি বিপ্লবের পরের দশ বছর থেকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা – উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে। গণতন্ত্র ছাড়া জনতার আর কিছু নেই, থাকতে পারেনা।


রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান রাজনৈতিক পদ্ধতিতেই হয়। সকল প্রতিবাদ পেরিয়ে একজন মানুষ যখন ইভিএমের সামনে পৌঁছন, তখন বেছে নিতে হয় রাজনীতিই। ই.ভি.এম. অরাজনৈতিকতা বোঝেনা।
প্রতিবাদ হোক, প্রতিরোধ হোক, গণতন্ত্রের মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষা হোক। তবু, রাজনীতি নির্বাচন করুন, সন্তর্পণে, ঠাণ্ডা মাথায়, ভেবে, অনেক ভেবে।
একটি পংক্তি ধার করি আবার। এবার ঋত্বিক ঘটকের থেকে-
“ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।”


(২)

বিচার চাই
অয়ন দাস


Aanupurbik 2


সাধারণ মানুষ স্বভাবগত ভাবে সহনশীল ও শান্তিপ্রিয়। তারা শাসককে ভয় পায় এবং ভয় পেয়ে মুখ বুজে যাবতীয় অত্যাচার সহ্য করে।শাসক আরও অত্যাচার শুরু করে। তখন মৃদু অসন্তোষ প্রকাশ করে সাধারণ মানুষ। শাসক পাত্তা দেয় না।শাসক মজা করে বলে - একটু আধটু বিরোধিতা না থাকলে কি খেলা জমে!
অত্যাচার আরও বাড়ে।আরও আরও আরও বাড়ে।একসময় ভয় পেতে পেতে মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায়।দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরও যখন সে অত্যাচারিত হতে থাকে তখন সে ফুঁসে ওঠে। তখন তার মন থেকে যাবতীয় ভয় উধাও হয়ে যায়। আশ্চর্য হাল্কা বোধ করতে থাকে সে। তখন একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি থেকে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন।সেই আগুন নেভানোর ক্ষমতা আর শাসকের থাকেনা।শাসকের যাবতীয় অস্ত্র তখন ভোঁতা হয়ে যায়।


কেন জানিনা আজকের পশ্চিম বাংলার অবস্থা দেখে আমার এই কথা মনে হচ্ছে।


সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে তবে সিবিআইয়ের কাছে গেছে কেসটা।সিবিআই এর আবার রেকর্ড রয়েছে কোনো কেসের সমাধান সূত্র না বের করতে পারার।সুতরাং প্রকৃত খুনিরা যে শাস্তি পাবেনা এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত।


তাহলে কী হবে?


শাসক-বিরোধী...বিরোধী-শাসক..শাসক-বিরোধী...বিরোধী-শাসক - এইরকম একটা যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা হবে।যুদ্ধে বিরোধীদের দুই এক গোলে হারিয়ে শাসক জয়ী হবে এবং....।


তবু এই নিকষ কালো আঁধারেও কিছু আলোর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে।


কীরকম ?


১) তিলোত্তমার বাবা মা মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া দশ লাখ টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাদের মেয়ের প্রাণের মূল্য যে দশ লাখ টাকা নয়, তা বুক চিতিয়ে বলার হিম্মত দেখিয়েছেন তাঁরা। আপনাদের স্যালুট ! আপনার মেয়ে ঘুমিয়ে আছে কিন্তু কোটি কোটি মেয়েকে সে জাগিয়ে দিয়ে গেছে। সেই মেয়েরা আপনাদের পাশে আছে।


২) সোসাল মিডিয়ার নামে যতই গালাগালি করি, সোসাল মিডিয়া দেখিয়ে দিয়েছে কী সাংঘাতিক ক্ষমতাশালী সে। আজ সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে তাকে বিপথে পরিচালনা করার দিন শেষ হয়ে গেছে।মাত্র একজন মানুষ নিজের ওয়ালে খুব ক্যাসুয়ালি একটা ডাক দিয়েছিল - চলো আমরা মেয়েরা রাত দখল করি( দখল শব্দটা নিয়ে আবার শাসক দলের নেতাদের ভীষণ আপত্তি। একজন বলেছেন - হুঁঃ..যারা বরকে সামলাতে পারেনা,পাশের বাড়ির লোককে ডেকে আনে তারা করবে রাত দখল!) হ্যাঁ মেয়েরা রাত দখল করেছেন। মেয়েরা নেতৃত্ব দিয়েছেন সেই রাত দখলের।পিছনে তাদের সমর্থনে এগিয়ে গেছেন পুরুষেরা।এই ঐতিহাসিক মিছিল,সমাবেশ কোনো রাজনৈতিক দলের মদতে হয়নি।আমি নিজে হেঁটেছি সেই মিছিলে।দেখেছি - সেই মিছিলে বিচারের দাবিতে গলা ফাটাচ্ছেন বহু শাসক দলের সমর্থক। এখানেই সরকারের পরাজয়।প্রত্যেক ব্যক্তি মানুষ নিজের ভয়ের থেকে মিশে যেতে চেয়েছেন এই জনতা পিন্ডে।সামিল হয়েছেন এই স্বতঃস্ফূর্ত গন আন্দোলনে। যারা বলছেন - একটা মিছিলে কিস্যু হবেনা, তাদের বলি এই যে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করার সাহস পেলো মানুষ, এই যে নিজের ভেতরের রাগ, অপমান, অসহায়তাকে অনেক মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারলো "ইডিয়ট কমন ম্যান" - এর ফল কিন্তু ভয়ংকর হতে পারে।


