বুধবার, ৮ মে, ২০২৪
সম্পাদকীয়
আজ দীর্ঘ চার বছর ধরে কবিতার আলো তার প্রতিশ্রুতি মতো আপনাদের হাতে তুলে দিচ্ছে সম্পূর্ণ কবিতার একটি পূর্ণাঙ্গ ট্যাবলয়েড। নাতিদীর্ঘ এই যাত্রাপথে প্রতিকূলতা যে আসেনি তা নয়। সব লিটিল ম্যাগাজিনকেই একটা সংগ্রামের অধ্যায়ের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। কবিতার আলোও তার বাইরে নয়। এসেছে প্রতিকূলতা, এসেছে বাধা। তাও অঙ্গীকারটুকু বজায় রাখতে ধীরে ধীরে চারা থেকে বৃক্ষে পরিণত হয়েছে আমাদের কবিতার আলো। আমরা আঁকতে চেয়েছিলাম বিগত ১০০ বছরে বাংলা কবিতার বিবর্তনের বাঁকবদলের ইতিহাস।যুগের সাথে সাথে বাংলা কবিতার আবশ্যিক পালা পরিবর্তনের অধ্যায়গুলো আমরা তুলে আনতে চেয়েছিলাম সরাসরি আপনাদের সামনে। এবং আমরা সেই কাজটিই করে চলেছি আজও। কবিতার আলো আপনাদের হাত ধরেই হেঁটে আসছে বিগত চার বছরের বেশি সময় ধরে। শুধু একটি ট্যাবলয়েড প্রকাশ করেই থেমে থাকিনি আমরা। বাংলা কবিতার প্রতি দায়বদ্ধতা বজায় রেখে ডিজিটাল মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়াতে বিভিন্ন কবিতা বিষয়ক অনুষ্ঠান এবং আলোচনাচক্র আয়োজন করেছি নিয়ম করে। আমাদের চলার কঠিন পথটুকু খুব যত্ন করে নিজেদের মধ্যে লুকিয়ে রেখে আপনাদের সামনে তুলে আনতে চেয়েছি বাংলা কবিতার দীর্ঘ যাত্রাপথের ধারাবিবরণীটুকু। পাঠক ও গ্রাহকদের ভালোবাসা না পেলে এই জায়গায় উত্তরণ যে সম্ভব নয় তা আমরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি। তাই নিজেদের দায়বদ্ধতাটুকু আর একবার স্মরণ করে আমরা কবিতার আলোর পক্ষ থেকে নিয়ে এসেছি আরও একটি নতুন উদ্যোগ। আজকের যুগে কারিগরি প্রাসঙ্গিকতাকে মাথায় রেখে আমরা আপনাদের হাতে তুলে দিতে চাই একটি যুগোপযোগী এবং সম্পূর্ণ বাংলা সাহিত্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি কবিতার আলো ব্লগজিন। আর এই পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশের জন্য আমরা বেছে নিয়েছি পঁচিশে বৈশাখের মতো বাঙালির এক মহামাহেন্দ্রলগ্নকে। রবিপক্ষের সূচনার আলোয় আলোকিত হয়ে আজ শুরু হচ্ছে কবিতার আলোর আরেকটি নতুন যাত্রাপথ। যেখানে বাংলা কবিতা ও সাহিত্যের বিভিন্ন দিকগুলি সাজানো হয়েছে তাদের নিজের আঙ্গিকে। প্রথম প্রকাশে বেছে নেওয়া হয়েছে কবিতার আলোর সম্পাদকদের মূল্যবান কলম। এরপর লিখবেন আপনারাই। আমাদের অঙ্গীকার, প্রতিমাসে তৃতীয় সপ্তাহে আমরা প্রকাশ করব কবিতার আলো ডিজিটাল ব্লগজিন। লেখা পাঠানোর জন্য ইমেইল আইডি - kobitaralo2019@gmail.com
লেখা পাঠান আপনারাও। বাছাই করা লেখা নিয়ে আমরা প্রতি মাসে হাজির থাকবো আমাদের ব্লগজিনের পাতায়। লেখা প'ড়ে এবং তাতে মন্তব্য করে পাশে থাকুন আমাদের। সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় শেয়ার করুন এই ব্লগজিনের লিংক এবং আপনাদের লেখা। আপনাদের পাশে থাকাই আমাদের উৎসাহ বৃদ্ধির প্রধান অনুঘটক। কবিতার আলো পড়ুন ও পড়ান।
বন্ধু | শর্মিষ্ঠা ঘোষ
ফিরিয়ে নিয়ে চল , আমায় ফিরিয়ে নিয়ে চল মায়ের গর্ভের নিশ্ছিদ্র আকুতিতে | ফিরিয়ে নাও মাটির গন্ধে বৃষ্টির ফোঁটায় বাতাসের আদরে | ফিরিয়ে নাও পুজো আর প্রেমে | সমর্পণ আর বিশ্বাসে | তুমিই পার তুমিই পার তুমিই তো পার সব | আমার না বলা কথাদের বোল ফোটাতে পার না চেনা রূপের দরজা খুলে দিতে পার না চেনা বন্ধুর হাত স্পর্শের দ্বিধা অতিক্রমও তোমারই সম্মতিতে | তুমিই পার তুমিই পার একমাত্র | তোমাকেই বলা যায় যত অভিমান কথা । তুমিই ভালো জান পুজো নাকি ছুপারুস্তম প্রেম। তুমিই দেখেছ যত ব্যথা রাত্রি । তুমিই , সে তুমিই বিপুল বিপ্লব। রোজ যাকে চিনি চির যে নির্ভর চোখ বুজে দিক নির্দেশ ভরসা তাকে 'নমো' বলে ঠাকুর করি না তো । তাকে 'এসো' বলে বুকের ভেতর ডাকি । 'বসো' বলে বন্ধু আসন পাতি ।
আমার রবি | রজত সরকার
আমার রবি
রজত সরকার
রাখ না তোর ম্যাড়ম্যাড়ে যতো ন্যাকা ন্যাকা সব লেখা
মাথায় থাকুন রবীন্দ্রনাথ যেন ন্যাতানো লতা পাতা।
অ্যায় গরু সর এক্ষুনি সর করিসনে কো ভুল,
ভীষণ রেগে মারব ছুঁড়ে হলুদ গাঁদার ফুল।
আধুনিকতার দোহাই দিয়ে যারা এমন কথাই বলেন,
না জানি হয়তো কিসের জ্বালায় আপন মনেই জ্বলেন।
প্রাণের কবিকে বুঝতে হলে কিচ্ছু লাগে না আর,
শুধু নির্মল একটি হৃদয় আর সরলতা দরকার।
আম বাঙালির মনের রাজ্যে গীতার বাণীর মতোই
বিরাজ করেন রবীন্দ্রনাথ, আসুক ঝঞ্ঝা যতোই।
আহত মনের গভীর গহনে সব হারানোর জখম
এক লহমায় দেয় জুড়িয়ে রবি ঠাকুরের মলম।
“আমি খাব না তোর পাতে” অভিমানী শিশু বলে,
মায়ের নায়ক বীরপুরুষটি ঘোড়ার পিঠে চলে,
তুমি কী ক’রে বোঝ আমার শিশু মনের কথা?
