শনিবার, ২০ জুলাই, ২০২৪


 


 

সম্পাদকীয়



কবিতাভিত্তিক

বিভ্রম 

মধুপর্ণা বসু




চোখ জুড়ে শুধু অতীতের সুর্মাদানী গলে পড়ে,

তাকে ডাকি অদ্ভূত বিস্মৃত নাম নিয়ে, যা ছিলনা

তবুও সেই নাম জপমালা হল কেন? 

আসল তলিয়ে গেছে হাজার টেথিসের সুনামি ওপারে,

ভালোবাসি একটা অস্তিত্বে, সেই সত্যি সেই-ই চাক্ষুষ।

বাকি আধা জন্ম অনতিক্রম্য, শুধু ঝাপসা ওপেক,

তার মধ্যে দিয়ে অচেনা নিজেও,

শুধু আজকের সেই ডাক সত্যি! 

কত তর্কে, কত ইজেল ভেঙে গুঁড়ো হল ঠাণ্ডা যুদ্ধে, 

মনের সাথে আত্মার,তার সাথে স্পর্শ প্রিয় অস্তিত্বের,           

আর তারও পরে...

অজানা গহীন কালো থেকে তুলে আনা প্রাণ শব্দ, 

সেই আজ পরিচয়ের থেকেও বড় সত্যি-

যা মাথার ধূসর বস্তুর প্রতিদ্বন্দ্বিতা সত্ত্বেও বিস্ময়

ভুলে যাওয়া অতীতের তলহীন কুয়া থেকে উঠে

বর্তমানকে কি এক অবুঝ টানে জড়িয়ে আছে।

কবিতাভিত্তিক

শব্দ কথার সম্পর্ক

শুভাদিত্য ঘোষ দস্তিদার




জীবনে কথার চেয়ে শব্দ খুবই অবশ্যম্ভাবী

কথার প্রেক্ষিতে ফোটা শব্দগুলো

ভালো - মন্দে মেশানো,

কিন্তু শব্দ জেগে থেকে

বিস্তৃত করে রাখে পাতা

আক্রমণ হতে পারে যে কোনোদিন

সম্পাদকের কলমের।


মাতৃসমা শব্দ যদি

তুমুল বিস্তার নিয়ে আসে কখনও

আমার খুব আনন্দ হয়,

আমি দেখতে পাই রূপসী যত কথা


কথার রকমারি আস্ফালন দেখে

আমার বড় হিংসে হয়,

কথা তো মানুষের মধ্যেই জেগে থাকে

সমাজ সংসারে জীবনে সর্বত্র।

কবিতাভিত্তিক

দুটি  জীবন

তাপস   মাইতি




মুখর পদধ্বনি ব'য়ে গেলে থেমে যায় ঝড়

গাছেরা বুঝি তখন আলোকিত হয়

অনেক পথ চলা চারদিকে

আবার মেঘ ওঠে

ঝড় তাহলে কি ফের সম্ভবনাময়

অথচ প্রকৃত প্রেমিকেরা আসেনি এখনও


ঝড়ের বদলে উঠলো বজ্র- বিদ্যুৎ

গানের সুরে পথ কাদা করছে বর্ষা

ফিরে যায় সকল পথচারী

কেবল দুটি জীবন বেড়িয়ে পড়েছে

খুঁজতে সেই গাছেদের পাড়ায়

যেখানে অন্ধকার জ্বালবে একটি প্রদীপ

কবিতাভিত্তিক

খুকি ও পাখিওয়ালা 

হারাধন ভট্টাচার্য্য।




"পাখি পুষবেন গো,পাখি," হাঁক দেয় পাখিওয়ালা

ডাক শুনে দোতলার গবাক্ষ থেকে দেখে মধুবালা।

"ও পাখিওয়ালা,দাঁড়াও,শুনতে পাচ্ছ,পাখিওয়ালা"/ পাখিওয়ালা চমকে ওঠে,- কে ডাকে কোন্ সে বালা! 

পুরনো রাজবাড়ী, সিংহদরজা সামনে ছোট্ট মেয়ে-/ পাখিওয়ালা অবাক চোখে,তারই চোখে রইল চেয়ে,

স্বর্ণচাঁপা গায়ের বরণ, মুখ খানি তার পরীর গড়ন  

কোন্ দেবকন্যা,মায়াভরা কাজল কালো দুটি নয়ন।

"ও পাখিওয়ালা, কী কী পাখি দেখাও না একবার "

কাছে গিয়ে পাখিওয়ালা,শোনায় তার পাখি-বাহার।  

জয়"এই দেখ টিয়া, চন্দনা, বুলবুলি, ময়না,শ্বেতকবুতর

আর কী পাখি নেবে,  তুমি চাইলে খুঁজব তেপান্তর।

"তোমার খাঁচার সব পাখিই নেব,কত দাম বলো চটপট,

দেখ না ওরা নীল আকাশে ওড়ার জন্য করছে ছট্ফট্,/ ডাকছে ওদের নীল আকাশ,ডাকছে ঐ সবুজ বনতল "

বলল খুকি, পাখিওয়ালা শূন্যে তাকায়, চিন্তায় বিহ্বল।

"এ তো অনেক দাম, তুমি কি কিনতে পারবে ও মেয়ে, বিনি পয়সায় একটি পাখিই তোমায় দিলাম তার চেয়ে"

বলেই পাখিওয়ালা চাইল খুকির চোখে। 

                                                          বলল মধুবালা

"সব পাখির দাম হবে না, দিই যদি এই সোনার বালা?"

"তোমার হাতের সোনার কঙ্কন,আমি নেবে কেমন ক'রে

ওর দাম তো অনেক টাকা,ও খুকি যাও গো ঘরে ফিরে"

বলল পাখিওয়ালা।  

                                "এ বালা লাগে না কোনো কাজে, পাখিগুলোকে দাও গো ছেড়ে, ভীষন কষ্ট খাঁচার মাঝে,/

মাকে ছেড়ে ওরা কি থাকতে পারে, ওদের মা'রা কাঁদে 

বলো, তোমায় যদি কেউ ফন্দি ক'রে,বন্দী করে ফাঁদে।"

বলেই খুকি বাড়িয়ে দিল হাতের সোনার বালাখানি ---

ছোট্ট খুকির কোমল কথায় কি ভাবল,বলল,"মামণি

তোমার সোনার বালা আমার পাখির চেয়েও দামি

ওটা তোমারই থাক, ওটা না হয় তোমায় দিলাম আমি,

সব পাখিই তোমায় দিলাম, মুক্ত করো  নিজের হাতে  উড়িয়ে দাও ওদের নীল আকাশে, ভাসুক আনন্দেতে।/ তোমার জন্য চিরতরে ছেড়ে দিলাম পাখি ধরার কাজ, 

তোমার কাছে শিখে নিলাম মুক্তির আনন্দ কি দরাজ!