৩) বুদ্ধিজীবীদের ভন্ডামি, স্বার্থপরতা,ন্যাকামি মানুষ ধরে ফেলেছে এবং প্রকাশ্যে তাদের অপমান করতে মানুষ আর ভয় পাচ্ছে না।যে সব সেলিব্রিটি সরকারের সমর্থনে কথা বলেছে তারা যে কী পরিমাণ ট্রোল্ড হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।ইতিহাস সাক্ষী বুদ্ধিজীবীরা চিরকাল সরকারের হয়ে কথা বলেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অবাক করেছে মানুষের সাহস।


৪) সরকার ভয় পেয়েছে।ভয় পেয়েছে কারণ এই ঘটনা চোখ খুলে দিয়েছে। প্রতিটি হাস্পাতালেই যে সেক্স র‍্যাকেট চলে,ড্রাগ র‍্যাকেট চলে, ঘুষের বিনিময়ে পাশ করানোর ঘৃণ্য অপরাধ চলে এবং সরকার যে জেনেশুনে চোখ বুজে থাকে, একটা নেক্সাস ও স্বজন পোষণ যে বহুদিন ধরে চলে আসছে এবং তা মানুষের কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে,এবং এই সামান্য স্ফুলিঙ্গের থেকে যে দাবানল জ্বলে উঠতে পারে সেই ভয় সরকার পেয়েছে।মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে সরকার ভয় পেয়েছে।সোসাল মিডিয়াকে ভয় পেয়েছে সরকার। তাই গতকাল মুখ্যমন্ত্রী হুঁশিয়ারি দিয়েছেন সাইবার ক্রাইমে গ্রেফতার করবার।এতদিন পরে বাধ্য হয়ে মহিলা সাংসদদের মুখ দেখা গেছে।


আপনারা প্লিজ আয়নার সামনে একবার দাঁড়ান।


এবার হাসপাতাল ভাঙচুরের বিষয়ে কিছু কথা বলি। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে হাসপাতাল ভাঙচুর করেছে "রাম" ও "বাম" তাহলেও সরকার দায়িত্ব এড়াতে পারেনা।পুলিশ কী করছিলো? কেন হামলা থামাতে অপারগ হলো? কেন ইন্টেলিজেন্স ফেলিওর হলো? কেন পুলিশকে নার্সদের লেডিস টয়লেটে গিয়ে লুকিয়ে থাকতে হলো?


কেন? কেন? এবং কেন?


এরপরে পুলিশের ওপর বিশ্বাস থাকে? আস্থা থাকে? আমি জানিনা।


বড় কষ্ট হয়, বড় হতাশ লাগে, বড় কান্না পায়।


বামফ্রন্টের অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে,বিপুল জন সমর্থন নিয়ে যারা ক্ষমতায় এলো,যারা বললো - বদলা নয় বদল চাই... তারা নিজেরাই আজ বামফ্রন্ট এর মেধাবী ছাত্র।তারা নিজেরাই আজ নব্য শোষক।একমাত্র ভবিষ্যৎ বলতে পারবে কবে এই শোষকদের হাত থেকে মানুষ মুক্তি পাবে।তারপর আবার কোনো অত্যাচারী শোষক আসবে কিনা তা-ও বলতে পারবে ভবিষ্যৎ।


এদের সবাইকে কিন্তু ইতিহাস তার তুলাদন্ডে বিচার করবে।ইতিহাস কিন্তু কাউকে ক্ষমা করে না।




এ তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে এলে সেলুকাস!