আমার ছোট্ট মনে ফুল ফোটা ওই দুর্বোধ্য ব্যথা?
“তমিজ মিঞার গরুর গাড়ি” চ’ড়ে এ মন যেতে চায়,
বক্সীগঞ্জে পদ্মাপাড়ের হাট আমি তোমার কাছেই পাই।
ছয়টি ঋতুর এমন মাধুরী, মন কি খুঁজে পেতো?
শরৎ কালের হিমেল পরশ, কোথায় পাওয়া যেত?
ভক্তি ভরা পূজার থালি কে ধরাত আমার হাতে!
দেশমাতৃকার চরণে হৃদয় লুটাতো কোন প্রভাতে?
“একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে, রাজার দোহাই দিয়ে”
তাদের মুখোশ কে ছিঁড়ে দিত বলো কবি, দৃঢ় শক্তি নিয়ে?
যখন চৈতি হাওয়ায় বিরহী এ মন ডাকে সর্বনাশ
ঠিক তখনই কোনও পঁচিশে আসে বৈশাখ মাস।
বাঙালি মননে সব পার্বণ হে কবি তোমায় ঘিরে
তোমারই তাগিদে নব যৌবন আসে যেন ফিরে ফিরে।
গহিন আঁধারে গোপন গগনে ঘনঘটা যদি ঘেরে
গম্ভীর মেঘ গুরু গর্জনে এক বর্ষণ খুঁজে ফেরে।
কী জানি কী হয় যখন হৃদয় একলা থাকতে চায়
তোমার গানে হারানো প্রাণে কাকে যেন খুঁজে পায়!
তোমার ছন্দে এ কোন কিশোরী নেচে চলে এলোকেশে
পেখম তুলে মনের ময়ূর, আজ পথ ফিরে পেল শেষে।
তুমি না থাকলে দেশের মানুষ কোন ভাষা আজ বলত!
তোমার দেখানো পথ না থাকলে কোন পথে সে চলত!
তোমার মতো দূরদর্শী কে আছে এ সংসারে?
যে বলতে পারে আগামীর কথা এমন মনের জোরে...
“আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতুহলভরে,
আজি হতে শতবর্ষ পরে!”
পৃথিবী | শুভঙ্কর ভৌমিক
রবি ঠাকুরের যে মরমি বলাই গাছের ব্যথায় কেঁদে উঠতো, সেদিন দেখছি ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে ছেলেটি একটা টব পেতেছে...
একটিও ফুলগাছ না লাগিয়ে তার নাম রেখেছে পৃথিবী!
জলহীন, মাটিহীন শুষ্ক টবের গায়ে একটা ডাইনোসরের স্টিকার সেঁটেছে;
কোন সবুজের বিজ্ঞাপন নয়, শুধু আদিম হিংস্রতার সংলাপ সেখানে;
ছেলেটির নাম অবশ্য কেউ জিজ্ঞেস করে নি এতোদিন,
শুধু রাস্তা থেকে তাকিয়ে দেখেছে -
'গীতাঞ্জলি' এপার্টমেন্ট...
ব্যালকনিতে ঝুলতে থাকা শূন্য টব;
সভ্যতার বেদী তলে একটা আদিম পৃথিবী...
রবীন্দ্র প্যাকেজ | পার্থপ্রতিম সেনগুপ্ত
লম্বা দাড়ি পিছনে হাত
তিনিই হলেন রবীন্দ্রনাথ।
সবাই বলে কৃষ্টি তার,
তুলনাহীন, চমৎকার।
সিরিয়াল কি সিগন্যালেতে
রবীন্দ্রনাথ থাকেন সাথে।
পাড়ার হারু, চায়ের দোকান,
মুখে লেগে রবীন্দ্রগান।
টিপছাপ দেওয়া নেতা হারুন,
রবির অনুরাগী দারুণ।
সাজান বাড়ি, আলমারি'তে
গীতাঞ্জলি রাখেন তাতে।
পঁচিশে বোশেখ ছাদের পড়ে
কেষ্টা মাতাল বোতল ধরে,
গলার ভেতর দু'ঢোক দিয়ে,
রবির গান ওঠেন গেয়ে।
বাঙালি মানেই রবীন্দ্রনাথ,
টোটাল প্যাকেজ দিন হোক বা রাত।
তুমিময় | শ্রীমন্ত সেন
তুমি আছো বলে কষ্টগুলো আজও কষ্ট বলে মনে হয় না,
কেমন যেন সুখের কোল ঘেঁষে চলে যায় আলগোছে,
তুমি আছো বলে নিজেকে চেনার দায়
আকাশে-বাতাসে, আলোর হুল্লোড়ে, পাখিদের পাখসাটে
নিশ্চিন্তে বিলিয়ে দেওয়া যায়—
তখন আর দায় থাকে না,
হয়ে ওঠে আনন্দের গহন উচ্ছ্বাস!