নীল আকাশে ডানা মেলে পাখিরা গাইল কতো গান 

খুকি ও পাখিওয়ালা রইল চেয়ে আনন্দ বিহ্বল প্রাণ।

কবিতাভিত্তিক


মনে পড়ে

বিশ্ব প্রসাদ ঘোষ



স্বপ্নের মধ্যে দীঘল রাজহাঁস

আর দীঘল কিছু দেখলেই

মনে পড়ে যায় সুজাতার কথা। 


যে নারী বুদ্ধকে পায়েস দিয়েছিলেন, 

অন্য কিছু বোধহয় নয়, তাহলে

বুদ্ধদেবের বাকি জীবনটা অন্যরকম হতো_

কবিতাভিত্তিক

বোকামো 

আসিফ আলতাফ




কিছু কিছু বোকামো আমার কড়ে আঙ্গুল ধরে হাঁটে,

এতো বকাঝকা করি

এতো রাগঝাক

তবু নাবালক সন্তানের মতো ওরা আমার আঙুল ধরেই থাকে;


আপনাকে দেখলে একটি বোকামো

কপোলে ঝুলে থাকা চুল ফু দিয়ে উড়িয়ে দেয়

আমি ওর কান্ড দেখে হেসে উঠি

আপনার দু গালে রং ধনু ওঠে;


একটি বোকামো আপনি হাসলে আমকে বিব্রত করে

তখন কী করবো কিছুই বুঝি না;


আপনি সামনে এলে একটি বোকামো

আমার প্রপোজ  ফ্লাওয়ার নিয়ে দে ছুট

তার কারণে আপনাকে একটি টকটকে লাল গোলাপ দিয়ে

আজো বলা হয়নি 

আই লাভ য়্যু ....

কবিতাভিত্তিক

ভোকাট্টা হবার অপেক্ষায়

উদয়ন চক্রবর্তী



এসো হাঁটতে হাঁটতে আমরা কিছু কথা বলি

ম্যাজেন্ডা রঙের হৃৎপিন্ডে যেন রক্তকরবীর

ছোঁয়া না লাগে 

যেন জার্মান প্রাচীর তৈরি না হয় সম্পর্কের সাঁকোয়

 ভাই সুপারি না দেয় ভাইয়ের জন্য


তারপরও আমরা না চাইলেও গ্রহণ লাগবেই

সম্পর্কের ছায়া ক্রমশ অন্ধকার ছড়িয়ে নিজের রক্ত মাংস চিবিয়ে খাবে

আর আকাশ তার নিজস্ব খেলায় মেতে থাকবে

তার সংসার নিয়ে


 আমরা হয়ত শকুন হয়ে দূর আকাশে

খুঁজে দেখব কোথায় মৃত বিবেক চিৎ হয়ে শুয়ে

এখনও প্রাণ আছে কিনা


মানুষের অমানুষি ক্লোন ঘুরে বেড়াবে

ঘরের ভেতর রাস্তা বাজার আর নগরদর্পণে

আমরা সবাই এখন রাজা

সবাই আমরা আততায়ী


একটা বেচাল একবজ্ঞা পেটকাটি ঘুড়ির

বেয়াদপি জীবন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে 

আমরা হারিয়ে ফেলছি নিজস্ব ঠিকানা

শূন্যহাতে আসা গন্ত্যবহীন যাত্রাপথে হঠাৎ

ভোকাট্টা হবার অপেক্ষায় বসে আছি

ওদিকে আমার আত্মজ স্বপ্নের রামধনু হাতে

পেরিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব সাঁকো।

কবিতাভিত্তিক

হেমন্তের রূপকথা 

জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় 




এবারও হেমন্ত হঠাৎ চলে গেল।আলতো ছোঁয়া যে পাইনি

এমন নয়,খানিক হাওয়া শিমুলের লাল,কিছুটা পলাশ আঁকড়

ঘেঁটু বা বুনোফুল দু-একটা ছোবল মারেনি এমনও নয়

তবু একটাও দীর্ঘ স্মৃতিকথা লিখিনি।

কোনো চাষি বা মজুরের ঘামে আগুনফুল আঁকিনি

প্রহরের পাখিডাক বা গোধূলির  ছবিও লিখিনি।

হেমন্ত হারিয়ে গেল।হেমন্ত মানে সেই অনাথ ছেলেটির সঙ্গে

বাসন্তীর দেখা হয়েছিল,আলাপ ও প্রলাপে স্কুল আর

কোচিং ক্লাসের ঘণ্টায় কোনো রামধনু কেউ তো দেখেনি

স্কুল সেরে বাসন্তীর পতিগৃহে যাত্রার পরপরই হেমন্ত উধাও ! 

শান্ত পুকুরের মতো গাঁয়ে ঢেউ উঠেছিল, স্বচ্ছজল,কাদা নয়,

ছেলেটা সবার প্রিয়,বড়ো ভালো, মেয়েটিও।


তবু হেমন্ত হারিয়ে গেল,হেমন্তেরা এভাবেই হারিয়ে যায়।

তার মায়ের চুলে পাক ধরেছে,ছোটো হয়েছে দীর্ঘশ্বাস

বিকেলের কাজ সেরে দরজা খুলে বসে সে ভাবনায় ডুবে থাকে

দিনের আলো কমে এলে রাতের আলো জ্বলে,

তার চোখের চিকচিক স্বপ্ন আরও উজ্জ্বল হয়।

তাতে অলৌকিক অক্ষরে লেখা হারানো মানিক লাভের

অনবদ্য রূপকথা।

কবিতাভিত্তিক

চিয়ার্স 

সুমন্ত দাশ রায়




আগের মতো মেঘ করেনা এখন।

কেমন যেন শুকনো আছে জমিন!

'বৃষ্টি' নামে ডাকলে তোমায় পাবো?

তোমার ফোনে অধরা ইনকামিং।


মেসেঞ্জারে দেখছিনা আজ কেন?

'শরীর খারাপ'? আজ কুড়ি দিন হলো।

আগের মাসের তারিখ মনে আছে,

সেদিনতো ফোন তুললে! আজ তোলো।


কী যেন এক বলার ছিলো কথা।

ভুলেই গেছি যা কিছু দরকারি।

আমার চোখে খুচরো পাপের বোঝা

তোমার চোখের কাজলে আন্তরিক।


বাতাসে আজ ধাক্কা খাচ্ছি অনেক।

মদ ধরিনি, অ্যালকোহলের কসম।

তবুও নেশায় মত্ত আছি এমন _

পারলে এখন আদিম হিসেব কষো।


মিটিয়ে দেবো পুরোনো ধার বাকি,

বকেয়া সুদ, থোড়াই করি কেয়ার!

মেঘকে নাহয় ডাকপিওনের বেশে 

পৌঁছে দেবো জানলাতে, মাই-ডিয়ার।


অথৈ জলে তল পাবেনা জেনেও 

ঘাটের কাছে নিজের ছায়া ঘাঁটি।

ছায়ার বুকে তরঙ্গ দাও বলেই 

নিয়ম করে জলের ধারে হাঁটি।


তোমার ছবি দেবো কি নিউজ-ফিডে?

ব্লক না হওয়ার নিয়ম নীতি মেনে।

ইথার ঘিরে জমতে থাকে ব্যথা।

আবার ভাবি -কী লিখবো ক্যাপশানে?


আচ্ছা ছাড়ো... যে কথা বলছিলাম_

এই হ্যাংওভার থাকুক স্মরণীয়।

একলা হয়ে ছাদের ধারে এসে 

আকাশকে আজ 'চিয়ার্স' বলে দিও।

কবিতাভিত্তিক

এই যেমন জড়িয়ে আছি

সায়ন চক্রবর্তী 





এই যেমন জড়িয়ে আছি

সুতোর সাথে সুতোর মতো

পায়ের চেনা জুতোর মতো

আদর আর ছুতোর মতো-

এই যেমন জড়িয়ে আছি।


হঠাৎ করে বিশ্বজুড়ে 

তেমন কিছু করা হবেনা

আমার কবিতা পড়া হবেনা

বিরাট কিছু গড়া হবেনা

হঠাৎ করে বিশ্বজুড়ে।


তবুও এমন এক এক দিনে

এই শহরেই ফিরে দাঁড়াবো,

তোমাদের প্রেমে ঘিরে দাঁড়াবো

আঁধারের বুক চিরে দাঁড়াবো

তবুও এমন এক এক দিনে।


এই যেমন জড়িয়ে আছি

তোমায় প্রেমে জড়িয়ে নিয়ে

শিশুকে কোলে ছড়িয়ে নিয়ে

বাঁচার নেশায় জরিয়ে নিয়ে 

এই যেমন জড়িয়ে আছি।

কবিতাভিত্তিক

 অতল হিয়া

সৌরভ ভাদুড়ী




গভীরে ডুব, মনখারাপী হাওয়া

আকাশ বুকে ঝুলছে একাই চাঁদ,

তোমার বুকে কে জানে কোন ছায়া 

গোপন প্রেমিক , পাতছে কি কেউ ফাঁদ?