দেখো আগুন জ্বলছে ধিকিধিকি, গুমরে উঠছে ক্রোধ।চিৎকার করছে বিশু পাগল।রাজ অন্তঃপুরে জেগে উঠেছে অতন্দ্র প্রহরীর সতর্ক চোখ। রঞ্জন!! চিৎকার করে উঠলো নন্দিনী। ভয়ে কেঁপে উঠলো রাজপ্রাসাদ। অলিন্দ থেকে বুক ফাটা হাসি হাসে প্রেতাত্মা চোখ।বন্দী পাখিটা তার আহত ডানা ঝাপটাতে থাকে।কয়েক ফোঁটা রক্তের গন্ধে রাত নেমে আসছে রাজপ্রাসাদে।


অপেক্ষা করো...একটু পরেই সারি সারি জ্বলে উঠবে মশাল।

মুক্তপদ্য

(১)

ফুটপাত দখল হবে মধ্যরাতে
সোমা দত্ত



mukta gadya 1


এত আলো তবু অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে শহর। তলিয়ে যাচ্ছে শীতল রক্তের দূষিত মেঘ। আঙুলের ক্লিকে মৃত্যু আর তার নিদারুণ যন্ত্রণা ঘুরে চলেছে প্লেট থেকে প্লেটে। উচ্ছিষ্টভোগীর জিভ উপরে নেবে বলে ছুটে চলেছে মানুষ। হাতে পোস্টার, স্লোগান। মুখের কশ বেয়ে পড়ছে উত্তেজনা। একের পর এক রাত এসে হাত ধরছে মেয়েদের। এইসব জোয়ার ভাটা অতিক্রম করে একটি ক্ষতবিক্ষত লাশ হেঁটে চলেছে পরজন্মের দিকে। নতুন করে সহ্য করবে বলে। নতুন করে সহ্য করবে তার গতজন্মের পরিচয়, মৃত্যুর মুখাপেক্ষী যন্ত্রণাসমূহ। যে সত্য অদৃশ্য তার ক্ষমতা অসীম। যে সত্য অদৃশ্য তার একশ' আট নাম। যে সত্য অদৃশ্য তার দশটি মাথা, একান্নটি ধাম।
তবে আমাদের গন্তব্য কী? আমরা কি অন্ধবিন্দুর ভিতরে মিলিয়ে যাওয়ার জন্য জন্ম নিয়েছি?শুধুমাত্র তড়িতাধান যুক্ত কণা? বন্ধনে পেঁচিয়ে ওঠা জটিল অস্তিত্ব, দৃশ্যত যার কোন চূড়ান্ত স্থিতাবস্থা নেই? কোথায় আমাদের হাড়, মজ্জা, হিমোগ্লোবিনের উত্তাপ? শুধুই কি শীতল প্রতিবাদ? ভাঙচুর কি তৈরি করবে না নতুন বানান?
এইসব ভাবতে ভাবতে একদিন শ্রাবণ শেষ হয়ে গেল। বৃষ্টিপাত থামল না তবু। গতকালের পোশাক থেকে ঝরে পড়ছে প্রতিশ্রুতি। কথা দিয়েছিলাম। কথা দিয়েছিলাম বিনামূল্যে বিতরণ করব সত্য। শপথ নিয়েছিলাম বিশ্বাস করব আমার মনের জোর আর প্রাণের মায়া দু মুঠোয় পিষে এগিয়ে যাব তোমার জন্য। বুক চিতিয়ে গুলি খেয়ে যারা মরে গেল তাদের সঙ্গে তুলনা করবনা তাদের যারা পিঠ দেখিয়ে বেঁচে নিল পঙ্গু জীবন। এখনো শ্লোগানে গলা মেলাতে লজ্জা হয় কেন তিলোত্তমা। জানো আমরা আয়না দেখিনা। অথচ আয়না দেখে নেয় আমাদের। কথা রাখতে পারিনি আজও। শ্রাবণ চলে গেল অথচ বৃষ্টি থামল না।
এবং দেখ বিগত দিনগুলোতে তুমি এবং আমি ক্রমাগত কাঁদছি... কাঁদছি... যতিচিহ্ন আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। অথচ তখনো অজুহাতের মতো খুঁজে চলেছি মেরুদণ্ডের যন্ত্রণা, মাছের ঝোলের নুন আর মাসান্তের মাহিনা।