কখনও এ বুকে তোমার অগাধ যাতায়াত,
কখনও কৃপণ পদচারণা,
কখনও গোপন ছাঁদে আলতো পায়ে আসো,
আমার সকল গ্লানি, সকল বেদনা
আপনার করে মাখো,
অনুভবে শুধু এই কথাটাই রাখো—
তুমি ছাড়া কেউ কিছু নয়, কিছু নয়,
সকলেই বুকের গহনে
তুমিময়, তুমিময়।
তাই আজ আলো আসে বুকে আপনার সুখে,
তাই আজ বৃষ্টি আসে বুকে অঝর শ্রাবণ-ধারায় ঝেঁপে,
তাই আজ ভুবনপুরের বোধ
লুটোপুটি খায় এ বুকে স্বচ্ছন্দে।
তুমিময় হয়ে আসে,
তুমিময় থেকে যায়—
শুধু তুমি আছো বলে।
রবিরঙ্গে | কৌশিক চক্রবর্ত্তী
(১)
ভিড় সামলাচ্ছে কেউ কেউ
অভিন্ন উচ্চতায় প্যান্ডেল টাঙানোর কথা
বাঁশ হাতড়ে খোঁজ পড়েছে বই
রবীন্দ্র রচনাবলী ষোড়শ খণ্ড...
টুকরো সাম্রাজ্য জোড়া লাগালে
ঠাকুরের জন্মলগ্ন দীর্ঘায়িত হয় আরও...
(২)
পানীয় জলের যোগান পর্যাপ্ত
বোতলে ভরে নিন শীতল শ্লোগান
মুখে উড়ে আসতে পারে গণতান্ত্রিক ভোর
সকাল হবে
এগিয়ে আসবেন রবীন্দ্রনাথ
রাস্তায় পরাবাস্তববাদীর ক্রমশ অনুসরণ...
(৩)
এবার পুজো
ফুলের উপাচার শূন্যতার পরিপন্থী
ধার্য হোক ঝুরোবালি-
মালা দাও গলায়-
তেত্রিশ কোটি প্রবঞ্চনা
এবং একটি মাত্র নির্বাপিত গোধূলির রং...
(৪)
বিসর্জনের সুর সংযমী
ঠাকুরের জন্মপথে উজানী সংশ্লেষ
রবিসন্ন্যাসের কথা উহ্য
ডিভাইড অ্যান্ড কনকার রুলে
সকলে উপকরণ ধরে আছে দু'হাতে...
উপরন্তু জোড়া লাগছে জোড়াসাঁকোর ব্যবচ্ছিন্ন ছাদ...
(৫)
এবার পঁচিশের ডাকে
হাতে এসেছে হারানো গোধূলি
ঘর চিনে নিচ্ছে রবিপ্রেমিক...
বিনিময়প্রথায় শিলমোহর দিয়েছ-
সমস্ত একনিষ্ঠ ঘাসমাঠের বদলে
জড়ো করেছি পুনশ্চর হারানো যতিচিহ্ন..
অভিনেতা রবীন্দ্রনাথ | বৈজয়ন্ত রাহা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরকালীন চিরবিস্ময়। অজস্র সৃষ্টিপ্রাচুর্যের মধ্যেই প্রতিফলিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সৃজনকৌশল এবং ব্যক্তিজীবনের নানামাত্রিক স্তর । তাঁর নাটক আজও গবেষণার বস্তু। কিন্তু তাঁর অভিনয় দক্ষতা নিয়ে চর্চা কিছু কম। আজ সেই বিষয়ে কিছু প্রাসঙ্গিকতার অবতারণা করি।
অন্যান্য শাখার মতো নাটক রচনায়ও রবীন্দ্রনাথ উৎকর্ষের পরিচয় দেন। নিজের রচিত নাটকে অসাধারণ অভিনয়ও করতেন তিনি। অভিনয় শিল্প সম্পর্কে তার অভিনিবেশ, চর্চা ও অনুশীলন প্রকারান্তরে তার সৃষ্টিকেই সমৃদ্ধ করেছিল। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অনেক সদস্য অভিনয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। মূলত পারিবারিক নাট্য ঐতিহ্য রবীন্দ্রনাথকে নাট্যাভিনয়ে উৎসাহ জোগায়।
১৭৯৫ থেকে ক্রমান্বয়ে ধারাবিবর্তনের মধ্যে দিয়ে বাংলা নাটকের পরিণতি পর্বে , পেশাদার নাট্যগোষ্ঠীর আবির্ভাবেও সৌখিন নাট্যচর্চা থেমে থাকেনি বরং পেশাদার নাট্যগোষ্ঠী তৎকালীন মধ্যবিত্ত শিক্ষিত চিত্তের দাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়। ফলে ঠাকুরবাড়ির শখের থিয়েটার চর্চা যেমন বন্ধ হয়নি তেমনি, ঠাকুর পরিবারের থিয়েটার-চাহিদা ও অভিনয়ে প্রশংসারও ঘাটতি পড়েনি।
সেসময় মধ্যবিত্ত শিক্ষিত যুবকদের সান্ধ্যবিনোদনের কেন্দ্র হিসেবে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ১২৯৯ বঙ্গাব্দে ‘সঙ্গীত সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সঙ্গীত সমাজের উদ্যোগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটক অভিনীত হলেও রবীন্দ্রনাথ সংগঠনটির সঙ্গে জন্মলগ্ন থেকে জড়িত ছিলেন। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘এই সময়ের অভিনীত নাটকের অধিকাংশ নায়ক-নায়িকার উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি, অঙ্গভঙ্গি ভালো ছিল না। এসব দেখার দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথের ওপর বর্তেছিল।’
ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধায় ‘সেকালের কথা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- জোড়াসাঁকো-নাট্যশালার দ্বিতীয় পর্বের সূচনা হয় রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে। ঠাকুরবাড়ির দ্বিতীয়পর্বের শুরুতে ‘বিদ্বজন সমাগম সভা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয় ১২৮১ বঙ্গাব্দের ৬ বৈশাখ। সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের পর বার্ষিক অনুষ্ঠানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘পুরুবিক্রম’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ। মাত্র তের বছর বয়সে এই নাটকে অভিনয় করে উপস্থিত দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেন তিনি।