কান্না? সে তো ভৌমজলের মতন 

খুঁড়লে বুকে বের হয়ে ঠিক আসে

পথ হারিয়ে ভ্রান্ত কোনো পথিক

পতঙ্গ যে আগুন ভালবাসে |


আগুন পোড়ায়, জলও ডোবায় জানি 

ডোবায় তোমায় নষ্ট ভালবাসা ?

হিমেল রাতই চাঁদকে ধরে রাখে

মরার আগেও মিথ্যে কাছে আসা !


স্রোতের ভাঁটা টানবে আবার হাত,

অতীত তোমায় দেবেই মরণ ডাক 

চোরাবালি কিংবা নবীন ভোর

ঘুম জমেছে, আজ এটুকুই থাক...

কবিতাভিত্তিক

একটি নির্মোহ কবিতা

শাশ্বত বোস




মরা নদীর জলে ডুব চান, বড় ভয়|

এখনই রেডিওয় পিকিং ভেসে আসে|

পৃথিবীটা এখন খসা চামড়ার দাদে ভুগছে|

গোলাপি মরুভুমি কবির কল্পনা

ছেড়ে, শরীরী ব্ল্যাকহোলে পাড়ি জমায়|

পেণ্ডুলামি প্রজাতন্ত্রে চতুষ্পদী পোকারা,

দেশভাগ ভুলে বনসৃজনে মাতবে|

স্বাস্থ্যবান পিরামিডের, মহাজাগতিক জ্যামিতিকাল,

এখন অভিযোজনের উলম্বপাতে,

ধরা দেয়| স্যাটায়ারে উলঙ্গ অপুষ্টি,

উদার ঊরু, গভীর যোনি, কিংবা নিরম্বু আপীন|

ধ্বংসের বুকে পা দিই আমি|

পরাগমোচনে মেয়েলি নক্ষত্রযাপন,

দীর্ঘ অনুচ্ছেদের রুমাল বেয়ে,

গান্ধর্বীর ধূসর মাইলফলক|

পৃথিবী আসলে, একটি মেয়ের নাম|

সম্মিলন

হাল-হকিকৎ

সৈকত মাজী




1.

ভাতা নাও

গুন গাও,

ম্যানিফেস্টো জুড়ে, শ্রী-এর মেলা।

হারিয়ে হুঁশ,

করি দিলখুশ,

আমাদের নিয়ে চলে খেলা।

2.

গরম হাওয়া

আকাশ ছোঁয়া,

ফি মাসে হেডলাইন মুদ্রাস্ফীতি।

গরিবের উনুনে

চাল চড়ে অনটনে,

রেপোরেটে ছাড় পায় ব্যাংক কটি।

3.

শ্রম ফেরি

আমরা করি,

ঘর ছেড়ে, বহুদূরে পরবাস।

পরিজন পরিবার,

বুকফাটা হাহাকার,

এসেছি জোটাতে দু'মুঠো ভাত।

4.

ফোটে কাশ

বাড়ে আশ,

শিল্প হবে তার বালিশে।

দেখো আনাচে কানাচে

উন্নয়ন চপ ভাঁজে,

মশকরা শুধু শুধু নালিশে।

5.

পদখালি ইস্কুলে

শিক্ষা তলায় অতলে,

শিরদাঁড়া ভেঙে দিলো কে?

যোগ্যরা রাস্তায়,

পচন ধরেছে শিক্ষায়,

নতুন সকাল আসবে কবে?

নিবন্ধ

কবিতার ভাল-মন্দ              

শ্রীমন্ত সেন




প্রাক্‌ কথন


কবিগুরু তাঁর ‘ঐকতান’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘শুধু ভঙ্গি দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ’। দুঃখের বিষয় আজকাল সেই ভঙ্গিসর্বস্ব কবিতা লেখার প্রবণতা বড় উৎকটভাবে দৃশ্যমান। এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃত কাব্যজগতের অনুসন্ধানে আমাদের অবশ্যই ব্রতী হতে হবে। এখানেই কবিতার ভাল-মন্দ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তাই আজ বাইশে শ্রাবণে কবিগুরুর মহাপ্রয়াণদিবসে সেই আলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক। তাঁকে স্মরণের মাধ্যমে এই প্রসঙ্গে আলোকপাত করে নিজেই ধন্য হই।


প্রথমেই স্বীকার করি যে আমি সেই অর্থে কবি নই, তবে আমি বরাবরই কাব্য সরস্বতী-র এক নগণ্য অনুরক্ত মাত্র। যেহেতু সারস্বত অঙ্গনে প্রাণের টানেই পড়ে আছি এবং বয়সও কম হয়নি, তাই কবিতা কী, কোনটা ভাল কবিতা ও কোনটাই বা খারাপ কবিতা—সে সম্বন্ধে সুস্পষ্ট না হলেও একটা অস্পষ্ট ধারণা অন্তত হয়েছে। উপরন্তু সারস্বত পত্রিকা ‘কবিতার আলো’-র সন্নিধানে এসে সেই কিঞ্চিত হলেও ধারণা-ঋদ্ধ হয়েছি। সেই ধারণাকে সম্বল করেই আমার আজকের এই আলোচনা। মনে হতেই পারে যে এ অনধিকারীর আলোচনা—হতেই পারে। আমি প্রথমেই তাই মাফ চেয়ে নিচ্ছি।         


‘কবিতার আলো’-র পর্যবেক্ষণ


এ কথা অনস্বীকার্য যে আজকাল কবিতা প্রচুর পরিমাণে লেখা হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাদের বেশির ভাগই ‘কবিতা পদবাচ্য’ নয়। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন –‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ যে সব তথাকথিত কবিতা লেখা হচ্ছে তাদের বেশ কিছু বিবৃতি, প্রতিবেদন বা রিপোর্টিং মাত্র, যা সাংবাদিকের কাজ, কবির নয়। কিছু কিছু তথাকথিত কবিতা তো স্লোগান ছাড়া কিছুই নয়।


আবার কিছু ছন্দোময় কবিতার নামে ছন্দোহীন বা ছন্দসামঞ্জস্যহীন রচনা। তেমনই কিছু কবিতা ‘আধুনিক গদ্যকবিতা’-র নামে যথেচ্ছাচার, তা না কবিতা না গদ্য। মনে রাখতে অনেকেই ভুলে যান যে গদ্য কবিতায় চাক্ষুষ ছন্দের দোলা না থাকলেও, অন্তর্লীন ছন্দস্পন্দন তো থাকারই কথা, যেমন রবীন্দ্রনাথেরই গানে আছে ‘নয়নসমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’। এ ছাড়া ভাবসৌন্দর্যের দোলা তো থাকেই।  