এইসব ভাত আর মাড়ের একান্ত পেটের টান ছিঁড়ে আমরা কি বলতে পারব না উল্টে দাও পাশার দান, বদলে ফেলো পোস্টারের ঠান্ডা ভাষা, ভেঙে দাও আঙুল থেকে ক্লিক করে সিঁড়িতে চড়ার বাসনা। এই ক্রম উত্তোরণের পথ থেকে ফিরে না আসতে পারলে আমাদের বিশ্বাস ভাঙবে না।
শহরে খুন হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন অজস্র লাঞ্ছনা। তুমি আর আমি লুকিয়ে আছি জনসংখ্যার সমুদ্রে। আমাদের বুকে এখনো নম্বর লাগেনি। একটি চিহ্নিত নম্বর হওয়ার বিপদসীমা থেকে কিছুটা দূরে আমরা চিৎকার করছি একযোগে। আমাদের প্রতিবাদ ভিড়ে মেশে, বাড়িতে ফিরে হাঁফায়, গরম চা খোঁজে, কাগজ হাতড়ায়, সোশ্যাল মিডিয়া তরঙ্গে তরঙ্গে খুঁজে নেয় আমাদের চাওয়া পাওয়া। রহস্যভেদ হলে পরে, তুমি আর আমি গুগল হতে পারি একসাথে। স্ট্রিমিং চলবে জীবিত ও মৃত মানুষের। কারফিউ লাগবে শহরে।'ফুটপাত দখল হবে মধ্যরাতে'। মূর্তি ভাঙব আমরা বিস্ফোরণে। স্বৈরাচারের পতন হল বলে স্লোগান দেব। তারপর? কতদূর যাব আমরা? কতটা মাটি খুঁড়ে পুনর্বার আবিষ্কার করব স্নানাগার?
রাজার ঘরের ভিতর রয়েছে সহস্র রাজার ঘর। আমরা একে একে ভাঙছি আর দেখছি একটি নতুন ঘর ঘিরে ধরেছে আমাদের, কী বিপুল মহিমায়। তুমি দাবা খেল না কেন তিলোত্তমা। মেয়েদের খোলা বুক ছুঁয়ে বলছি চেকমেট দেবনা। খেলায় খেলায় ঢেকে রাখব তোমার রহস্য। মরতে ভয় পাই না অথচ মৃত্যুর পেশীবহুল হাতুড়ি দেখলে আমি বদলে ফেলি স্টেটমেন্ট। তোমার ডায়েরি আমি পড়ব না। আমি বেঁচে থাকব এই ধুমধামের পৃথিবীতে, বেঁচে থাকব ছবির পিক্সেলে, ওয়েব ভার্সনে। তোমাকে ট্যাগ করে টেনে নেব দলে। বলব তুমি আমার। একসঙ্গে ভার্চুয়াল জীবন বাঁচব আমরা, ভাইরাল হব, নিলামে দেব তোমার মৃত্যুযন্ত্রণা আর কানের উপরে গোঁজা হলুদ ফুল। তুমি হলুদ ফুলের পাপড়িতে কপিরাইট স্বীকৃত হয়ে প্রেসক্রিপশন লিখবে আমাদের সুস্থতার।
এবং এই নাতিদীর্ঘ ফ্রাস্ট্রেশনের পরে তুমি আমাকে একটি সুলভ বিয়োগ চিহ্ন দেবে সে আমি জানি। আসলে আমি হতাশা লিখছি হতাশাকে ছুরি মেরে। আমাদের ভিতরে যেসব ছোটখাটো দুর্নীতি, লোভের আকর, লাভের খিদে তার মুখ আমি দেখেছি। অপরাধকে দেখেছি ধীরে ধীরে গাঢ় হতে। আমরা কেন ডিনামাইটের মতো হতে পারছি না তিলোত্তমা? কেন রোজ খুন হয়ে যাচ্ছি না রাজার বাড়ির ফুটপাতে। কেন লাশের উপর লাশ, তার উপরে আরও নতুন লাশ পেরিয়ে যেতে যেতে একবার মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া লিখে দিতে পারছি না তার কালো কপালে। আর কতদিন পুরোনো গানের ধূলিকণা জড়ো করে শহীদের বাণী লিখে যাব আমরা? উৎসব কি ভাঙতে পারিনা আমরা? বলতে পারিনা এই শহরের বুকে আর কোনদিন আলো জ্বলবে না?
আমাকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলি দাও তিলোত্তমা। খণ্ড খণ্ড শরীরের সাথে মিশে যাক তোমার অনুচ্চারিত যন্ত্রণা।