অনেকে মনে করেন ‘সঙ্গীত সমাজ’ এর উদ্যোগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রহসনমূলক ‘এমন কর্ম আর করব না’ নাটকে অলীকবাবুর ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ প্রথম অভিনয় করেন। ‘অলীকবাবু’ চরিত্রটি ফরাসি নাটক থেকে নিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। কিন্তু অভিনয়ের পূর্বে রবীন্দ্রনাথ এই চরিত্রটিকে অনেক অদলবদল করে ফরাসি গন্ধ দূর করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের বন্ধু প্রিয়নাথ সেনের মন্তব্য তুলে ধরেছেন প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়- ‘এমন সুন্দর অভিনয় কখনও দেখি নাই। … যাঁহারা রবিবাবুর অভিনয় দেখিয়াছেন- তাহারা জানেন যে কবিবর শুধু আধুনিক বঙ্গ সাহিত্যের শিরোমণিই নহেন, নট চূড়ামণিও বটে।’ প্রিয়নাথ সেনের এ মন্তব্যে রবীন্দ্রনাথের অভিনয় প্রতিভা সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়। কৈশোরে দাদা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নাটকে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নিজের নাট্যভাবনা ও অভিনয় প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন তিনি। মূলত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উৎসাহ রবীন্দ্রনাথের নাট্যজীবনে ব্যতিক্রমী ধারার সূচনা করে। ‘মানময়ী’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ ‘মদন’ চরিত্রে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ‘ইন্দ্র’ এবং কাদম্বিরী দেবী ‘উর্বশী’ চরিত্রে অভিনয় করেন। এ নাটকটি বাংলা নাট্যসাহিত্যে গীতিনাট্যের প্রথম প্রয়াস হিসেবে স্বীকৃত। ‘বিদ্বজন সমাগম সভা’য় রবীন্দ্রনাথ নিজের লেখা ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকের বাল্মীকি চরিত্রে অভিনয় করেন। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী প্রতিভাদেবীও এ নাটকে সরস্বতীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের অভিষেক ঘটে পরিবারের বাইরে সাধারণ দর্শকদের সামনে। ব্যাপকভাবে দর্শকনন্দিত হন রবীন্দ্রনাথ। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’র অভিনয় সাফল্যের পর তিনি ‘কালমৃগয়া’ নামে একটি গীতিনাট্য রচনা করেন। ঠাকুরবাড়ির তিন তলার ছাদে এই নাটকটি প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়। কোলকাতার বহু সম্ভ্রান্ত ও গণ্যমান্য ব্যক্তির সামনে প্রদর্শিত এই নাটকে রবীন্দ্রনাথ ‘অন্ধমুনি’ চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের আপ্লুত করে দেন। পরবর্তীতে তিনি শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় পারিবারিকভাবে অভিনীত নাটকে অভিনয় ছেড়ে দেন।
অভিনয় দক্ষতায় নাটকের চরিত্রের বলিষ্ঠতা যথাযথভাবে প্রমাণ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। শব্দ প্রক্ষেপণের ভঙ্গি, সাজ ও চরিত্রের অন্তর্নিহিত বক্তব্যটি যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতেন বলেই তার অভিনীত নাটক তৎকালীন সময়ে খুব জনপ্রিয় ছিল। ১৩০৩ বঙ্গাব্দে ‘সঙ্গীত সমাজ’ আয়োজিত ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ নাটকে রবীন্দ্রনাথ কেদারের ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই নাটকে নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ অভিনয় করেছিলেন। কেদারের সাজপাট ও ঢিলেঢালা মেকআপে রবীন্দ্রনাথ এমন কপট বিনয়ের অবতারণা করেছিলেন, এতে চরিত্রের মূলভাবটি অনায়াসে দর্শকরা বুঝতে পেরেছিলেন।