একটি অনলাইন পত্রিকার ঘড়ি বিষয়ক লেখা আহ্বানের প্রেক্ষিতে এক কবি লিখলেন ঘড়ির আকার, অবয়ব, তার কী কী যন্ত্রাংশ থাকে অর্থাৎ কটি কাঁটা ইত্যাদি, যুগে যুগে তার আকারের বিবর্তন প্রভৃতি নিয়ে কবিতা। আর একজন লিখলেন—

মহাকালের ঘড়ি

এখানে সময় দ্যাখে আপনার মুখ,

এখানে ক্রমশ জমে দুরাশার ছায়া,

এখানে সময় রাখে সব সুখ-দুখ,

এখানে প্রতি পদে আগামীর ছায়া।


পিছুটান ভেঙে চলা মানুষের মাপে,

উৎসুক বিশ্বের অফুরান ডাক,

মহাকাল জেগে থাকে নিমেষের খাপে,


নশ্বর জীবনের সীমানা ছাড়াক। (মাত্রাবৃত্ত ছন্দে)


প্রথম কবিতাটি একটি প্রতিবেদন বা রিপোর্ট ব্যতীত কিছুই নয়। কিন্তু দ্বিতীয় কবিতাটি কবিতায় সময়কে ধরে রাখতে সক্ষম হল। মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক রচিত হল। ‘পিছুটান ভেঙে চলা মানুষের মাপে।’ … ‘মহাকাল জেগে থাকে নিমেষের খাপে’। যা নিয়ে কবিতা, তাকে ছাড়িয়ে অন্যমাত্রায় পৌঁছে যাওয়ার মধ্যেই কবিতার সার্থকতা—নিমেষ তখন শাশ্বতে পরিণত হয়। 


উল্লেখ্য যে বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভায় বলা হয়েছিল-- সামনে একটি শুকনো কাঠ পড়ে আছে—এই ভেবে মুখে মুখে একটা শ্লোক রচনা করতে। এক কবি বললেন, ‘শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্ঠত্যগ্রে (‘তিষ্ঠতি+অগ্রে’) -–মানে ‘সামনে একটি শুকনো কাঠ পড়ে আছে’। তিনি আক্ষরিক অর্থে ভাবকে কবিতায় ধরলেন। আর মহাকবি কালিদাস বললেন, ‘নীরসঃ তরুবরঃ পুরতো ভাতি’—অর্থাৎ তরুদের মধ্যে বরণীয় এক নীরস তরু সম্মুখে বিভাসিত হচ্ছেন—এইখানে তিনি তরুতে মনুষ্যত্ব আরোপ করে সম্মানিত করলেন—ভাবকে প্রকাশের উত্তুঙ্গ মাত্রায় নিয়ে গেলেন। এইখানেই ভাল ও মন্দের কবিতার পার্থক্য। 


‘কবিতার আলো’-র অভিমত  


‘কবিতার আলো’-র  মতে ‘সৌন্দর্যই কবিতার মূল গঠনবৈশিষ্ঠ্যের ধর্ম ও বক্তব্য’। কাব্যময় শব্দদ্যুতি পাঠকের মনকে বিভাসিত করে তোলে, ভাবকে তার অব্যর্থ লক্ষ্যে পৌঁছতে সাহায্য করে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে কবিতা স্থবির নয়, তার প্রকাশভঙ্গিও অটল অচল অপরিবর্তনীয় কোনও বস্তু নয়। আগেকার কবিতা আর এখনকার কবিতার অভিমুখ, ভাব আর প্রকাশ এক নয়। এটা আমাদের মানতেই হবে। কিন্তু তথাকথিত অনেক কবিই তা মানেন না, ফলে তাঁরা পুরনো কাব্যধাঁচেই পড়ে আছেন, যা এ যুগে শুধু বেমানানই নয়, হাস্যকরও কোনও কোনও ক্ষেত্রে। যুগ বদলাচ্ছে কিন্তু কবিতা বদলাবে না—এ তো হতে পারে না। তাই কবিতায় যুগযন্ত্রণার প্রকাশ অবশ্যম্ভাবী এবং তা অবশ্যই সাম্প্রতিক কবিতাভাষায়।  


কবিতার ভাব ও প্রকাশ


সব ক্ষেত্রেই যেমন, কবিতার ক্ষেত্রেও তেমনই থাকে কালের দাবি। সেই দাবি মানতে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ কালোত্তীর্ণ কবিরা তা মেনেছেন, তাই তাঁদের স্বকাল পেরিয়ে তাঁদের কবিতা আজও ভাস্বর। কিন্তু তাই বলে তাঁদের অনুসৃত ভাষা ও প্রকাশভঙ্গি আজও অনুসরণযোগ্য—এ কথা সত্য নয়। সে যুগের ক্ষেত্রে তা যথাযথ থাকলেও এ যুগে তা অচল—এ কথা স্বীকার করার মধ্যে কোনও গ্লানি নেই।

যেমন তখনকার প্রাসঙ্গিক কিছু শব্দ বা শব্দবন্ধ এই যুগের কবিতায় অচল। যথা—‘তরে, মম, তব, নেহারি, অয়ি, লো, দিঠি, মোর পরে, ভ্রমি, উছলি, আজি, উচ্ছ্বসি, মোর, মোরে, দোঁহে, দুঁহুঁ, তেঁউ, তোরে, আমারে, তাহারে, কারে, কাহারে, যারে, যাহারে, বিসরি, পাশরি, জলকে, কী পরি, আজিকে, উথলি, মাঝে, সনে, সাথে, লাগি, স্মরি, জনমে, ত্যজি, নারি (পারি না অর্থে), হেরো, সিনান, অবগাহি, মরমে মরি, লভিনু, বরিনু, মাঝারে’ ইত্যাদি শব্দ বা শব্দবন্ধ আজকের যুগের কবিতায় ব্যবহার না করাই শ্রেয়।

একই কারণে ‘ডাবল ৭মী বিভক্তি’-ও পরিত্যাজ্য। ‘ঘরেতে, বনেতে, মনেতে, সাঁঝেতে, বসনেতে, সাগরেতে’ ইত্যাদি ডাবল-৭মী বিভক্তিযুক্ত শব্দ না ব্যবহার করাই ভাল। যেখানে ‘ঘর’ শব্দের ৭মীর একবচন ‘ঘরে’ বললেই মিটে যায়, সেখানে আবার ৭মী বিভক্তি ‘তে’ ব্যবহার করে ‘ঘরেতে’ করার কোনও যুক্তি নেই। তাই যুগের প্রয়োজনে এই সংশোধন। কিন্তু আজকের যুগেও বহু কবিই তাঁদের কবিতায় এই জাতীয় শব্দ অক্লেশে ব্যবহার করে চলেছেন। ফলে সেই কবিতাগুলি প্রকাশের দিক দিয়ে খারাপ কবিতা-র শ্রেণিতে গণ্য হচ্ছে। আমরা অগ্রসর হব সামনের দিকে—পিছনের দিকে নয়। অবশ্যই পিছন ফিরে তাকাব—সে আমাদের ঐতিহ্যময় অতুল রত্নভাণ্ডারের মণিমাণিক্যের আকর্ষণে—পথের দিশা নির্ধারণে।   