(২)

এ লড়াই জিততে হবে
শর্মিষ্ঠা ঘোষ


 
mukta gadya 2


প্রতিবাদ ব্যাপারটাই আপেক্ষিক। আমরা কোন ঘটনায় উদ্বেলিত হব , কোন ঘটনায় চুপ করে থাকব সবকিছুই আমাদের পক্ষ অবলম্বনের উপর নির্ভর । তারপরও কখনো কখনো আমরা বাধ্য হই অন্তত সামনাসামনি স্বীকার করতে যে , যা হয়েছে তা ঠিক হয়নি। এবার রইল সুবিচার পাবার জন্য আমি কি করছি, কি বলছি? অপরাধী আমার পক্ষের হলে আমি সেফ খেলব। আমি সুবিচার চাইবো নরম করে কিন্তু ভান করব এই অপরাধের পেছনে কি আছে তা আমার জানা নেই। আর যদি ক্ষমতাবান হই তো প্রশাসনকে ব‍্যবহার করব অপরাধ এবং অপরাধীকে আড়াল করতে। লোকে কি বলছে না বলছে কি ভাবছে না ভাবছে কি চাইছে না চাইছে আমি সেসব তোয়াক্কা করব না। আমি তখন তিন বাঁদর, কিছু বলি না শুনি না দেখি না। আর যদি বিরোধীপক্ষে থাকি তো তীব্র ভাষায় প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি চাইব নানারকম প্রশ্ন তুলব প্রশাসনের গাফিলতি থাকলে ল‍্যাক অব গভরনেন্সের জন‍্য মুখ্য প্রশাসকের বিচার পর্যন্ত চাইব কারণ দিনের শেষে দায়িত্ব তার। তার জন্য পদত্যাগ এসব কিছুই চাইবো। নিজের কর্ম ঢাকার জন্য প্রশাসক তখন নিজেও মুখ লুকোন জনতার বিচার চাওয়ার মিছিলে। বাধ্য হন অত্যাচারীতের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করতে। কিছু মানুষ সেই ক্ষেত্রে কিছুদিন বিভ্রান্ত বোধ করে। কিন্তু কোন মিথ্যাই বেশিদিনের জন্য ময়দানে থাকতে পারে না। কারণ মিথ্যাচার এর অনেকগুলি মুখ। একটি ভার্সন ধরে রাখা মুশকিল অনেক মুখে। জনতার হুজুগে আন্দোলন এর পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী মঞ্চ তৈরি না হলে বেশিদিন আন্দোলন এর রাশ হাতে রাখা যায় না। আঞ্চলিক প্রতিবাদগুলি সংহত করে সর্ব‍ব‍্যাপী গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে হয়। সাহস এবং সত‍্য অবলম্বনে লেগে থাকতে হয় অভীষ্ট লক্ষ্যে স্হির। আমাদের তো দেয়ালে পিঠ না ঠেকলে ঘুরে দাঁড়ানো হয় না সচরাচর। অনেক মূল্য চোকাতে হয় তারজন‍্য অনেক সময়ই। কথায় বলে আগুনে পুড়ে সোনা। আর মানুষ সুন্দর
প্রতিবাদে। সহমর্মিতায়। সহযোগিতায়। সুতরাং বলাই যায় এ লড়াই বাঁচার লড়াই। এ লড়াই জিততে হবে। প্রতিবাদ মানুষ চেনায়। বন্ধু চেনায়। গুড সামারিটান তৈরি করে। তৈরি করে গুড সিটিজেন। দেশ কাল জাতির ইতিহাসে এদের কিঞ্চিৎ ভূমিকা রয়ে যায়।

ছোটগল্প

ম‍্যানিকুইন
অদিতি সেনগুপ্ত



maniqueen




সারবেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ম‍্যানিকুইনের দল। প্রি-পূজা স্টক ক্লিয়ারেন্স চলছে শপিং মলের প্রতিটা শোরুমে। অক্সেমবার্গ আর টার্টেলের শোরুমের মাঝে নতুন একটা শোরুম। রথযাত্রার দিন খুলেছে। নামজাদা ব্র‍্যান্ড, কিন্তু প্রি-পূজা সেল আর ওপেনিং ধামাকা মিলিয়ে বেশ মোটা অঙ্কের ছাড় চলছে এখানে। আর তাই সকাল থেকেই ভীড় উপচে পড়ছে এই শোরুমে। ম‍্যানিকুইনগুলোর গায়ে সাঁটা নানান মূল‍্যের প্রাইস ট‍্যাগ। দেখতে দেখতে কাঁপা হাতে দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢোকে রাখি। অনেকক্ষণ ধরে এটা সেটা ধরে ধরে দেখতে থাকে। ওর চোখেমুখে কিসের যেন একটা খোঁজ! সস্তার আধময়লা জামাকাপড়ের মোড়ক ওকে আলাদা করে দিচ্ছিল ক্রেতাদের থেকে। স্টোর ম‍্যানেজার বেশ কিছু সময় ধরে নজর করছিল রাখিকে।


-- কী চাই এখানে?


কানের কাছে আকস্মিক প্রশ্নবাণে চমকে তাকায় রাখি। শোরুমের লোগো আর আইকার্ড দেখে বোঝে ব‍্যক্তিটি এই শোরুমের সঙ্গেই যুক্ত। আমতা আমতা করে বলে,


-- আআ আমি মানে। আমার একটা কাজের খুব দরকার। সেজন্যই শোরুম গুলোতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আসলে পুজোর আগে তো অনেক লোক নেওয়া হয়, তাইই...


-- হুম। তা কোথা থেকে আসা হচ্ছে?


-- শীতলা গাঁয়ে আমার বাড়ি স‍্যার। বাবার কারখানায় লকআউট। ভাইবোনগুলো ছোট ছোট। মা তিনটে বাড়িতে রান্নার কাজ করে। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়ে চলেছে ওই টাকায় প্রায় না খেয়েই কাটাতে হচ্ছে। যা হোক কিছু কাজ দিন স‍্যার। আপনি যা বলবেন আমি তাইই করার চেষ্টা করব...


-- আরে থামো থামো। একসুরে বলেই চলেছে...! শোনো...


-- হ্যাঁ হ্যাঁ স‍্যার...