এছাড়া শান্তিনিকেতনে অভিনীত প্রহসন নাটক ‘বিনে পয়সার ভোজ’ এ যাদুকরী অভিনয় দিয়ে দর্শকদের অভিভূত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মূল উদ্দেশ্য ছিল অভিনয়ের মাধ্যমে বাংলা নাটকের উন্নয়ন। একই সঙ্গে নাটকের সঙ্গে সাহিত্যের সব শাখার সমন্বয় সাধন। তিনি যেমন ঠাকুরবাড়ির অগ্রজদের নাটকে অভিনয় করতেন তেমনিভাবে নিজের রচিত নাটকেও অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকদের রসসিক্ত করতেন। রবীন্দ্রনাথের ৬৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নৃত্যনাট্য ‘নটীর পূজা’ অভিনীত হয় শান্তিনিকেতনে। এ নাটকে ‘ভূপালি’ চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এ নাটকের দর্শক হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২২ সালে কোলকাতার আলফ্রেড ও ম্যাডান রঙ্গমঞ্চে ‘শারদোৎসব’ নাটকে সন্ন্যাসীর ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেন- “শারদোৎসব এর অভিনয়াঙ্কিকের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের ভবিষ্যৎ নাটকসমূহের অভিনয় বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাইয়াছিল। রবীন্দ্রনাথের নাট্যাভিনয় ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হইয়াছিল, ‘শারদোৎসব’ অভিনয়ের মধ্য দিয়াই তাহার প্রথম সূচনা দেখা দিয়াছিল।”
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় ‘রবীন্দ্র জীবনী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ তাঁহার বাল্যকালে নাটক ও অভিনয়ের যে দৃষ্টান্ত ও আদর্শ সৃষ্টবোধের অগোচরে উপলব্ধি করিয়াছিলেন, তাহা সম্পূর্ণ ইউরোপের আদর্শে গড়া থিয়েটারের অনুকরণে রচিত নাটকের অভিনয়। এই সব অভিনয়ের ক্ষীণ স্মৃতিকণিকাগুলি বালকের অবচেতনে মনের স্তরে সঞ্চিত ছিল এবং উত্তরকালে তাহাই পূর্ণাঙ্গ আর্টরূপে কবির জীবনে প্রকাশ পায়।’ শেষ জীবনে এসে তিনি নৃত্যনাট্যের ওপর জোর দিয়েছিলেন। নৃত্যকলার মাধ্যমে উচ্চাঙ্গ অভিনয় দক্ষতা অর্জনে তিনি দেহের প্রতিটি অঙ্গকে কীভাবে অভিনয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা যায় সেদিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। যে কারণে রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য আজো দর্শক শ্রোতার মননে গভীর রেখাপাত করে। এ প্রসঙ্গে নৃত্যশিল্পী শান্তিদেবী ঘোষ বলেছিলেন- ‘নাটকের বিভিন্ন চরিত্রের অভিনয় একা তিনি শিখিয়েছেন পাখি পড়ানোর মতো করে। প্রত্যেকটি কথার সঙ্গে কোথায় কিভাবে ঝোঁক দিতে হবে, কিভাবে স্বরের বৈচিত্র্য আসবে, সবই তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খুরূপে দেখিয়েছেন।’
বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ নাটক রচনার মতো অভিনয়েও নতুনত্ব ও আধুনিকতার বিস্তার ঘটিয়েছেন। বহুমাত্রিক ব্যবহারে নাট্যাঙ্গনকে বহুমাত্রিকতা ও বিশিষ্টতা দান করেছেন। রবীন্দ্রত্তোর বাংলার দর্শকসমাজে বাংলা নাটকের যে সমাদর তার বীজ রবীন্দ্রনাথের হাতেই প্রোথিত। বাংলা সাহিত্যের প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথ যেমন প্রাসঙ্গিক তেমনি তার উন্নত রুচি ও অভিনয় ঐশ্বর্য নাট্যমুগ্ধ বাঙালির হৃদয়েও চিরভাস্বর।
দরিদ্র রবীন্দ্রনাথ | অজিতেশ নাগ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম বিত্তশালী পরিবারে হলেও তিনি কিন্তু আদতে জমিদার ছিলেন না। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিবারে সবার জন্য হাতখরচ বেঁধে দিয়েছিলেন। ঠাকুর বাড়ির তৎকালীন খরচের ক্যাশবই থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী মৃণালিনীর জন্য মাসোহারা ধার্য ছিল মাত্র ২৫ টাকা আর রবীন্দ্রনাথের জন্য বরাদ্দ ছিল ১০০ টাকা মাত্র। এই টাকা খরচ করেই চলতে হয়েছে তাঁদের। ফলে নিজস্ব সংসার চালাতে রবীন্দ্রনাথকে প্রচুর অর্থকষ্টের মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করতে হয়েছে। আর্থিক সংকট তাঁর ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনকে বিপর্যস্ত করেছিল বারবার। পারিবারিক ও সাংসারিক ব্যয়ভার বহনে তিনি অনেকটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। উপায়ন্তর না পেয়ে বাধ্য হয়েই তিনি বন্ধু-বান্ধবের কাছে টাকা ধার করেও সংসার চালিয়েছেন – এ তথ্য অনেকের কাছেই অসঙ্গত বিবেচিত হলেও বিস্ময় প্রকাশের কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথের জন্য জমিদারির