ছন্দ-কবিতা/ পদ্যকবিতা


দুঃখের বিষয় অনেকেই ছন্দ না জেনেই ছন্দ-কবিতা বা পদ্য কবিতা লিখে থাকেন। তাঁদের কবিতায় পর্ববিন্যাস তথা মাত্রাবিন্যাস করা যায় না। প্রতিটি ছন্দের আলাদা নিয়ম ও চলন আছে। সেগুলি অনেকেই জানেন না বা জেনেও মানেন না। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে অন্ত্যমিলই বুঝি ছন্দ-কবিতা বা পদ্য কবিতার একমাত্র লক্ষণ বা পরিচয়। তাই তাঁরা  ছন্দের চলনের তোয়াক্কা না করে যেমন-তেমনভাবে লিখে শেষে অন্ত্যমিল দিয়ে ভাবেন যে বুঝি সব দায় সারা হয়ে গেল। কিন্তু মনে রাখতে হবে অন্ত্যমিল ছন্দ নয়। তাই কবিতা লিখতে হলে (এমনকী গদ্যকবিতাও) আগে ছন্দ শিখতে হবে, তাদের চলন জানতে হবে, পর্ব/মাত্রাবিন্যাস জানতে হবে, তাল ও লয় জানতে হবে এবং বিভিন্ন ছন্দের পার্থক্যও জানতে হবে।


আবার অন্ত্যমিলেও হাস্যকর অসামঞ্জস্য লক্ষিত হয়। যেমন—ভরা/তোড়া, গন্ধ/বন্ধু, চুপ ক’রে/ আর ঘরে, ঘাটে/লোটে, হোলি/তুলি, যাই/কেউ-ই, খেলা/(বালুকা)বেলা, বেড়ে/দূরে, ধরে/দূরে, আকৃতি/প্রশান্তি, ডালি/হোলি, লিখি/পাখি, বিনিদ্রা/তন্দ্রা, বাহানা/মাহিনা, ভাজা/মজা, শ্রেষ্ঠ/কষ্ট, যাই/কেউ-ই ইত্যাদি।


এখানে উল্লেখ যোগ্য যে একমাত্র শেষ অক্ষরের মিলই অন্ত্যমিলের মণিকাঞ্চনযোগ নয়। অন্তত শেষ দুটি অক্ষরের সাদৃশ্য ভদ্রগোছের অন্ত্যমিলের সহায়ক। এখানে ‘ভরা’-য় ‘ভ’ অকারযুক্ত, আর ‘তোড়া-য় ‘ত’ ওকারযুক্ত। ‘গন্ধ’-এ ‘ন্ধ’ অকারযুক্ত, ‘বন্ধু’-তে ‘ন্ধু’ উকারযুক্ত। ‘খেলা’-য় ‘খে’ ‘বিকৃত’ বা ‘অর্ধ-বিবৃত’ একার যুক্ত, উচ্চারণ ‘খ্যা’ আর ‘বেলা’-য় ‘বে’ ‘স্বাভাবিক’ বা ‘অর্ধ-সংবৃত’ একারযুক্ত, উচ্চার ‘বে’... ইত্যাদি। এইদিকে অবশ্যই দৃষ্টিপাত আবশ্যক।  


গদ্যকবিতা  


মনে রাখতে হবে যে যুগের প্রয়োজনেই গদ্যকবিতার জন্ম হয়েছে। কিন্তু ছন্দের মধ্যে থেকেই ছন্দ ভেঙেই তার জন্ম। এই জন্ম হয়েছে অক্ষরবৃত্ত ছন্দের মুক্তক থেকে—তা আবার দুই প্রকার—ক) সমিল মুক্তক ও খ) অমিল মুক্তক। মুক্তক-এর অর্থ-- সব পঙক্তিতে সমমাত্রার পর্ব থাকে না। কোনও পঙক্তিতে হয়তো ‘৮—৬—২’ মাত্রার পর্ব। আবার কোনও পঙক্তিতে ‘৬—৪—২’ মাত্রার পর্ব।


সমিল মুক্তকে অন্ত্যমিল থাকে কিন্তু অমিল মুক্তকে অন্ত্যমিল থাকে না। এই মুক্তক থেকেই গদ্যকবিতার জয়যাত্রা শুরু। সেখানে এইসব পর্ব বা মাত্রার বিষয়টি সেভাবে না থাকলেও একটা অন্তর্নিহিত ছন্দের দোলা থাকেই। তাতেই কবিতা প্রাণস্পর্শী হয়ে ওঠে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, অনেক গদ্যকবিতায় সেই ছন্দের অন্তর্লীন দোলাটুকু অনুপস্থিত থাকে। তাই তা নিষ্প্রাণ শব্দগুচ্ছ ব্যতীত আর কিছুই নয়—কবিতা তো নয়ই, খারাপ কবিতাও নয়।


কবিতার ভাল-মন্দ


ভাল কবিতা তখনই হয় যখন তার ভাব ও প্রকাশ দুই-ই ভাল হয়। কেবল ভাব ভাল—কিন্তু প্রকাশ তদনুরূপ নয়, সেক্ষেত্রে সেটি ভাল কবিতা হতে পারে না। আবার ভাব ভাল নয়, কিন্তু প্রকাশ খুব ভাল—সেক্ষেত্রেও তা ভাল কবিতা বলে বিবেচিত হবে না।


 একটি সার্থক গদ্যকবিতার উদাহরণ—


ছায়া


শ্রী কৌশিক দাস


“সে আমাকে একটি গাছের ছায়ায় দাঁড় করিয়ে রেখে চলে

      গিয়েছিল একদিন।

        গাছ নেই, কেবল ছায়াটি আঁকড়ে আমি পড়েছিলাম নিযুত বছর।


        একদিন বিকেলবেলা ছায়াটি ছাই রঙা পাখি হয়ে উড়ে যেতে


        যেতে বলে গেল—


        “প্রেমিক, বাড়ি যাও! ছায়ারা চিরদিন পলাতক।”


        দ্রুত পায়ে বাড়ি ফিরি! দরজা অবধি অনার্য ঘাস। কেবল তুলসী


        তলায় আমলকি গাছের নীচে একটি ন্যূব্জ ছায়া মুছে যেতে যেতে


        বলে গেল—


        “খোকা, এত দেরি করলি!” (‘কবিতার আলো’-য় প্রকাশিত)


এখানে ছায়ার প্রতীকের আড়ালে এক অমোঘ সত্যকে কত রঙে এঁকে দিলেন কবি। আমাদের মনও ছায়ামেদুর হয়ে ওঠে অনায়াসে।


উগ্র আধুনিকতার নামে উগ্র যৌনসর্বস্বতা


অতি আধুনিকতামনস্ক কিছু কিছু কবি ভাবেন উগ্র যৌনসর্বস্বতাই বুঝি ভাল কবিতার একমাত্র বৈশিষ্ঠ্য। কিন্তু তাঁরা ভুলে যান যে তা আমাদের দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে সুসমঞ্জস নয়—কাব্যসরস্বতীর সঙ্গে তো নয়ই। কবিতার পঙক্তিতে পঙক্তিতে যৌনতার উদগ্র নিদর্শন—এতে তাঁদের যৌন প্রদর্শনবাতিকের স্ফুর্তি হয় বটে কিন্তু কাব্যসরস্বতীর আত্মিক অস্বস্তি বাড়ে বই কমে না। অথচ উগ্র যৌনতার প্রদর্শন না করেও মানব-মানবীর প্রেম সুস্নিগ্ধভাবে বর্ণনা করা যায়। আমি সেই অর্থে কবি নই, তবু আমার একটি কবিতায় বিনম্রভাবে তা দেখাতে চেষ্টা করেছি— 


‘চুম্বন-ক্ষণ’


কোথায় ছিল তোমার দীপ্র সাহস-ভরা মন?

নাওনি কেন এতদিনেও একটিও চুম্বন?

বিষের ভয়ে? কোলাহলের উদগ্র দর্শন

কেড়েই নিল এ দুজনার অলীক কিছু ক্ষণ?