-- এই প্রত‍্যেকটা ম‍্যানিকুইন দেখছ তো, এগুলোতে যে জামাকাপড় পড়ানো আছে, এগুলো প্রতিদিন সকালে খুলে সব ঝেড়ে মুছে আবার পরিয়ে দিতে হবে। এছাড়া সমস্ত জায়গা পরিস্কার করতে হবে। রাত দশটার আগে কিন্তু ছুটি নেই। কি? পারবে এতো সব?


-- হ্যাঁ স‍্যার পারব স‍্যার, খুব পারব। কিন্তু এতো রাত্রে ফিরব কী করে, না মানে বাস তো তখন...


-- সে তো জানিনা। তবে তুমি এসো। তোমার দ্বারা হবে না।


-- না না স‍্যার পারব স‍্যার। বাবার সাইকেলটা নিয়ে আসব স‍্যার।


-- হুম...শোনো, প্রতিদিন দুশো টাকা করে পাবে আর একবেলা খাওয়া। এছাড়া দুবার চা। রাজি থাকলে কাল থেকেই চলে এসো।


-- রাজি স‍্যার। আপনাকে কি বলে যে ধন্যবাদ জানাবো!


-- ঠিক আছে ঠিক আছে ওসবের দরকার নেই। শুধু কাজে ফাঁকি দিওনা আর কামাই কোরোনা। আর শোনো, কাল আসার সময় দুকপি পাশপোর্ট সাইজ ফটো আর আধার কার্ডের ফোটোকপি করিয়ে আনবে।


★★★★★★


-- স‍্যার দশটা বেজে গেছে এবার আমি বেরোবো?


-- শোনো বাপু এই উইকএন্ডে এতো হিসেবমতো বাড়ি যাওয়ার তাড়া লাগালে চলবে না। এমনিতেই আজ স্টাফ কম আছে। তারওপর আজ আবার মালিক এসেছে। এখন যাওয়া চলবে না। কাজ করো চুপচাপ। দরকার হলে পৌঁছে দেওয়া হবে।


প্রায় মাসখানেক হয়ে গেলো এখানে কাজ করা। সেই সকাল দশটা থেকে রাত দশটা একফোঁটা বসা নেই! বাড়িতে ফিরে যখন বিছানায় যায় মনে হয় ওর নিম্নাঙ্গ বলে কিছু নেই! কিন্তু তবুও সংসারের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁতেদাঁত চিপে কাজটা করে যায়।


রাখি বাড়িতে মাকে ফোনে জানায় যে আজ ওর ফিরতে আরও রাত হবে। তারপর আবার কাজে লেগে পড়ে। একে সকলেই বাড়ির পথ ধরে। শুধু রাখি অপেক্ষায় থাকে কখন ওকে পৌঁছে দেওয়া হবে। আরও বেশ কিছু সময় পরে ম‍্যানেজার ওকে বলে ওই যে কালো রঙের যাইলো গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে ওতে উঠে পড়তে। রাখি ব‍্যাগ গুছিয়ে পা বাড়ায় গাড়ির দিকে। দরজাটা খুলতেই একটা ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে ঝাপটা মারে ওর। কোনোরকমে উঠে এককোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে পড়ে রাখি।


"আরে চিকনি চামেলি ছুপকে আকেলি পুয়া চড়হাকে আয়িইই..."


আরেএএএ ইয়ে দ‍্যাখো ইয়ার ইয়ে তো সচমে চিকনি চামেলি ছুপকে বইঠি হুয়ি হ‍্যায়!


চার পাঁচজন ছেলে হুড়মুড়িয়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। মদের ঝাঁঝালো গন্ধে এসি গাড়ির কাচবন্ধ ডিব্বাটায় দম আটকে আসছিল রাখির আর সেইসঙ্গে একটা হিমশীতল ভয়ের স্রোত নামছিল শিড়দাঁড়া বেয়ে।


-- আরে জানেমন, কুছতো বোলো ইয়ার! পুরো কুড়িহাজার টাকা তুলে দিয়েছি তোমার ওই ম‍্যানেজারের হাতে। আজতো গোটা রাত মস্তি হবে তোমাকে নিয়ে। উফফফফ কেয়া ফিগার হ‍্যায়। উউউমমমাহহহ পুরা মাক্ষন।


-- আআ আমাকে প্লিজ ছেড়ে দিন। আমার বাড়িতে আমি ছাড়া দেখার কেউ নেই। আমার বাবা...


আর কিছু বলার সুযোগ মেলেনা রাখির...