দায়িত্ব দেয়ার পরে বরাদ্দ করে দেন মাসিক ৩০০ টাকা। জমিদারি পরিচালনা, সংসার চালানো, অতিথি আপ্যায়নসহ সকল খরচ ঐ ৩০০ টাকার মধ্যেই তাঁকে করতে হতো। এ কারণে তিনি অর্থ খরচের দিক থেকে খুবই মিতব্যয়ী ছিলেন। প্রয়োজনের বাইরে কোনো খরচ তিনি করতেন না। অত্যন্ত সাদামাঠা জীবন ছিল তাঁর। রবীন্দ্রপুত্র রথীন্দ্রনাথের কথায় সে চিত্রই ফুটে ওঠে- ‘অন্যদের মতো বাবা তখন দুশো টাকা মাসোহারা পেতেন। তাতেই তাঁকে সংসার চালাতে হতো। জমিদারির ভার বাবার ওপর যখন দেয়া হলো তখন মহর্ষি তাঁকে আরও একশ টাকা মাসোহারা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। বহুকাল ধরে এই তিনশ’ টাকাই বাবার মাসিক বরাদ্দ ছিল’। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আদতে ছিলেন অবৈষয়িক মানুষ। ফলে বিশাল জমিদারিত্ব পরিচালনায় তাঁর কবিচিত্ত অল্পদিনের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে ওঠে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তিনি পাটের ব্যবসা শুরু করেন। এখানকার পদ্মাপাড়ের মানুষের জীবন, প্রকৃতি ও জীবনবোধ তাঁর কবি হৃদয়ে সাহিত্য সৃজনের উপাচার হিসেবে ধরা দিয়েছিল কবির অজান্তেই। এ কারণেই তাঁর ব্যবসার প্রসার হয়নি এবং ক্ষতিও হয়েছিল বিস্তর। তিনি বুঝলেন ব্যবসা তাঁর জন্য নয়। ইতিমধ্যে সংসারে এসেছে পাঁচটি ছেলেমেয়ে। ফলে রবীন্দ্রনাথ আরো মিতব্যায়ি হয়ে উঠলেন, একদম আমাদের মত ঘোর সংসারী। ব্যয় সংকোচনের উদ্দেশ্যে তিনি সস্তা ও কমদামী পণ্য সামগ্রীই ব্যবহার করতেন ও করতে বলতেন। ছেলেমেয়েদের কিনে দিতেন সাধারণ জামা, জুতো, পোশাক-পরিচ্ছদ ও সস্তায় বইখাতা। দাম বেশির জন্য ছেলেমেয়েদের কখনো দাঁত মাজার পেস্ট কিনে দেননি। তার পরিবর্তে দিয়েছেন কম দামের সস্তা দন্তমঞ্জন। মেয়েদের সুগন্ধি তেলের বদলে কিনে দিয়েছেন সস্তা নিমের তেল।
বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে লেখা একটি চিঠিতে কবির এ আর্থিক দুরবস্থার চিত্র পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন- ‘প্রতিদিনের খুচরা খরচ প্রায় ধার করে চালাতে হয়’। অন্য একটি পত্রে তিনি লিখেছেন- ‘আমি তোমাকে সত্য বলচি এখন আর আমাদের কারো হাতে এক পয়সা নেই। আমার একমাত্র মহাজন হচ্চেন সত্য, তার কাছ থেকে ইতিমধ্যে ২০০ টাকা ধার নিয়ে সংসার চালিয়েছি।… আমাদের পরিবারে আজকাল এমনি দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছে যে, সে দূর থেকে তোমরা ঠিক উপলব্ধি করতে পারবে না।… দেনা যে ক্রমে কত বেড়ে যাচ্চে সে বলতে পারিনে।… আমার বয়সে আমি কখনো এমন ঋণগ্রস্ত এবং বিপদগ্রস্ত হইনি’। নিত্য অভাবের তাড়নায় ধার করতে করতে বাড়ছিল ঋণের বোঝা। মহাজনী কায়দায় উচ্চ হারে সুদ দিয়ে ঋণ গ্রহণ করা ছাড়া তাঁর কোনো গত্যন্তর ছিল না। ১৯০১ সালের ১৪ মার্চ তারিখে কবির লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায়। কবি লিখেছেন- ‘দোহাই তোমার সুদটা যাতে ১০ পার্সেন্টের বেশি না হয় সেই চেষ্টা কোরো।…নিতান্তই অসম্ভব হলে ১০ পার্সেন্টেই শিরোধার্য করে নিতে হবে।’ সংসারের অভাব কোন স্তরে পৌঁছালে রবীন্দ্রনাথের মতো একজন মানুষ চড়া সুদে ঋণ নিতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এর পরেও ছিলো মেয়েদের বিয়ে। সব মেয়েদের পাত্রস্থ করে রবীন্দ্রনাথ আক্ষরিক অর্থে প্রায় ফতুর হয়ে গেলেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে তাঁর সংগৃহীত পুরাতন বই তিনি বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন এবং তাঁর রচিত গ্রন্থের কপিরাইট পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন।
তাই যখন রবীন্দ্র বিরোধীরা লেখেন, - ‘থাকতো যদি টাকা পয়সা / থাকতো জমিদারি / রবির মতো কবি হতে / লাগতো নাকো দেরি’। তখন সত্যি সেইসব মানুষজনের জন্য করুণা হয়।
রবীন্দ্রনাথ এর স্বদেশ ও রাষ্ট্রভাবনা এবং আধুনিক ভারতবর্ষ | অয়ন_দাস
রবীন্দ্রনাথ আর সোশ্যালমিডিয়া | অদিতি সেনগুপ্ত
যদি আজকের এই ভার্চুয়াল দুনিয়ায় রবিঠাকুর থাকতেন, তাহলে তাঁর উপর এই সোশ্যাল মিডিয়া দাপট কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারতো তাই ভেবেই কাল্পনিক এক কথোপকথন...