আর কি এসে সেই পাখিটা তাকাবে জুল জুল!

আর কি ঝুঁকে পড়বে ঝরে কুমারী বকুল!

ভেসে যাওয়া প্রতি নিমেষ ছিল সমুৎসুক,

বৃথাই দিলে বেচারীদের অভাবিত দুখ।


হত না হয় একটি নিমেষ অজর চিরন্তন,

হত না হয় কালের বুকে ছায়াপথের ধন।

বাইরে না থাক, ও বসন্তের এবুকে অবস্থান,

অন্তত চুম্বনে তাকেও এইটুকু দাও মান।


টলুক গিরি, উঠুক ঝঞ্ঝা, প্রবল জলোচ্ছ্বাস,

একঘেয়েমির আঁস্তাকুড়েও আসুক না বিভাস।

নব যুগের কবি লিখুন ‘গীতগোবিন্দম্‌’,

নতুন রবি বর্মা আঁকুন আভাস মনোরম।


এটি ভাল না মন্দ কবিতার মধ্যে পড়ে, সে বিচারের ভার আপনাদের উপরই ছেড়ে দিলাম।


পুরাতন প্রকরণে ভাব ও প্রকাশের আধুনিকীকরণ


পুরাতন রীতিকে যুগোপযোগী করে নতুন ভাবের বৈভবে রসস্থ করেও অনায়াসে প্রকাশ করা যায়। তাতে অতীত বর্তমানের দ্বারে এসে সুরম্য হয়ে ধরা দেয়। যেমন—বিশিষ্ট কবি ও ‘কবিতার আলো’-র সম্পাদক শ্রী বৈজয়ন্ত রাহা মহোদয়ের রচিত  নীচের সনেটটি—


স্বপ্ন


যেভাবে অধর তোলে বিষাদের আলো

প্রেমিকার দেশ থেকে উৎসের খোঁজে

জলের মিনার জানে সেভাবে ঘনালো

নদীর ভিতরে নদী, ভুলে চোখ বোজে,

অকারণে দূর চায় নিকটের দূর,

সাঁজবেলা লুফে নেয় রাতচোরা স্তব

হেরে যাওয়া বাঁশি শোনে রাখালিয়া সুর

ঘরে ঘরে ঘোরে নদী, মরা উৎসব


জল তাই চুপ চাপ নীচে বয়ে যায়

শিয়রে বসেনি আলো, ঘুম স্মৃতিহীন

কাছের মানুষ শোনে সাঁকো-বাহানায়

নদীর উপর নদী ভেসে থাকে ক্ষীণ


চিবুকে আঙুল রাখি, চোখে রাখি চোখ


আজ থেকে সব কষ্ট শুধু আমি হোক

আমরা বিস্মিত না হয়ে পারি না কী ভাবে অধুনা প্রায় অব্যবহৃত একটি প্রকরণে ভাষা মাটির কাছাকাছি এসে বুকে নাড়া দিয়ে গেল “আজ থেকে সব কষ্ট শুধু আমি হোক”—এটি সত্যিই ভাবে ও প্রকাশে একটি ভাল কবিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

ভাল কবিতা নিয়ে কিছু কথা

শ্রী রাহার মতে কবির মননের স্তরই কবিতায় ফুটে ওঠে। ভাল কবিতা এক এক বার পড়লে এক এক রকম ভাব ফুটে ওঠে। 

কবির হৃদয়ে কল্পনা এবং কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তশক্তির সহাবস্থান। কোনও কিছুর সঙ্গে আত্মিক সংযোগ-স্থাপনই হল ভাল কবিতার জন্মের উৎস। পথের পাশে একটি বুনোফুল পড়ে আছে। কেউ তা লক্ষ করেন কেউ বা করেন না। যিনি ওই বুনোফুলের সঙ্গে আত্মিক সংযোগ স্থাপন করতে পারেন এবং তাঁর কবিতায়  তাকে অনুভবের সঙ্গে প্রকাশ করতে পারেন, তিনিই প্রকৃত কবি। আর প্রকৃত কবি ক্ষণজন্মা প্রাণ।

ভাল কবিতা পড়লে বা শুনলে মন আনন্দে রিন রিন করে বেজে ওঠে, তার প্রভাব অনেক দিন পরেও রয়ে যায়। কবির যন্ত্রণা কবিতার আঁতুড়ঘর। কবি তাঁর যন্ত্রণাকে আস্বাদ্যমান এবং রসময় করে কবিতায় প্রকাশ করেন। ব্যক্তিগত আনন্দকেও আস্বাদ্যমান ও রসময় করে সার্বজনীন করে প্রকাশ করেন। বেদনার অনুভূতিকে দ্রষ্টা হয়ে বিশ্বজনীন করে তোলেন।  

কবির অলৌকিক ক্ষমতা আছে, শব্দ দিয়ে অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারেন। কবি শুধু কবি নন। কবি দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, অদ্ভুত মনের অধিকারী। কবি আল মাহমুদ বলেছেন যে কবি পারেন নিজের সংস্কৃতি, বিশ্বাস, ঐতিহ্য, উপলব্ধি ও অনুভবগুলিকে সীমানা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে কবির নিজের মনে নিজস্ব সাম্রাজ্য আছে। এর সঙ্গে বাস্তবজগতের সত্যের কোনও মিল নেই। তাই কবিতার সঙ্গে বাস্তবজগতের মিল খুঁজতে গেলে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কবির বয়স হয় না। কবিতায় কবিকে চেনা যায়। কবিতা যখন প্রকৃত অর্থে কবিতা হয়ে ওঠে, তখন আর ভাল কবিতা ও খারাপ কবিতা বলে কিছু থাকে না। কবিতা তখন সব কিছুর ঊর্ধ্বে ভাস্বর ও বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। 


উপসংহার


প্রকৃত ভাল কবিতা লিখতে গেলে আগে আত্মস্থ হতে হবে, ভাবের অনুভবে মনকে ঋদ্ধ করে প্রকাশের যুগোপযোগী দিশা খুঁজে নিতে হবে। তবেই রসময় সুন্দরের আবির্ভাব হবে—অক্ষরে অক্ষরে তার রসঘন অবস্থান ঘটবে। এটি সারস্বত সাধনার পৌনঃপুনিক অনুশীলনের ফলেই সম্ভবপর হবে।

কথাচিত্র

নির্বিকল্প  - দ্বিতীয় অঙ্ক

মনি ফকির




আহা, চা টা বড্ড ভালো বানিয়েছ। অনেকদিন পর।

এভাবেই থেকে যাবে? পাল্টাবে না?

না। এভাবেই। বদলে যাওয়াটা খুব কষ্টকর। আমার অভিযোজন পোষায় না। 

কিন্তু, তুমি কেন এভাবে আটকে গেলে। আমাদের তো কথা হয়েছিল, কেউ কাউকে আটকাবো না।

আমায় তো তুমি আটকাও নি।

কিন্তু তুমি আমায় আটকে দিয়েছ। আমি মুক্ত থাকতে চাই। 

এই শোনো না। এতদিন পর এসেছ, এসব কাটাও। একটা কথা বল।

কি?

হঠাৎ এত দিন পর এলে। কেন?

সব কারণ তোমায় জানতে হবে?

একদম নয়। নিছক কৌতূহল। 

বলব না। আমার এসব ভালো লাগছেনা। আমি আসি।

হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।

কি হলো হাসছ কেন?

যেতে চাইছো, অথচ আসি বলছ। আর এদিকে আমায় হেবি ফান্ডা দিলে, মুক্তি, চুক্তি কত কি।

খুব মজা লাগছে তাই না?