মুখে ঢোকানো কাপড়ের ডেলাটা ধীরে ধীরে শ্বাসরোধ করে ফ‍েলে ওর। কিন্তু তারপরেও মুক্তি মেলেনা! প্রাণহীণ শরীরটার উপরেই পালা করে চলতে থাকে পৌরুষ প্রদর্শন।


সকালে রাখির বাড়িতে থানা থেকে ফোন যায়,
-- আপনার মেয়ে মদ‍্যপ অবস্থায় সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ট্রাকের সামনে চলে আসে। স্পট ডেড। আপনারা আসুন বডি শনাক্ত করে নিয়ে যান।


তারপর আরও একটা ফোন যায় পূর্তমন্ত্রীর কাছে,
-- হ্যাঁ স‍্যার কেসটা সামলে নিয়েছি। মদ খেয়ে অ‍্যাক্সিডেন্ট করেছে বলে দিয়েছি। বাড়ির লোক আসছে। দাহকার্যটা চটপট মিটিয়ে ফেলাতে পারলেই নিশ্চিন্ত!


শপিং মলের ম‍্যানিকুইনগুলোর প্রাইসট‍্যাগ বদলে যায়। ৭৮ তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে আজ পুরো ৫০ শতাংশ ছাড়! মাইকে তারস্বরে বেজে চলেছে,


"আজা আজা দিল নিচোরে রাতকি মটকি ফোড়ে..."

ব্যক্তিগতগদ্য

নীরবতার অনুবাদ
কাকলি দাশ বন্দ্যোপাধ্যায়



neerabataar onubaad


মা ,তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ মা?
ঘুমাও ,মা ঘুমাও ,
কতদিন ঘুমাও নি তুমি !

মা শোন, আমার চেম্বার ঘরটা ভাড়া দিয়ে দিও ,
আমার জমানো টাকাটা দিয়ে তোমার গলার হারটা ছাড়িয়ে এনো  ,
বাবার বাড়ি করার স্বপ্নটা আর পূরণ করতে পারলাম না মা আমায় ক্ষমা করো।

মা তুমি শুনছো?
আমার মাথায় একটু বিলি কেটে দেবে
না থাক তুমি ঘুমাও,
সেদিনও গহন রাতের ক্লান্তির পাশে এমন উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল তোমার শুশ্রূষা-
সে জানতো গভীর ঘুমচিহ্নের আবাসভূমি পেরোলেই ভোরের ললিত রাগ শোনাবে তার ঘরে ফেরার গান, 
কিন্তু অবচেতনে উপাসনার ক্যানভাস থেকে কিছু অপরিশোধিত শব্দের আনাগোনা তার স্বস্তিকে অবরুদ্ধ করেছিল বারবার -
ঠিক তখনই স্বপ্নের পাশে বসে তোমার এই মেয়েটা সলমা চুমকি দিয়ে লজ্জাবস্ত্র বুনতে বুনতে একটা নদী হয়ে বয়ে চলল ছলছল ছলছল...

হঠাৎই  প্রেক্ষাপট বদলঃ

সেই মায়াচ্ছন্ন রাতেঃ

নদীর বুকে হঠাৎই হানা দিল কৌশলী দস্যুর বেপরোয়া উমেদারদল...
ষড়যন্ত্রীদের আদিম হাত নারীর মর্যাদা বাস্তুচ্যুত করতেই সারা শরীরে বেজে উঠল সাইরেন, 
মস্তিষ্কের সংকেতে রক্তরসে ছড়িয়ে পড়লো এপিনেফরিন,
সেরিব্রাম চিৎকার করে উঠলোঃ 
ফাইট মেয়ে ফাইট, ফাইট অর ফ্লাইট।
ততক্ষণে পাকদণ্ডী বেয়ে অগণিত কামপরবশ কীট শরীরের অলিগলির দখল নিয়ে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে তার ঐশ্বর্য।

গোপন সুড়ঙ্গ আবিষ্কারের পৈশাচিক উল্লাসে বেপরোয়া পৌরুষ ঠোঁট গাল স্তন উরু জঙ্ঘায় বসাচ্ছে স্নেহহীন শ্বাদন্তের তীক্ষ্ণতা।
শ্বাপদদের জিভের লালারস আর রক্তে ভিজে যাচ্ছে  উন্মুক্ত যৌবন।
যন্ত্রণায় নীল হওয়া শরীরটার দুটো পা চিরে ধরে, হাত পা মুখ বেঁধে অশ্লীলতার অনুবাদ করতে  উন্মত্ত যখন ওরা, তখন শেষবারের মত সব শক্তি এক করে চিৎকার করে মেয়েটা বলেছিল, "এ অন্যায়ের শাস্তি তোরা পাবি"

আর সহ্য করে নি 
ওই কালনেমীর দল এই তেজ। 
বুকের উপর চেপে বসে এক্কেবারে গলাটা চেপে  ধরল একজন অনুগত 
আর এক নরপিশাচ তখনই আমার মুখের উপর চেপে বসলো যাতে সব শ্বাসপথ রুদ্ধ করা যায়।