স্থানঃ জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির অন্দরমহল।
পাত্র-পাত্রীঃ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাদম্বরী দেবী।
রবীন্দ্রনাথঃ ও নতুন বৌঠান কোথায় গেলে একবার এদিকে এসে দেখো একদম লেটেস্ট ভার্সন আইফোন এনেছি তোমার জন্য। তোমার সেলফোনটা তো ৩জি এক্কেবারে আউটডেটেড।
কাদম্বরীঃ বলি ঠাকুরপো আইফোন তো আনলে তা জিওর সিমটা ভরে দিয়েছো তো নাকি। বিহারী বাবু আজকাল আবার ওনার কবিতার ফেসবুক লাইভ দিতে শুরু করেছে, তারপর ইউটিউবেও আবার ওনার চ্যানেল আছে তাই ডেটা টা একটু বেশীই চাই বাপু আমার।
রবীন্দ্রনাথঃ আরে হ্যাঁ হ্যাঁ জিওর সিম ভরেই একেবারে নিয়ে এসেছি, তাইতো আধার কার্ড সঙ্গে নিয়েই বেরিয়েছিলাম। আর শুধু তাই নয় একেবারে ওয়াই-ফাই কানেকশনের কাজও সারা। যত প্রাণে চায় দেখো বিহারী বাবুর লাইভ! তা...শুধু বিহারীবাবুর কবিতার লাইভ ই দেখা হবে নাকি এই অধমেরটাও একটু আধটু দেখা হবে। ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন আমার ফেসবুক লাইভ -এর ভিউয়ারস কিন্তু পুরো বিশ্বজোড়া।
কাদম্বরীঃ আহা চটছো কেন বাপু আমিতো জানি তোমার খ্যাতি জগতজোড়া আর তাইতো তুমি বিশ্বকবি। নোবেল প্রাইজখানা কি আর এমনি এমনি পেয়েছো নাকি। বড় ভালো লাগে জানো মাঝেমধ্যে কখনও যদি বেরোই ট্রাফিক সিগনালেও তোমার গান বাজে। তবে তোমার উপর কিন্তু একটা বিষয়ে আমার ভারী অভিমান হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথঃ কি হয়েছে নতুন বৌঠান আবার অভিমান কিসের!
কাদম্বরীঃ তেমন বড় কিছু ব্যাপার নয় আসলে আগে তোমার সব লেখার প্রথম শ্রোতা বা পাঠিকা ছিলাম আমি, কিন্তু যখন থেকে এই হতচ্ছাড়া ফেসবুকটা এসেছে তখন থেকেই হয় লাইভ নয় পোস্ট হয়ে যায়। হ্যাঁ আমায় তুমি ট্যাগ করো ঠিকই কিন্তু তারসাথে আরো কতজন যে থাকে তার কোনো ঠিক নেই।
রবীন্দ্রনাথঃ আচ্ছা এই কথা ঠিক আছে এবার থেকে তোমার সামনে বসেই লাইভ করবো নয় টাইপ করবো তাহলেই তোমার প্রথম শোনা বা পড়া হয়ে যাবে।
কাদম্বরীঃ যাই বলো ঠাকুরপো আমাদের যৌবনে এতোসব ফেসবুক, টুইটার ওহো সেতো এখন আবার কি যেন ছাই ও হ্যাঁ মনে পড়েছে-- এক্স, তারপর ওই ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ এতসব ছিলোনা কিন্তু মনের বাঁধন অনেক দৃঢ় ছিলো। এখন ইন্টারনেটের জাল যতো বিস্তার হচ্ছে ততোই যেন সম্পর্কের জাল সঙ্কুচিত হয়ে পড়ছে।
রবীন্দ্রনাথঃ ঠিকই বলেছো বৌঠান তবে দ্যাখো একটা বিষয় ভেবে, এই আধুনিক যুগ বলেই অতখানি আফিম খাওয়ার পরও তোমায় বাঁচিয়ে আনতে পেরেছি। আর তাছাড়া, "আমরা নতুন যৌবনেরই দুত" এটা শুধু আমার রচনা নয় আমি আক্ষরিক অর্থেই নবীনের পূজারী।
কাদম্বরীঃ হুমম, কিন্তু কী লাভ হলো বেঁচে ফিরে!
কেমন যেন উদাস হয়ে পড়েন কাদম্বরী দেবী।
রবীন্দ্রনাথঃ চিয়ার আপ বৌঠান ওসব ভেবে আর মন খারাপ করতে হবেনা, এখন চলো তোমায় আইফোনের ফিচারসগুলো বুঝিয়ে দি। আরে নতুন দার সঙ্গে একটা ফেক অ্যাকাউন্ট খুলে ভাব জমাও তো, দেখবে তোমাদের মাঝের সব বরফ গলে যাবে। আর এই আমিতো রইলামই তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
প্রস্থান...
কবির সাথে রবিকাল | নীলম সামন্ত
দীর্ঘ এই দুপুরে জানালায় রোদ ঝাঁপিয়ে পড়লে আমি রূপকের হাত ধরি। রোদের নাম হয়ে যায় রাজা। আলগোছে স্পর্শ। নরম আদর। হঠাৎ ঘুমভাঙা চোখে সিগারেটের আগুন। কত কিই যে জ্বলে যায়, মিটিমিটি চোখে ভবঘুরেরা জড় হয়। তাদের মধ্যে যারা বিদেশযাত্রায় গিয়ে চিঠি লিখত তারা রবীন্দ্রনাথ৷ অক্ষরগুলো যেন নতুন কবিতা শোনা কাদম্বরী-চোখ। আহা রে, অমন অমলতাসের পথে কত রোদই না এসেছিল। আজকাল রাস্তায় সেসব ঝুলে আছে দেখে মেয়েরা গয়না বানিয়ে গলায় পরে৷ হলুদ পাপড়ি বুকের ওপর নরম হয়ে লুটিয়ে থাকে৷ আমি গুনগুনিয়ে উঠি, 'রোদন ভরা এ বসন্ত'...