দারুন। এই শোনো তুমি রূপকথায় বিশ্বাস কর?

না।

আর পরী? পরী মানো?

কি আজগুবি কথা বল না। আর একদম অপ্রাসঙ্গিক।

আরে সত্যি বলছি, সব মানুষের একটা একান্ত ব্যক্তিগত রূপকথা থাকে। আর পরীও। অবশ্য তাদের ডানা থাকেনা, আর গোলাপী ফুল ফুল গাউন পড়ে, হাতে জাদু ছড়ি নিয়েও ওড়ে না।

মানে ডানাকাটা পরী?

একদম। 

তা যদি থেকেই থাকে, তাতে কি।

কিছুই না। কেউ মানতে চায়না। বা বিশ্বাস করেনা। আমি সেই বিশ্বাস টি ফেরৎ আনতে চাই।

এনে কোন মোক্ষ লাভ হবে শুনি?

আরে মানুষের অপরাধ প্রবণতা অনেক কমে যাবে। তুমি দেখ।

তোমার সাথে ওর যোগাযোগ নেই।

আছে।

আসে না? 

আসবে, ও একদিন আসবে। এখানে কিছু ফেলে গেছে।

ওহ্। কি ফেলে গেছে?

তা তো জানি না। কিন্তু কিছু একটা ফেলে গেছে। এই তুমি নিয়ে যাও না। 

পাগল নাকি। আর কারো জিনিস, আমি কেন নেব?

আরে নিয়ে যাওনা। আমার তো নিজের ই ঠিক নেই। 

আর সে এসে যদি খোঁজে; তখন?

তোমার ফেলে যাওয়া জিনিস টা দিয়ে দেব ওকে। আবার কি। 

হাহা, তুমি না যা তা। আচ্ছা তোমার জানতে ইচ্ছে করে না?

কি বলত?

আমার কথা। আমি কি করছি, কেমন আছি?

না। কারণ আমি জানি সব। আর তুমি এখন কি করছ, তার জেনে আমার কি। 

সেদিন নন্দনে, তোমার আমাকে ওর সাথে দেখে, খারাপ লাগেনি?

না।

হিংসে হয়নি?

এক ফোঁটা ও না।

বাজে কথা। একদম মিথ্যে কথা।

না। যা আমার কখনোই ছিল না, তা নিয়ে আমার অধিকার বোধ নেই। 

আরে অদ্ভুত ব্যাপার। তোমার একটাও ইন্সট্রুমেন্ট দেখছি না! 

দিয়ে দিয়েছি। একটা হোম এর বাচ্চাদের। 

সেকি কেন? 

ওরা বাজাক না। আমার এখন  আর দরকার নেই।

আর লেখা গুলো?

সব পুড়িয়ে দিয়েছি।

তুমি কি পাগল নাকি? কেন এসব করছ।

শোনো, আমার গান, কথা, সুর, সৃজনশীলতা - আমার ওপর বড্ড ছড়ি ঘোড়াচ্ছিল। আমার পোষায় না। আমি কারো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারবোনা। আচ্ছা একটা উপকার করবে?

বল।

গাড়ি এনেছ? 

আমায় একটু নামিয়ে দেবে।

কোথায়? 

যেখানে ইচ্ছে। আমি নিজেই যেতাম কিন্তু, একটু লোভ হলো, তুমি এগিয়ে দাও।

এই অসুস্থ শরীরে কোথায় যেতে চাও।

শরীরের আবার কি। জীর্ণ হলে, খোলস পাল্টে নিলেই হবে। আমি কোথায় যাবো ঠিক করিনি, তবে এমন কোথাও যেখানে আবার শূণ্য থেকে শুরু করব।

কোনো যোগাযোগ থাকবে না?

না। তবে আবার দেখা হবে। আবার নতুন করে বন্ধুত্ব হবে। আমার লাস্ট অ্যাটাচমেন্ট এই লেখার খাতা টা নিয়ে যেও। তোমার জন্যই রাখা ছিল।

মুক্তপদ্য

গোল্ডেন ড্রপ

নীলম সামন্ত




এবং একটা ঈশ্বরহীনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঘুম পায়। প্রচন্ড ঘুম। আমাদের বিজ্ঞানীরা এখনও পর্যন্ত এমন কোন ব্ল্যাকহোল পায়নি যার ভেতর ভগ্নপ্রায় মানুষরা পিঠ ঠেকিয়ে একটু জিরোতে পারবে৷ তাই নক্ষত্ররা জিরিয়ে নেয় দুদন্ড। নক্ষত্ররা জিরোতে বসে হাতে করে মেঘ নামিয়ে আনে।  জমা করে শাঁখের ভেতর৷ খুব ছোটবেলায় শুনেছিলাম শাঁখের ভেতর ঘুমিয়ে ছিল বাড়ির বাস্তুসাপ৷ আমার ভেতর কে যে ঘুমিয়ে আছে দীর্ঘদিন।

কেউ ঘুমোলেই আমি ঘুমোতে পারি তা নয়৷ রাত বাড়লে বালিশে কান পেতে শুনি জলডুবি হওয়া ছেলেটির গোঙানি। অথচ যখন গ্রামের বাড়ি যাই ঈশ্বর চেপে থাকতেন। যিনি আমার ঈশ্বর তাঁর পায়ের ছাপে একবার জন্মেছিল একশ আটটা প্রজাপতি৷ আমি শাঁখ বাজিয়েছিলাম। শাঁখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল নদী৷ যার নাম এখন আর মনে নেই৷ তবে আমার ঈশ্বরের ব্যক্তিগত কোন নদী নেই৷ পাখি আছে৷ খাঁচায় আটকানো দিন রাত৷ নাম জানিনা। আমি যা জানি তা খুবই সহজ সরল। ঈশ্বর ও তার নরম পা।

একদিন দুপুরে ঈশ্বরের পা ছুঁয়ে বন্ধুকে বলেছিলাম "দেখ কী নরম"!  উত্তরে বন্ধু হেসেছিল। বলেছিল " ভঙ্গুর"। পায়ের পাতায় হাত বুলিয়ে দেখে নিচ্ছিলাম গাছের শেকড়ে কতখানি জল, কতখানি মাটি। তিনি পা সরিয়ে নেননি। শিরা উপশিরা ছড়িয়ে আঁকড়ে ধরছিলেন আবেশ৷ সেদিন ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করা হয়নি ওনার ব্যক্তিগত কোন গাছ আছে কিনা। গাছেদের কি গাছ থাকে?  হয়তো থাকে, হয়তো বা না৷ কেউ কেউ তো নিজেরাই নিজের ছাদ-ছাতা। 

আমাদের দেখা হয়নি বহুকাল। কিছু মুহুর্ত ভুলতে নেই বলে মনে করি। মনে করতে করতে দেখি ঈশ্বর গাছ শাঁখ নদী সাপ সকলেই হাসছে ছবির মত। খাঁচার পাখি তার উলম্ব প্রতিবিম্বে লিখে রাখছে করতালি ও অন্ধকারের সমীকরণ।  উপসংহারে বার বার লিখছে হাতে হাত মিললে অন্ধকার জন্মায়। সে করতালিই হোক বা করমর্দন৷ আচ্ছা, এক কথা বার বার লিখলে কি খুব বেশি ঝংকার তৈরি হয়? হয়তো হয়৷ আমার জানা নেই। আমার জানা নেই কারণ আমি লিখতে পারি না৷ যেটুকু কথা বলি তা জলের সাথে। যখন শরীর থেকে নদী বেরিয়ে যায় তখন গ্লাসে করে জল খাই৷ সব শেষে হাতের ওপর রেখে দিই গোল্ডেন ড্রপ৷ 