জানো তখনও ধর্ষকাম নরখাদকরা আমার দেহের প্রতিটি অধ্যায় ভোগ করে
চলেছে।

ওরা ভেবেছিল 
আমাকে দুর্বল করে 
হত্যা করে নামহীন গোত্রহীন বেওয়ারিশ করবে।

ওরা জানতো না আমি আগুনপাখি -ফিনিক্স

একটা আমি-র থেকে 
আজ জন্ম নিয়েছে 
হাজার হাজার তিলোত্তমা হাজার হাজার অভয়া 
তারা তোমার পাশে অসুরদলনী দুর্গার মতো 

শয়তানগুলোকে ধরো মা, ওদের ধরো। 
ওদের পালাতে দিও না
ছিঁড়ে দাও ওদের কদর্য মুখের উপর সাঁটা মোহন মুখোশ

চোখের জলে নিভিয়ে ফেলো না মা বুকে জ্বলা চিতার ওই আগুন-
দৃঢ়তার মাপকাঠিতে রেখোনা কোনো ক্ষয়।

ওরা সুযোগসন্ধানী, ওৎপেতে আছে যে কোন সময় ভিটের অবসাদ জরিপ করে দুর্যোধনী কায়দায় ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে 
সওদা করবে তোমার দারিদ্রের।

ওরা এলে তোমাদের মেরুদন্ডটা সামলে রেখো মা।

রেখায় লেখায়

 

Rekhaai Lekhaai 1

Rekhaai Lekhaai 2

Rekhaai Lekhaai 3

Rekhaai Lekhaai 4

মানুষের মুখ

 

Manusher Mukh

শনিবার, ২০ জুলাই, ২০২৪


 


 

সম্পাদকীয়



কবিতাভিত্তিক

বিভ্রম 

মধুপর্ণা বসু




চোখ জুড়ে শুধু অতীতের সুর্মাদানী গলে পড়ে,

তাকে ডাকি অদ্ভূত বিস্মৃত নাম নিয়ে, যা ছিলনা

তবুও সেই নাম জপমালা হল কেন? 

আসল তলিয়ে গেছে হাজার টেথিসের সুনামি ওপারে,

ভালোবাসি একটা অস্তিত্বে, সেই সত্যি সেই-ই চাক্ষুষ।

বাকি আধা জন্ম অনতিক্রম্য, শুধু ঝাপসা ওপেক,

তার মধ্যে দিয়ে অচেনা নিজেও,

শুধু আজকের সেই ডাক সত্যি! 

কত তর্কে, কত ইজেল ভেঙে গুঁড়ো হল ঠাণ্ডা যুদ্ধে, 

মনের সাথে আত্মার,তার সাথে স্পর্শ প্রিয় অস্তিত্বের,           

আর তারও পরে...

অজানা গহীন কালো থেকে তুলে আনা প্রাণ শব্দ, 

সেই আজ পরিচয়ের থেকেও বড় সত্যি-

যা মাথার ধূসর বস্তুর প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও বিস্ময়

ভুলে যাওয়া অতীতের তলহীন কুয়া থেকে উঠে

বর্তমানকে কি এক অবুঝ টানে জড়িয়ে আছে।

কবিতাভিত্তিক

শব্দ কথার সম্পর্ক

শুভাদিত্য ঘোষ দস্তিদার




জীবনে কথার চেয়ে শব্দ খুবই অবশ্যম্ভাবী

কথার প্রেক্ষিতে ফোটা শব্দগুলো

ভালো - মন্দে মেশানো,

কিন্তু শব্দ জেগে থেকে

বিস্তৃত করে রাখে পাতা

আক্রমণ হতে পারে যে কোনোদিন

সম্পাদকের কলমের।


মাতৃসমা শব্দ যদি

তুমুল বিস্তার নিয়ে আসে কখনও

আমার খুব আনন্দ হয়,

আমি দেখতে পাই রূপসী যত কথা


কথার রকমারি আস্ফালন দেখে

আমার বড় হিংসে হয়,

কথা তো মানুষের মধ্যেই জেগে থাকে

সমাজ সংসারে জীবনে সর্বত্র।

কবিতাভিত্তিক

দুটি  জীবন

তাপস   মাইতি




মুখর পদধ্বনি ব'য়ে গেলে থেমে যায় ঝড়

গাছেরা বুঝি তখন আলোকিত হয়

অনেক পথ চলা চারদিকে

আবার মেঘ ওঠে

ঝড় তাহলে কি ফের সম্ভবনাময়

অথচ প্রকৃত প্রেমিকেরা আসেনি এখনও


ঝড়ের বদলে উঠলো বজ্র- বিদ্যুৎ

গানের সুরে পথ কাদা করছে বর্ষা

ফিরে যায় সকল পথচারী

কেবল দুটি জীবন বেড়িয়ে পড়েছে

খুঁজতে সেই গাছেদের পাড়ায়

যেখানে অন্ধকার জ্বালবে একটি প্রদীপ

Kobitar Alo March Sankhya 2025

   প্রচ্ছদ ঋণঃ-  পিনাকী রায় (কণিষ্ক)