বসন্তের পাঠ চুকে গেলেও ছায়া ঝুলে থাকে পাতার কিনারায়। যারা নির্মাণ বুঝে পৃথিবীকে দু'হাতে তুলে ধরতে চেয়েছে তারাই ধ্বংসের বীজ গর্ভে ধারণ করেছে৷ কবোষ্ণ যোনীপথে আকণ্ঠ বাঁশি-সুর। শাড়ির কুচিতে ধরে রেখেছি সুররিয়ালিজমের বালিঘড়ি৷ রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, শুনতে পাচ্ছেন, আমি আপনাকে তুমি করে বলতে চাওয়ায় সোনামুগ বিকেলে কারা যেন আতপের গন্ধে আবির মিশিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এ যে ভরা গ্রীষ্ম! আপনার 'আকাশ ভরা সূর্য তারা'য় কত খিদে ঝুলে আছে। বসন্তে ফুল হল, শস্য হল, তাও খিদে কেন মেটে না? বলতে পারেন নীলপাখি নাম দেওয়ার সময় কবি কতবার আপনার দিকে তাকিয়েছেন? বহু দীঘল ওই সবুজ, যারা বসেছে তারাও বৃক্ষ হয়ে আঁকড়ে আছে অসুস্থ প্রাণেদের। কবির দিকে তাকিয়ে থাকি, অনন্তবীথি, বাদামী প্যাস্টলকে দেখাই চুম্বনের প্রকারভেদ।
এবেলায় বরং ফিরে যাই। আমার তো কবি হওয়া হল না। শুধু তোমার গানের লাইনগুলোয় হাত বুলিয়ে অনুভব করেছি নিবিড় শঙ্খসুর। কবি বলেছিলেন, দক্ষিণমুখী হতে। অনর্গল কবিতা পড়ে যাবে আর আলতা পরতে পরতে বেলা ফুরিয়ে আসবে৷ আপনি কি বলেন রবীন্দ্রনাথ এ কি গভীর প্রেম? কি হল বলুন? এতো মৌনতা! টিকটিক ঘড়ির শব্দে গোপন করছি হোঁচটের ক্ষত, তাই হয়তো কৃষ্ণচূড়া বেড়ে উঠেছে৷ ফুলের ভেতর বসে আছে মধ্যযামের নীলপাখি। আমার হঠাৎ হঠাৎ খিদে পায় কেন বলুনতো? আপনার শহরের সবুজ বাড়িটায় একদিন হেলান দিয়েছিলাম, পেট ভর্তি কচুরি, ছানার জিলিপি ও ট্রাফিক সিগনালের রবিগান৷ সামনেই একটা মেয়ে পদ্ম বিক্রেতা। আমারও গালগুলো গোলাপি হয় রোদ শুতে এলে। অপূর্ব মেয়েটি আমার গালের মতোই নিরস্ত্র। আমি জানি তার ভেতর অজস্র সাপ ঘুমিয়ে আছে। কার কখন ঘুম ভাঙে। কিন্তু পৃথিবী রসাতলে তলিয়ে যাবার আগেও পুরনো মোমবাতির ছবিতে মেতে থাকবে ধুলোর এক্সিবিশন৷ মেয়েটি তখন হয়তো সাপের বিন বিক্রেতা৷
এই সাত পাঁচের ভেতরেই আমি শব্দহীন। চারপাশে জল ভরে গেলে পাতারা ভেসে ওঠে। জলের ভেতর বিবস্ত্র হলে স্বীকার করি আপনি আমার প্রতিবেশী বন্ধু। আসবাবপত্রের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাই স্থির পটচিত্র, যেখানে আপনার চোখের ওপর কাচ ফুটে আছে। নাকে ইঁদুর পালানো পায়ের ছাপ। সাহস করেই এগিয়ে যাই। আসলে আমার দরকার একটি খেলনাবাড়ির। রবিঠাকুর, আপনার সৃষ্টির রঙে প্রতিটা দেওয়াল লাবণ্য হয়ে উঠলে আমার প্রয়োজনীয়তা গুলিয়ে যাবে৷ নীলপাখি তখন অমিতের খোঁজে অশ্লীলতার সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করবে মানুষ খোয়ানো জ্যোৎস্নাদের। ফুলের মতো তাদেরও নাম করণ করবেন?
তা করতেই পারেন। তবে আজ আপনার জন্মদিন৷ আজ একটি জাতির জন্মদিন। জাতি সাদা লালে মেতে উঠবে ভেবে বিনা শর্তেই আমি আবার জানালামুখী হব। খানিকটা দেখতে পাবেন। উরুতে হাজার প্রজাপতি। আমিও মনে মনে ওড়ার পরিকল্পনাই করছি৷ তারপর কোনদিন ভুলে যাব আমার শরীরে অনেক ঘর৷ এক একটাতে এক একজন। আপনি মাঝের ঘরে৷ আপনার সৃষ্টি করা প্রতিটা প্রেমিকই তখন পাঞ্জাবীর শেষ বোতাম আটকে নিচ্ছে। জানালায় কাঠবেড়ালি দেখে আমি উঠে যাই বিস্কুটের খোঁজে। ছুটে যাই পথ পেরিয়ে। আপনাকে, আপনাদের পেরিয়ে অস্থির নদীজলের দিকে৷ আপনি অপেক্ষা করুন। আমি স্নান সেরে ভিজে কাপড়ে আসছি, ধুপ জ্বালানোর সময় হয়ে গেল।
-
প্রচ্ছদ ঋণঃ- দেবদুত মুখোপাধ্যায় সূচীপত্র ----------------------- প্রচ্ছদ ------------------ দেবদুত মুখোপাধ্যায় সম্পাদকীয় কলাম ------------...