ঈশ্বর বলেন আমি গঙ্গার মত শান্ত, গঙ্গার মতই উত্তাল। ভরা কোটালের দিন আমার গায়ের রঙ গোলাপি হয়ে যায়৷ আর ভাটার সময় মাটি। আমি কি নদী? তিনি জানেন। তিনি সব জানেন। তবে খোল করতাল খঞ্জনির উল্লাস জন্মাইনি একবারও৷ সেকথা সে বলেনি৷ বলেনি বলেই আজও অপেক্ষা করি মুক্ত আকাশে  নবজন্মের ; মেঘের নদী কিংবা গাছ গাছালির ফলদায়ী মা।

অরাজনৈতিক ভ্রম

রাজনীতি আসলে এক জমি

কৌশিক চক্রবর্ত্তী



 


অরাজনৈতিক শব্দটি কতটা যৌক্তিক? সব সিদ্ধান্তের পিছনে থাকে কোনো না কোনো অরাজনৈতিক ভ্রম। "আমি নিরপেক্ষ" এই শব্দবন্ধের প্রতিবন্ধকতা অনেক। আসলে আমরা নিঃশব্দে হেঁটে গেলে পায়ের শব্দ শোনা যায় না। কিন্তু আমরা হাঁটছি না সে কথা কতদূর প্রাসঙ্গিক? আপনি কোন সিদ্ধান্তকে রাজনীতির বাইরে রাখছেন? রাজনীতি অর্থে কী? রাজার নীতি? কদাপি না। রাজা শব্দটি বড় আপেক্ষিক। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে"। অর্থাৎ রাজ মনন অন্তরে। মুকুট পরলেই রাজা হওয়া যায় না। রাজা সন্ন্যাসীও হতে পারেন। আবার কপর্দকশূণ্য হাতে রাজা বনবাসীও হতে পারেন। আমরা জানি রাজা হরিশ্চন্দ্র ডোমের জীবিকা নির্বাহ করেছিলেন। সেই অর্থে দেখতে গেলে আপনার রাজত্ব আপনার অধীনস্থ। আর সেই রাজত্বে সব সিদ্ধান্তই রাজনৈতিক। 

এই ধরুন বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনকে ধরা যাক। সংরক্ষণ আইনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন আজ ঢাকা, ময়মনসিংহ, বড়িশাল বা কুমিল্লার পথে পথে আগুনের লেলিহান সর্বগ্রাসী শিখার মত ছড়িয়ে যাচ্ছে, তা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আর একটি রাজনৈতিক লড়াই। ঝাণ্ডা রাজনীতির পরিচয়৷ তবে দেশের পতাকা হাতে রাজপথে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক কিভাবে নিজেকে অরাজনৈতিক ব্যক্তিসত্তায় পরিচয় করাতে পারে? রাজনীতি এক মঞ্চ। যে মঞ্চের মধ্যিখানে আমরা সবাই দক্ষ বা অদক্ষ কুশীলব। সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনার সন্তান চিন্তা করছে কিভাবে স্কুলে পৌঁছে সম্পূর্ণ না হওয়া হোম ওয়ার্কের খাতা জমা দেবার হাত থেকে বাঁচতে হবে। একবার ভাবুন তো। এরমধ্যে কি রাজনীতির কোনো পাঠই নেই? আসলে রাজনীতি আমাদের আত্মায়। প্রতিদিন আমরা এক অরাজনৈতিক ভ্রমের আবহে বাস করি৷ অরাজনৈতিক শব্দটাই এক অবাস্তব বিভ্রম। সামাজিক পরিকাঠামোয় এর কোনো অস্তিত্ব নেই। অরাজনৈতিক সত্তা নেহাতই এক আস্ফালন। আর এই আস্ফালনের মধ্যে থাকে এক মোড়কের আস্তরণ। তার ভেতরে আমরা স্বচ্ছন্দে বাস করবার চেষ্টা চালাই৷ অথচ নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্বটুকু লুকিয়ে সমাজে নিজস্বতার মিথ্যে জাহির করে বেড়াই সাবলীল ভাবে৷ 

বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ছাত্র আন্দোলন বর্তমান সময়ে সব থেকে বড় রাজনৈতিক ইস্যু৷ দেশে সংরক্ষণ আইনের বিরুদ্ধে পথে নামে ছাত্রদল। কী তাদের রাজনৈতিক সত্তা? তারা ছাত্র। দল বিচার করলে তারা ছাত্রলীগ হতে পারে। কিন্তু এই লীগের বাইরে তাদের সবথেকে বড় পরিচয় তাদের ছাত্রসত্তা। আর ছাত্রাবস্থায় যে রাজনৈতিক পাঠ মস্তিষ্কের দখল নেওয়া শুরু করে, সেই মতাদর্শই সারাজীবন পরিচালিত করে আপামর জীবনের স্রোতকে। তাই ছাত্রাবস্থা হল রাজনীতির হাতেখড়ির সময়৷ কিন্তু সেই সময় যদি কোনো ছাত্রকে প্রাণ দিয়ে তার দাম দিতে হয়, তবে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক কিছু হয় না৷ ১৯৫২ থেকে ২০২৪। মাঝের এই সময়টায় অনেক বদলেছে ঢাকা। কিন্তু বদলায়নি ছাত্রদের রাজনৈতিক সত্তা৷ যে বল বুকে নিয়ে বরকতরা ছাত্র রাজনীতির পতাকা বহন করে পথ এটা ছিল ঢাকার রাজপথে, এই ক্ষেত্রে দলই আবু সাঈদের বেশে রাজনৈতিক সত্তাটুকু বাঁচিয়ে রাজপথে বুক চিতিয়ে গুলি খেল। এবং সেই রাজনৈতিক সত্তার ক্ষমতাটুকুর বলে হয়ে গেলে গুলি খাওয়ার পরেও দাঁড়িয়ে থাকে হাজার মানুষের মধ্যিখানে। রাজনীতি আসলে এক জমি৷ যে জমির উপর দাঁড়িয়ে মানুষ কথা বলতে পারে, যে জমির উপর দাঁড়িয়ে মানুষ হিসাব চাইতে পারি। আর ব্যক্তি সত্তায় এই হিসাবটুকু চেয়ে নেওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। রাজনৈতিক সত্তা বুকে নিয়ে শহীদ হবার ঘটনা আজ প্রথম নয়। ক্ষুদিরাম বসু যদি এই প্রথার পুরোধা ব্যক্তিত্ব হন, তবে তার রাজনৈতিক সত্তার অহংকারই তার শহীদ হওয়ার শক্তি। রাজনীতি জীবনকে নাড়া দেয়৷ একটি ভোট একটি গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের মঞ্চ৷ আর সেই ভোটের আড়ালে মিশে থাকা মনন আকাশচুম্বী। সেখানে অনেক লড়াই, অনেক আন্দোলন। 

প্রতিটি মানুষের জন্য সবার প্রথমে দরকার মঞ্চ। সে সাংসারিক পরিমণ্ডলেই হোক, বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অথবা কর্মক্ষেত্রে৷ রাজনৈতিক মঞ্চ বেঁধেই আমরা হেঁটে যাই প্রতিটা দিন। রোজকার লড়াইয়ে স্বীকৃতির জায়গাটাই তো রাজনীতির সহজ পাঠ।

  প্রচ্ছদ ঋণঃ-  অদিতি সেনগুপ্ত